তুমি হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব -১৫+১৬+১৭

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৫

নিশুতি রাত। সিঙ্গেল সোফায় বসে রয়েছে দুয়া। অস্থিরতা বিরাজমান রন্ধ্রে রন্ধ্রে। একবার সোফায় দেহ এলিয়ে বসছে তো আরেকবার সোজা হয়ে বসছে। কখনোবা দাঁত দিয়ে নখ কা’মড়ানোর মতো বাজে অভ্যাসও চর্চা করছে। গলদেশ শুকিয়ে কাঠ। তড়িৎ উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল বেড সাইড টেবিলের কাছে। বিছানার কোণে বসে ডান হাতে গ্লাস এবং বাঁ হাতে জগ নিলো। পানিতে পূর্ণ করলো গ্লাসটি। অতঃপর জগ পূর্বের স্থানে রেখে ঢকঢক করে পানি পান করলো। শুকনো গলা অবশেষে সিক্ত হলো। ডান হাতে ওড়নার একাংশে সিক্ত মুখ মুছে গ্লাসটি রেখে দিলো। এখনো ধুকপুক ধুকপুক করছে অন্তঃপুরে। কি হবে এবার! মেয়েটার ভয়ডর কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতেই আগমন হলো অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ডান পাশে তাকালো দুয়া। দেখতে পেল তূর্ণ আসছে। কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো মেয়েটার মুখশ্রী। শুকনো ঢোক গিলে উঠে দাঁড়ালো। তূর্ণ মোবাইল স্ক্রল করতে করতে আসছিল। একবার চোখ তুলে অর্ধাঙ্গিনীর পানে তাকালো। মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বসলো সিঙ্গেল সোফার একটিতে। মোবাইলে মগ্ন মানুষটিকে দেখে দুয়া স্বল্প সময়ের জন্য হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। পুনরায় বসলো বিছানায়।‌ নীরবে অতিবাহিত হলো কিছু সময়। হাতে থাকা মোবাইলটি গোলাকার টি টেবিলের ওপর রেখে উঠে দাঁড়ালো তূর্ণ। তা লক্ষ্য করে খানিকটা ঘাবড়ে গেল দুয়া। এবার? তবে ঘাবড়ে যাওয়ার মতো কিছু হলো না। তূর্ণ পা বাড়ালো ওয়াশ রুমের দিকে। উঠে দাঁড়ালো দুয়া। দৃষ্টি একবার বিছানায় তো আরেকবার সোফা। কখনোবা টাফটেড বেঞ্চে। উঁহু উঁহু! হবে না। তবে কি? দুয়া মনে মনে অসন্তোষ প্রকাশ করলো একটা ডিভান কিংবা বড় সোফা কেন নেই। হুয়াই! খট করে দরজা উন্মুক্ত হবার শব্দ হলো। পিছু ঘুরে তাকালো মেয়েটা। তূর্ণ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে বের হয়েছে। দুয়া একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কিন্তু তূর্ণ তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো।

” কি ব্যাপার? এখনো শুয়ে পড়িসনি কেন? ”

থতমত খেল মেয়েটা। মেকি হেসে আমতা আমতা করতে লাগলো। যা দেখে তূর্ণ’র ভ্রূ যুগল কুঁচকে গেল। তবে কিছু বললো না। তোয়ালে যথাস্থানে রেখে রুমের দ্বার আঁটকে দিলো। এতেই মেয়েটার পরাণপাখি ফুরুৎ! উড় গায়া! তোতলাতে তোতলাতে বললো,

” দ্ দরজা আঁটকালে কেন? ”

পিছু ঘুরে তাকালো তূর্ণ। মৃদু বিস্ময় প্রকাশ করে বললো,

” ঘুমানোর আগে দরজা আটকাবো না! সিঙ্গেল অবস্থাতেই সবসময় দরজা আটকে ঘুমাতাম। এখন তো মিঙ্গেল। বউ আছে। দরজা জানালা সব আটকে ঘুমাতে হবে। ”

নাকমুখ কুঁচকে ফেলল দুয়া। ক্ষীণ স্বরে বললো,

” ঘুমাবো কোথায়? ”

” হুঁ? কি বললি? ”

” জিজ্ঞেস করলাম ঘুমাবো কোথায়? ”

তূর্ণ হাঁটতে হাঁটতে বেডের কাছে এলো। বসলো বিছানার বাম পাশে।

” ওহ্ তার মানে আমি ভুল শুনিনি? তুই আসলেই ভারতীয় সিরিয়াল মার্কা প্রশ্ন করেছিস? ”

অবাক হলো দুয়া!

” কিহ্! এখানে ভারতীয় সিরিয়াল এলো কোথা থেকে?”

” কোথা থেকে আবার? তোর প্রশ্ন থেকে। ভারতীয় ইনা, মিনা, ডিকাদের মতো রাতদুপুরে প্রশ্ন করছিস ‘কোথায় ঘুমাবো?’ কেন রে এত বড় বিছানা চোখে পড়ছে না? অন্ধ হয়ে গেছিস! ”

” তুমি আমাকে অন্ধ বললে? আমাকে কোন দিক দিয়ে অন্ধ লাগে? উল্টো অন্ধ তো তুমি। চশমা কে পড়ে? আমি না তুমি? ”

মেয়েটার কন্ঠে মৃদু ঝাঁঝ! বক্র হাসলো তূর্ণ।

” বেগমসাহেবা! ভদ্র ভাবে কথা বলুন। রাতটা কিন্তু আমার সাথেই কাটাতে হবে। আমি কিন্তু টুরু ভদ্রলোক।‌ দেখা গেল রাতদুপুরেই প্রমাণ দেয়া শুরু করলাম অন্ধ কি না! ”

টেনে টেনে শেষোক্ত কথাটা বললো তূর্ণ। যা শুনে ঘাবড়ে গেল দুয়া। দু হাতে টপসের অংশবিশেষ খামচে ধরলো। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে ক্ষীণ স্বরে বললো,

” ব্ বাজে কথা বলবে না। ”

দাঁত কেলিয়ে হাসলো তূর্ণ। মাথা নাড়িয়ে বললো,

” আচ্ছা। এবার ঘুমাতে আসুন। নাকি ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্লিপিং স্লিপিং? হুঁ? ”

দুয়া দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। বড় বড় কদম ফেলে বিছানার ধারে অগ্রসর হলো। এসে দাঁড়ালো ডান পাশে। একবার বিছানা তো আরেকবার বরের দিকে তাকাচ্ছে। তূর্ণ বিছানায় শুয়ে দেহে ব্ল্যাংকেট জড়াতে জড়াতে বললো,

” মাঝখানে ভারত পাকিস্তান বর্ডারের আশা করে থাকলে ভুলে যা। আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণর রুমে কোনো সীমান্ত, ভেদাভেদ নেই। আছে শুধু সমতা, একাত্মতা। বুঝেছিস? ”

দুয়া মাথা নাড়লো অর্থাৎ সে বুঝেছে। অথচ বোকা মেয়েটা বুঝতেও পারলো না তার সদ্য বিবাহিত অর্ধাঙ্গ সমতা, একাত্মতা বলতে আসলে কি বুঝিয়েছে। না বুঝেই সে সম্মতি পোষণ করলো!

” গুড! এবার লাইটস অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে আয়। শুয়ে পড়। ”

ভদ্র মেয়ের মতো দুয়া কক্ষের আলো নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালালো। এসে বসলো তূর্ণ’র পাশে। নিঃশব্দে শয্যা গ্রহণ করলো। স্বামীর থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। তূর্ণ তা লক্ষ্য করে কিছু বললো না। চুপচাপ আঁখি পল্লব বন্ধ করে নিলো। চোখেমুখে তৃপ্তির আভা!
.

তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কেটে গেল। কর্ণ কুহরে পৌঁছাচ্ছে কিছু অদ্ভুত ধ্বনি। আস্তে ধীরে আঁখি পল্লব মেলে তাকালো তূর্ণ। নিজের বাম পাশে তাকিয়ে অতঃপর তাকালো ডান পাশে। দুয়া ওদিক ফিরে শুয়ে। পৃষ্ঠদেশ ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত হচ্ছে! তবে কি মেয়েটা! কাঁদছে! তড়িৎ দেহ হতে ব্ল্যাংকেট সরিয়ে স্বল্প উঠে বসলো তূর্ণ। অর্ধাঙ্গীর পানে মৃদু ঝুঁকে বসতেই স্পষ্ট হলো সবটা। দুয়া কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। সে ক্রন্দন ধ্বনি কর্ণ কুহরে পৌঁছাতেই মানুষটির হৃদয়ের অন্তঃস্থলে ভূকম্পন হলো। হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে চলেছে ধড়াস ধড়াস। স্বেদজল উপস্থিত ললাটে। তূর্ণ ওকে ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। কি ভেবে যেন বেডের হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসলো। ডান হাতটি আলতো ভঙ্গিতে রাখলো অর্ধাঙ্গিনীর মাথায়। ক্রন্দনরত ললনা হঠাৎ কারোর স্পর্শ টের পেয়ে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেল। স্বল্প সময়ের মধ্যেই সে ঘাবড়ে যাওয়া ভাব লাঘব হলো। চুপটি করে শুয়ে রইলো মেয়েটা। কিছু বললো না। শুধু অনুভব করে গেল পুরুষালি স্পর্শটুকু। আদুরে হাতটি তখন ওর মাথায় ঘুরে চলেছে। কেশের ভাঁজে ভাঁজে ছুঁয়ে যাচ্ছে আঙ্গুল। মাথার চামড়ায় পুরুষালি স্পর্শ অনুভূত হতেই শিরশির করে উঠছে কায়া। সে স্পর্শে নেই কোনো কামুক ভাব। আছে শুধু একরাশ ভরসা। পাশে থাকার আশ্বাস। আলতো ছোঁয়ায় মেয়েটির ক্রন্দন কখন থেমে গেল টেরও পেলো না। আরাম পেয়ে আস্তে ধীরে মুদিত হলো নেত্রপল্লব। ঘুমিয়ে পড়লো একসময়। ঘন নিঃশ্বাসের ধ্বনি কর্ণ গহ্বরে পৌঁছালে হাতটি থেমে গেল। দুয়া’র পানে মৃদু ঝুঁকে গেল মানুষটি। স্বচক্ষে দেখে নিলো ঘুমন্ত অর্ধাঙ্গীকে। মলিন হাসলো তূর্ণ। নিভৃতে আরেকটু ঝুঁকে গেল। প্রিয়তমাকে প্রথম হালাল স্পর্শ করলো। ছোট্ট এক চুমু অঙ্কন করে দিলো ললাটের কার্নিশে। মৃদু স্বরে আওড়ালো,

” প্রথম হালাল স্পর্শ দিলাম তোমায়
হোক না তা তোমার অজান্তে
একদিন এই ছোঁয়াটুকু তুমি সাদরে মেখে নিবে সর্বাঙ্গে
অপেক্ষা সেদিন সে প্রহরের। ”

দিবাকরের আলোয় আলোকিত ধরনী। তাহমিদা শাড়ির আঁচলে ভেজা হাত মুছতে মুছতে ডেকে চলেছেন কন্যাকে। ব্যস্ত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে চলেছেন,

” দুয়া! অ্যাই দুয়া! ঘুম থেকে উঠেছো? দুয়া? ”

সাড়া নেই কারোর। ওনার কণ্ঠনালী হতে ‘ চ ‘ সূচক শব্দ নির্গত হলো। কক্ষের বদ্ধ দ্বার খুলে তাহমিদা প্রবেশ করলেন কক্ষে। বিছানায় দৃষ্টি না ফেলে এগিয়ে গেলেন জানালার ধারে। জানালা হতে পর্দা সরাতে সরাতে ডেকে চলেছেন,

” দুয়া! উঠে পড়ো। ভার্সিটি যাবে না? দুয়া! ”

পর্দা দু পাশে বিভক্ত করে জানালা খুলে ফেললেন উনি। অতঃপর তাকালেন পেছনে। এক মুহুর্তের জন্য ওনার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো! শূন্য বিছানায় দৃষ্টি আবদ্ধ রইলো কয়েক পল! বাস্তবতা বোধগম্য হতেই নেত্রকোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা অশ্রু। বিছানা শূন্য! দুয়া নেই। সে তো নতুন নীড়ে। শ্বশুরবাড়িতে। ধীরপায়ে বিছানার ধারে অগ্রসর হলেন তাহমিদা। বসলেন বিছানার এক পাশে। আলতো করে ছুঁয়ে দিলেন বালিশ। এখানে মাথা রেখেই তো মেয়েটা ঘুমাতো। প্রতিদিন সকালে উনি ডাকতেন। তবেই মেয়ের ঘুম ভাঙ্গতো। অ্যালার্মে কাজ হতোই না। মেয়ের নাকি মায়ের কণ্ঠ না শুনলে নিদ্রা ভঙ্গ হয় না। মায়ের কণ্ঠ শুনবে, মা মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দেবে। তবেই ঘুম ভেঙ্গে যাবে। তাহমিদা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। কপোল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো বিন্দু বিন্দু অশ্রু। আজ তো মেয়েটা তার কণ্ঠ শুনতে পেল না। মা আদুরে হাত বুলিয়ে দিলো না। কেমন কাটছে মেয়েটার সকাল? সে ঠিক আছে তো? চিন্তিত হলো মাতৃ হৃদয়! পরক্ষণেই ভাবলেন মেয়ে আল্লাহ্’র রহমতে নিশ্চয়ই ভালো আছে। সে যে যোগ্য স্থানে রয়েছে। সেখানে আদর-যত্নের কখনো খামতি হবে না। বড় আপা মায়ের মতো আগলে রাখবে তার মেয়েটাকে। তবুও মা তো মা ই হয়। মায়ের স্থান দখল করা কি সহজ?

‘ ছায়াবিথী ‘ এর ডাইনিং রুম। পরিবারের সদস্যরা প্রায় সবাই উপস্থিত। বাকি শুধু দু’জন।

” ওরা দু’জন কোথায়? ঘুম থেকে ওঠেনি? ”

তাসলিমা স্বামীর পানে তাকালো। প্লেটে খাবার সার্ভ করতে করতে জবাব দিলো,

” উঠেছে। আসছে‌। ”

বলতে না বলতেই হাজির নবদম্পতি। সকলের চাহনি ওদের দিকে নিবদ্ধ। তা লক্ষ্য করে কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো মেয়েটি। চেনা মানুষগুলো আজ নতুন এক সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধা। অন্যরকম অনুভূতি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তূর্ণ চোখের ইশারায় ওকে সাথে আসতে বললো। দু’জনে এলো টেবিলের কাছে। তূর্ণ বসতে বসতে সকলের উদ্দেশ্যে বললো,

” আসসালামু আলাইকুম। গুড মর্নিং এভ্রিওয়ান। ”

তাসলিমা মুচকি হেসে বললেন,

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। গুড মর্নিং। ”

” গুড মর্নিং ভাইয়া! ”

একসাথে উইশ করলো দুই বোন। তৃষা এবং নিশি। বিনিময়ে তূর্ণ মুচকি হাসলো। দুয়া সকলের পানে একবার তাকিয়ে তূর্ণ এবং তৃষার মধ্যবর্তী শূন্য চেয়ারে বসলো। নিজাম সাহেব মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে পুত্রবধূকে জিজ্ঞেস করলেন,

” কি মা? কেমন আছো? নতুন পরিবেশে অস্বস্তি হচ্ছে না তো? অবশ্য এটা তো তোমার চেনা ঘর ই। শুধু সম্পর্কের সমীকরণ একটু বদলে গেছে। ”

” হুঁ। ভাইয়া এখন সাইয়্যা। ”

তৃষার বিড়বিড় করে বলা কথাটা শুনে নিশি মুখ টিপে হাসতে লাগলো। আর দুয়া? লজ্জা মিশ্রিত রাগী দৃষ্টিতে বাম পাশে তাকালো। তা লক্ষ্য করে তৃষা ভয় পাওয়ার ভান করে ফিক করে হেসে উঠলো। তাসলিমা মেয়েকে বলে উঠলেন,

” সকাল সকাল দাঁত বের করে হাসছিস কেন? ”

” এমনিই আম্মু। ভয় পাইছি তো তাই। ”

তূর্ণ সবজি খিচুড়ি মুখে পুরে বললো,

” ভয় পেলে মানুষ হাসে? তোর মতো অটিস্টিক দ্বারাই সম্ভব। ”

তেঁতে উঠলো তৃষা।

” কিহ্! আমি অটিস্টিক! আব্বু আম্মু। তোমরা শুনলে ভাইয়া কি বললো? ”

” হুঁ শুনলাম। ”

বাবার নির্লিপ্ত জবাবে তৃষা ভাবিকে পার করে ভাইয়ের দিকে তাকালো। রাগত স্বরে বললো,

” আমি অটিস্টিক না। তুমি অটিস্টিক। বুইড়া অটিস্টিক। ”

” আচ্ছা। ”

তূর্ণর জবাবে তৃষা তো রাগে গজগজ করছে। কিন্তু দুয়া? বহু কষ্টে হাসি দমিয়ে রাখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। পারছে না অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে। লাইক সিরিয়াসলি! বুইড়া অটিস্টিক! দুয়া যখন হাসি চেপে রাখতে ব্যস্ত তখনই কর্ণ কুহরে পৌঁছালো গম্ভীর স্বর,

” এই যে? বুইড়া অটিস্টিকের বউ! বুড়ি অটিস্টিক। বেশি হাইসেন না। দাঁত খসে পড়বে। ”

দুয়া কটমট চোখে ডান পাশে তাকালো। কিন্তু মহাশয় ওর চাহনি লক্ষ্য করলে তো! সে তো একমনে খিচুড়ি খেয়ে চলেছে। যেন এছাড়া আর কোনো কর্ম নেই। হুহ্! দুয়া রাগটা চেপে গেল। খাবার খাওয়ার দোয়া পড়ে খেতে শুরু করলো। তাসলিমা সকলকে খাবার সার্ভ করে মায়ের পাশে চেয়ারে বসলো। খেতে ব্যস্ত সকলে।

অপ্রাপ্তি! অপ্রাপ্তি! জীবনে প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির খাতা আজ ভরপুর। সর্বদা কেন সে-ই হেরে যাবে? কেন অপূর্ণ রইবে তার সকল ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা? যখনই কিছু চেয়েছে, পেয়েছে। পেতে পেতে এক অদম্য জেদ চেপে বসলো। সে ভাবতে লাগলো তার সকল ইচ্ছা পূরণ হবে। অপূর্ণ রইবে না কিছুই। কিন্তু আজ? সেই বোকামি মনে করে হাসি পায়। তাচ্ছিল্যের হাসি। একটা মানুষ যখন চাওয়ার সাথে সাথেই সব পেয়ে যায় তার ভেতর এক ভিন্ন আত্মবিশ্বাস থাকে। কিন্তু সেই মানুষটি ই যখন একসময় হেরে যেতে থাকে। অপূর্ণ রয়ে যায় তার ইচ্ছেরা। তখন জেদ চেপে বসে। সবকিছু অসহ্য লাগে। মানতে নারাজ ব্যর্থতা। বরাবরের মতো আজও হেরে গেল সে। ব্যর্থতা জড়িয়ে ধরলো আষ্টেপৃষ্ঠে। কি করে এই ব্যর্থতা, যাতনা সইবে সে? জানা নেই। জানা নেই। আছে শুধু একরাশ ক্ষোভ এবং যন্ত্রণা!

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দুয়া। দু হাত ধরে রাখা রেলিং। কোমর অবধি রেলিং। বাকিটা উন্মুক্ত। হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে কায়া। অনাবৃত কেশ নৃত্যরত হাওয়ার পরশে। মেয়েটা যখন স্রষ্টার পরিকল্পনা, জীবন নিয়ে চিন্তায় মগ্ন তখন কর্ণ কুহরে পৌঁছালো রিংটোন। তার ফোন বেজে চলেছে। ভাবনায় ছেদ পড়লো। রেলিং হতে দু হাত সরিয়ে নিলো দুয়া। বেলকনির দ্বার পেরিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো। শূন্য বিছানার এক পাশে মোবাইলটি রাখা। সেদিকে অগ্রসর হলো দুয়া। হাতে মোবাইল তুলে নিলো। লক্ষ্য করলো বাসা থেকে কল এসেছে। অভিমানিনী তার সমস্ত অভিমান ভুলে তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করলো।

” হ্যালো আসসালামু আলাইকুম! আম্মু কেমন আছো? আব্বু কেমন আছে? তোমরা সবাই ভালো আছো তো?”

চমকালো মেয়েটি! ফোনের ওপাশে মায়ের বদলে অন্য একজন। যাকে সে আশাও করেনি। সত্যিই সে ফোন করেছে!

চলবে.
#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৬

ফোনের দু প্রান্তে দু’জন। আবেগে আপ্লুত। মেয়েটার কপোল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। ওপাশ হতে শোনা গেল আদুরে নিষ্পাপ কণ্ঠস্বর,

” আপু! ”

সশব্দে কেঁদে উঠলো দুয়া। জাহিনের আদুরে কণ্ঠে নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছে। ভেজা কণ্ঠে থেমে থেমে বললো,

” ভাইয়্যু! আমার ভাইয়্যু! ত্ তুই সত্যিই আমাকে ফোন করেছিস? ”

প্রশ্নের উত্তর দিলো না জাহিন। বরং নিজের আকুতি পেশ করলো।

” আপু তুমি। তুমি চলে আসো। তোমাকে ছাড়া আমার কান্না পাচ্ছে। আমি কেঁদে ফেলছি আপু। ভালো লাগছে না। আব্বু কাঁদে। আম্মু কাঁদে। আমিও কাঁদি। তুমি প্লিজ আসো। আসো না। ”

ক্রন্দনরত দুয়া মুখে হাত রেখে চাপা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ওপাশ থেকে জাহিন বোনের ক্রন্দন ধ্বনি টের পেল। আদুরে গলায় বলে উঠলো,

” কাঁদে না আপু। তুমি না গুড গার্ল? গুড গার্ল কাঁদে না। খালামণি, তূর্ণ ভাইয়া বকবে। কাঁদে না। ”

” ভাইয়্যু! ”

” হাঁ আপু। তু তুমি কেঁদো না। আমিও কাঁদছি না। আমরা না গুড? কাঁদি না তো। ”

দুয়া ভাঙা গলায় বললো,

” কাঁদছি না। আমরা তো গুড। আমার ভাইয়্যু সবচেয়ে গুড বয়। একদম স্ট্রং। তাই না? ”

জাহিন মাথা নেড়ে সম্মতি পোষণ করলো।

” হাঁ আমি স্ট্রং।‌ অন্নেক স্ট্রং। বাহুবলীর মতো। ”

কান্নার মাঝেও হেসে উঠলো দুয়া।

” তাই? আমার ভাইয়্যু বাহুবলীর মতো স্ট্রং? ”

” হাঁ। তুমিও স্ট্রং। আমার দুই আপুই ইয়া শক্তিশালী। কাঁদে না ঠিক আছে? ”

জাহিন হাত নাড়িয়ে শক্তির মাত্রা বুঝালো। দুয়া নিঃশব্দে হাসলো। হাতের উল্টো পিঠে অশ্রু কণা মুছে বললো,

” আমার ভাইটা এখন কি করে? স্কুলে গিয়েছিল? ”

” হুঁ গিয়েছিলাম। তুমি জানো আপু আজকে ক্লাস টেস্ট ছিল। আমি হায়েস্ট মার্ক পেয়েছি। ম্যাম আমাকে গুড বয় বলেছে। ”

” তাই? মাশাআল্লাহ্! আমার ভাইটা ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ্ আরো ভালো করবে। ”

” হুঁ।‌ হুঁ। আব্বুও তাই বলেছে। আমি বড় হয়ে সায়েন্টিস্ট হবো। একদম নিউটন। অনেক সূত্র বানাবো। ”

দুয়া হাসিমুখে টাফটেড বেঞ্চে বসলো।

” হাঁ আমার ভাইয়্যু অনেক সূত্র বানাবে। সবাই সে-ই সূত্র মুখস্থ করবে। বইয়ে থাকবে সূত্রগুলো। ”

খুশি হলো ছোট্ট প্রাণটা। সোফায় ভালোমতো বসে বললো,

” আপু? ”

” হাঁ ভাইয়্যু। বলো। ”

” আমি না? তখন সহজ সহজ সূত্র বানাবো। সবাই আমাকে ভালো বলবে। বকবে না। ”

দুয়া হেসে উঠলো ভাইয়ের সরল কথায়। সম্মতি পোষণ করে বললো,

” ঠিক আছে। তুমি একদম সোজা সোজা সূত্র বানাবা। স্টুডেন্টরা এতে খুউব খুশি হবে। তোমার প্রশংসা করবে। ”

খুশিতে গদগদ হলো জাহিন। আদুরে কণ্ঠে ছোটাপু’র কাছে কত কথা বলতে লাগলো। দুয়া খুশিমনে তা শুনছিল। সহজ-সরল কথার জবাব দিচ্ছিল। ওর ইন্ট্রোভার্ট ভাইটা এত কথা বলতে জানে? এত মিশুক! কখনো তো বুঝতে পারেনি। হয়তো ছোট বাচ্চাটা এই স্বভাব প্রকাশ করেনি বলে। আজ অবশেষে সাময়িক দূরত্বে দু’জনের মধ্যকার ব্যবধান ঘুচে গেল। আদুরে আলাপে লিপ্ত হলো দুই ভাই-বোন!

আঁধারে নিমজ্জিত বসুধা। উন্মুক্ত জানালা গলিয়ে মৃদু হাওয়া প্রবেশ করছে কক্ষে। ছুঁয়ে যাচ্ছে কায়া। ডান কাত হয়ে শুয়ে রয়েছে দুয়া। দেহে জড়ানো ব্ল্যাংকেট। বাম পাশে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে তূর্ণ। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। হাতে উপন্যাসের বই। সমস্ত মনোযোগ বইয়ের পাতায়। দুয়া বাম কাঁধে মুখ এনে আড়চোখে তাকালো স্বামীর পানে। পড়নে তার শুভ্র রঙা টি শার্ট এবং ট্রাউজার। লালচে চুলগুলো এলোমেলো রূপে কপালে পড়ে রয়েছে। সদ্য ফ্রেশ হয়ে আসায় চুলগুলো স্বল্প সিক্ত। চোখে চশমা। সমতল কাঁচের আড়ালে লুকায়িত চক্ষুতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই মেয়েটার গলা শুকিয়ে গেল। অজানা অনুভূতি ঘিরে ফেললো আষ্টেপৃষ্ঠে। শুকনো ঢোক গিলে তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো দুয়া। এসব কি করছিল সে? নিজেকে নিজেই ধমকে দিলো। শক্ত হয়ে পড়ে রইলো বিছানায়। ঘুম আসছে না। বরং রাজ্যের সমস্ত চিন্তাভাবনা মস্তিষ্কে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। যেই দুয়া সর্বদা প্রেম ভালোবাসা থেকে দূরে দূরে থেকেছে। নিজেকে প্রস্তুত করেছে হালাল সঙ্গীর জন্য আজ সে বিবাহিতা। তারও রয়েছে একান্ত একজন মানুষ! বড্ড চেনা। কাছের সে-ই মানুষটি। তবুও ‘কিন্তু’ রয়ে যায়। চেনা পরিচিত মানুষটি আজ আর শুধুমাত্র কাজিন নয়। তার বিবাহিত স্বামী। বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব মেনে নেয়া উচিত। এতেই কল্যাণ। মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টি। তবুও ভাই মেনে আসা মানুষটিকে স্বামীর আসনে বসাতে সময় লাগছে। অস্বস্তি হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ্ সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো একটু সময়ের প্রয়োজন। টাইম ইজ দ্যা বেস্ট হিলার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয়ই সবটা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। তারাও হয়ে উঠবে অন্য সবার মতো স্বাভাবিক দম্পতি! আসলেই তাই?

স্বাভাবিক দম্পতি বিষয়টি মনে হতেই কুঁকড়ে গেলো মেয়েটা। মস্তিষ্কে হানা দিলো কত দুষ্টু চিন্তাভাবনা। নিজেকে ছিঃ ছিঃ বলে নিজেই আবার লাজে রাঙা হলো। মুখ লুকালো বালিশে। তূর্ণ বইয়ের পাতা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দুয়া’র পানে তাকালো। মেয়েটা এত নড়চড় করছে কেন? এনি প্রবলেম? মনের কথা মুখে আনলো তূর্ণ।

” দুয়া! ”

পুরুষালি ডাকে হকচকিয়ে গেল দুয়া! ভয় হলো তার উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা মানুষটি জেনে যায়নি তো? পরক্ষণে বোধগম্য হলো সে ভুলভাল ভাবছে। মনের কথা তূর্ণ ভাইয়া জানবে কি করে? দুয়া ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলো,

” হুঁ? ”

” ঘুমাসনি? ”

দুয়া ডান কাত হয়েই জবাব দিলো,

” না। ঘুম আসছে না। ”

বক্র হেসে তূর্ণ বললো,

” তাই? কালকের মতো ঘুম পাড়িয়ে দেবো? ”

লাজে র’ক্তিম হলো মুখশ্রী। মৃদু স্বরে আপত্তি জানালো তৎক্ষণাৎ।

” না না। আ আমি ঠিক আছি। ”

অধর কা’মড়ে হাসলো তূর্ণ। বইয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো,

” তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। নাহলে আমি কিন্তু নিজস্ব পন্থায় ঘুম পাড়িয়ে দেবো। ”

মেয়েটা ইচ্ছে স্বত্ত্বেও কিছু বলতে পারলো না। কণ্ঠনালী যেন অবরুদ্ধ! শব্দমালা বের হচ্ছেই না। অগত্যা চুপটি করে শুয়ে রইলো। ঘুমের আগের দোয়া দরুদ পাঠ করতে করতে একসময় তলিয়ে গেল নিদ্রায়। দুয়া ঘুমিয়ে গেছে নিশ্চিত হতেই তূর্ণ হাতে থাকা বইটি বন্ধ করলো। চশমা এবং বই রাখলো পার্শ্ববর্তী বেড সাইড টেবিলের ওপর। টেবিল ল্যাম্প বন্ধ করতেই ড্রিম লাইটের আলোয় ছেয়ে গেল কক্ষ। তূর্ণ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তার অর্ধাঙ্গীর পানে। মাইরা’র পানে! চোখেমুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তিকর আভা। অধর কোণে চিকন হাসির রেখা। আস্তে করে মাইরা’র পানে ঝুঁকে গেল তূর্ণ। তার মনোবাসনা পূরণ করতেই বুঝি ঘুমন্ত ললনা বাম কাত হয়ে শুলো। খুশি হলো প্রেমিক চিত্ত। ধীরে ধীরে হাতটি বাড়িয়ে দিলো। আলতো ছোঁয়ায় কপালে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো সরিয়ে দিলো। চোখের পাতায় হালকা ফুঁ দিতেই ঘুমন্ত ললনা নড়ে উঠলো। মুচকি হাসলো তূর্ণ।

” মাইরা! আমার চিরসঙ্গিনী মাইরা! কি আছে তোমাতে? তোমার এই মায়াবী মুখশ্রীতে কেন এত মায়া? যে মায়াজালে জড়িয়েছি বহুকাল পূর্বে। বেড়োতে পারিনি আজও। বের হতেও চাই না।‌ আবদ্ধ থাকতে চাই তোমাতে। আমার মাইরা’তে! ”

তৃপ্তিময় হাসলো তূর্ণ। ঘুমন্ত সঙ্গিনীর কপালের মধ্যভাগে এঁকে দিলো অধরের ছোঁয়া। ঘুমের ঘোরে দুয়া হালকা নড়ে উঠলো। কিন্তু নিদ্রা ভঙ্গ হলো না। প্রেমিক পুরুষটি সন্তুষ্ট চিত্তে হাসলো। আস্তে করে শয্যা গ্রহণ করলো তার মাইরা’র পার্শ্বে। কোমল হাতটি নিজের রূক্ষ হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে নিলো। মোহাচ্ছন্ন কণ্ঠে বলতে লাগলো,

” মাইরা! তোমায় দেয়া এ নামটি শুনলে তুমি অবাক হবে কি? জানতে চাইবে না কেন তোমায় ডাকছি ‘মাইরা’? ”

মানুষটির তৃপ্তিময় হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা দেখলো না রমণী। মিস করে গেল অতি মোহনীয় এক সম্বোধন। মাইরা!
°

আদিত্যর কিরণে উজ্জ্বল বসুন্ধরা। ঘুমের ঘোরে নড়েচড়ে উঠলো দুয়া। হালকা হলো নিদ্রা। নেত্রপল্লব খুলতে গিয়েও ব্যর্থ। যেন আঠালো কিছুতে আটকে রয়েছে। আস্তে ধীরে ডান হাতে কপালে পড়ে থাকা এলোমেলো চুল সরিয়ে চোখ মেলে তাকালো। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো নতুন এক দিন। এক নতুন সূচনা। মুচকি হাসলো মেয়েটি। দু হাতে আড়মোড়া ভাঙ্গতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হলো। সরু চোখে তাকালো বাম পাশে। হতবিহ্বল হয়ে গেল মুহুর্তেই! তার কোমল বাঁ হাতটি আবদ্ধ পুরুষালি হাতের আঁজলায়। শক্ত রূপে আবদ্ধ করে রেখেছে। যেন ছেড়ে দিলেই হাতছাড়া হবে। সকাল সকাল এমন দৃশ্য মোটেও প্রত্যাশা করেনি দুয়া। বিস্মিত চাহনিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। যখন হুঁশ ফিরল আরেক দফা অবাক হলো! দ্রুততার সহিত হাতটি ছাড়িয়ে নিতে গিয়েও নিলো না। আস্তে ধীরে আদুরে কায়দায় হাতটি ছাড়িয়ে নিলো। অতঃপর তড়িৎ বেগে উঠে বসলো। গলায় ভালোমতো ওড়না জড়িয়ে দেহ হতে ব্ল্যাংকেট সরিয়ে নিলো। পা নামালো জমিনে। বিছানা ত্যাগ করে আরেকবার তাকালো ঘুমন্ত সঙ্গীর পানে। এবার নিজের হাতে দৃষ্টি পড়তেই কেমন ভিন্নরকম অনুভূতি হলো। যে অনুভূতি সম্পর্কে অজ্ঞাত সে! পরিচিত নয়। মেয়েটা এলোমেলো চিন্তাভাবনা করতে করতে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। উদ্দেশ্য ফ্রেশ হয়ে নেয়া।

ইউনিভার্সিটি চত্বর! ক্যান্টিনে বর্গাকৃতির টেবিল ঘিরে বসে রয়েছে বন্ধুরা। একমাত্র দুয়া অনুপস্থিত। তৃষা সিঙ্গাড়ায় কা’মড় বসিয়ে নাটুকে কণ্ঠে বললো,

” দোস্তরা। বি রেডি। তোমাদের সামনে পেশ করতে চলেছি বছরের সেরা চমকপ্রদ সংবাদ। ”

বিশাল নাকমুখ কুঁচকে বললো,

” পেটুক মাইয়া! আগে খা। তারপর বল। নইলে আগে বল এরপর খা। দুইডা একলগে করতে গিয়া ডিরেক্ট জগাখিচুড়ি! ”

তৃষা সিঙ্গাড়া মুখে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। তা দেখে নাক ছিটকালো বিশাল।

” ছিঃ! ”

” হা হা হা। ঠিক আছে। আগে খাই। তারপর বলি। তোরা রেডি থাক। ”

পুষ্পি মুখ খুললো এবার।

” এমনভাবে রেডি হতে বলতাছোছ যেন বসুন্ধরা সিটি কিংবা যমুনা ফিউচার নিয়া যাবি। ”

তৃষা আপত্তি জানালো।

” উঁহু। নো বসুন্ধরা নো যমুনা। অনলি মঙ্গল গ্রহ। ”

” আচ্ছা? তা কি সংবাদ শুনি? ” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিন্দু।

তৃষা এক ঢোক পানি পান করে বেশ ভাব নিয়ে বসলো। সকলের দৃষ্টি ওর দিকেই নিবদ্ধ। তৃষা গম্ভীর স্বরে প্রথম শক দিলো।

” তূর্ণ ভাইয়া বিয়ে করে ফেলছে। ”

” ওহ্ আচ্ছা। ”

পরক্ষণেই হতবিহ্বল হলো বিন্দু! বড় বড় চোখ করে শুধালো,

” কি! আদ্রিয়ান স্যার ব্ বিয়া করছে? কবে? ”

” তিনদিন আগে। ”

পুষ্পি চেয়ার থেকে পড়তে গিয়েও পড়লো না। তার ক্রাশ কিনা বিয়ে করে ফেলেছে। তা-ও না জানিয়ে! এতবড় দুঃখ রাখবে কোথায়? তিয়াশ এসবে বিশ্বাস করলো না। অবিশ্বাসের স্বরে বললো,

” বোকা পাইছিস? তোর ভাইয়া বিয়ে করলো আর কাকপক্ষী টেরও পেলো না! এটা কি নাটক সিনেমা? ”

” উঁহু কোরিয়ান ড্রামা। ”

বিন্দু তৃষার পিঠে ঘুiষি মে রে বললো,

” ফা জি ল মাইয়া! ঢঙ করিছ না। সত্যি করে বল কি বলতে চাস। ”

তৃষা মিথ্যা মিথ্যা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো। চোখ রাঙানি দিয়ে বললো,

” সত্যিই আমার ভাইয়া বিয়া করছে। আর তোদের দুয়া বেবিও। ”

” দুয়া! ও আবার কি করেছে? স্পষ্ট করে বলছিস না কেন? খালি কথা প্যাচায়। ”

তিয়াশ এর কণ্ঠে অসন্তোষ প্রকাশ পাচ্ছে।

” আরে ভাই তোরা বুঝতে পারছিস না কেন? তূর্ণ ভাইয়া আর দুয়া দু’জনেই বিয়ে করে ফেলছে। ”

” কাকে? ”

বিস্ময়ে অভিভূত বিশাল! বাকি বন্ধুরাও স্তব্ধ! বিন্দুর মুখ ফসকে পানি পরে গেল। তৃষা ক্ষি’প্ত হয়ে একটা স্ল্যাং ইউজ করে বললো,

” একে অপরকে। ”

” হোয়াট! ”

হতবাক সকলে! মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চলেছে একে অপরের। প্রকৃত বিষয়টা বোধগম্য হচ্ছে না? নাকি বিশ্বাস হতে চাইছে না? পুষ্পি কম্পিত কণ্ঠে বললো,

” ত্ তুই এসব কি বলছিস তৃষ? আদ্রিয়ান স্যার আর দুয়া? বিয়ে করছে! তা-ও একে অপরকে! ওহ্ মাই আল্লাহ্! এ এটা সত্যি? ”

” হুম পাঁচশ পার্সেন্ট সত্যি। ”

” অবিশ্বাস্য! ”

বিশালের কথা শুনে তৃষা দাঁত কেলিয়ে হাসলো।

” বিশ্বাস হয় না? বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বান্ধবী যখন বাচ্চা কোলে নিয়া আইবো আর কইবো ‘ মিট ইয়্যর ভাগিনা ‘ তখন বিশ্বাস হইবো নে। ”

তিয়াশ এখনো ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছে না।

” তুই সত্যি বলছিস তৃষ? দুয়া সত্যিই? ”

” হ রে ভাই সত্যি। দুয়া কাল আসবে নে। তখন ওকেই জিজ্ঞাসা করিস। ”

বিশাল পুনরায় ঘোরাচ্ছন্ন কণ্ঠে বলে ফেললো,

” অবিশ্বাস্য! ”

” আসলেই অবিশ্বাস্য! কেমনে কি হইলো বুইন? ”

পুষ্পি প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে রয়েছে তৃষার পানে। তা লক্ষ্য করে তৃষা কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো। এবার? বিয়ের খবর তো দিয়েই দিলো। এখন বলবে টা কি? সত্যি নাকি মিথ্যা? নাকি অর্ধ সত্যি? তৃষা যখন ভাবনায় লিপ্ত তখনই কর্ণ কুহরে পৌঁছালো,

” কি অবিশ্বাস্য? আর কে বিয়ে করেছে? ”

হকচকিয়ে গেল সবাই! এ কোথা থেকে উদয় হলো? এবার? ওদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো অযাচিত আগন্তুক। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো কে বিয়ে করেছে। পুষ্পি বিরক্ত হয়ে চরম সত্যিটা বলেই ফেললো,

” দুয়া। ”

” হোয়াট! ”

ওপাশের মানুষটি চরম আশ্চর্যান্বিত! তা লক্ষ্য করে ওরা ঘাবড়ে গেল। এবার? কাণ্ড ঘটে গেল রে! ওহ্ নো!

চলবে.#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৭

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুই পক্ষ। তৃষা ও বন্ধুরা মৃদু ঘাবড়ে রয়েছে। সন্তর্পণে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। আর বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মানব? সে ভ্রূ কুঁচকে শুধালো,

” কি বললে? দুয়া বিয়ে করেছে? ”

পুষ্পি এখন বোকা বনে গেছে। বুঝতেই পারছে না কি থেকে কি বলবে। শেষমেষ এভাবে ফেঁসে গেল? কি দরকার ছিল মুখ ফসকে সত্যিটা বলার? এবার কি হবে? ওরা যখন অস্থিরতায় চরম বিপর্যস্ত তখনই হঠাৎ সশব্দে হেসে উঠলো রুমান। হকচকিয়ে গেল ওরা সকলে। ক্যান্টিনে উপস্থিত বাকিরাও ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রুমান হাসতে হাসতে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো সাগরেদরা। রুমান হাসতে হাসতে বললো,

” হোয়াট অ্যা জোকস্! হা হা। আমার দুয়া ডার্লিংয়ের কথা ব্যতিত বহুদিন পর অন্য কারোর কথায় হাসলাম। পুষ্পি থ্যাংকস টু ইউ। একটা ক্লেমন ট্রিট দিলাম। মনে করে ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নিয়ো। ওকে? ”

পুষ্পি দাঁতে দাঁত চেপে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো। ওই শ*তান এর দিকে তাকালেই গা’লমন্দ করতে ইচ্ছে করবে। রুমান এবার ওদের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। উদাসীন কণ্ঠে শুধালো,

” দুয়া ডার্লিং কোথায়? আসেনি? ”

তৃষা রাগ নিয়ন্ত্রণ করে জবাব দিলো,

” না আসেনি। ”

” কেন? ও ঠিক আছে তো? অসুখ হয়েছে? ”

আলগা পিরিত দেখে বন্ধুদের মেজাজ বেশ গরম!

” রুমান ভাই। দুয়া ঠিক আছে। সময় হলে চলে আসবে। এবার আমরা আসি? আসসালামু আলাইকুম। ”

বিশাল লম্বা এক সালাম দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এলো। হাঁটতে হাঁটতে রাগ প্রকাশ করলো বিন্দু।

” শা লা শ*তান! মেয়ে মানুষ দেখলেই জিভ ল্যাক ল্যাক করে ওঠে! কোন অলক্ষুনে যে ওইটার কুনজর দুয়া’র ওপর পড়লো? মন তো চায় ওর লু* চোখ দুইটা তুলে মার্বেল খেলি। ”

বিশাল গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

” নেহাত ভার্সিটির সিনিয়র ভাই। পাওয়ারফুল লোক। নইলে বুঝিয়ে দিতাম কত ধানে কত চাল। ”

তিয়াশ চোখের চশমা ঠিক করে বললো,

” সবকিছুরই সীমা থাকে। সেই সীমা অতিক্রম করলে অসুবিধা। আপাতত যা হচ্ছে অতিরিক্ত হচ্ছে। ঠিক হচ্ছে না। আদ্রিয়ান স্যারকে কি জানানো উচিত? ”

তৃষা ভাবুক হয়ে বললো,

” উঁহু আপাতত থাক। ভাইয়া এমনিতেই চায় না ভার্সিটির কেউ জানুক ভাইয়া আমাদের আপনজন। যদি ওই রুমান বেশি বাঁদরামি করে তখন নাহয় বলা যাবে। ”

” ঠিক বলছোছ। আপাতত ওইটারে দাঁতে দাঁত চিপা টলারেট করতে থাকি। ”

পুষ্পির কথায় সম্মতি পোষণ করলো বন্ধুরা। হাঁটতে হাঁটতে ওরা যার যার ডিপার্টমেন্টের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো।

আদিত্যর কিরণে উজ্জ্বল বসুধা। ফজরের সালাত আদায় করে দুয়া আর ঘুমায়নি। বাগানে হাঁটলো অনেকটা সময় নিয়ে। নিজেকে বিলিয়ে দিলো প্রকৃতির মাঝে। ফুলের সুবাস টেনে নিলো ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়ায় দেহমন জুড়িয়ে গেল। অনেকটা সময় অতিবাহিত হলো বাগানে। অতঃপর দুয়া বাড়িতে প্রবেশ করলো। পুরো বাড়ি এখনো কেমন নীরব! সবাই ঘুম থেকে ওঠেনি বোধহয়। দুয়া বড় শ্বাস ফেলে লিভিংরুম ক্রস করে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলো। পথিমধ্যে দেখা হলো তাসলিমার সাথে। দু’জনেই একে অপরকে দেখে মুচকি হাসলো।

” আসসালামু আলাইকুম খালামণি। গুড মর্নিং! ”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। গুড মর্নিং। কিন্তু এসব কি শুনছি দুয়া? ”

ভ্যাবাচ্যাকা খেল দুয়া!

” মানে? আমি কি ভুল কিছু বলেছি? ”

” নিশ্চয়ই বলেছিস। তবে কি আমি ভুল শুনেছি? ”

তাসলিমার কণ্ঠ কিঞ্চিৎ রূঢ়। যাতে ঘাবড়ে গেল মেয়েটা। আমতা আমতা করে বললো,

” খালামণি আ আমি..”

কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই,

” আবারো? তোর সাহস তো কম না। ”

দুয়া এবার মলিন মুখে খালামণির কাছে গিয়ে তাকে দু হাতে আলিঙ্গন করলো। আদুরে কণ্ঠে বললো,

” খালামণি! ও খালামণি! রাগ করছো কেন? আমি কি ভুল করেছি? তুমি বলো। আমি শুধরে নেয়ার চেষ্টা করবো। ”

” কচু করবি। যে মেয়ে বিয়ের পর শাশুড়িকে খালামণি ডাকে তার দৌড় কতদূর জানা আছে আমার। ”

জিভ কা’মড়ে হালকা সরে গেল দুয়া। মেকি হেসে বললো,

” হি হি। তুমি শাশুড়ি মা! মনে থাকে না তো। তাই গালতি ছে মিস্টেক হয়ে যায়। ”

তাসলিমা ওর কান মলে দিলো।

” পাঁজি মেয়ে। ভুল করে আবার হিন্দি বলা হচ্ছে? ”

দুয়া মিথ্যা মিথ্যা কঁকিয়ে উঠলো।

” আউচ! লাগছে খালামণি। ”

” আবারো? খালামণি বলে কতকাল ডাকবি? মা বল। ”

দুয়া শাশুড়ির হাতটা কান থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,

” উঁহু খালামণি! লাগছে তো। কান ছাড়ো। আমি মা বলছি। উফ্। ”

তাসলিমা দজ্জাল শাশুড়ির ভান ধরে কান ছেড়ে দিলেন। শাসনের স্বরে বললেন,

” মা বলবি কিনা বল। ”

ফিক করে হেসে উঠলো দুয়া। হাসতে হাসতে বললো,

” তোমার কথা শুনে বাংলা সিনেমার নাম মনে পড়ে গেল খালামণি। ভালোবাসা দিবি কিনা বল। শাকিব খানের। হা হা হা। ”

তাসলিমা আর অভিনয় জারি রাখতে পারলেন না। ব্যর্থ হয়ে উনিও হেসে উঠলেন। জড়িয়ে ধরলেন আদুরে ছানাটাকে। দুয়াও ওনার বুকে আদুরে ছানার মতো মিশে গেল‌। তাসলিমা ওর চুলের ভাঁজে চুমু এঁকে বললেন,

” ভার্সিটি যাবি না আজ? ”

” হুঁ যাবো। ”

” আচ্ছা রুমে যা। ধীরে সুস্থে রেডি হ। ”

” হুঁ। ”

খালামণির অধরের ছোঁয়া ললাটে পেয়ে দুয়া তৃপ্তিময় হাসলো। মাথা সরিয়ে নিলো বক্ষস্থল হতে। তাসলিমা ওর এলোমেলো চুল গুছিয়ে দিলেন। বললেন,

” গিয়ে দেখ তূর্ণ উঠেছে কিনা। না উঠলে ডাক দে। ”

” আচ্ছা। আমি যাচ্ছি। ”

মুচকি হেসে লিভিংরুম ত্যাগ করলো দুয়া। সেথায় তাকিয়ে তৃপ্তির আভা ফুটে উঠলো তাসলিমার মুখশ্রীতে। উনি খুশিমনে কিচেনের দিকে অগ্রসর হলেন।
___

দুয়া’র মুখমণ্ডলে খুশির ছাপ। আনমনে মেয়েটা প্রবেশ করলো বেডরুমে। প্রবেশ করেই সম্মুখে দৃষ্টি আবদ্ধ হলো। হকচকিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। মৃদু চিৎকার করে দু হাতে আঁখি যুগল আড়াল করে ঘুরে দাঁড়ালো। ওর চিৎকারে হতবিহ্বল হলো উপস্থিত মানব!

” হোয়াট দ্যা হেক! সকাল সকাল চেঁচামেচি করছিস কেন পুতলা? ”

অপর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েই দুয়া জবাব দিলো,

” চিৎকার করবো না তো কি করবো? এ কি হাল করে দাঁড়িয়ে আছো? ছিঃ। লজ্জা শরম নেই নাকি? ”

তূর্ণ সমতল আরশিতে দুয়া’র অবস্থান লক্ষ্য করে ঘুরে দাঁড়ালো। একবার তাকালো নিজের দিকে। পড়নে তার শুভ্র রঙা তোয়ালে। উদোম দেহে শুধুমাত্র তোয়ালে। যা কোমড় থেকে হাঁটু অবধি। ডান হাতে শুকনো একটি তোয়ালে। যা চালনা করে চলেছে কেশের ভাঁজে ভাঁজে। নিজেকে দেখে তূর্ণ বক্র হাসলো। দুয়া’র পৃষ্ঠদেশে তাকিয়ে বললো,

” লজ্জা নারীর ভূষণ। জন্মগত ভাবেই ছেলেরা বেলাজ। বেশরম। জানিস না বুঝি? ব উ? ”

শেষোক্ত থেমে থেমে বলা ‘ বউ ‘ শব্দটি দুয়া’র কর্ণ গহ্বরে ঝঙ্কার সৃষ্টি করলো। অজান্তেই চক্ষুযুগল হতে দু হাত সরে গেল। অধর কোলে দেখা মিললো সরু রেখার। দু কপোলে লজ্জালু আভা। ওপাশে থাকা মানুষটি কি তা অনুধাবন করতে পারলো? হাতে থাকা তোয়ালেটি বিছানায় ফেলে দিলো তূর্ণ। আস্তে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলো তার মাইরা’র পানে। পুরুষালি কদম অনুভব করতে পারলো মেয়েটি। ললাটে দেখা মিললো স্বেদজলের। সেথা হতে সরে যাওয়ার ইচ্ছে সত্ত্বেও এক কদম নড়তে পারলো না দুয়া। পদযুগল যেন মেঝেতে আটকে। ওর খুব সন্নিকটে এসে থামলো তূর্ণ। দাঁড়ালো পৃষ্ঠদেশ ছুঁই ছুঁই করে। এত সন্নিকটে পুরুষালি উপস্থিতিতে মেয়েটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়লো শিহরণ। তড়িৎ সেথা হতে সরে যাওয়ার প্রয়াস চালালো। কিন্তু বাধাপ্রাপ্ত হলো অপ্রত্যাশিতভাবে। ডান কাঁধ আঁকড়ে ধরেছে মানুষটি। না চাইতেও থমকে গেল মেয়েটি। শ্বাস প্রশ্বাস এর গতিবেগ দ্রুততম। কাঁধে হাত রেখেই আরো সন্নিকটে এলো তূর্ণ। কর্ণে উষ্ণ শ্বাস ফেলে ফিসফিসিয়ে শুধালো,

” সে কি বেলাজ পুরুষের সান্নিধ্যে লজ্জা পাচ্ছে? ভেঙ্গে দেবো কি লাজের সমস্ত স্তর? ”

এমন ভ”য়ংকর শব্দমালায় মেয়েটির সারা কায়ায় কম্পন শুরু হলো। আর পারলো না সইতে। কাঁধ হতে হাতটি সরিয়ে দ্রুততম পায়ে কক্ষ ত্যাগ করলো। সেথায় তাকিয়ে নিম্ন অধর কা’মড়ে হাসলো তূর্ণ। সে কি মোহনীয় হাসি!

” দুয়া বেবি! তুই নাকি বিয়ে করে ফেলেছিস? ”

সবে মাত্র বোতলে মুখ লাগিয়েছিল দুয়া। পুষ্পির কণ্ঠে এতটাই স্তব্ধ হলো যে নাকেমুখে বিষম খেলো। ঘাবড়ে গেল ওরা সকলে। তৃষা তাড়াতাড়ি করে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলো মেয়েটা। তৃষা চক্ষু গরম করে পুষ্পির দিকে তাকালো।

” ফ*ন্নি মাইয়া! আরেকটু হলেই তো আমার ভাইয়ের ভবিষ্যত মাইরা দিতি। ”

” স্যারের ভবিষ্যত! মানে কি বুইন! এক্সপ্লেইন মি প্লিজ।”

পুষ্পির নাটুকে কথায় তৃষা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

” আমার ভাইয়ের বউ এই মাইয়া। অর কিছু হইলে আমার ভাইয়ের কি হইতো? আমার অনাগত ভাতিজা ভাতিজি কোথ থে আইতো? প্লে স্টোর থে? ”

এত ভ’য়াবহ দূরদর্শিতা! হতবিহ্বল বন্ধুরা সকলে! দুয়া তো পারছে না লাজে রাঙা হয়ে মাটির অন্তরালে লুকিয়ে পড়তে। ছিঃ! মেয়েটা এত বেশরম কেন? পুষ্পি দাঁত কেলিয়ে হাসলো।

” প্লে স্টোর কেন? আমি আছি না? একশো উনপঞ্চাশ তম ক্রাশরে নাহয় শাদী করে তোরে ভাতিজা ভাতিজি গিফট করতাম। ”

” এ্যাহ্! শখ কত মাইয়ার। ” তৃষা বিদ্রুপ করে হাসলো।

তিয়াশ এসব ছেড়ে দুয়া’র পানে তাকালো।

” দুয়া। ”

ডাক শুনে ওর দিকে তাকালো দুয়া।

” হাঁ বল। ”

” তুই কি সত্যিই…। বিয়েটা সত্যি সত্যিই হয়েছে? ”

দুয়া তাকালো তৃষার পানে। তৃষা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। দুয়া এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

” হাঁ রে। সত্যি। নাউ আ’ম ম্যারিড। বেটারহাফ অফ আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ। ”

বন্ধুরা চরম আশ্চর্যান্বিত! ভুলে গেল কোনোরূপ বাক্য ব্যয় করতে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বান্ধবীর দিকে। বিন্দু এবার ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো। দুয়া’র পিঠে ঘু|ষি মে রে বললো,

” কত্ত বড় শ*তান। বন্ধুমহলরে না জানাইয়া তিন কবুল বইল্লা ফেললো! এই তুই এইডা করতে পারলি? একটুও বুক কাঁপলো না? আমগো ভাগের খাবার এমনে মাইরা দিলি? ছিঃ ছিঃ ছিঃ। তুই তো বন্ধু নামের ক*লঙ্ক। ”

দুয়া রাগ করতে গিয়েও পারলো না। সশব্দে হেসে উঠলো। এতে আরো তেঁতে উঠলো বিন্দু। দুয়া হাসতে হাসতে বললো,

” ডায়লগবাজি শেষ? নাকি আরো আছে? ”

” আছে। কিন্তু এহন বলার মুড নাই। আই অ্যাম তো ক্লান্ত। ”

সকলেই হেসে উঠলো। দুয়া হাসি থামিয়ে এবার গম্ভীর হলো।

” দোস্ত যেখানে আমি নিজেই জানতাম না বিয়ে হবে সেখানে তোদেরকে বলবো কি করে? ”

বন্ধুরা এহেন কথায় চমকালো!

” মানে? ঠিক বুঝলাম না। ”

তিয়াশ জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে রয়েছে। দুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

” বিয়েটা একদম আনএক্সপেক্টেড ছিল। আমরা কেউই জানতাম না। ”

” দেখ দোস্ত আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। তুই একটু ক্লিয়ার করে বলবি! ”

বিশালের কথায় সম্মতি পোষণ করলো বিন্দু।

” হাঁ ক্লিয়ার করে বল। আসলে হয়েছিল টা কি? ”

জবাবের অপেক্ষায় বন্ধুমহল। দুয়া বুঝতে পারছে না সে কি জবাব দেবে। যেখানে সে নিজেই প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অবগত নয়। এখন বলবে টা কি?

অপরাহ্ন প্রহর। ক্লাসমেটের কাছ থেকে জরুরি নোটস কালেক্ট করে বাড়ি ফিরছে তৃষা। চলন্ত রিকশায় বসে উপভোগ করছে শহরের অপরাহ্ন। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ দৃষ্টি গেল রাস্তার এক পাশে। অবাক হয়ে গেল মেয়েটা! এ কি দেখছে সে! জাবির! হাঁ জাবির ই তো। রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে। ক্ষণিকের মধ্যেই মানুষটিকে পেছনে ফেলে অগ্রসর হলো রিকশা। পিছু ঘুরে আরেকবার তাকালো তৃষা। নিশ্চিত হলো ওটা জাবির ই। আস্তে করে সোজা হয়ে বসলো তৃষা।

” জাবির ভাইয়া! উনি এখানে কি করছেন? ওনার মা-বোন না বিয়ের দু’দিন পর ই বগুড়া চলে গেল? তাহলে উনি রয়ে গেলেন কেন? আর উনি যে শহরেই আছেন এটা কি দুয়া জানে? উঁহু জানে না বোধহয়। ও জানলে কোনো না কোনোভাবে আমিও জানতে পারতাম। এর মানে ও জানে না। তাহলে এই মানুষটা শহরে করছে কি? ”

ভাবনায় পড়ে গেল তৃষা। চলন্ত রিকশায় ভাবুক মেয়েটি অপরাহ্নের সৌন্দর্য বাদ দিয়ে ভাবনার সাগরে ডুবে গেল।

” তূর্ণ ভাইয়া! আজ একটা সত্যি জানতে চাই। আমাদের বিয়ের পেছনে লুকায়িত সত্যিটা কি? কেন বিয়ে হলো আমাদের? সে রাতে এক্সাক্টলি কি হয়েছিল? ”

একসাথে এত প্রশ্ন! হতবিহ্বল হলো আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ!

চলবে.

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here