তৃতীয় ব্যক্তি,পর্ব:৮

#তৃতীয়_ব্যক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ৮

থানার জীর্ণ শীর্ণ একটা কক্ষে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে সামিয়া। রাত প্রায় তিনটে বাজে। সন্ধায় দুটো শুকনো রুটি আর পাতলা ডাল দিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু, সেগুলো এখনও সেখানেই পরে আছে। সামিয়া এক টুকরো রুটিও মুখে তুলেনি। আর না এক ঢোক পানি পান করেছে। সে থানায় আসার পর থেকেই কারো সাথে কোন কথা বলেনি। অনেকেই অনেকভাবে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোনভাবেই সে কোন প্রকার কথা বলেনি।

সে যে কামড়ায় আছে, সেই কামড়ার বাকি কয়েদিরা অনেকভাবেই টিপ্পনীও কেটেছে; তবুও সামিয়া নিঃশ্চুপ। শেষমেষ তারা বিরক্ত হয়ে সামিয়ার থেকে দূরে সরে গেছে।
কেউ ইচ্ছে করে কথা না বললে কী তাকে জোর করে কথা বলানো যায়? সামিয়াকেও কথা বলানো সম্ভব হয়নি।

নিলয়ের বাড়িতে এখনও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। নিলয়ের মা-বাবা, বোন থেকে থেকেই বিলাপ করে কাঁদছ। সামিয়ার বাবা-মা ঢাকাতেই আছেন। এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন তারা। সামিয়ার কী হয় সেটা জেনেই গ্রামের বাড়িতে ফিরবেন তারা।

সামিয়ার ফোন জব্দ করা হয়েছে তখনই, যখন সামিয়াকে থানায় এনেছে। থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা সেই ফোন নিয়েই এতক্ষণ ঘাটাঘাটি করছিলেন। ফোনটা যদিও তার দেখার কথা না। কিন্তু, তিনি এই চাঞ্চল্যকর ঘটনাটা নিয়ে বেশ আগ্রহী। সকাল হলেই ফোনসহ যাবতীয় সমস্ত জিনিসপত্র কোর্টে জমা দেয়া হবে। সামিয়ার ফোন ঘাটাঘাটি করে, তিনি ঘটনার কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে তিনি পাশে থাকা আরেক অফিসারকে বলছেন,
“বুঝলে নবীন, আজকাল মেয়েদের ইজ্জতের কোন দাম নাই। এরা ঘরে স্বামী রেখে আবার বাইরে যায় পরকীয়া করতে! ব্যাপারটা যেটা আন্দাজ করেছিলাম মনে হচ্ছে সেটাই হবে। ফোনে তো তেমন আলামতই পেলাম। একটা ছেলের সাথে বেশ মাখামাখি দেখলাম। এই মাখামাখির কারণেই বলি হলো বেচারা স্বামী। আহারে!”

দ্বিতীয় অফিসার, প্রথম অফিসারের কথায় কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। সে কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
“এসব আর নতুন কী! মেয়েরা যেমন পরকীয়ায় লিপ্ত হচ্ছে, ছেলেরাও তেমন। কারে ভালো বলবেন! সে যাইহোক, আরেকটা লাশের কোন হদিস পেলেন? ওই লোকটা কে? আর তাকে কেনইবা মেরে ফেলা হলো!”
প্রথম অফিসার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চিন্তিত হওয়ার ভংগিতে বললেন,
“সেটা আমিও ভাবছি। মেয়েটা কঠিন জিনিস, বুঝলে। অনেক চেষ্টা করেও কোন লাভ হলো না। কোর্টে যেতে দাও, ৭দিনের রিমান্ড চাবো। তারপর দেখব কিভাবে কথা না হলে থাকে!”

দ্বিতীয় অফিসার চিন্তিত হয়ে বললেন,
“কিন্তু স্যার, মেয়ে মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পারমিশন কী আমাদের দেওয়া হবে?”
“তা দেওয়া হবে না। তবে, আমাদের সেখানে থাকার পারমিশন পাওয়া যাবে। কেইস যেহেতু আমাদের হাতে, সেহেতু আমরা এর সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকব।”
“স্যার, শীলা ম্যাডামকে কেইসটা রেফার করেন। তারপর দেখবেন কী হয়!”
“হ্যাঁ, আমিও সেটাই ভেবেছি।”

রাত ঘনিয়ে সকাল হয়ে এলো। রাতের সমস্ত অন্ধকার কেটে, ভোরের আলোর সাথে না-কি মিশে যায়? ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই রাতের অন্ধকার কেটে যায়। রাতের আঁধার সকালে মিশে গেলেও; রাতের করা পাপ সকালের আলোয় ধুয়ে মুছে যায় না। কড়ায় গন্ডায় পাপ তার হিসেব চুকিয়ে নেয়। পাপ করলে তার শাস্তি পেতে হবেই! সে যেভাবেই হোক।

সামিয়াকে দুজন লেডি কনস্টেবল টানতে টানতে কোর্টের বারান্দা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দুদিনের না খাওয়ায় ওর শরীর কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে, যে কোন সময় মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে। ওর চোখ মুখের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। শরীর কেমন কাঁপছে, মুখ কালো বর্ণ ধারণ করছে। সারা শরীরের শক্তি যেন ফুরিয়ে গেছে। কনস্টেবল দুজন নিজেদের শক্তিতে ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

সামিয়ার বাবা-মা আদালতে উপস্থিত হয়েছেন আরো অনেক আগেই। সামিয়াকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো। জজও আদালতে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি সামিয়ার দিকে খানিকক্ষণ আড় চোখে তাকিয়ে রইলেন। এমন একটা মেয়ে, কী করে দু-দুটো মার্ডার করতে পারে, সেটাই বোধহয় ভাবছেন তিনিও।
সামিয়ার বিপক্ষের উকিল উপস্থিত হলেও পক্ষের কোন উকিল উপস্থিত হলো না। সামিয়ার পক্ষে কোন উকিল নিযুক্ত করা হয়নি। কোর্টের আদেশ কী আসে সেটা দেখেই ব্যবস্থা নেবেন সামিয়ার বাবা।

একে একে সমস্ত আলামত আদালতে পেশ করা হলো। সামিয়ার মোবাইল ফোনও দেয়া হলো। স্পটে উপস্থিত থাকা পুলিশ অফিসারও নিজের বক্তব্য রাখলেন। রক্তমাখা ছুরি, কাপড়, সব দেয়া হলো।
সমস্ত কিছুই সামিয়ার বিপক্ষে চলে গেল। জজ বেশ কয়েকবার সামিয়াকে নিজের বক্তব্য রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু, সামিয়া কোন কথাই বলেনি। সামিয়ার বিপক্ষে সমস্ত কিছুই চলে গেল। খুনের আসল রহস্য উদঘাটন করার জন্য কর্তব্যরত অফিসার ৮দিনের রিমান্ডের আবেদন করলেন। জজ ৭দিনের জায়গায় ৪দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলেন। কিন্তু, সামিয়ার অবস্থা দেখে তিনি প্রথমে সামিয়ার চিকিৎসা করানোর হুকুম দিলেন। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করার আদেশ দিলেন।

এতকিছু ঘটে গেল, তবুও সামিয়ার মুখে কথা নেই। সামিয়ার বাবা-মা নীরবে কাঁদছেন। কান্না ছাড়া তাদের এখন আর কিছু করারও নেই। আদালতের সমস্ত কাজ শেষে, সামিয়াকে আবারও পুলিশ ভ্যানে উঠানো হলো। সামিয়ার মা, সামিয়ার পিছু ছুটতে ছুটতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। সেখানে লুটিয়েই তিনি কাঁদতে লাগলেন। সামিয়া তখনও নিঃশ্চুপ। শুধু ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে একফোঁটাও পানিও পড়ছে না। মরুভূমির মত শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
ওকে টানতে টানতে পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে, দরজা লাগিয়ে দেওয়া হলো।
সামিয়ার বাবা-মা পাগলের মতন বিলাপ করতে থাকলেন। একমাত্র মেয়ের জীবনে এসব কোন বাবা-মা’ই সহ্য করতে পারবে না।

হাসপাতালের ফ্রিজে সেই অজ্ঞাতনামা লাশ, অজ্ঞাতনামা হিসেবেই রয়েছে। এখনও তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তিনদিন পেরিয়ে গেলেও, কেউ তার কোন খোঁজ করতে আসেনি। এমনকি, তার পরিচয়টা পর্যন্ত জানা যায়নি। সামিয়ার চিকিৎসা শেষে রিমান্ডে নিলে পরিচয় পাওয়া যাবে বলে আশা করে আছেন পুলিশ অফিসার। ময়না তদন্তের রিপোর্টও আদালতে পেশ করা হয়েছিল। সেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, ধারালো ছুরি দিয়ে গলায় পোস দেওয়ার ফলে মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটা বডিতে ৩/৪বার করে পোস দেওয়া হয়েছিল। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার জন্য পেটের মাঝ বরাবর দু’ঘা ছুরিও চালিয়েছিল আসামি।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, খুন করার আগে তাদের চেতনানাশক কিছু খাওয়ানো হয়েছিল। কিন্তু কী খাইয়েছিল সেটা বোঝা যাচ্ছে না। ময়না দতন্তে এসেছে, ছুরির আঘাতে খুন হয়েছে। শ্বাসরোধ করেছিল বা চেতনা নাশক কিছু খাওয়ানো হয়েছিল সেটা পাওয়া যায়নি।
সামিয়ার সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় দিন গোনা ছাড়া এখন আর কিছু করারও নেই। তবে, আসামিকে রিমান্ডে নিয়েও যে কোন লাভ হবে না; সেটা ভাবছেন সকলেই। সে কী আসলেই কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে! না-কি সবই অভিনয়, সেটাই দেখার বিষয় এখন।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here