তুমি বললে আজ ২ পর্ব -৩১

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩১

.
সময়ের গতিবেগ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। হুট করেই দুঃখ সুখের মুহুর্তগুলো বেরিয়ে যায় নিজ আওতায় থেকে, হারিয়ে যায় সময়, রেখে যায় কিছু পুরোনো স্মৃতি। রিফাপুর বিয়ের প্রায় এক মাস পেরিয়েই গেছে। ব্যস্ত হয়ে পরেছে সবাই নিজ নিজ কর্মস্থলে। কিন্তু আমি? আমি এক অতিথি পাখির মতো নতুন বাসা বেঁধেছি নিজ ঘরে। সময়ের তাগিদে নিজেকে পরিবর্তন করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি, ভুলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমার হয়েও না হওয়া তাসাফি নামক সেই মানুষটাকে। কিন্তু সারাদিন সেই মানুষটাকে ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও দিন শেষে ঠিকই তার জন্য অবুঝ মনটা পুড়ে উঠে, হু হু করে কেঁদে উঠে তাকে কাছে পাবার জন্য।

প্রায় তিন সপ্তাহের মতো তাসফি ভাইয়ের সাথে দেখা নেয় আমার, আর না আছে কোন প্রকার যোগাযোগ। আবারও উনাকে সবকিছু থেকে ব্লক করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি ওনার থেকে। রিফাপুর বিয়ের পরেই ভার্সিটি থেকে ওনার জয়েন ই-মেইল আসে। বিয়ের সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে চলে যান ঢাকায়। এত বছর ছুটি কাটিয়ে আবারও লেকচার হিসেবে জয়েন ভার্সিটিতে। ওনার বিষয়ে জানার আগ্রহ না থাকলে ঠিকই আমার ওনার কথাগুলো কানে এসে পৌঁছায়।
তাসফি ভাইয়া ঢাকায় যাবার আগে আমার সাথে বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু সেই সুযোগটা আমি দেই নি। ভীষণ ভাবে এরিয়ে গিয়েছি ওনাকে, পড়াশোনার দোহাই দিয়ে গুটিয়ে নিয়েছি নিজেকে। সাদিক ভাইয়ার বাসা থেকে আসার আরও একদিন পর কিয়ানা আপু সহ তাসফি ভাইয়ার বন্ধুরাও চলে যান। সেদিন রাতের পর কিয়ানা আপুর সাথেও আর কথা হয় নি আমার, শুধু চোখে চোখে তাকানো তেই সীমাবদ্ধ ছিলো।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার মাঝামাঝি সময়। এই সময়টা রোদের তীর্যক আলো থাকার কথা থকলেও সেটা নেই। ধূসর মেঘে গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বিষন্ন মন নিয়ে ছাঁদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছি। আমার ভাবনার মাঝে তাসফি নামক মানুষটাকে আনতে না চাইলেও বারংবার এসে আঁটকে যাচ্ছে সেই মানুষটা। ওনার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত, প্রতিটি সময়ে এসে থমকে যাচ্ছে যেন।

নিজের ভাবনায় মসগুল থাকায় হুট করেই কেউ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরায় অপ্রস্তুত হয়ে চমকে উঠলাম। দু’হাতে ছিটকে সরানোর চেষ্টা করে হালকা চেচিয়ে উঠলাম ‘কে?’ বলে। আঁকড়ে ধরার মানুষটা ছাড়লো না আমায়, বরং আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিলো, মুখ গুঁজে দিলো ঘাড়ে। আঁকড়ে ধরে স্পর্শগুলো অনুভব হতেই বুঝতে পারলাম মানুষটা ঠিক কে হতে পারে।

“একমাত্র এই আমি ছাড়া তোকে ছোঁয়ার কারোর সাহস নেই রুপু।”

ধীরগতিতে ওনার বলা কথায় আবারও কেঁপে উঠলাম কিছুটা। এতদিন পর ওনার একটুখানি স্পর্শে গলে যেতে লাগলাম যেন, ছেড়ে দিতে লাগলাম নিজের শরীরের ভার ওনার উপর। চোখ দুটো আস্তে করে বন্ধ করতেই, বন্ধ চোখের দৃশ্যপট হয়ে উঠলো সেদিন রাতের কিয়ানা আপুর দেখানো সেই ছবি, এবং তার বলা সেই কথাগুলো। সহ্য করতে পারলাম না আর ওনার স্পর্শ গুলো। দু’হাতে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলাম ওনাকে। মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলাম,

“ছাড়েন আমাকে, একদম ছুবেন না।”

ওনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে সরে যেতেই হাসলেন উনি। কাছে এগিয়ে এসে বললেন,
“বউটা আমার উপর খুব রেগে আছে বুঝি? অনেক অনেক সরি রুপু। ভার্সিটি থেকে হুট করে ইমেইল টা চলে আসলো যে, না যেয়েও কোন উপায় ছিলো না।”

বলেই একটু থামলেন। আরও কিছুটা দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে এগিয়ে এলেন। বললেন,
“অভিমানের পাল্লাটা মনে হয় একটু বেশিই হয়ে গেছে, তাই না? আবারও রাগ করে সবকিছু থেকে ব্লক করেছিস। জানিসই তো তোর এই দূরত্বটা আমি মেনে নিতে পারি না।”

এক হাতে বাহুতে রেখে অপর হাতে আমার গালে রাখতে চাইলেন। তার আগেই আবারও ছিটকে সরিয়ে দিলাম ওনাকে। চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“রাগ বা অভিমান হওয়ার জন্য আগে কাছের মানুষ হতে হয়। আপনি আমার কে হন, যে আপনার প্রতি আমার রাগ বা অভিমান আসবে? একদম কাছে আসার চেষ্টা করবেন না আমার।”

দাঁড়ালাম না আর সেখানে, আর না তাকালাম তাসফি ভাইয়ের দিকে। দ্রুত পায়ে ছাঁদ ত্যাগ করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। সোজা রুমে এসে বিছানার এক কোণায় গুটিশুটি হয়ে বসলাম। দু’হাতে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। এতদিন পর ওনাকে কাছে পেয়ে সামলাতে পারছি না নিজেকে, কিছুতেই আটকে রাখতে পারছি না নিজের আবেগকে।

কই? ওনার আসার কথা তো আমি জানি না, কারো থেকে তো শুনিও নি। তাহলে ওনার হঠাৎ আগমনের কারণটাই বা কি? আর এই বাসাতেই বা কি করছেন উনি? তাহলে কি ওনার বলা মতে শুধুই আমার জন্য এসেছেন? না… না, সেটা কি ভাবে হয়? ওনার জীবনে তো আমার কোন জায়গায় নেই, ওনার সবকিছু জুড়েই তো শুধু কিয়ানা নামক মানবী রয়েছে।

“ইস্! বউটা আমার এতটা রেগে আছে জানলে এতদিন কিছুতেই অপেক্ষা করাতাম না, খুব তারাতাড়িই চলে আসতাম। এবারের জন্য সরি রুপু, আর এভাবে চলে যাবো না।”

নিজের ভাবনায় ডুবে থাকায় কখন রুমে এসেছেন বুঝতেই পারি নি। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম দরজাটাও ভেতর থেকে লক করা। কথাটা বলেই পাশ ঘেঁষে বসে পড়লেন। আমাকে জড়িয়ে নিতে চাইলেন দু’হাতে।

“বললাম না তখন, ছুবেন না আমাকে। বারবার কেন এভাবে জড়াজড়ি করছেন? বিরক্ত লাগছে আপনার এসব নেকামি।”

অবাক হয়ে তাকালেন আমার কথায়। প্রচন্ড অবাকের রেশ ধরেই বলে উঠলেন,
“কি বলছিস তুই রুপু? আমি নেকামি করছি?”

“হ্যাঁ! করছেন। আপনার এই গায়ে পড়া স্বভাবটা বিরক্ত লাগছে আমার। সহ্য হচ্ছে না আপনাকে, চলে যান আমার সামনে থেকে।”

সহসায় কিছু বললেন না উনি। বেশ কিছু সময় চুপ করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। কিছুটা সময় নিয়ে এক হাতে আমার গালে রাখলেন। নরম গলায় আস্তে করে বললেন,
“কি হয়েছে তোর রুপু? বল আমাকে। আমার তো জানার অধিকার আছে, না বললে আমি বুঝবো কিভাবে?”

“কোন অধিকার নেই আপনার, কিশোর অধিকার খাটাতে আসছেন আমার কাছে? এক্ষুনি বেরিয়ে যান এখান থেকে।”

থমকে গেলেন উনি। কিছুটা চিৎকার করে বলে উঠলেন,
“রুপু….. কি বলছিস তুই এগুলো? কি করেছি আমি?”

“বিশ্বাস ভেঙেছেন আপনি আমার। আবারও নতুন করে জন্ম নেওয়া ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ে খেলেছেন আমার সাথে। অন্য কাউকে নিজের জীবনে জড়িয়ে আমার সাথে প্রতিনিয়ত অভিনয় করে গেছেন কেন? আছে আপনার কাছে এর উত্তর?”

“তোর কাছে আমার ভালোবাসাটা ঠুনকো বলে মনে হচ্ছে? অভিনয় বলে মনে হচ্ছে আমার ভালোবাসা তোর কাছে? এসব বলে কি বোঝাতে চাইছিস তুই আমাকে?”

“আপনি কি আসলেই বুঝতে পারছেন না, নাকি বুঝতে চাইছেন না? আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই বলছি।”

বলেই একটু থামলাম। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে দু’হাতে চোখ মুছে নিলাম। বললাম,
“আপনাকে আর আমার সাথে অভিনয় করতে হবে না, নিতে হবে না আর আমার দ্বায়িত্ব। মুক্তি দিলাম আপনাকে, আমার দ্বায়িত্ব থেকে চিরতরে মুক্তি দিলাম আপনাকে। আপনি কিয়ানা আপুর সাথে নতুন ভাবে জীবন শুরু করেন, আপন করে নেন আপনার ভালোবাসার মানুষকে। আমি কখনোই আপনাদের মাঝে বাঁধা হয়ে আসবো না।”

“মাথা ঠিক আছে তোর? কি বলছিস এগুলো? আমাদের মাঝে কিয়ানার কথা আসছে কেন?”

“কেন আসছে, তাই না? সেটা তো আপনি খুব ভালো ভাবেই জানেন।”

একটু থেমে আবারও জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস টেনে নিলাম। চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“কেন? কিয়ানা আপুকে এত বছর ধরে ভালোবাসার পর, তার সাথে রাতের পর রাত কাটানোর সময় মনে ছিলো না আপনার, কেন সে আমাদের মাঝে আসবে? ওও সরি, উনি কেন আমাদের মাঝে আসবে? আপনাদের মাঝে তো আমি এসেছি। ছিঃ ঘৃণা হচ্ছে আপনাকে আমার, গত কয়েকদিনের আপনার ছোঁয়ায় রি রি করছে আমার শরীর। ঘৃণা হচ্ছে আপনার দেওয়া স্পর্শ গুলোর কথা ভেবে। আপনার চেহারা দেখতেও চাই না আমি, ঘৃণা হচ্ছে আপনাকে আমার, আপনার প্রতিটি ছোঁয়ায় ভীষণ ভাবে ঘৃণা।”

“রূপা….”

চিৎকার করে উঠে বেশ জোরে থাপ্পড় দিলেন আমার গালে। বিছানায় ঝুঁকে গিয়ে গালে হাত রেখে জোরে করে কেঁদে উঠলাম। ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলাম,
“অবাক হলেন, তাই না? ভাবছেন এতকিছু কি ভাবে জেনে গেলাম? আপনার ভালোবাসার মানুষটিই জানিয়েছেন সবকিছু। সাথে আপনাদের দুজনের প্রতিটি রাতের ভালোবাসার স্বাক্ষী হিসেবে কিছু ছবিও দেখিয়েছেন।”

“অনেক বেশিই জেনে গেছিস, দেখিস এতকিছু জানার জন্য যেন আফসোস করতে না হয় তোকে।”

বলেই চুপ হয়ে গেলেন তাসফি ভাই। আধা মিনিটের মতো সময় নিয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠলেন,
“কিয়ানা তোকে কি বলেছে বা কি দেখিয়েছে সেটা জানা নেই আমার। কিন্তু বিশ্বাস, সামান্যতম বিশ্বাস রাখা উচিত ছিলো আমার প্রতি। এতো ঠুনকো বিশ্বাস নিয়ে আমাকে ভালোবাসা উচিত হয় নি তোর, আমার ভালোবাসার ডাকে সারা দেওয়া তোর কিছুতেই উচিত হয় নি। আদোও কি কখনো ভালোবাসতে পেরেছিস আমায়? বিশ্বাসটা তোর ভাঙে নি রূপা, ভেঙেছে আমার। তোর প্রতি আমার ভালোবাসাটা মিথ্যে প্রমানিত হলো, ভেঙে গেল আমার মন। ঠুনকো হয়ে গেল আমার পবিত্র ভালোবাসা।”

একটু থামলেন উনি। জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে বললেন,
“আর কখনোই পেতে হবে না আমার স্পর্শ, দেখতে হবে না আমার চেহারা। ভালো থাক আমার প্রতি একরাশ ঘৃণা নিয়ে। আর কখনোই আমার চেহারা তোকে আর দেখতে হবে না।”

কথাটা শেষ হতেই আর দাঁড়ালেন না উনি, আর না আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন। পকেট থেকে ফোনটা বের করতে করতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন। একবার পিছন ফিরে তাকালেন না উনি। রুম ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই ছ্যাঁত করে উঠলো বুকে। কেমন জানি শুন্য অনুভূতিতে ছেয়ে গেল সমস্তকিছু। সহ্যশক্তি হারিয়ে মাথা এলিয়ে দিলাম বিছানায়, কানের সন্নিকটে এসে প্রতিধ্বনি হতে লাগলো ওনার বলা শেষ কথাগুলো। তাহলে কি সত্যিই হারিয়ে ফেললাম ওনাকে, ওনার থেকে পাওয়া সুখানুভূতিকে? হু হু করে কেঁদে উঠলাম। মনে মনে আওরাতে লাগলাম ওনাকে বলতে না পারা কথাগুলো।
“ভালোবাসি তাসফি, অনেক বেশিই ভালোবাসি আপনাকে। নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।”

.
বাইরের হালকা চেচামেচির আওয়াজে সদ্য ঘুমিয়ে পরা চোখ জোড়া মিটমিট করে খুলে ফেললাম। অতিরিক্ত কান্নার ফলে কখন চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এসেছে বুঝতেই পারি নি। ধীরে ধীরে আওয়াজটা যেন তীব্র হতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ডর মতো সময় অতিক্রম হতেই বুঝতে পারলাম আম্মু ও বড়মার গলা ভেসে আসছে। কিছু বুঝতে না পেরে হালকা মাথা ব্যাথার রেশ নিয়েই বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করলাম। চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম এখন হয়তো সন্ধ্যারাত।
এর মাঝেই বেশ শব্দ করে দরজা খুলে আম্মু ভেতরে ঢুকে গেল। কান্না করতে লাগলো কিছুটা শব্দ করেই। প্রচন্ড অবাক হলাম আমি। আম্মুকে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই আম্মু কান্না করতে করতে বলে উঠলো,

“তাসফি খুব বাজে ভাবে বাইক এক্সিডেন্ট করছে রূপা, ছেলেটা কি অবস্থায় আছে কিছু জানা নেই। আমার হসপিটালে যাচ্ছি, তুই সাবধানে থাকিস মা।”

আম্মুর কথাটা কর্ণপাত হতেই থমকে গেলাম আমি। নিজের স্তম্ভিত হারিয়ে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলাম আম্মুর দিকে। প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। হঠাৎই কানে ভেসে আসলো তাসফি ভাইয়ের বলা শেষ কথাটা।

‘আর কখনোই পেতে হবে না আমার স্পর্শ, দেখতে হবে না আমার চেহারা। ভালো থাক আমার প্রতি একরাশ ঘৃণা নিয়ে। আর কখনোই আমার চেহারা তোকে আর দেখতে হবে না।’

.
.
চলবে…..

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here