তৃতীয় ব্যক্তি,পর্ব:৩

#তৃতীয়_ব্যক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ৩

রাত প্রায় ১টা বাজে, নিলয় এখনও বাড়ি ফিরেনি। সন্ধ্যার খানিক পরেই কল করে জানিয়ে দিয়েছে সে, আজ বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হবে। এমনও হতে পারে রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে গেছে। অফিসে খুব জরুরী মিটিং আছে, সেই সাথে অফিসে নাইট পার্টি হবে। মিটিং শেষের হ্যাং আউট যাকে বলে। নিলয় বাসায় ফিরতে পারবে না কথাটা আজকাল অবাক করে না আর সামিয়াকে। কথাটা ইদানিং এত শুনছে যে, গা সওয়া হয়ে গেছে।

ঘণ্টা খানেক আগেই সেই অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছিল। বিরক্ত লাগছিল বলে সে কল রিসিভ করেনি। উল্টো ফোন সাইলেন্ট মুডে রেখেছে। তখন থেকেই মিনিট খানেক বাদে বাদে ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠছে। সামিয়া সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করছে না। সব কিছু কেমন বিষিয়ে তুলেছে তাকে। অন্ধকার ঘরে খুব করে ঘুমনোর চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সে। হালকা চোখ বুজে রাখলেই সেই পুরোনো স্মৃতি গুলো তাড়া করছে, কষ্ট দিচ্ছে। সেই স্মৃতির b পাতায় বারবার ডুবে যাচ্ছে সামিয়া।

নিলয়ের সাথে সামিয়ার প্রথম দেখা হয়েছিল সামিয়ার খালার বাড়িতে। বিক্রমপুরের এক ছোট্ট গ্রামে থাকে সামিয়ার খালারা। সামিয়ার খালাত বোনের বিয়েতে নিলয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। নিলয় তার মায়ের সাথে সেই বিয়েতে এসেছিল। নিলয় মূলত সামিয়ার খালার বান্ধুবির ছেলে। সেই সুবাদেই বিয়েতে এসেছিল নিলয়। প্রথম প্রথম শুধু চোখা-চোখি হতো, কেউ কারো সাথে কোন কথা বলতো না। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হবার শেষ মুহূর্তে বিয়ে বাড়ির অবস্থা বেশ নাজেহাল থাকে। সকলের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কান্নাকাটি করতে করতে কণের বিদায় হয়।

সেই সময়টাতে সামিয়া ঘরের এক কোণে বিষন্ন মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। নিলয় ছিল ঠিক তার পাশেই। নিলয়ই প্রথমে সামিয়ার সামনে এলো। সামিয়াকে নিচু স্বরে বললো,
“বোনের জন্য কষ্ট হচ্ছে বুঝি?”
সামিয়া নিলয়কে মুখে চিনতো। সে রাশভারী কন্ঠে বললো,
“তাতো হবেই!”
এরপর আর কেউই কোন কথা বাড়ায়নি। বিয়ের সমস্ত কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়। একে একে সকলেই ঘুমিয়ে যায়।

পরদিন সকালে সামিয়া যথারীতি বাড়ির পেছনের বাগানের দিকে যায়। সেখানটায় একটা খুব সুন্দর শান বাঁধানো ঘাট আছে। সামিয়ার বেশ ভালো লাগে জায়গাটা। সে সেখানে গেল। কিন্তু, আকস্মিকভাবে সেখানে নিলয়কে দেখে একটু ভরকে গেল সামিয়া। নিলয়কে এর আগে কখনো এই জায়গাটায় দেখেনি সে। আর এত সকালে নিলয় এখানে থাকবে সেটা সে কোনভাবেই ভাবতে পারেনি। পেছন ফিরে হাঁটতে ধরতেই নিলয় সামিয়া বলে ডাক দিলো। নিলয়ের ডাকে থেমে গেল সামিয়া। নিলয় পুকুরের শানের উপর বসে ছিল। সামিয়া সেদিকে এগিয়ে গেল।

নিলয় মৃদু হেসে বললো,
“চলে যাচ্ছিলে যে? আমি আছি বলে?”
সামিয়া নিলয়ের কথার প্রেক্ষিতে মৃদু হাসলো, কোন কথা বললো না। নিলয় আবারও বললো,
“তুমি আমার থেকে বেশ ছোট, এজন্যই তুমি বলছি। আমি আবার খুব বেশি ফর্মালিটি করতে পারি না। তুমি চাইলে এখানে বসতে পারো।”
সামিয়া নিলয়ের সামনের দিকের শানটায় বসলো। নিলয় আবারও বললো,
“এই জায়গাটা ভীষণ সুন্দর, বাড়ি গেলে আমি এই জায়গাকে খুব করে স্মরণ করবো।”
সামিয়া মৃদু স্বরে বললো,
“আমারও বেশ লাগে। এর আগে কখনো এমন জায়গায় আসিনি আমি। খালার বাড়ি হলেও এই প্রথম এলাম। অনেক সুন্দর বাড়িগুলো, কাঠের তৈরি সব বাড়ি, কী যে সুন্দর!”
“হ্যাঁ, আসলেই অনেক সুন্দর। যদিও এই সৌন্দর্য্য আর উপভোগ করতে পারবো না।”

সামিয়া নিলয়ের দিকে হালকা চোখে তাকালো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, কিন্তু মুখে কিছুই বললো না সে। নিলয় বিষন্ন হয়ে বললো,
“আসলে আমরা আজই চলে যাবো। বিয়ে তো শেষ, আর থেকে কী হবে? তাছাড়া আমার অফিস খুলে গেছে, আর থাকতেও পারবো না।”
সামিয়া নিলয়ের কথায় বেশ অবাক হলো। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বললো,
“আপনি চাকরী করেন? আমি আরো ভেবেছি পড়াশুনা করছেন বোধহয়।”

সামিয়ার কথায় হাহা করে হেসে উঠলো নিলয়। নিলয়ের হাসি দেখে সামিয়ার বেশ অস্বস্তি হলো। এই সামান্য কথায় হাসির কী আছে! নিলয় হাসি থামিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, ঠিকই ভেবেছিলে তুমি। আমি পড়াশুনা করছি, আর তার পাশাপাশি চাকরীও করছি। বিএসসি ভর্তি হবার পরপরই একটা চাকরী পেয়ে গেলাম। এই সময়ে চাকরী মানে সোনার হরিণ,তাই আর সুযোগকে হাতছাড়া করলাম না। পড়াশুনার পাশাপাশি চাকরীও করতে শুরু করলাম। ব্যাপারটা আসলে মন্দও না, আমি বেশ ইনজয় করি।”
সামিয়া আস্তে করে বললো, “ও আচ্ছা।”

এই বলে দুজনই নিঃশ্চুপ রইলো খানিকক্ষণ। নিরবতা ভেঙে নিলয়ই কথা বলে উঠলো।
“তুমি যেন কিসে পড়?”
সামিয়া ওড়নার মাথার আঙুল প্যাচাচ্ছিল। সে অস্ফুট স্বরে বললো,
“এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি, রেজাল্টের অপেক্ষায় আছি।”
“ও, অ্যাডমিশন কোথায় নেবে?”
“রেজাল্টের উপর নির্ভর করছে।”
“তবুও কোন ইচ্ছে নেই?”
“জি আছে, দেখি কী হয়।”
“বলতে চাইছো না তো? আচ্ছা বাদ দাও। তোমরা বাড়ি যাবে কবে?”
“আমি জানিনা, আম্মু রাতে শুধু বললো আর দুই/একদিন থাকবে হয়তো।”
“তোমার সাথে তো আর দেখা হবে না।”
“দেখা হবার তো কথাও না।”
“হ্যাঁ, কিন্তু…।”
“কিন্তু কী?”
“না,কিছুনা।”

আবারও দুজন চুপ হয়ে গেল। পুকুরের পানির দিকে আনমনেই তাকিয়ে আছে সামিয়া। পানিগুলো কী সুন্দর টলমল করছে। এই পানিতে সাঁতার কাটতে বেশ লাগবে। কিন্তু, সে পানিতে নামার সাহস পায় না। পানিতে নামতে পারে না সে। পানিতে নামলেই ডুবে যাওয়ার ভয় পেয়ে বসে সমস্ত শরীরে। পানির দিক থেকে সমস্ত মনোযোগ সরিয়ে নিলো সামিয়া। নিলয়ের দিকে একবার তাকালো। নিলয়ও সামিয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। দুজনের চোখ একত্রে মিশিয়ে যেতেই চোখ নামিয়ে নিলো সামিয়া।

নিলয় আমতা আমতা করে বললো,
“একটা রিকুয়েস্ট করলে রাখবে?”
সামিয়া নিলয়ের কথায় বাঁকা চোখে তাকালো ওর দিকে। নিলয় হালকা ঢোক গিলে বললো,
“না রাখলে থাক, সমস্যা নেই।”
সামিয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,
“ফোন নাম্বার চাইবেন নিশ্চই!”
নিলয় একটু নড়েচড়ে বসে বললো,
“উহু, তোমার ফেসবুক আইডি লাগবে।” নিলয়ের কথায় সামিয়া থ হয়ে গেল। হাসি চেপে বললো,
“এ’কদিন আপনাকে আমি বোকাসোকা একটা ছেলে ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কোন মেধাবী ছেলে। যে সারাক্ষণ নিজের জগতেই বিচরণ করে। কিন্তু, আপনি তো বিশাল চৌকস মানুষ।”

সামিয়ার কথায় নিলয়ের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো। সামিয়া নিলয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নিলয়ের দিকে একটু ঝুঁকে বললো,
“হাতে ফোন আছে দেখছি, ডাটা অন করে আমার নাম সার্চ করুন।”
নিলয় সাথে সাথেই সামিয়ার নাম সার্চ করলো। সামিয়া ততক্ষণে নিলয়ের পাশে বসে পড়েছে। নিলয় বাঁকা চোখে একবার সামিয়াকে দেখলো। তারপর সামিয়ার ফেসবুক আইডির দিকে মনোযোগ দিলো। সে ফোনের স্ক্রিনের দিকে চোখ রেখেই বললো,
“আমার পাশে বসেছো, কেউ দেখে ফেললে কিন্তু কেলেঙ্কারি হবে।”
সামিয়া সাথে সাথেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। একটু দূরে দাঁড়িয়ে বললো,
“তাতে আর বয়েই গেল।”

ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে, ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো সামিয়া। প্রায় শ’খানেক কল এসেছে। এবার আর ধৈর্য রাখতে পারলো না সামিয়া। সে কল রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে একটা রাশভারী কন্ঠে ভেসে এলো। “এই-যে আমার জানপাখি, এতক্ষণে ফোন ধরলে! সেই কখন থেকে আমি তোমার মিষ্টি কন্ঠটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছি। তড়পাচ্ছি, কতর হয়ে আছি।”
কথাগুলো শুনেই মেজাজ গরম হয়ে গেল সামিয়ার। সে রাগান্বিত স্বরে বললো,
“তোর সমস্যা কী হ্যাঁ? এতরাতে কী জন্যে কল করেছিস? জানিস না আমি একজন বিবাহিত মেয়ে, আমার স্বামীকে দেবো ফোনটা?”

সামিয়ার কথায় হাহা করলে হেসে উঠলো ছেলেটা। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“তা, তোমার স্বামী কই গো? দাও তো দেখি ফোনটা তাকে, আমিও একটু তার সাথে কথা বলি।”
ছেলেটার কথায় সামিয়া কিছুটা ভয় পেলো। একা এক বাসায় আছে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে যদি কোন বিপদ ঘটে, তখন কী করবে সে! খট করে কল কেটে দিয়ে ফোনের সুইচ অফ করে দিলো সামিয়া। রাগে দুঃখে কান্না পাচ্ছে সামিয়ার, শরীর জ্বলে যাচ্ছে। এভাবে একা এক বাড়িতে কীভাবে রেখে গেল নিলয়! এই কয়েক বছরেই এত অবহেলা!

সেই নিলয় আর এই নিলয়কে একটুও মেলাতে পারেনা সামিয়া। আগের দিনগুলো ভাবলেই সমস্ত শরীরে কাটা দিয়ে উঠে। নিজের প্রতি নিজের প্রচন্ড ঘৃণা কাজ করে। এসব ভাবতে ভাবতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সামিয়া। কাদতেঁ কাদতেঁই কারো স্পর্শ অনুভব করে সে। অন্ধকার ঘরে কাউকে দেখতে পারছে না সে। হুট করেই কারো স্পর্শে ভয়ে কুঁকড়ে যায় সামিয়া। কে কে বলে চিৎকার করতেই নিলয় সামিয়াকে শক্ত করে আকড়ে ধরে। সামিয়াকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
“এই, আমি তোমার নিলয়। ভয় পেয়েছো? আরেহ, কিসের ভয়? বাসা লক করে গিয়েছিলাম, আমি ছাড়া আর কে আসবে! পাগলী একটা। বলেই তো ছিলাম, আমার আসতে দেরি হবে। এতে ভয় পাওয়ার কী আছে!”
কথাটা বলেই সামিয়ার কপালে আলতো করে চুমু দেয় নিলয়। কিন্তু সামিয়া কোনভাবেই শান্ত হতে পারে না। এক অজানা ভয়ে কুঁকড়ে থাকে তখনও।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here