তৃতীয় ব্যক্তি,পর্ব:৪

0
529

#তৃতীয়_ব্যক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ৪

সকাল বেলা সমস্ত কাজ সেরে, নিলয়কে অফিসে পাঠিয়ে, বিছানায় শরীরটাকে একটু এলিয়ে দিলো সামিয়া। সেই রাতে ফোনটাকে অফ করে রেখেছিল সে, মাত্র ফোনের কথা মাথায় এলো। বালিশের নিচে থেকে ফোন হাতে নিয়ে ফোনের সুইচ অন করলো সে। ফোনের ডাটা অন থাকা অবস্থাতেই ফোন অফ করেছিল সামিয়া। ফোনটা অন করার সাথে সাথেই ফোন কেঁপে কেঁপে নোটিফিকেশন আসতে লাগলো।

নিলয়ের মেসেজের নোটিফিকেশন আসতেই সে চট করে সেটা ওপেন করে ফেললো। নিলয় সামিয়ার কিছু ছবি পাঠিয়েছে মেসেঞ্জারে। ছবিগুলো খুঁটে খুঁটে দেখছে সামিয়া। অন্ধকার ঘরে কেমন গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে সে। কোনটায় মাথার নিচে হাত দেওয়া, কোনটাতে আবার চোখের উপর হাত দেওয়া। আবার কান্নাভেজা চোখের ছবি। সবটাই চুরি করে তুলেছে নিলয়। নিলয় বাসায় এসে চুপিচুপি এসব ছবি তুলেছে। সামিয়া ঘুণাক্ষরেও তার কিছুই বুঝতে পারেনি।

ছবিগুলো দেখেই দুই চোখ ভিজে উঠলো সামিয়ার। এই-তো সেই নিলয়! যে নিলয় মাঝে মাঝেই হুটহাট এমন ছবি মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে সামিয়াকে চমকে দিতো।
“কই, নিলয় তো একটুও বদলে যায়নি! আমার নিলয় সেই আমার নিলয়ই আছে!”
আনমনেই সামিয়া আবারও সেই পুরনো স্মৃতিগুলো আওড়াতে লাগলো।

সেদিন বিক্রমপুর এ নিলয় সামিয়ার খালার বাড়ি থেকে যাওয়ার পর, সামিয়ার কেমন জানি কষ্ট হচ্ছিলো। না চাইতেও নিলয়কে সামিয়া মিস করছিল। সামিয়া কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, কেন তার এমনটা হচ্ছে। রাতে ঘুমোতে গিয়েও ঘুমোতে পারছিলো না সে। ফোনের ডাটা অফ করতে যাবে, এমন সময় নিলয় নামের একটা আইডি থেকে সামিয়ার কাছে মেসেজ এলো। নিলয় নামটা দেখেই সামিয়া সমস্ত শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। অদ্ভুত এক শিহরণ জেগে উঠলো তার সর্বাঙ্গে। তড়িঘড়ি করে মেসেজ ওপেন করতেই থমকে গেল সামিয়া। শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। ভয়ে তার হাত-পা রীতিমত কাঁপছে।

নিলয় সামিয়াকে বেশ কিছু ছবি পাঠিয়েছে। সবগুলো ছবি সামিয়ার অজান্তে তোলা হয়েছে। কোন ছবিতে সামিয়া হাসছে। কোন ছবিতে সামিয়ার চুল মুখের উপরে উড়ছে। আবার কোন ছবিতে সামিয়া হাতের নখ দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে আছে। এমন অসংখ্য ছবি পাঠিয়েছে নিলয়। সাথেই একটা ভিডিও। সামিয়া পুকুরের পানিতে পা চুবিয়ে বসে আছে। মাঝে মধ্যে সেই পানিতে পা দোলাচ্ছে।
ছবিগুলো দেখে সামিয়ার হুশ-জ্ঞান হারিয়ে গেল। সে কোন রিপ্লাই না দিয়ে সরাসরি মেসেঞ্জারে কল করল। সামিয়ার পাশে কেউ ছিল না বলেই সে কল করার মতো সাহসটা পেয়েছে।

নিলয় ফোন কানে নিয়ে চুপটি করে বসে আছে। সামিয়া কাঁপা গলায় হ্যালো বললো। ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসার আগেই সামিয়া আবারও বললো,
“এই ছবিগুলো আপনি কীভাবে পেলেন? আমি-তো আপনাকে কোন ছবি দেইনি, তাহলে কীভাবে পেলেন? প্লিজ ওগুলো ডিলিট করে দিন। আম্মু জানলে আমাকে খুব মারবে।”
কথাগুলো বলেই সামিয়া ফুপিয়ে উঠলো। সামিয়ার এই ফুপানো কণ্ঠের কথা নিলয়ের কাছে অপূর্ব লাগলো। তার খুব ইচ্ছে করছিল এই মুহূর্তে সামিয়ার মুখটা দেখার। এই মুহূর্তে সামিয়াকে দেখতেও নিশ্চই চমৎকার লাগছে!

নিলয় মৃদু হেসে বললো,
“বোকা মেয়ে।”
সামিয়া অবাক হয়ে বললো,
“মানে?”
নিলয় এবার হাহা করে হেসে বললো,
“এই ছবিগুলো তোমার কাছে আগে ছিল? না আমিই প্রথম দিলাম, কোনটা?”
সামিয়ার যেন হুস ফিরল এবার। সে নিজের মাথায় নিজেই একটা গাট্টা মেরে বললো,
“আসলেই তো! ওগুলো তো আমার কাছে ছিলই না। তাহলে পেলেন কীভাবে?”

নিলয় আবারও হাসলো। নিলয়ের হাসিতে সামিয়া কিছুটা বিরক্ত হলো। নিলয় বললো,
“আরে বোকা মেয়ে, ওগুলো আমি তুলেছি। বিয়ে বাড়ীতে আমি ছবি তোলার দায়িত্বে ছিলাম জানো না? তখনই তুলেছি। এমন আরো অনেক ছবি আছে আমার কাছে, সময় হলেই পাঠাবো তোমায়।”
সামিয়া মুখটা ভার করে বললো,
“ইশ! এইটা আমার মাথায় আগে আসলো না কেন? অযথা এত রাতে আপনাকে কল করলাম। আসলেই আমি একটা বোকার হদ্দ!”
নিলয় হেসে বললো,
“আগে বললে কী এই অঘটন টা ঘটতো! আমি কখনোই ভাবিনি তুমি আমাকে এভাবে কল করবে। ছবিগুলো তুলে বেশ ভালই করেছি, কী বলো?”
সামিয়া সাথে সাথেই কল কেটে দিলো। এবার সে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। লজ্জায় গালগুলো একদম লাল হয়ে গেছে।

সামিয়া এখনও নিলয়ের পাঠানো ছবিগুলো দেখছে। ছবিগুলো দেখতে দেখতেই কলিং বেলের আওয়াজ হলো। নিলয় এসেছে ভেবে সামিয়া একদৌড়ে চলে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে সে কাউকেই দেখতে পেলো না। দরজার সমানেই একটা প্যাকেট রাখা আছে। সামিয়া এদিক-ওদিক তাকানোর পর প্যাকেটটা নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। প্যাকেটটা নিয়ে সে সোজা সোফায় এসে বসলো। প্যাকেটের মধ্যে এক বক্স কাচের চুড়ি, কিছু চকলেট আর কিছু ফুল আছে। তার সাথে একটা ছোট্ট চিরকুট পেলো সামিয়া। চিরকুটটা খুলতেই সেখানে লক্ষ্য করলো লেখা আছে,
“একটু ব্যালকনিতে আসবে? প্লিজ।”

সামিয়া চিরকুটটা হাতে নিয়েই ব্যালকনিতে গেল। এদিক-ওদিক তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলো না সে। ফিরে আসার মুহূর্তেই একটা সাদা গাড়ি নজরে এলো সামিয়ার। গাড়িটা রাস্তার পাশের কৃষ্ণচূড়ার গাছের আড়ালে দাঁড় করানো আছে। সামিয়া সেই গাড়ির দিকে তাকাতেই গাড়ির দরজা খুলে গেল। গাড়ির ভেতর থেকে ফরমাল ড্রেস পরিহিত একজন যুবক বেরিয়ে এলো। সেই ছেলেটা ফোন হাতে নিতেই সমাইয়ার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। সামিয়া একদৌড়ে ঘরে গেল ফোন নেওয়ার জন্য। ফোন নিয়ে আবারও সে ব্যালকনিতে এলো। ছেলেটা তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে। সামিয়া সবটা বুঝার জন্য কল রিসিভ করলো। ফোন কানে ধরে রাস্তার দিকেই তাকিয়ে রইলো সে। সেই ছেলেটাও ফোন কানে নিলো, মিষ্টি সুরে বললো,
“আজ আমার পাখির সামনে নিজেকে ধরা দিলাম। লুকোচুরি অনেক হলো, আর কত!”

কথার কোন উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিলো সামিয়া। ব্যালকনি থেকে ঝড়ের বেজে চলে এলো নিজের ঘরে। বিছানায় বসে হাঁপাতে লাগলো সে।সামিয়া এতদিন ভেবেছিল,কোন অশিক্ষিত ছেলে এসব করছে। ওকে বিরক্ত করছে ইচ্ছে করেই। কোথাও থেকে নাম্বার পেয়ে বোধহয় মজা নিচ্ছে। কিন্তু, এখন তার সে ভাবনা ভেঙে গেছে। ছেলেটা যথেষ্ট স্মার্ট, সুদর্শন। দেখে বোঝাই যাচ্ছে ছেলেটা বিশাল বড় পরিবারের, ভালো জবও করে।
এমন একজন ছেলে ওর সাথে এসব কেন করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না সে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরঝর করে পড়ছে সামিয়ার। দ্রুত গতিতে হার্টবিট প্রবাহিত হচ্ছে। কিছুই মাথায় আসছে না ওর। কী হচ্ছে ওর সাথে সেটা সে বুঝত পারছে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here