#তৃতীয়_ব্যক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ১০
মাঝখানে টেবিল রেখে দুপাশে দুটো চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসে আছে সামিয়া এবং অফিসার শীলা। অফিসার শীলা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামিয়ার দিকে। সামিয়া কে আজ ভীষণ বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে। প্রচণ্ড ক্লান্ত সে। সে যে অনেকদিনের অভুক্ত এবং অনিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিল; সেটা তার চোখে-মুখে স্পস্ট ভাবে ফুটে উঠেছে।
শীলা সামিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে একটা গ্লাস এগিয়ে দিলো। সামিয়াও হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিয়ে নিলো এবং মুহুর্তের মধ্যেই পুরো গ্লাস খালি করে ফেললো। পানি পান করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো সে। পানিটা বেশ ঠাণ্ডা ছিল। ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি বোধহয়। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেঁটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল সামিয়ার। পানিটুকু পেয়ে সে উপকৃত হলো।
ইদানিং কোন খাবার তো দূর, পানিও তেমন স্পর্শ করতো না।
পানির গ্লাস টেবিলের উপর রেখে শীলার দিকে তাকালো সামিয়া। শীলার চোখে চোখ পড়তেই শীলা মৃদু হাসলো। সামিয়া চোখ নামিয়ে নিলো। শীলা হালকা কেশে বললো,
“শুনলাম তুমি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছো। এসব করলেও কিন্তু কোন লাভ হবে না। এই-যে তুমি কথা বলছো না, কিছু খাচ্ছো না, এতে করে কী তুমি ভাবছো তোমার শাস্তি মওকুফ হবে? উহু, হবে না। মোটেও এমনটা ভেবে বসে থেকো না। বরং তুমি আমাদের সাথে কোয়াপরেট করো। আমাদের সবটা খুলে বলো। আমরা তোমার শাস্তির কম করার ব্যবস্থা করব।”
শীলার কথায় শুষ্ক ঠোঁটে মৃদু একটা হাসি দিল সামিয়া। সামিয়ার এই হাসিটা বেশ অমায়িক, মায়ায় ভরা। শীলার চোখেও সেই মায়া ধরা দিল। সে ব্যাপারটা কে এড়িয়ে যেতে বললো,
“তুমি শিক্ষিত, সুন্দরী, ভদ্র এবং অত্যন্ত রুচিশীল একজন মেয়ে। তুমি কিভাবে পরকীয়ার মত জঘন্য কাজে জড়িত হয়েছো! সত্যিই আমি ভাবতে পারি না। যাইহোক, তোমার সেই প্রেমিক পুরুষটি কোথায়? তোমাকে এভাবে বিপদে রেখে পালিয়ে গেল কী করে! এবার বুঝতে পারছো তো, এসব প্রেম ভালোবাসা আসলে কিছুই না!”
“সে এই পৃথিবীতে থাকলে তো আমাকে রক্ষা করবে!”
আচমকা এমন কথায় ভরকে গেল শীলা। ভূত দেখার মত চমকে উঠলো সে। সামিয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শীলার দিকে। শীলা ঢোক গিলে বললো,
“তারমানে, বাকি যে লাশটা ছিল সেটা ওই ছেলের লাশ?”
সামিয়া আদ্র গলায় বললো,
“হুম।”
শীলা আবারও ভরকে গেল। সে বিস্ফোরিত চোখে বললো,
“স্বামী এবং প্রেমিক দুজনকেই একসাথে খুন! ইন্টারেস্টিং তো! আচ্ছা, এতদিন তুমি বোবার অভিনয় কেনো করলে? গত কালকের অতটুকু ডোজেই দেখি কাজ হয়ে গেছে।”
সামিয়া হাহা করে হেসে উঠলো। শীলা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালো। সে মনে মনে ভাবছে,
“এতদিন আমার রহস্যতায় সকলে রোমাঞ্চিত হতো। আমাকে দেখলে ভয় পেতো। ভয়ে কাপড় পর্যন্ত নষ্ট করতো! আর এই মেয়ে কি-না হাসছে!”
শীলা নিজেকে আবারও শক্ত করে ফেললো। এতক্ষণ ধরে যে নরম গলায় কথা বলছিল, সেই গলা এবার পুরুষালি হয়ে গেল। সে দরাজ গলায় বললো,
“এই মেয়ে, আমি কি তোমার বন্ধুবি লাগি? আমার সাথে
এমন মজা করার মানে কী? আর এভাবে হাসছো কেনো?”
সামিয়া হাসি থামিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিল। শীলা বললো,
“এতদিন কথা বলনি কেন?”
সামিয়া শীলার চোখে চোখ রাখল। তাকে বেশ আত্মবিশ্বাসী লাগছে। সে স্পষ্ট ভাষায় বললো,
“এতদিন নিজেকে সময় দিয়েছি। আমার মনে হয়েছে, আমার নিজেকে কিছুটা সময় দেওয়া উচিত। সেজন্য কোন কথা বলিনি। তাছাড়া, কথা বলার মত অবস্থাতেও আমি ছিলাম না।
আমি যে ঘটনা টা ঘটিয়েছি, তার জন্য আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, আমার কী করা উচিত। নিজের হাতে দুটো খুন করেছি, এটা আমার জন্য ভয়ংকর একটা অভিজ্ঞতা। কিন্তু, আমি মোটেও এই ব্যাপারটা নিয়ে অনুতপ্ত নই। আমি যেটা করেছি, সজ্ঞানে এবং ঠাণ্ডা মাথায় করেছি।”
সামিয়ার কথা শুনে প্রচন্ড রকমভাবে উদ্বিগ্ন হলো শীলা। এর আগে কখনোই এমন স্বীকারক্তি পায়নি সে। কোন আসামি আজ অব্দি এভাবে, এতটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করেনি। সকলেই বলেছে, ভুল করেছে। কিংবা মাথা ঠিক ছিল না বলে এমনটা করেছে। কিন্তু, এই মেয়ে তো অবলীলায় সবটা স্বীকার করে নিলো।
সাহস আছে বটে! অফিসার শীলা গম্ভীর গলায় বললো,
“তুমি জানো এরজন্য তোমার শাস্তি কী হতে পারে?”
সামিয়া পূর্বের ন্যায় বললো,
“জি, জানি। আমার ফাঁসি হবে। আমার ফাঁসি হলেও কোন আফসোস নেই। আমি অপরাধ করেছি, শাস্তি পাবো। এটাই স্বাভাবিক বিষয়। এসব নিয়ে আমার কোন কষ্ট নেই।”
শীলা খানিকক্ষণ কিছু একটা ভেবে বললো,
“তুমি আমাকে যেসব বললে, সেসব কোর্টে বলতে পারবে?”
সামিয়া দরাজ গলায় বললো,
“জি, পারব।”
শীলা উঠে দাঁড়ালো। দুই-পা এগিয়ে আবারও পিছিয়ে এসে বললো,
“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তুমি পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে এই খুন দুটো করোনি। এর পেছনে নিশ্চই কোন রহস্য আছে। আমি নিশ্চিত, এমন কিছু ঘটেছে বলেই তুমি এই কাজটা করেছো। তোমার যদি কোন সমস্যা না হয়, আমি সেই ঘটনাটা জানতে চাই। আমার মনে হচ্ছে, তুমি কোনভাবে নির্দোষ। তুমি পরিস্থিতির শিকার ছিলে। এমন কিছু ঘটেছিল, যায় শেষ হিসেবে তুমি এটাই বেছে নিয়েছিলে। কী, বলবে আমায়?”
আকস্মিক ভাবে একজন দায়িত্বরত অফিসারকে এভাবে করুন সুরে কথা বলতে দেখে সমিয়াও খানিক ভরকে গেল। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“আমি একজন আসামি। শুধু আসামি না, ডাবল মার্ডার কেইসের আসামি। আমাকে কেন এসব বলছেন? কেনই বা আমার থেকে এসব জানতে চাইছেন?”
শীলা আবারও সামিয়ার মুখোমুখি বসলো। তাকে বেশ বিচলিত দেখাচ্ছিল। সে খানিক ব্যথিত হয়ে বললো,
“জানিনা কেন এসব বলছি। শুধু জানি, তোমার প্রতি আমার অদ্ভুত একটা মায়া কাজ করছে। আমি সেই মায়াকে উপেক্ষা করতে পারছি না। হয়তো বা, নিজের ছোট বোনটার কথা মনে পড়ে গিয়েছে। যাইহোক, বাদ দাও। বলবে আমায় সবটা? আমি তোমাকে আমার সর্বোচ্চ দিয়ে আগলে রাখবে। কথা দিচ্ছি, যতটা সম্ভব তোমাকে কম শাস্তি পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করব।”
সামিয়া অফিসার শীলার আকুতি শুনে মৃদু হাসলো। শীলা বললো,
“আমার হাতে আরো দুদিন সময় আছে। আমি আগামীকাল আবার আসবো। আমাকে তোমার সবটা বলবে।”
সামিয়া কিঞ্চিৎ হেসে বললো,
“আমার কোন কম শাস্তির ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই চাই, আমার ফাঁসি হোক।”
শীলা কোন কথা না বলে কামড়া থেকে বেরিয়ে গেল। সামিয়া কে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন লেডি কনস্টেবল এসে দাঁড়ালো ওর পাশে। সে তখনও বসে আছে চেয়ারে। ওর কেনজানি চেয়ার থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। সেখানটাতেই বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। গলা ছেড়ে কাদতেঁ ইচ্ছে করছে। ভেতরের সমস্ত দুঃখ কষ্টকে উগলে বাইরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার কিছুই সে করতে পারলো না। এ ক’দিনে সে নিজেকে একজন কঠোর হৃদয়ের মানুষ হিসেবে প্রস্তুত করেছে। মনের সমস্ত আবেগকে গলা টিপে হত্যা করেছে।মনকে করে তুলেছে এক কঠিন পাথর।
যে মেয়ে নিজের হাতে স্বামীকে খুন করতে পারে, সে মেয়ে অবশ্যই কঠিনের থেকেও কঠিন হৃদয়ের অধিকারী। এভাবেই নিজেকে নিজে স্বান্ত্বনা দিয়েছে সে।
সামিয়া তার মনে আসা সমস্ত আবেগ এবং কান্নাকে কোৎ করে গিলে ফেললো। ভেতরে লুকিয়ে রাখা সমস্ত অনুভূতিকে আবারও গলা টিপে মেরে ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে হেঁটে আবারও সেই অন্ধকার কামড়ায় ফেরত গেল সে।
চলবে….