তুমি বললে আজ ২ পর্ব -৩৪(শেষাংশ)

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩৪ ( শেষাংশ )

.
“হ্যাঁ! তাসফি ঠিক কথায় বলেছে। তোরা ছেলেটাকে ছেড়ে দে এখন, একটু রেস্ট নিক। তোরাও চল, কয়েকদিন তো আর কম কিছু গেলো না।”

বড়মা বলেই উঠে দাঁড়ালো বিছানা ছেড়ে। দরজার কাছে যেতেই আম্মুও উঠে দাঁড়ালো। একাই ভঙ্গিতে সবাইকে আসতে বলে বড়মার পিছন পিছন বেরিয়ে গেল। সাদিক ভাইয়ার দোহাই দিয়ে রিফাপুও চলে আসলো সেখান থেকে। ফুপিও নেমে দাঁড়ালো বিছানা ছেড়ে। তাসফি ভাইয়াকে ধরে আলগোছে শুইয়ে দিলো বিছানায়। বললো,

“কিছুর প্রয়োজন হলে সাথে সাথে ডাকবি আমাকে, একা একা কিছু নিতে যাবি না কিন্তু।”

“ঠিক আছে, ডাকবো আমি আম্মু। তুমি সবাইকে নিয়ে যাও, আর কেউ যেন আমাকে ডিস্টার্ব না করে।”

“ঘুমা তুই, আমি দরজা ভিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।”

মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে সরে আসলো ফুপি। আমি একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলাম। দেখে গেলাম মা ছেলের ভালোবাসা। আমার দিকে একবার তাকালো ফুপি, কিছু না বলে এগিয়ে যেতে লাগলো দরজার কাছে। এর মাঝেই ফুপিকে ডেকে উঠলেন তাসফি ভাইয়া। পিছন ফিরে তাকালো ফুপি। বললো,

“কি হয়েছে বাবা, কিছু লাগবে?”

“আমি তো বললাম সবাইকে রুম ছেড়ে যেতে বলো। ঘুমাবো আমি। সবাইকে মানে, সবাইকে। কেউ যেন আমাকে ডিস্টার্ব করতে না আসে।”

চমকে উঠে তাকালাম ওনার দিকে। কথাটা যে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সেটা বুঝতে এতটুকুও সময় লাগলো না। ফুপি এগিয়ে এলো আমার কাছে। আমার মতোই কিছুটা অবাক হয়ে তাকালো তাসফি ভাইয়ের দিকে। বললো,

“রূপা থাক তোর কাছে। একটু কথা বল ভালো লাগবে।”

“বললাম তো আম্মু আমি ঘুমাবো। সবাইকে যেতে বলো। কথা বলার চেয়ে রেস্ট নিলে একটু বেশিই ভালো লাগবে।”

“কিন্তু ও….”

“বললাম তো রেস্ট নিতে দাও। একজনের জন্য এভাবে বিরক্ত করছো কেন আমাকে?”

তাসফি ভাইয়ার মূদু ধমকে চমকে উঠলাম কিছুটা। ছলছল করে উঠলো চোখ দু’টো। আঁটকে রাখা অশ্রু গুলো গড়িয়ে পড়তেও সময় নিবে না হয়তো। ফুপিও হয়তো এমনটা আশা করে নি। কিছুটা অবাক হয়েই আমার হাতে এক হাত রাখলো। মাথা তুলে তাকালাম ফুপির দিকে। কিছু বলার আগে আমি বলে উঠলাম,

“ফুপি, উনি…. ”

“এখন চল মা, পরে কথা বলিস ওর সাথে। শরীরটা হয়তো সত্যিই ভালো লাগছে না।”

এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম তাসফি ভাইয়ের দিকে। সামান্যতম আসায়, যদি একবার তাকায় আমায় দিকে। কিন্তু না! একটিবারের জন্যও চোখ ফিরিয়ে তাকালেন না আমার দিকে। ওনার এই মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সাথে ওনার করা অপমানে আর দাঁড়াতে পারলাম না সেখানে। ফুপিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে আসলাম রুম ছেড়ে।নিজের বরাদ্দকৃত রুমে ঢুকে কিছুটা শব্দ করেই দরজা লাগিয়ে দিলাম।

.
সময়ের গতিবেগে কেটে গেছে প্রায় সপ্তাহ তিনেকের মতো। হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই। তাসফি ভাইয়াও অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। পায়ের ক্ষত সেরে না গেলেও নিজেই একটু একটু চলাফেরা করতে পারেন।
আম্মু বড়মা চলে গেছে বেশ কিছুদিন আগেই। তাসফি ভাইয়ার দেখাশোনা করার জন্য থেকে গেছে ফুপি। কলেজে ছুটি পরায় ফুপির সঙ্গী হিসেবে আমাকেও থাকতে হয়েছে।

এতদিন একটি বারের জন্যও কথা বলেন নি তাসফি ভাই। আমি গেলেও সেদিনের মতোই অপমান করেছেন। এক মুহুর্তও থাকতে দেন নি নিজের কাছে। প্রথম কয়েকদিন ওনার মুড সুইং ভেবে এড়িয়ে গেলেও আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে দেন। বারবার একই ভাবে ফিরিয়ে দেন আমাকে। অবহেলা করেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু সবকিছুতেই ছিলেন নীরব। একটা শব্দও কথা বলেন নি আমার সাথে।
তাসফি ভাইয়ের এই নীরব অভিমান প্রতিনিয়ত তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে মনে, অপরাধী সত্তাটা বারংবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। না! এভাবে ধুকে ধুকে আর কিছুতেই থাকতে পারবো না, মানতে পারবো না ওনার অবহেলা গুলো। এই মুহুর্তেই ওনার সাথে কথা বলতে হবে আমার, জানতে হবে কি চান উনি।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার আগ মুহুর্তে। চারদিকে আজানের প্রতিধ্বনিতে প্রতিফলিত হয়ে উঠলো। এতক্ষণ ছাঁদে দাঁড়িয়ে থাকলেও আজানের শব্দে আর দাঁড়ালাম না। ছাঁদের দরজা আটকিয়ে সোজা রুমে চলে আসলাম। অজু করে নামজ আদায় করে নিলাম। জায়নামাজেই বসে বসে ভাবতে লাগলাম, এখনি ওনার সাথে কথা বলতে হবে আমার। জানতে হবে, কি চান উনি এই সম্পর্কের পরিণতি। আর বসে থাকলাম না। জায়নামাজ উঠিয়ে গুছিয়ে রাখলাম নিজ স্থানে। সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে গেলাম রুম ছেড়ে।

তাসফি ভাইয়ের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে ঢুকে গেলাম রুমে। দরজা খোলার শব্দে চট করে মাথা তুলে তাকালেন। আমাকে রুমে ঢুকতে দেখে চোখে মুখে বিরক্তিকর রেশ ফুটে উঠলো। আমাকে কিছু না বলে ডেকে উঠলো ফুপিকে। কিন্তু ওনাকে খুব একটা সময় দিলাম না আমি, চট করে দরজা লক করে দিলাম। আজকে যে করেই হোক ওনার সাথে কথা বলতে হবে আমার। আগের চেয়েও দ্বিগুণ বিরক্ত হলেন উনি। চিৎকার করে ডাকতে নিলেন ফুপিকে। ওনাকে থামিয়ে আমি বলে উঠলাম,

“কি সমস্যা আপনার?”

জবাব দিলেন না উনি। মাথা ঘুরিয়ে কোলে থাকা ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। প্রতিনিয়ত ওনার এই ইগনোর আর সহ্য হলো না আমার। এগিয়ে গেলাম বিছানার কাছে। ওনার কোল থেকে ল্যাপটপটা সরিয়ে নিলাম। মৃদু চেচিয়ে বলে উঠলাম,

“কি সমস্যা আপনার? এভাবে ইগনোর করছেন কেন? সবার সাথে কথা বলেন, কিন্তু আমার সাথে একটা শব্দও উচ্চারণ করেন না। কেন? কি হয়েছে আপনার?”

আমার দিকে তাকালেন তাসফি ভাই। কিছু না বলে চুপ করেই রইলেন। আবারও বলে উঠলাম,

“কথা বলছেন না কেন? আমার সাথে কথা না বলে এভাবে চুপ করে আছেন কেন? কিছু তো বলেন।”

এবারও একইভাবে চুপ করে রইলেন তাসফি ভাই। শান্ত ভাবে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। এবার যেন আর সহ্য করতে পারলাম না আমি। ছলছল করে উঠলো চোখ দুটো। বসে পরলাম ওনার সামনে, বিছানায়। আস্তে করে বললাম,

“কি হয়েছে আপনার, তাসফি ভাইয়া? এতটা অবহেলা কেন করছেন আমাকে? জানি! আমি ভুল করেছি, সেদিন ঝোঁকের বসে অনেক কিছু বলে ফেলেছি আপনাকে। প্লিজ! আমাকে ক্ষমা করেন দেন। থাপ্পড় দে, ধমক দেন যা খুশি করেন। তবুও প্লিজ এভাবে চুপ করে থাকবেন না।”

আলগোছে ওনার হাতে হাত রাখলাম। আবারও কিছু বলার উদ্যোগ হতেই ছিটকে আমার হাত সরিয়ে নিলেন উনি। শান্ত স্বরে বলে উঠলেন,

“ঘৃণাকৃত জিনিস তো স্পর্শ করতে নেই, ছুঁতে নেই তাদের। তাহলে আমাকে কেন স্পর্শ করা হচ্ছে?”

“তাসফি ভাইয়া আপনি….”

“দূরে যা! এতটা কাছে এসেছিস, অবশ্যই ঘৃণা হচ্ছে আমার প্রতি? আমাকে দেখে অবশ্যই নির্লজ্জ পুরুষ বলে মনে হচ্ছে?”

“তাসফি ভাইয়া প্লিজ! আমি সত্যিই সেদিন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কিয়ানা আপুর দেখানো ওইসব ছবিগুলো দেখে মাথা ঠিক ছিলো না আমার। প্লিজ! আমাকে ক্ষমা করে দিন।”

“তাহলে এখন ঘোর কাটলো কিভাবে? মাথা ঠিক হলো কিভাবে এখন?”

চুপ হয়ে গেলাম আমি। উত্তর দিতে পারলাম না সহসায়। একটু সময় নিয়ে বললাম,

“কিয়ানা আপু! কিয়ানা আপু সব সত্যিটা বলে দিয়েছে আমাকে। সবকিছু সাজানো ছিলো, আমাকে মিথ্যে বলে আপনাকে পেতে চেয়েছিলো।”

“ওও আচ্ছা, কিয়ানা সত্যিটা বলে দিলো? আর সবকিছু তুই বিশ্বাস করে নিলি?”

এবার চুপ করে গেলাম আমি। মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলাম ওনার কথার। হঠাৎ হেঁসে উঠলেন উনি। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

“বাহ্! যার কথায় আমাকে ঘৃণা করছি, এতবড় অপবাদ দিলি এখন তার কথাতেই আমাকে বিশ্বাস করে ফেললি? তাহলে তোর কাছে আমার জায়গাটা ঠিক কোথায় থাকলো? কোথায় থাকলো আমার প্রতি সেই বিশ্বাস টা?”

টুপ করে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো আমার চোখ থেকে। জবাব দেওয়ার মতো কিছুই রইলো না যেন। তবুও বললাম,
“আমি সত্যিই আপনাকে এসব কথা বলতে চাই নি, অবিশ্বাস করতে চাই নি আপনাকে। কিন্তু কিয়ানা আপুর বলা কথা আর দেখানো ওই ছবিগুলো…. ”

“একটাবার আমাকে বলতে পারতে রুপু। আমাকে জানতে চাইতে, এসব আসলেই সত্যি কি না? কিন্তু তুমি তো শুধু অবিশ্বাস করে গেছো আমাকে, ঘৃণা করে গেছো প্রতিনিয়ত। অসম্মান করেছো আমার ভালোবাসাকে, ঘৃণা করেছো আমার পবিত্র স্পর্শকে।”

“আমি আপনাকে এতটা আঘাত করতে চাই নি, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন।”

“সেদিন বলেছিলে না, আমার দ্বায়িত্ব থেকে মুক্তি দিলে আমাকে? আমি মুক্ত করে দিলাম তোমাকে।”

“কি বলছেন এগুলো আপনি? আমাদের সম্পর্কটা কি ছেলে খেলা মনে হচ্ছে আপনার কাছে?”

“তোমার প্রতি আমার সমস্ত অনুভূতির মৃত্যু হোক রুপু!”

চমকে উঠলাম আমি। কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। বুকের তীব্র যন্ত্রণা হু হু করে বেড়ে গেল। তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। পুরো শরীরের সাথে পা দু’টোও মৃদু ভাবে কাঁপতে লাগলো। লাঘব হওয়া গায়ে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে চিৎকার করে বলে উঠলাম,

“তাসফি…. কি বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার? কিভাবে বলতে পারলে এই কথা, আমার প্রতি তোমার এই সুপ্ত অনুভূতির মৃত্যু কিভাবে চাইতে পারলে?”

নীরবতায় বিরাজ করলো রুম জুড়ে। কেটে গেল মিনিট দুয়েক সময়। নীরবতাকে ভেঙে দিলেন তাসফি ভাই। চিৎকার করে বলে উঠলে,

“বেরিয়ে যা রুম থেকে, বেরিয়ে যা বলছি। একদম আমার সামনে আসবি না।”

পা দু’টো অসার হয়ে আসলো আমার। এখানে এক মুহুর্তও দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠলো আমার জন্য। দু’হাতে চোখের অশ্রুগুলো মুছে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসলাম দরজার কাছে। দরজা খুলে এক ছুটে বেরিয়ে গেলাম সেখান থেকে।

.
.
চলবে…..

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালোবাসা অবিরাম।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here