তৃতীয় ব্যক্তি,পর্ব:৯

#তৃতীয়_ব্যক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ৯

টানা ৭দিন চিকিৎসা শেষে হাজতে নেওয়া হলো সামিয়া কে। এই সাতদিন ডাক্তার সব রকমের চিকিৎসা দিয়েছে ওকে। সব কিছু করেও মুখ দিয়ে কোন কথা বের করতে পারেনি তারা।
হাসপাতালেও এতদিন কোন লাশ রাখে না বলে, সেই অজ্ঞাতনামা লাশটাকে সরকারি কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছে। তার কোন পরিচয় এখনও বের হয়নি। সামিয়াও কিছু বলেনি সেব্যাপারে।

থানার কর্তব্যরত অফিসার ইনচার্জ তদন্তের ভার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের অফিসার শীলার কাছে হস্তান্তর করলেন। নারী অফিসার ছাড়া নারী কয়েদির জিজ্ঞাসাবাদ সম্ভব না। তবে, সেই অফিসাররাও সাথে থাকবেন।

সামিয়া কে হাজতে প্রেরণ করার সাথে সাথেই অফিসার শীলা তার কাজ শুরু করে দিলো। সামিয়াকে একটা কাঠের চেয়ারের উপর বসিয়ে রাখা হয়েছে। তার ঠিক মাথা বরাবর ঝুলছে ১০০ ভোল্ট এর বাল্ব। একেতো গরম, তার উপর মাথার উপরে এত পাওয়ারের আলো জ্বলছে, সামিয়ার অবস্থা একদম খারাপ হয়ে গেল। সে রীতিমত ঘামছে। কপাল, গাল বেয়ে বেয়ে ঘাম পড়ছে। পরনের শাড়িও ভিজে উঠেছে মুহুর্তের মধ্যেই।

অফিসার শীলা খাকি পোশাকে সামিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে। তার হাবভাব দেখলে একজন সাধারণ মানুষও ভয় পেয়ে যাবে। এতটাই শক্তিশালী দেখতে এই মহিলা! ভীষণ দাপুটে, এবং কথাবার্তাও কর্কশ।
সামিয়া মাথা নিচু করে বসে আছে। অফিসার শীলা সামিয়ার সামনের দিকের চেয়ারটা টেনে ওর মুখোমুখি বসলো। অফিসার মুখোমুখি বসাতেও সামিয়ার কোন ভ্রুক্ষেপ হলো না। সে স্থির হয়ে বসে আছে, একদম নির্বিকার চিত্তে।

শীলা খানিকক্ষণ সামিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর কর্কশ কন্ঠে বললো,
“দেখতে তো বেশ বোকাসোকা লাগে। চেহারাও মাশা আল্লাহ, মায়ায় ভরা। তা, এইকাজ করলা কেন? স্বামী থাকতেও আরেক পোলারে ভালো লাগলো কী দেইখা? রুচি এমন খারাপ কেন তোমার?
বলি, এই মায়াবী চেহারা দিয়েই কী আরেক পোলারা ফাঁসাইছিলা?”
সামিয়া তখনও নির্বিকার। অফিসার শীলা আবারও বললো,
“কথা না কইলেই কী তুমি বইচ্চা যাইবা? না মনু, কথা না কইয়া বাঁচন গেলে তো সব আসামি তাই করতো। এইসব ভং অনেক দেখছি। ভংচং বাদ দিয়া কও, কাহিনী কী! এইরকম একজন স্বামী পাইয়াও পরকীয়া কেন করলা, আর কেন’ই বা স্বামীরে খুন করলা? আর, তার সাথে আরেক পোলা কে ছিল? কও, কও, ভালোই ভালোই কইতাছি কইয়া ফালাও।”

দূরেই বসে আছে থানার কর্তব্যরত অফিসার। তিনি শীলার কথায় মিটিমিটি হাসছেন। তার পাশেই বসা দ্বিতীয় অফিসার। তিনি কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“স্যার, ম্যাডামের তো দেখছি সেই দাপট! উনার শুধু নামই শুনেছি এতদিন, কখনো সামনে থেকে দেখিনি। এবার বুঝলাম কেন সবাই উনারে এত ভয় পায়। আর, এত শিক্ষিত একজন অফিসার, কেমন যেন আসামিদের ভাষায় কথা বলছে!”
প্রথম অফিসার একটু নড়েচড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললেন,
“এইটুকু দেখেই এমন! চুপ করে শুধু দেখে যাও, উনার ভয়ে আসামিদের কাপড় নষ্ট করারও রেকর্ড আছে। উনি আসামি হয়েই, আসামিদের ট্যাকেল দেন। সবে তো শুরু! উনার কাছে এই মেয়েটা তো দুধভাত!”

শীলা আবারও সামিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলো। সামিয়া এখন পর্যন্ত মাথা তুলে উপরে তাকায়নি, সে মাথা নিচু করেই বসে আছে। অফিসার শীলাও বেশ ধৈর্য নিয়ে সবটা দেখছে। অফিসার শীলা বললো,
“কথা কী সহজে বাহির হইব, না আমি আমার চেহারা দেহামু? এমন ভোলাভালা সাইজ্জা কোন লাভ হইব না। আরেকটা লাশের পরিচয় কী হেইডা আগে ক। পরে খুন কেন করছস সেইডা শুনুম।”
সামিয়া কোন কথাই বলছে না। অফিসার শীলা এবার খানিক বিরক্ত হলো। সে লেডি কনস্টেবল কে ইশারায় কী যেন আনতে বলল। সাথে সাথেই কনস্টেবল একটা বালতি এনে হাজির করলো। বালতির মধ্যে মোটামুটি গরম পানি আছে। ফুটন্ত গরম পানি না, তবে হালকার থেকেও একটু বেশি গরম পানি। যেটা একজন মানুষ সহজে সহ্য করতে পারবে না, আবার শরীরে ঢাললে শরীর ঝলসেও যাবে না; এমন গরম।

অফিসার শীলা সেই বালতি সামিয়ার শরীরের উপর ঢেলে দিলো। সামিয়ার শরীরে পানি পড়তেই সে একটু নড়ে উঠলো, কিন্তু মুখে কিছুই বললো না। শীলা বুঝতে পারছে না কী করবে। এই মেয়েকে সেভাবে অত্যাচার করতে তার ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু, অত্যাচার না করেও উপায় নেই। যেভাবেই হোক তার মুখ খোলাতেই হবে। অফিসার শীলা আবারও সামিয়ার মুখোমুখি বসলো। শান্ত গলায় সে বললো,
“দেখো, আমি তোমার উপর খুব বেশি অত্যাচার করতে চাইছি না। আমি ভালোভাবে বলছি, প্লিজ কী হয়েছে বলো। কেন তুমি এভাবে দুটো মানুষকে মেরে ফেললে! তোমার পক্ষে একা এইকাজ সম্ভব না জানি। তোমার সাথে আর কে ছিল সেটা বলো। আর, তোমার সেই প্রেমিক সুমন, সে কই? সেও কী তোমার সাথে জড়িত? জড়িত হলে, সে এখন কোথাও? প্লিজ আমাকে সবটা বলো। তুমি আমাদের সাথে একটু সহজ হও। আমাদের সাহায্য করলে আমরাও কোর্টে তোমার হয়ে আর্জি করব। তোমার শাস্তি যেন কম হয়, সেটা দেখব।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে গেল শীলা। শীলা থেমে যেতেই সামিয়া মাথা উচুঁ করলো, চোখ মেলে শীলার দিকে তাকালো।
সামিয়া কে মাথা তুলতে দেখে, পেছনের দুই অফিসার এবার নড়েচড়ে উঠলো। ঘটনা কী তবে এবার খোলাসা হবে?
সেই চাঞ্চল্যকর ঘটনার অবসান এত তাড়াতাড়ি ঘটবে!
দ্বিতীয় অফিসার প্রথম অফিসারকে ফিসফিস করে বললেন,
“স্যার, মাইয়া কী এত জলদি হার মানবো? আপনার কী মনে হয়? আমারতো মনে হয় না এখনই কিছু বলবো। যেই থ্যাটার থ্যাটা এই মাইয়া!”
প্রথম অফিসারও কিঞ্চিৎ চিন্তিত। তিনি চিন্তার ভংগিতে বললেন,
“আমারও তো সেটাই মনে হচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি বলবে বলে মনে হচ্ছে না। এত তাড়াতাড়ি বললে এই কেইসের মজা আর থাকবে না। ৪দিন রিমান্ড পাইলাম, একদিনেই কাম হইলে চলবো?”

অফিসার শীলা বিরক্ত হয়ে পড়লেন। সামিয়া এখনও নিশ্চুপ। সামিয়া চোখ মেলে তাকালেও তার জোড়া ঠোঁট খুলে গেল না। অফিসার শীলা আরো কিছুক্ষণ চেষ্টা চালালো। বিভিন্ন পদ্ধতিও প্রয়োগ করলো, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। সামিয়া কে আবারও হাজতের কামড়ায় পাঠানো হলো। অফিসার শীলা বাকি দুই অফিসারের সাথে এই বিষয়েই আলোচনা করছে। দিব্যি কথা বলতে পারা একটা মানুষ, কয়েকদিনেই কিভাবে বোবা হয়ে যেতে পারে! এই প্রশ্নটাই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে তিনজনের মনে। মেয়েটা কী আসলেই কথা বলতে পারছে না, না-কি অভিনয় করছে?

আকস্মিক খুন করা, একজন সাধারন মেয়ের পক্ষে কোনভাবেই স্বাভাবিক বিষয় না। যেখানে অনেক সময়, একটা মেয়ে একটা মাছ বা মুরগি কাটতেই ভয় পায়; সেখানে দুটো মানুষ জবাই করা কী এতই সহজ! এই কারণে কী মেয়েটির বাকশক্তি হারিয়ে গেছে! অতিরিক্ত শক থেকে সে এমন হয়ে গেছে!
এমন নানারকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের মাথায়। তারা আজকের মত জিজ্ঞাসাবাদ বন্ধ করে দিলেন।

অফিসার শীলা বাকি দুই অফিসারের উদ্দ্যেশ্যে বললো,
“আমি তবে আজ উঠি। এখান সোজা বাসায় যাবো। অন্যদিকে মাইন্ড ডাইভার্ট করলে চলবে না এখন। সারারাত ধরে এই বিষয়টা নিয়েই ভাবতে হবে আমায়। কিছু একটা সমাধান বের করতেই হবে। এভাবে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। এই মেয়ের দৌড় কতদূর আমি সেটাও দেখব!”
অফিসার শীলা থানা থেকে বের হয়ে গেল। বাকি দুই অফিসারও চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ল। এই কেইসটা এত সহজ কিন্তু, এমন জটিল হলো কেন? যেখানে আসামি হাতেনাতে ধরা পড়েছে, সেখানে এত জটিলতা কেন আসছে! ব্যাপারটা কিছুতেই মাথায় আসছে না কারোরই।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here