তুমি হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব -১২+১৩+১৪

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১২

” তোর প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে বোন। মন খারাপ করিস না। ”

হতভম্ব হলেন সাজেদা! মলিন কণ্ঠে শুধোলেন,

” কেন? ”

” কারণ আমি ইতিমধ্যে কারো কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ”

চরম আশ্চর্যান্বিত হলেন সাজেদা এবং তানজিনা! সাজেদা বুঝতেই পারছেন না ওনার কিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত। তার এতদিনের স্বপ্ন এভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে!

” ত্ তুমি এসব কি বলছো ভাইয়া? তুমি কারো কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ! কার কাছে? ”

” তাসলিমা আপার কাছে‌। ”

সাজ্জাদ সাহেবের সরল জবাব। দ্বিতীয় দফায় হতভম্ব হলেন সাজেদা এবং তানজিনা! তাহমিদা অবশ্য চুপটি করে দাঁড়িয়ে। সাজেদা কোনোমতে নিজেকে সামলে প্রশ্ন করলেন,

” প্রতিশ্রুতি দিয়েছো! কবে? আমাদের তো বিন্দুমাত্র জানালে না। নাকি ফুপু হিসেবে আমার জানার অধিকার নেই? ”

সাজ্জাদ সাহেব না বোধক উত্তর দিলেন।

” এমন কিছুই নয়। মাস তিনেক আগে আপার সাথে কথা হয়েছে। প্রস্তাব আমার মনমতো ছিল। তাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। কয়েক বছর পর দুয়া মা’কে তূর্ণ’র হাতে তুলে দেবো। আপাতত ও পড়ালেখা করছে। করুক। ”

সাজেদা বিদ্রুপের হাসি হাসলেন।

” বাহ্! আবারো পক্ষপাতীত্ব? তুমি বরাবরই বাপের বাড়ির থেকে শ্বশুরবাড়িকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে এসেছো ভাইয়া। আদরের মেয়ের বিয়ের বেলাতেও তাই করছো? ”

অবাক হলেন সাজ্জাদ সাহেব! তাহমিদা মন খারাপ করে দৃষ্টি নত করে নিলেন। সাজ্জাদ সাহেব বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন,

” তুই এসব কি বলছিস? আমি পক্ষপাতীত্ব করি? ”

” হাঁ করোই তো। আফটার অল তারা সমাজের উঁচু শ্রেণীর লোক। তোমার সুখদুঃখের সাথী। মানি প্লান্ট। তাদের তোষামোদ করতে হবে না? ”

সাজ্জাদ সাহেব খানিকটা রাগত সুরে বললেন,

” সাজেদা! মুখ সামলে কথা বল। ভুলে যাস না আমি তোর বড় ভাই। ”

” আমি মুখ সামলেই কথা বলছি ভাইয়া। আর তুমি আমার বড় ভাই সেটাও ভুলিনি। মনে আছে। তবে তুমি ভুল করছো। ছোট বোন হিসেবে সেই ভুলটা আমি শুধরে দেয়ার চেষ্টা করছি মাত্র। ”

” আমি ভুল করছি? কেমন ভুল? ” সাজ্জাদ সাহেব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোনের পানে।

” ভুল ই তো। ও ই তূর্ণ না তূর্য কি যেন নাম! ও মানুষ হিসেবে দুয়া’র যোগ্য নাকি? সবসময় ঠোঁটকাটা, নির্লজ্জ কথাবার্তা বলে। বড়ছোট কিছুই মান্য করে না। এর উপর দুয়া সর্বদা ওর যন্ত্রণায় তটস্থ। এরা জুটি হিসেবে একদম বেমানান। ওদের বিয়ে হলে সংসারে অশান্তি ছাড়া কিছুই থাকবে না। ক’দিনের মধ্যেই হয়তো ডিভোর্স হয়ে যাবে। ফুপু হিসেবে আমি এটা হতে দিতে পারি না। ”

প্রিয় ভাগ্নেকে নিয়ে এমন কটূক্তি মানতে পারলেন না তাহমিদা। উনি নরম কণ্ঠে বলে উঠলেন,

” আপা তোমাদের মধ্যে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। কিছু মনে করো না। তূর্ণ কিন্তু ছেলে হিসেবে মোটেও খারাপ না। ওর বিরুদ্ধে তোমরা একটাও অভিযোগ পাবে না। সবাই ওকে ভালো জানে‌। আর ভালোবাসেও। আমার বোনের ছেলে বলে বলছি না। তূর্ণ খাঁটি হীরা। সব বাবা মা ই ওর মতো জামাতা চাইবে। ”

সাজেদা বিদ্রুপ করে বললেন,

” হুঁ! খাঁটি হীরা। তুমি তো বলবেই ভাবি। তোমার সম্মানীয় বড় বোনের ছেলে কিনা! ”

তাহমিদা কিছু বলতে উদ্যত হতেই সাজ্জাদ সাহেব হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন। বোনের উদ্দেশ্যে বললেন,

” সাজেদা তুই তূর্ণ’কে কেন অপছন্দ করিস জানি না। তবে শুধু আমরা নই। আশপাশের সবাই জানে তূর্ণ কেমন ছেলে। মেয়ে জামাই হিসেবে আমাদের দুয়া’র জন্য ওর মতো ছেলে পাওয়া দুষ্কর বটে। ”

দম ফেলে উনি পুনরায় বলতে লাগলেন,

” আর কি যেন বলছিলি? তূর্ণ সবসময় ঠোঁটকাটা, নির্লজ্জ কথাবার্তা বলে, বড়ছোট কিছুই মান্য করে না? কথাটায় একটু ভুল আছে। ও কিন্তু সবার সাথে এমন আচরণ করে না। শুধুমাত্র ফ্যামিলির লোকেদের কাছেই তূর্ণ ঠোঁটকাটা, দুষ্টু ছেলে। বাইরের দুনিয়ায় আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ একজন গম্ভীর মানুষ। ও একটা ভার্সিটির লেকচারার। খুব ভালো করেই জানে কোথায় কেমন আচরণ করতে হবে। কোন জায়গায় কোন আচরণ মানানসই। তূর্ণ ছেলেটা ফ্যামিলি ম্যান। তাই ফ্যামিলিতে একজন মাটির মানুষের মতো মিশে থাকে। ও নিজে নামকরা একটা ভার্সিটির লেকচারার। বাবার এত ধনসম্পদ। পূর্বপুরুষ সূত্রেও বেশকিছু সম্পদ পেয়েছে। তবুও ছেলেটার মধ্যে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। ও যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো মানুষের সাথে সহজেই মিশতে পারে। এই যে আমরা তো মধ্যবিত্ত। ওদের ক্লাসের নই। তবুও ওই পরিবারের সাথে আমাদের খুবই ভালো সম্পর্ক। কখনো মনেই হয় না তারা আমাদের উঁচু শ্রেণীর। আমাদের নিচু দৃষ্টিতে দেখছে। ”

বাবার কথার রেশ ধরে তানজিনা বললো,

” আর ফুপি। তুমি বললে না? দুয়া তূর্ণ’র যন্ত্রণায় তটস্থ, এটা সম্পূর্ণ ভুল। ওদের মধ্যে সম্পর্কটা খুব স্নিগ্ধ, সরল। কোনো প্যাঁচ নেই। খুনসুটিতে ভরপুর। ছোটবেলা থেকেই দু’জনে পাশাপাশি বড় হয়েছে। আমরা সবাই জানি এমনকি দেখেছি। দুয়া তূর্ণ বলতেই পা’গল। ছোটো থেকেই আমার বোনটার বেশীরভাগ আবদার ছিল ওর তূর্ণ ভাইয়ার কাছে‌। দু’জনের বয়সের পার্থক্য নয় বছর। তবুও ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। একে অপরকে বুঝতে পারে। সুখদুঃখে সঙ্গ দেয়। দুয়ার কোনো বিপদ হলেই নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসে তূর্ণ। আবার তূর্ণ’র সামান্য কিছু হলেই আমার বোনটা কেঁদেকেটে সাগর বানিয়ে ফেলে। এসব আজো চলমান। ওদের সম্পর্কটা দিনকে দিন গ্ৰো করেছে। আরো মজবুত হয়েছে। ওরা একে অপরের জন্য পারফেক্ট ম্যাচ। ”

সাজেদা ব্যঙ্গ করে বললেন,

” বাহ্! বড়লোক বাড়ির সম্বন্ধ পেয়ে সবাই তো ঠিকভুল গণ্য করতেই ভুলে গেছে। সমানে গুণগান গেয়ে যাচ্ছে। চমৎকার তো! ”

সাজ্জাদ সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন,

” তুই যে প্রস্তাব দিলি তা আমাদের ভাবনার বাইরে ছিল। এর উপর আমি কারো কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই জাবির এর সাথে দুয়া মায়ের সম্বন্ধ হচ্ছে না। এজন্য তুই এভাবে কটূক্তি করে বলতে পারিস না। এটা বাজে শোনায়। ”

” তোমরা বাজে সিদ্ধান্ত নিতে পারো। অথচ আমি বললেই দোষ? ”

” সাজেদা! ” গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠলেন সাজ্জাদ সাহেব।

” হাঁ সাজেদা। সাজেদা ভুল কিছু বলছে না। এখনো সময় আছে ভাইয়া। বড়লোকের ছেলে। এর উপর কারোর ধার ধারে না। বেপরোয়া স্বভাবের। ওখানে মেয়ে দিয়ো না। পরে পস্তাবে। ”

” পরেরটা না হয় পরেই দেখা যাবে। আপাতত এসব কথা বন্ধ কর। আমি আর এই বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নই। ”

উঠে দাঁড়ালেন সাজ্জাদ সাহেব। বোনের দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন,

” দুয়া’র কানে যেন এসব কথাবার্তা না যায়। ”

ওখান থেকে প্রস্থান করলেন সাজ্জাদ সাহেব। পিছুপিছু তাহমিদা এবং তানজিনা। রাগে ক্ষো’ভে দু হাতে সোফা খামচে ধরলেন সাজেদা। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা তার। সবটা শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। আর কত চলবে এসব? আর কত?

গোধূলি লগ্ন। রিকশা থেকে নামলো দুই ললনা। দুয়া ভাড়া পরিশোধ করতে করতে হাসিমুখে বললো,

” বিশাল আস্ত এক ড্রামাবাজ। দেখলি ওর কাণ্ড? অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে পারবে না বলে শেষমেষ হাড়কাঁপানো জ্বরের নাটক? ”

তৃষা চোখমুখ কুঁচকে বললো,

” শা লা আস্ত এক ব দ। এমন ড্রামা করলো! আমি তো ভাবলাম আজরাইল দেখা দিয়ে ফেললো কিনা! ”

রিকশাওয়ালা প্রস্থান করতেই দুয়া হাসতে হাসতে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। হাসতে হাসতে বললো,

” আমিও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই তো ভার্সিটি শেষে তোকে নিয়ে ওর বাড়ি ছুটলাম। আর গিয়ে দেখি কি? ”

” মিচকা শ*তান একটা! ওর ভালো হবে না বলে রাখলাম। ফাইনালে ফেল করে পরেরবার ইমপ্রুভমেন্ট দেবে। ”

” হোয়াট অ্যা অভিশাপ! ”

দুয়াকে হাসতে দেখে তৃষা নিজেও হেসে উঠলো। বললো,

” যাই বলিস না কেন। এসবের ভিড়ে ভালোমন্দ নাস্তা তো খাওয়া হলো। ছানা মিষ্টিটা কিন্তু অসাম ছিল! এখনো মুখে স্বাদ লেগে আছে। ”

” একদম। আচ্ছা ঠিক আছে। এখন তাহলে যাই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আম্মু চিন্তা করবে। আল্লাহ্ হাফিজ। আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আল্লাহ্ হাফিজ। ”

বিদায় নিলো দু’জনে। দুয়া প্রবেশ করলো তাদের অ্যাপার্টমেন্টে। আর তৃষা হাঁটতে লাগলো নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যা কিনা মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত।

বাড়ি ফিরে খুশিতে বাকবাকুম জাহিরাহ্ দুয়া! ফুপু এসেছে। এখন আবার খালামণিও চলে এসেছে। সাথে নানুমনি ফ্রি। দুর্দান্ত! অসাধারণ! দুয়া কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে ছুটে এলো লিভিং রুমে। নানুমনির পাশে বসে তাকে শক্ত করে আলিঙ্গন করলো। ডান কপোলে চুমু এঁকে বললো,

” নানুমনি! আমার কিউটি! কবে এলে তুমি? ”

আনোয়ারা বেগম মুচকি হেসে নাতনিকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বললেন,

” এই তো নানুভাই আজ সকালে এসেছি। ”

দুয়া গাল ফুলালো। অভিমানী স্বরে বললো,

” একে তো সে-ই সকালবেলা এসেছো। আবার আমাদের বাসায় না এসে বড় মেয়ের বাসায় উঠেছো। এমনটা করতে পারলে তুমি? হুঁ? একটুও খারাপ লাগলো না? ”

আনোয়ারা বেগম মুচকি হেসে নাতনির গাল টিপে দিলেন।

” আমার কিউটি! গাল ফুলাতে হবে না। আমি আসতে একটু দেরি করেছি তাতে কি হয়েছে? কয়েকদিন তো তোমাদের কাছেই থাকবো। ”

” সত্যি? ” খুশিতে আত্মহারা হয়ে প্রশ্ন করলো দুয়া।

” হুম। সত্যি। ”

ওদের হাসিখুশি মুহূর্ত সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন সাজেদা। রাগে গজগজ করতে করতে পা বাড়ালেন ভাইয়ের কক্ষের দিকে।
.

কক্ষে সাজ্জাদ সাহেব এবং তাহমিদা কিছু বিষয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। বিনা অনুমতিতে সেখানে প্রবেশ করলেন সাজেদা। যা দেখে দু’জনেই কিছুটা বিব্রত বোধ করলো।

” তুই? কিছু বলবি? ”

ভাইয়ের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে ভাবিকে উদ্দেশ্য করে সাজেদা বললেন,

” ভাবি তোমার কোনো আপত্তি না থাকলে আমি ভাইয়ার সাথে একাকী কথা বলতে চাই।‌ অবশ্য তুমি থাকলেও অসুবিধা নেই। ”

ভাবিকে সম্পূর্ণ রূপে অবজ্ঞা করে সাজেদা ভাইকে বলে উঠলেন,

” ভাইয়া! এসব কি শুনছি? তোমার শাশুড়িও এখানে থাকবে? ওনার কি কমনসেন্স বলে কিছু নেই? বাসায় অলরেডি মেহমান আছে। আমি আছি, আমার মেয়ে আছে। আমাদের মিনিমাম স্পেস দরকার। এরমধ্যে উনি ড্যাং ড্যাং করতে করতে চলে এলেন? কেন? ধনী মেয়ের বাড়িতে জায়গা হয়নি? তাড়িয়ে দিয়েছে? ”

” সাজেদা! ”

ধমকে উঠলেন সাজ্জাদ সাহেব। তাহমিদা মলিন মুখে তাকিয়ে।

” মুখ সামলে কথা বল। উনি আমাদের মায়ের বয়সী। তোর ভাবির মা হয়। ভুলে গেছিস? ”

” না ভুলিনি। তবে উনি বোধহয় ভুলে গেছেন এটা ওনার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। যখন তখন আসাযাওয়া উচিত নয়।”

” উনি তানজি, দুয়া ওদের নানুমনি। যখন খুশি তখন আসতে পারেন। আমরা বাঁধা দেয়ার কে? আর তুই বোধহয় শুনিসনি উনি আমাদের বাসায় এখুনি আসছেন না। কিছুদিন পর আসবেন। আপাতত বড় আপার বাসায় থাকবেন। ”

” হাঁ তাই তো করবেন। বড়লোক মেয়ের বাসা ছেড়ে ফকিরের বাসায় আসবেন কেন? ”

এতসব বাজে কথা শুনে ছলছল করছে তাহমিদা’র নয়ন জোড়া। সাজ্জাদ সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

” বাসায় মেহমান। ফালতু কথা বাদ দিয়ে নিজের রুমে যা। এক বিষয়ের ক্ষো ভ অন্য বিষয়ে প্রকাশ করা ঠিক হচ্ছে না। রুমে যা। ”
.

বাবা-মায়ের রুম থেকে তর্কবিতর্কের শব্দ আসছে। কি হচ্ছে এসব? কৌতূহল বোধ করে উঠে দাঁড়ালো দুয়া। নানুমনিকে সোফায় বসিয়ে রেখে রুমের দিকে পা বাড়ালো। খানিক অগ্রসর হতেই লক্ষ্য করলো খালামণি পানির গ্লাস হাতে বাবা-মায়ের রুমের কাছাকাছি থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে। কিছুটা অবাক হলো দুয়া!

” খালামণি! তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো? নানুমনি তো পানি চেয়েছে। ”

হঠাৎ কারোর কণ্ঠে হকচকিয়ে গেলেন তাসলিমা! কোনমতে নিজেকে সামলিয়ে বললেন,

” এই তো যাচ্ছি। তুইও চল মা। ”

” তুমি যাও আমি আসছি। আব্বু আম্মুর রুমে কি নিয়ে যেন তর্ক হচ্ছে। আমি দেখে আসছি। তুমি যাও। ”

তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানালেন তাসলিমা।

” বড়দের কথায় নাক গলাতে নেই। তুই চল আমার সাথে। ”

দুয়া খালামণির সাথে চলেই যাচ্ছিল হঠাৎ কর্ণ কুহরে পৌঁছালো ফুপুর কণ্ঠ। তৎক্ষণাৎ দু’জনেই দাঁড়িয়ে গেল।
.

” তুমি আমাকে এত বড় কথাটা বলতে পারলে ভাইয়া? তোমার কাছে এখন বাপের বাড়ির ঊর্ধ্বে শ্বশুরবাড়ি! বাহ্ ভাইয়া বাহ্! সব পুরুষ মানুষ ই বুঝি বিয়ের পর বউয়ের নেওটা হয়ে যায়? শাড়ির আঁচল ধরে ঘুরে? ”

চোখ রাঙানি দিলেন সাজ্জাদ সাহেব।

” মুখ সামলে কথা বল সাজেদা। তুই কিন্তু এবার অতিরিক্ত করছিস। আর গলার আওয়াজ নামিয়ে কথা বল। ওনারা বাসায়। ”

” হাঁ তো? আমি কি তাদের ভয় পাই? তোমার বোন হই আমি। আর ওনারা পরের বাড়ি। তোমার বউয়ের আপনজন। তোমার একমাত্র আপনজন আমি। তাই তোমার উচিত আমাকে প্রাধান্য দেয়া। তা না করে ওই বাড়ির লোকেদের তরফদারগিরি করছো? কি করে? সত্যি করে বলো তো তারা কি তোমায় কালোজা*দু করেছে? নাহলে কি করে এতটা বদলে গেলে তুমি? তুমি তো এমন ছিলে না। আমার সহজ-সরল ভাইটা এখন দিনরাত বউয়ের কথায় উঠছে। বসছে। এসব কোন ধরনের কাপুরুষত্ব? ”

আর সহ্য করতে পারলেন না সাজ্জাদ সাহেব। অজান্তেই ওনার হাত উঠে গেল। তৎক্ষণাৎ হাত ধরে বাঁধা প্রদান করলেন তাহমিদা। অবাক কণ্ঠে বললেন,

” তুমি এসব কি করতে যাচ্ছিলে? নিজেকে শান্ত করো।”
.

কক্ষের বাইরে থাকা দু’জন স্পষ্ট শুনতে পেল এসব। দুয়া ছলছল চোখে তাকালো খালামণির পানে। তাসলিমা চোখের পানি লুকিয়ে মেকি হেসে সেথা হতে সরে গেলেন। দুয়া বুঝতে পারছে না সে কি করবে। ভেতরে যাবে নাকি এখান থেকে চলে যাবে? মেয়েটা যখন মন খারাপ করে কঠিন ভাবনায় মশগুল হঠাৎ…
#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৩

” ফুপি! ও ফুপি! তুমি এসব কি করছো? যেয়ো না প্লিজ। ফুপি! ”

দুয়া’র অনুনয় উপেক্ষা করে লাগেজ হাতে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন সাজেদা। লিভিং রুমে পরিবারের সদস্যরা সকলে উপস্থিত। তাসলিমা এবং আনোয়ারা বেগম এক কোণে মলিন বদনে দাঁড়িয়ে। সাজ্জাদ সাহেব থমথমে মুখে দু হাত পিঠের ওপর বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। দুয়া ফুপির বাম হাত আঁকড়ে ধরলো। উনি দাঁড়িয়ে পড়তেই দুয়া ভেজা কণ্ঠে বললো,

” ও ফুপি! তুমি এমন করছো কেন? আব্বুর সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছো! যেয়ো না। প্লিজ ফুপি। ”

সাজেদা মায়া মায়া চোখে ওর দিকে তাকালেন। ললাটে চুমু এঁকে বললেন,

” আমাকে যেতে হবে মা। এত অপমান সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ”

” ফুপি! ”

ছোট্ট জাহিন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মায়ের কোমড় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদার চোখে নোনাজল। সাজেদা দুয়া’র থেকে সরে গিয়ে মেয়ে তানুর দিকে তাকালেন।

” চল। ”

তানু মায়ের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে বললো,

” আমি যাবো না আম্মু। তুমি দয়া করে মামার সাথে রাগ.. ”

আর বলা হলো না। কিশোরী মেয়েটা বাঁ গালে হাত রেখে হতবিহ্বল নয়নে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। বাকি সকলে স্তব্ধ! সাজেদা এ কি করছে! সাজেদা মেয়ের দিকে র’ক্তিম চাহনিতে তাকিয়ে থেকে গটাগট কদম ফেলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। কেউ বাঁধা প্রদান করার সুযোগ অবধি পেল না। সাজ্জাদ সাহেব চোখের জল লুকিয়ে নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়ালেন। তাসলিমা এবং তাহমিদা মলিন চোখে একে অপরের দিকে তাকালো। আর জাহিরাহ্ দুয়া! সে তো হতবাক! অশ্রুসজল নয়নে তাকিয়ে রইলো দরজায়।

আঁধার রজনী। বিছানায় মুখোমুখি বসে নিজাম সাহেব এবং তাসলিমা। অবাক কণ্ঠে নিজাম সাহেব বললেন,

” তুমি এসব কি বলছো? ”

” আমি ঠিকই বলছি। সাজেদা এই সম্পর্কে রাজি নয় বোধহয়। এজন্যই আমাদের প্রতি পুষে রাখা রাগ ভাই ভাবিকে দেখালো। অশান্তি করে একাকী বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। ”

” এ তো অবিশ্বাস্য কাণ্ড! সে আমাদের এমন ভাবে! এতটাই অপছন্দ করে! ”

তাসলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

” সাজেদা আমাদের পছন্দ করে না এটা বহু আগেই বুঝতে পেরেছি। তবুও কখনো কোনো বাজে রিয়েক্ট করিনি। দেখাসাক্ষাৎ হলে সবসময় চেষ্টা করেছি মিলেমিশে থাকার। তারপরও যে সে আমাদের এতটা অপছন্দ করে ভাবতে পারিনি। ”

” আমি তো কখনো সেভাবে অনুধাবন ই করিনি যে সাজেদা আমাদের… ”

কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে তাসলিমা বললেন,

” ওসব ছাড়ো। এবার এটা বলো আমরা কি করতে পারি? সাজ্জাদ ভাই এসবের রেশ ধরে তূর্ণ দুয়ার সম্পর্কে হস্তক্ষেপ করবেন না তো? ওদের দু’জনের মধ্যে এসবের বাজে প্রভাব পড়বে কি? ”

” কিছুই বুঝতে পারছি না তাসলিমা। সে সাজ্জাদের ছোট বোন হয়। স্বাভাবিক ভাবেই… ”

” আমি ওসব বুঝি না। দুয়া আমার পুত্রবধূ হবে। লাল টুকটুকে বউ সেজে আমাদের বাড়িতে আসবে। এটাই শেষ কথা। এরমধ্যে আমি কোনোরূপ বাঁধা চাই না। বুঝতে পেরেছো আমি কি বলতে চাচ্ছি? ”

নিজাম সাহেব মুখ ঘুরিয়ে বসলেন। আনমনে বললেন,

” হুঁ। দেখা যাক কি হয়। ”

দু’জনেই চিন্তিত ভবিষ্যত নিয়ে। ওনারা টেরও পেলেন না দরজার বাহিরে দন্ডায়মান কেউ একজন ওনাদের কথোপকথন শুনে ফেলেছে। কি হতে চলেছে এবার?

আঁধার রাত্রির ন্যায় কোমল হৃদয়ের অধিকারিণী মেয়েটার মনেও আঁধার নেমেছে। স্টাডি টেবিলে ম্লান বদনে বসে রয়েছে দুয়া। বিছানায় বসে তানজিনা এবং তানু। তানজিনা আদুরে হাতে ক্রন্দনরত তানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। খানিক বাদে দুয়া চেয়ার টেনে পিছু ঘুরে বসলো। ক্ষীণ স্বরে শুধালো,

” বড়াপু! ফুপি সত্যিই চলে গেল? ফিরবে না? ”

তানজিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

” জানি না রে বোন। কি থেকে কি হলো! সবটাই জটিল। কিছু বুঝেও যেন বুঝতে পারলাম না। ”

দুয়া মন খারাপ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এসে বসলো বিছানায়। তানুর পাশে। ওর বাঁ কাঁধ ডান হাতে আঁকড়ে ধরে নিজের দিকে মুখখানি ফিরিয়ে নিলো। মেয়েটার আদুরে মুখটা কেমন র’ক্তিম আভায় ছেয়ে গেছে! কপোলে পাঁচ আঙ্গুলের স্পষ্ট ছাপ! দেখতেই কোমল হৃদয় ব্যথিত হচ্ছে। দুয়া আদুরে হাতে ওর ছোট বোনটির নোনাজল মুছে দিলো। আশ্বস্ত করতে বললো,

” কাঁদিস না তানু। ফুপি ঠিক চলে আসবে। তোকে ছাড়া, আমাদের ছাড়া সে একা একা থাকতে পারবে? পারবে না তো। ঠিক চলে আসবে। কাঁদিস না বোন। ”

” আপু! ”

মেয়েটা দুয়া’র বুকে মাথা এলিয়ে পুনরায় কাঁদতে লাগলো। তানজিনা ও দুয়া এই দৃশ্য অবলোকন করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়লো। তানজিনা কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ নজর পড়লো দরজায়। ছোট ভাইটা দাঁড়িয়ে। মুখখানা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। ভয় পাচ্ছে কি? তানজিনা হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো। কিন্তু জাহিন এলো না। দৌড়ে চলে গেল সেথা হতে। বড় করে শ্বাস ফেললো তানজিনা। এসব কি হচ্ছে? কবে হবে এসবের সমাধান?

দু’টো দিন অতিবাহিত হলো। মনে হচ্ছিল সময় বুঝি থমকে গিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা যেন স্থির এক জায়গায়। নড়তে নারাজ। প্রতিটা মিনিট, ঘন্টা অস্বস্তিতে পাড় হলো। অবশেষে স্বস্তি মিললো দু’দিন পর। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় বাড়ির ল্যান্ডলাইনে কল এলো। কল রিসিভ করলেন তাহমিদা। ওপাশ থেকে ননদের কথাবার্তা শুনে আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন উনি। ফোনালাপ শেষে খুশি খুশি সকলকে জানালেন সুসংবাদ।

” আপা ফিরে আসছে। ওনার অভিমান কেটে গিয়েছে।”

খুশিতে ভরে উঠল সকলের হৃদয়। তবে আসলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে? নাকি আসন্ন নতুন কোনো মুসিবত?

তমসায় আচ্ছাদিত রজনী। আনন্দে মুখরিত শুভ্র রঙা
‘ ছায়াবিথী ‘ নামক ডুপ্লেক্স বাড়িটির লিভিংরুম। তাহমিদা কিচেনে হাতে হাতে সহায়তা করছেন বড় বোনকে। লিভিং রুমে সোফায় পাশাপাশি বসে সাজেদা এবং আনোয়ারা বেগম। ছেলে-মেয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুনসুটিতে মত্ত। সাজেদা অনুতপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে আনোয়ারা বেগমের বাম হাতটি দু হাতের আঁজলায় ভরে নিলো। মোলায়েম স্বরে বললো,

” মাওই মা! কি বলে ক্ষমা চাইবো বুঝতে পারছি না। এমন ভুল আমি কি করে করতে পারলাম? বড়ছোট ভুলে গিয়ে যা নয় তাই বললাম! আমি সত্যিই লজ্জিত মাওই মা। কি বলে ক্ষমা চাইবো জানি না। আপনি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিন। নিজের মেয়ে মনে করে ভুলটা মাফ করে দিন মাওই মা। নাহলে আমি যে.. ”

বৃদ্ধা মুচকি হেসে ডান হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

” ক্ষমা চাইতে হবে না সাজেদা। মানুষ মাত্রই ভুল করে। আমি কিছু মনে করিনি। তোমার যদি নিতান্তই ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয় ওপর ওয়ালার কাছে করো। সে নিশ্চয়ই মহান! সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমাশীল। ”

সাজেদা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

” আপনি সত্যিই কিছু মনে করেননি তো মাওই মা? আমার যে খুব অনুশোচনা হচ্ছে। গত দু রাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। অনবরত অনুশোচনায় দ গ্ধ হচ্ছিলাম। আমায় দয়া করে ভুল বুঝবেন না। আমি কি থেকে কি বলে ফেলেছি। নিজেই বুঝতে পারছি না। ”

আনোয়ারা বেগম অতি সুন্দর কায়দায় সবটা সামলিয়ে নিলেন। মিলমিশ হয়ে গেল দু’জনের।
.

দোতলার করিডোরে দাঁড়িয়ে ফোনালাপে ব্যস্ত ছিল জাবির। হঠাৎ পেছন থেকে ‘ ভাউ ‘ শব্দ করে ভয় দেখানোর প্রয়াস চালালো কেউ একজন। তড়িৎ পিছু ঘুরে তাকালো জাবির। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো ছোট বোনের হাসিখুশি মুখখানি। তা লক্ষ্য করে গম্ভীর মুখশ্রীতে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো। জাবির বাঁ হাতে বোনকে বুকে জড়িয়ে নিলো।

” কি রে বুড়ি! ভাইকে ভয় দেখানো হচ্ছে? ”

” হুঁ। কিন্তু ভাই আমার ভূতেরও সর্দার। তাই তো কাউকে ভয় পায় না। ”

নিঃশব্দে হাসলো জাবির। বোনের গাল টিপে দিয়ে শুধালো,

” আমি ভূতের সর্দার? ”

মাথা নাড়িয়ে আপত্তি জানালো তানু। ভাইয়ের বুকে লেপ্টে আদুরে গলায় বললো,

” উঁহু। আমার ভাইয়া ওয়ার্ল্ড’স্ বেস্ট ব্রাদার। ”

” বাব্বাহ! এতবড় কমপ্লিমেন্ট? ”

” হাঁ। ”

হেসে উঠলো দুই ভাই-বোন। তানু এবার ভাইয়ের বুক থেকে মাথা তুললো। তাড়া দেখিয়ে বললো,

” ভাইয়া চলো চলো। আমার সাথে ছাদে চলো। আমরা ছোটরা সবাই ছাদে আড্ডা দিচ্ছি। ”

” হাঁ তো? তুই যা। তুই ছোট। যা। আমাকে কি দরকার? আমি তোর মতো পুঁচকে নাকি? ”

তানু গাল ফুলিয়ে বললো,

” ভাইয়া! তুমি যাবে কি না? ”

হাসলো জাবির।

” চল। ”

খুশিমনে তানু ভাইয়ের হাত ধরে ছাদের দিকে পা বাড়ালো।
.

আঁধার রজনী। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দুয়া। পড়নে তার ডিপ রেড লং টপস এবং প্লাজো। দীঘল কালো কেশ খোঁপা বন্দী হয়ে ওড়নার অন্তরালে লুকায়িত। দু কানের পাশ হতে ছোট ছোট কিছু চুল কপোলের কোমল আবরণ ছুঁয়ে রয়েছে। দৃষ্টি নিবদ্ধ চন্দ্রিমায়। স্বল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা মানব সম্মোহনী চাহনিতে তাকিয়ে রয়েছে হৃদয়ে লুকানো ললনার পানে! চন্দ্রের মোহনীয় দ্যুতিতে উজ্জ্বল মুখশ্রী। মায়ায় পূর্ণ জাদুময়ী আঁখি যুগল! অধর কোণে চিকন হাসির রেখা! ফোলা ফোলা দু কপোল। সম্মোহিত মানবের অপলক চাহনি ঘুরে বেড়াচ্ছে মায়াবী মুখখানি জুড়ে। বেড়ে চলেছে হৃদয়ের অস্থিরতা। ধুকপুক ধুকপুক কলরব ভেসে আসছে বক্ষপিঞ্জরের অন্তরালে লুকায়িত হৃদযন্ত্র হতে। একটুখানি নৈকট্য, ছুঁয়ে দেয়ার তৃষ্ণায় পীড়িত হয়ে চলেছে পৌরুষ চিত্ত। ছোট বোনের ডাকে মোহাচ্ছন্ন ভাব কেটে গেল। বিরক্ত হয়ে ‘ চ ‘ সূচক শব্দ নির্গত হলো কণ্ঠনালী হতে।

ছাদে জমে উঠলো আড্ডা। তরুণ তরুণীরা বসে ফ্লোর ম্যাটে। বহুদিন পর একসাথে এতজন জমায়েত হয়েছে। হাসিখুশিতে অতিবাহিত হতে লাগলো প্রহর। তাসলিমার একান্ত অনুরোধ রক্ষার্থে এখানে এসে মন্দ হয়নি কিন্তু। দুর্দান্ত সময় কাটছে।

” ছিঃ ছিঃ ছিঃ! শেষমেষ এই চলছিল তোমাদের মধ্যে? মা-বাবার দেয়া শিক্ষা ভুলে গিয়ে শেষমেষ যি*না ব্য*ভিচারে লিপ্ত হলে? ছিঃ! ”

হতবিহ্বল দুই মানব মানবী একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সম্মুখে তাকালো।

” তুমি এসব কি বলছো? বিশ্বাস করো আমরা কোনো অন্যায় করছিলাম না। আমরা তো…! ”

” চুপ। আর একটাও কথা নয়। এই ছিল পেটে পেটে? আর আমি ভাবছিলাম..! এটা কি করে করতে পারলে তোমরা? ”

মানবী সাফাই দেয়ার চেষ্টা করলো। তবে লাভ হলো না। না চাইতেও ঘটে গেল অভাবনীয় সে কাণ্ড!
#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৪

” বলো মা কবুল। ”

বয়স্ক কাজি সাহেবের কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই ক্রন্দনরত দুয়া দিশেহারা বোধ করতে লাগলো। মায়াবী আঁখি যুগল অশ্রুসিক্ত। লালাভ আভা ফুটে উঠেছে নাকের ডগায়। নরম-কোমল বাম হাতটি পিiষে যাচ্ছে ডান হাতের ঘর্ষণে। দুয়া ভেজা আঁখি পল্লব ঝাপটে সম্মুখে তাকালো। পরিবারের সদস্যরা দাঁড়িয়ে। থমথমে মুখশ্রী সাজ্জাদ সাহেবের। বাবার মুখখানা দেখে দুয়া আরো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। সাজ্জাদ সাহেব কিয়ৎক্ষণ নিষ্পলক চাহনিতে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের পানে। অতঃপর চোখের পলকের ইশারায় আদরের কন্যাকে অনুমতি প্রদান করলেন। কাজি পুনরায় তাগাদা দিলো,

” বলো মা কবুল! ”

নেত্রপল্লব বন্ধ হয়ে গেল মেয়েটির। কপোল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা অশ্রু কণা। মনে মনে স্রষ্টার নাম নিয়ে মেয়েটি মৃদু স্বরে বললো,

” কবুল! ”

” আবারো বলো মা‌। ”

” কবুল। কবুল। ”

” আলহামদুলিল্লাহ্! ”

আল্লাহ্’র কালাম সাক্ষী রেখে তিন কবুল বলে একে অপরের সনে চিরজীবনের তরে জড়িয়ে গেল আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ এবং জাহিরাহ্ দুয়া! সাক্ষী রইলো দুই পরিবারের সদস্যরা। সাজ্জাদ সাহেব কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে সেথা হতে প্রস্থান করলেন। তাহমিদা শাড়ির আঁচলে নোনাজল মুছে এগিয়ে এলো মেয়ের পানে।

দুয়া’র পড়নে ডিপ রেড লং টপস এবং প্লাজো পাজামা। ওড়নার অন্তরালে আবৃত দীঘল কালো কেশ। র’ক্তিমায় আচ্ছাদিত মুখশ্রী। নোনাজল লেপ্টে দু কপোলে। তাহমিদা মেয়ের পাশে বসলেন। মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে আবেগাপ্লুত মেয়েটি মায়ের বুকে মুখ লুকালো। কাঁদতে লাগলো অবিরাম। তাহমিদা স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতে লাগলেন মেয়ের মাথায়। তূর্ণ এতক্ষণ বহু সংযম করে বসে ছিল। আর সম্ভব হলো না। মোবাইল হাতে নিয়ে বড় বড় কদম ফেলে সেথা হতে প্রস্থান করলো। এত লোকের ভিড়ে একজনের চেহারায় প্রকাশ পেল স্পষ্ট ক্ষো’ভ!

ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোর ঘরে। গত রাত থেকে সকলে এ বাড়িতে অবস্থান করছে। এবার বিদায় লগ্ন। কিন্তু পূর্বের ন্যায় এবারের বিদায় লগ্ন নয়। তাহমিদা দিশেহারা বোধ করছেন। বুঝতে পারছেন না কি করে সামলাবেন মেয়েকে। সোফায় বসে আদুরে কন্যা যে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে চলেছে সেই কখন থেকে। বিবাহকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর ব্রেকফাস্ট অবধি করেনি।

” দুয়া! মা! কাঁদে না। এই তো আমি। ”

” যাবা না। আ আম্মু। যাবা না। ”

অস্পষ্ট স্বরে বলে চলেছে মেয়েটা। তাহমিদা দুঃখ ভারাক্রান্ত নয়নে তাকালেন বড় বোনের দিকে। চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে তাসলিমা এসে বসলেন দুয়া’র অপর পাশে। দুই মায়ের মধ্যিখানে দুয়া। তাসলিমা ওর কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে মুখখানি ফিরিয়ে নিলেন। দুঃখবোধ করলেন মেয়েটার অশ্রু ভেজা মুখ দেখে। আদুরে হাতে দু কপোলের অশ্রুবিন্দু মুছে নিলেন। কোমল কন্ঠে বললেন,

” কাঁদে না মা। তোকে কাঁদতে দেখে আমাদের বুঝি খারাপ লাগছে না? এত কাঁদছিস কেন? তোকে তো একদিন না একদিন আমার বাড়িতে আসতেই হতো। নাহয় কয়টা দিন আগেই চলে এলি। তাই বলে এভাবে নাকের জল চোখের জল এক করে কাঁদতে হবে? ”

” খালামণি! ”

আদুরে কণ্ঠে লাই পেয়ে মেয়েটা আরো কেঁদে উঠলো। গত রাতের সে-ই অনাকাঙ্ক্ষিত বি’শ্রী মুহুর্ত যে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ছাড়ছে না পিছু। সেসব মনে পড়তেই অক্ষিকোল বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু অশ্রু। এসময় লিভিং রুমে উপস্থিত হলো তূর্ণ মহাশয়! এত কান্নাকাটি দেখে বিগড়ে যাওয়া মেজাজ বুঝি আরো বিগড়ে গেল। ধমকে উঠলো তৎক্ষণাৎ।

” এত কান্নাকাটি কিসের? এটা কি বিয়েবাড়ি নাকি কুলখানির অনুষ্ঠান? ”

তড়িৎ চমকালো উপস্থিত সকলে! দুয়া ভীত চোখে একটিবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তাসলিমা গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,

” এসব কি ধরনের কথাবার্তা তূর্ণ? ঠিকভাবে কথা বলো। ”

” আমি ঠিকভাবেই বলছি আম্মু। বরং তোমার আদরের প্রিয় ভাগ্নি কেঁদেকেটে আমাদের দামী সোফা নষ্ট করে ফেলছে। ওকে কাঁদতে নিষেধ করো। ভাল্লাগছে না এসব। ”

” বিয়ে হয়েছে শ্বশুরবাড়িতে। বাবার বাড়ির লোকেরা চলে যাচ্ছে। মেয়েটা কাঁদবে না? ”

” কাঁদতে হলে বাপের বাড়ি গিয়ে কাঁদতে বলো। আমাদের সুখী পরিবারে কান্নাকাটি নিষেধ। ”

এতবড় চাপাবাজি শুনে দুয়া কান্না ভুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার সদ্য বিবাহিত স্বামীর পানে! এসব কি শুনছে সে!

” ভাইয়া! আমাদের বাড়িতে কান্না নিষেধ? কাব ছে? আমি তো জানতাম না। ”

তৃষা ফোঁড়ন কেটে বলতেই তূর্ণ গরম চোখে তাকালো বোনের দিকে। ত্যা ড়া জবাব দিলো,

” আজ! এই মুহূর্ত থেকে। ”

দুয়া’র নাক রাগে ফুলে ফেঁপে উঠলো। ভাইয়ের এক্সট্রা চাপাবাজি শুনে ভেংচি কাটলো তৃষা। তাসলিমা নব পুত্রবধূর চোখের পানি মুছে ললাটে চুমু এঁকে দিলেন। ছোট বোনকে আশ্বস্ত করতে বললেন,

” তাহমিদা! মন খারাপ করিস না। মেয়েকে দূরে কোথাও পাঠাসনি তো। মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বে সে। তা-ও আবার বড় বোনের কাছে। চিন্তা কিসের? শুধু শুধু চিন্তা করবি না তো। ”

তূর্ণ মাঝখানে বাঁধা দিয়ে বললো,

” শাশুড়ি মা’কে অহেতুক চিন্তার পাশাপাশি মেয়েকে অশ্রু বিসর্জন দিতেও নিষেধ করতে বলো। আমার বাড়িতে ন্যা কা নোনাজল চলবে না কিন্তু। ”

দুয়া দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। দু পাশে দুই মা যে। পরে ঠিক এসবের জবাব দেবে। হুঁ।
.

বিদায়ের পালা। বাবার বুকে লেপ্টে রয়েছে মেয়েটা। মলিন মুখশ্রী। সাজ্জাদ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু এঁকে দিলেন। অতঃপর বড় বড় কদম ফেলে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি হতে। দুয়া ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল সেদিকে। মেয়েদের জীবনে এই বিদায় মুহুর্ত এতটা বেদনাদায়ক কেন! কেন তুফানি ঝড় ওঠে হৃদমাঝে!

নিজ কক্ষে গালে হাত দিয়ে বসে তৃষা। ধ্যান মগ্ন মেয়েটা। ভেবে চলেছে কত কি! সকালের দৃশ্যটা এখনো স্পষ্ট রূপে চোখের পর্দায় ভাসছে।
___

তিন কবুল বলে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো তূর্ণ এবং দুয়া। পরিবারের সদস্যদের ভিড়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে জাবির। থমথমে মুখশ্রী। র’ক্তলাল আঁখি যুগল। বারবার শুকনো ঢোক গিলছে সে। দৃষ্টি নিবদ্ধ নবদম্পতির পানে। অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ভেতর। কি করে এই যাতনা মিটাবে সে? বুকের মধ্যিখানে যে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে! ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়ছে তনুমন। জাবির যখন যন্ত্রণায় কাতর তখনই তার পাশে এসে দাঁড়ালো এক মানবী। ফিসফিসিয়ে শুধালো,

” ভালোবাসেন? ”

হকচকিয়ে গেল জাবির! কোনোমতে নিজেকে ধাতস্থ করে বাম পাশে তাকালো। দেখলো কৌতুহলী এক মায়াবী মুখশ্রী। তৃষা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে।

” কি হলো? বলুন। আপনি কি দুয়াকে ভালোবাসেন? ”

যাতনায় ক্লিষ্ট মানুষটি এক শব্দে প্রতিবাক্য করলো,

” না। ”

” তাহলে? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? চোখমুখ কেমন লাল হয়ে গেছে। আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন? ”

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে তৃষা। অসময়ে এত প্রশ্ন! বিরক্তিতে ছেয়ে যাচ্ছে অন্তঃপুর। তাই তো জাবির গম্ভীর স্বরে বললো,

” প্লিজ লিভ মি অ্যালোন। ভালো লাগছে না আমার। ”

মনমতো উত্তর না পেয়ে তৃষা এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেল।

” আচ্ছা গত রাতে আপনি কো… ”

আর বলা হলো না মেয়েটির। ওকে থামিয়ে দিলো বিরক্তিকর এক শব্দ,

” ননসেন্স। ”

এক শব্দে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে সেথা হতে সরে গেল জাবির। তার যাওয়ার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তৃষা।
___

তৃষা গালে হাত দিয়ে ভাবনার সমাধান পেয়ে গেল।

” হুঁ। বুঝতে পারছি। উনি ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গেছেন। এতটাই ব্যাকা হয়ে গেছেন যে মাথার সার্ভার ডাউন। তাই তো আমার মতো কিউট মেয়েকে ননসেন্স বললেন। ইয়াহ। ”

নিজেকে ননসেন্স বলায় ভালো লাগলো না মেয়েটার। ভেংচি কেটে উঠে দাঁড়ালো সে। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

” ব্যাটার চোখে নির্ঘাত ছানি পড়ছে। তাই তো ভুলভাল দেখে। আলিয়া ভাটের জায়গায় দেখতে পাচ্ছে আউলা কেশী ভূত। হুহ্! ”

দুয়া’র দু পাশে দাঁড়িয়ে দুই ননদিনী। নিশি এবং তৃষা। দু’জনে দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে নতুন ভাবিকে নিয়ে ভাইয়ের রুমে এলো। তৃষা ভাব নিয়ে বাম পা দিয়ে ঠেলে বদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত করলো। চেনা রুমে প্রবেশ করতে অচেনা এক অস্বস্তি। মিইয়ে গেল দুয়া। দু হাত অনবরত কচলাতে লাগলো। দৃষ্টি অবনত। তৃষা দাঁত কেলিয়ে হাসলো।

” হি হি চিল। এখন রাত নয় দিন। আমার ভাই আবার দিনের বেলায় ভদ্রলোক। হা’মলা চালায় না। সো রিল্যাক্স বেবি। ”

কর্ণদ্বয় যেন উত্তপ্ত হয়ে উঠলো দুয়া’র। নাক ছিটকে বললো,

” ছিঃ! কিসব বলছিস! আমি কি তূর্ণ ভাইয়ার ভদ্রতা – অভদ্রতা সম্পর্কে জানতে চেয়েছি? ”

নিশি হেসে উঠলো। বললো,

” ভাবিজি আর কত ভাইয়া ডাকবেন? এবার তো অভ্যাস পরিবর্তন করুন। ”

তৃষা দু হাত দু’দিকে ছড়িয়ে মনপ্রাণ ঢেলে বাতাসের সুভাস নিলো।

” আহা! জীবনটা কি সুন্দর! ভাইয়া যখন সাইয়্যা! আহা! কি লজ্জা! ”

লজ্জার ভাব ধরে দু হাতে মুখ লুকালো তৃষা। দুয়া বি শ্রী একটা গালি দিতে গিয়েও গিলে নিলো। সশব্দে হেসে উঠলো নিশি।

” হয়েছে হয়েছে এখন চল। নইলে চাচি দেখলে ধাওয়া দেবে। ”

” হাঁ চলো চলো। ”

ব্যস্ত পায়ে দুয়া’র দু হাত ধরে কক্ষে প্রবেশ করলো দুই বোন। শিরশির করে উঠলো মেয়েটির সারা কায়া। অজানা এক অনুভূতিতে আবিষ্ট হলো তনুমন। পায়ের তলে সুড়সুড়ি অনুভূত হচ্ছে বুঝি। কেঁপে কেঁপে উঠছে কায়া। শুকনো ঢোক গিলে নিলো বার কয়েক। অজান্তেই চোখ বুলালো চেনা রুমে আরো একবার।

কক্ষের মাঝ বরাবর দেয়াল ঘেঁষে মাস্টার বেড। শুভ্র চাদর বিছানো সেথায়। বালিশের কভার এবং কুশন দুটোও শুভ্র রঙা। বেডের দুই পাশে বেড সাইড টেবিল। বেডের সম্মুখ ঘেঁষে শুভ্র রঙা টাফটেড বেঞ্চ। কক্ষের ডান পাশের দেয়ালের দু প্রান্তে বড় বড় দুইটি জানালা। পর্দা সরিয়ে মধ্যখানে ফাঁকা। সেথা হতে আলো প্রবেশ করছে কক্ষে। ডান পাশের দেয়ালের মাঝ বরাবর প্রশস্ত দু’টো সিঙ্গেল সোফা। মধ্যখানে গোলাকার কালো রঙা টি টেবিল। বেডের বিপরীত দিকে কক্ষের দরজা। দরজার ডান পাশে বড় ওয়াল স্মার্ট টিভি। বাম পাশে ওয়াশরুম। বাম দিকের দেয়াল ঘেঁষে ড্রেসিং টেবিল এবং সামান্য ব্যবধানে কাবার্ড। কক্ষের দেয়াল পুরোটাই শুভ্র রঙা। আসবাব অবধি শুভ্র রঙে রঙিন। দুয়া বিড়বিড় করে আওড়ালো,

” ব্যাটার পা থেকে মাথা অবধি সব সাদা। রুমটার দশাও তাই। ধবধবে সাদা। ”

একাকী কক্ষে টাফটেড বেঞ্চে বসে ছিল দুয়া। মলিন মুখখানি। তখনই মোবাইল স্ক্রল করতে করতে প্রবেশ করলো তূর্ণ। এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল নববধূকে দেখে! সে যে এখন বিবাহিত, চিরকুমার ক্লাব থেকে বহিষ্কৃত ভুলেই গিয়েছিল! এখন বউকে দেখেই মনে পড়লো বুঝি! বড় শ্বাস ফেলে তূর্ণ বললো,

” কি রে কান্নাকাটি শেষ? বন্যা বানানো আরো বাকি আছে কি? ”

হঠাৎ কারোর কণ্ঠে হকচকিয়ে গেল দুয়া! ভাবনা থেকে বেরিয়ে সম্মুখে তাকালো। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তূর্ণ’তে। পড়নে নীলাভ টি শার্ট এবং ট্রাউজার। টিশার্টের কলার উঁচু করে রাখা। লালচে চুলগুলো হালকা এলোমেলো। জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে। চোখে চোখ পড়তেই দুয়া দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তূর্ণ মোবাইল হাতে বসলো সিঙ্গেল সোফার একটিতে। দেহ এলিয়ে দিয়ে আয়েশ করে বসলো। বললো,

” এত কান্নাকাটি কিসের সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আবিয়াত্তা থেকে বিয়াত্তা হয়ে গেছিস বলে দুঃখ হচ্ছে? নাকি বফ আছে? ”

বফ! এতবড় কথা!

” বফ! কিসের বফ! আমার কোনো বফ নেই। ”

” তাহলে বিশাল, তিয়াশ কি লেডি? নারী? ”

হকচকিয়ে গেল দুয়া!

” তুমি কিসের মধ্যে কি বলছো? ওরা আমার বন্ধু। তুমি কিন্তু বফ অন্য অর্থে ইউজ করেছো। ”

তূর্ণ খুশি খুশি তাকালো ওর দিকে।

” আরে বাহ্! বিয়ে হতে না হতেই এত উন্নতি? বর কোন কথা কোন অর্থে বলছে শুনেই বুঝে যাচ্ছিস? ”

হতবাক মেয়েটার কর্ণ কুহরে তখন ভেসে ভেসে আসছে ‘ বর ‘…! হাঁ বর। তার তিন কবুল বলে বিয়ে করা বর! সর্বদা কাজিন জানা মানুষটি এখন ওর বর! হৃদয়ের অন্তঃস্থলে কোথাও বুঝি মৃদু তরঙ্গ বয়ে গেল!

” কি রে! বর বলতেই মধুচন্দ্রিমা অবধি চলে গেলি নাকি? তা কোথায় গেলি? মালদ্বীপ না সুইজারল্যান্ড? ”

দুয়া আজ অবাকের ওপর অবাক হচ্ছে! তূর্ণ ভাইয়ার এ কি নয়া রূপ দেখছে সে! মানুষটা সেই তখন থেকে লাগামহীন বলেই চলেছে! মানে কি?

” তুমি এসব কি বলছো? ছিঃ! কিসের মধুচন্দ্রিমা! আমি কোথাও যাইনি। ”

দুয়া’র প্রতিবাদী স্বর শুনে তূর্ণ অধর কা’মড়ে হাসলো।

” আচ্ছা! বরের কাছেই বসে আদর সোহাগে বিজি ছিলে? ”

” ছিঃ! ”

দু হাতে দুই কান চেপে ধরে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালো দুয়া। কক্ষ ত্যাগ করতে করতে বলে গেল,

” তুমি একটা বেশরম, অ*শ্লীল লোক! ছিঃ! ”

দুয়া কক্ষ হতে প্রস্থান করতেই সশব্দে হেসে উঠলো তূর্ণ। আজ বড্ড খুশি খুশি লাগছে! কারণে অকারণে মন গেয়ে উঠছে,

‘ আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে ‘

নীরবতায় আচ্ছাদিত কফিশপ। প্রায় জনশূন্য বলা চলে। মুখোমুখি বসে দু মানব। ধোঁয়া ওঠা কফির মগ টেবিলে। একে অপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দু’জনে। ভিন্ন ভিন্ন চাহনি তাদের।

” আমি আবারো জিজ্ঞেস করছি ওই ক্যাঁচালে আপনার হাত ছিল কি না? ”

” আমি আগেও বলেছি। আবারো বলছি। আমি কিছুই জানি না। ”

” আচ্ছা? কিছু না জেনেও আপনার টাইমিং বড্ড পারফেক্ট হয়ে গেল না? ”

” না। আমার দরকার ছিল। তাই গিয়েছিলাম। কোনো টাইমিং নেই এখানে। ”

কফির মগে চুমুক দিলো এক মানব। মাথা নাড়িয়ে বললো,

” প্লানড্ টাইমিং না হলেই ভালো। নইলে আমার টাইমিং কিন্তু আবার ধরাবাঁধা নয়। যেকোনো সময় যেকোনো কিছুই হয়ে যেতে পারে। সো বি কেয়ারফুল। ”

বিপরীতে থাকা মানব বক্র হাসলো। মলিন সে হাসি। কফি পান করে উঠে দাঁড়ালো প্রথম মানব। মেনু কার্ডের মধ্যে বিল পরিশোধ করে সাথে টিপস্ও দিলো। অতঃপর চোখের ইশারায় বিদায় জানিয়ে পা বাড়ালো বহির্গমন পথের দিকে। স্লাইডিং ডোর পেরিয়ে প্রস্থান করলো সে। রয়ে গেল এক দুঃখ ভারাক্রান্ত মানব।

চলবে.

[
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here