তৃতীয় ব্যক্তি,পর্ব:২

#তৃতীয়_ব্যক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ২

অফিসে কিছুতেই মন বসছে না নিলয়ের। মনটা খুব ছটফট করছে। মাথার চুলগুলোও কেমন উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে। সকাল সকাল বসের কাছে ঝাড়ি খেয়েছে সে। কোন এক ফাইলের হিসেব ভুল করেছে। ল্যাপটপের ফাইলে হিসেব ঠিক থাকলেও, খাতায় উঠাতে ভুল করেছে। এই সামান্য বিষয় নিয়েই বিশাল কথা শুনিয়ে দিয়েছে বস। নিলয়ের ডেস্কের পাশেই আসিফ বসে। বেশ কিছুক্ষণ নিলয়কে পর্যবেক্ষণ করল আসিফ। তারপর চেয়ার ঘুড়িয়ে নিলয়ের দিকে ফিরে আসিফ বললো,
“আরেহ ব্যাটা, বসের ঝাড়ি খেয়ে এমন মুখ কালো করে রাখতে হবে? এমন কত শত ঝাড়ি খেলাম! নিলয় তোর মনে নেই, হেড স্যারের কাছে বকা খাওয়ার পর দুজনে কেমন খিলখিল করে হাসতাম। আমাদের হাসি দেখে স্যার আরো বেশি বকতেন। কখনো কখনো তো ঘা কয়েক লাগিয়েও দিতেন! ধুর ব্যাটা, এসব কিছুই না। বাদ দে তো।”

আসিফের কথা যেন নিলয়ের কানে পৌঁছল না। সে উল্টো আসিফকে বললো,
“আচ্ছা আসিফ, তুই কী কোন মেয়েকে পছন্দ করিস?”
হুট করেই নিলয়ের এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল আসিফ। সে তোতলাতে তোতলাতে বললো,
“হঠাৎ এই কথা কেন?”
“এমনিই মনে হলো। বল না, কাউকে পছন্দ করিস?”
আসিফ বসা থেকে উঠে নিলয়ের ঘাড়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হালকা নিচু হয়ে বললো,
“মা তোকে ঘটকালি করতে বলেছে? তোর কোন শালী টালি আছে নাকি? থাকলে আমি রাজি। পাত্রী দেখারও কোন দরকার নেই। সোজা বিয়ের পিড়িতে গিয়ে বসব।”
“কেন? পাত্রী দেখবি না কেন? আর তুই তো হিন্দু, মুসলিম মেয়েই বা বিয়ে করবি কেন?”
“ধুর ব্যাটা, হিন্দু মুসলিম কী রে? সুন্দরী একটা বউ হলেই হলো। আর, ভাবি যে জি..।”
আসিফ জি উচ্চারণ করতেই নিলয় একটু নড়ে উঠলো। নিলয়কে নড়তে দেখে,
পুরো কথাটা শেষ না করে আসিফ কথা ঘুড়িয়ে বললো,
“না মানে, ভাবি যে সুন্দরী! তার বোনরাও নিশ্চই তেমনই হবে।”

আসিফের কথায় নিলয় আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে যা ভাবছে, তা কী কোনভাবে সত্যি! কথাটা ভাবতেই বুকের মধ্যে কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। শরীর ঘামতে লাগলো রীতিমত। ততক্ষণে আসিফ নিজের ডেস্কে ফিরে গেছে, কাজেও মন দিয়েছে। নিলয় আর বেশিক্ষণ অফিসে থাকতে পারলো না। অসুস্থতার কথা বলে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল সে।

আজকেও দরজার সামনে একটা ফুলের বুকে আর কিছু ক্যাটবেরি রাখা ছিল। সামিয়া রান্না করছিল। কলিং বেল বাজার শব্দ কানে যেতেই সে দৌঁড়ে এসে দরজা খুলে দিলো। কিন্তু, দরজার ওপাশে কেউই ছিলো না। দরজার সামনে সেই ফুলের বুকে আর চকলেট গুলো ছিলো।
ফুলগুলো নিয়ে দরজা পূনরায় বন্ধ করে দিয়ে সামিয়া সোফায় গিয়ে বসলো। প্যাকেটটা খুঁটে খুঁটে দেখতে লাগলো সে। আজকে ফুল আর চকলেটের সাথে একটা চিরকুটও আছে। তড়িঘড়ি করে সামিয়া সেই চিরকুটটা পড়তে শুরু করলো,

“প্রিয় সামিয়া,
কী ভাবছো বলো তো? প্রতিদিন তোমার পছন্দের ফুল, চকলেট কে দিচ্ছে, সেটা? না কি তুমি এসব নিয়ে কিছু ভাবছোই না! আচ্ছা, তুমি কি ভাবছো এগুলো তোমার ওই হাদারাম স্বামী দিচ্ছে? খবরদার না, ভুলেও এটা ভাববে না। আমি তোমার ঐ হাদারাম স্বামী নই। আমি তো তোমার ভালোবাসা। আবার বলতে পারো তুমিই আমার ভালোবাসা। সে যা-ই হোক। আমি তো আমার ভালোবাসাকে খুব তাড়াতাড়িই আমার কাছে আনবো। রেডি থেকো, কেমন? আর শোন, আমার দেওয়া সেই কালো শাড়ি টা পরে একবার ব্যালকনিতে এসো। আমি তোমাকে নয়নভরে দেখে নেবো। কী, আসবে তো? ”

চিরকুটটা পড়া মাত্রই সামিয়ার মাথা চক্কর দিতে শুরু করলো। সে এতদিন যেটা ভেবেছে সেটা তাহলে সম্পূর্ন মিথ্যে ছিল! কিন্তু, মিথ্যে হলে ওই শাড়ি আলমারির মধ্যে কী করে এলো? সামিয়ার মাথায় কিছুই আসছে না, সবটাই কেমন গোলমেলে লাগছে।
সে চিরকুটটা হাতে নিয়েই ব্যালকনির দিকে ছুটতে লাগলো। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পাগলের মত এদিক-ওদিক দেখতে লাগলো। কিন্তু, কাউকেই সে দেখতে পেলো না।
বেশ কয়েকবার এদিক-ওদিক তাকানোর পর সে ঘরে এলো। আবারো সোফায় বসতেই তার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।
সামিয়া ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো,
“সামিয়া, তোমাকে না বললাম কালো শাড়ি টা পরে এসো। না পরেই এলে কেনো? আমি কিন্তু খুব মন খারাপ করেছি। যাইহোক, তুমি যে এসেছো এটাই কিন্তু অনেক। মন খারাপ একটু হলে, মন ভালোটা আরো দ্বিগুণ হয়েছে।”

সামিয়া কোন কথার জবাব দিচ্ছে না। সে চুপ করে কন্ঠটা চেনার চেষ্টা করছে। কিন্তু, কিছুতেই সে কন্ঠ চিনতে পারছে না। একদমই অচেনা-অজানা একটা কণ্ঠ। এর আগে কখনোই সে এই কণ্ঠ শুনেনি।
“এই সামিয়া, কিছু বলছো না কেনো? তোমার ওই কোকিল কন্ঠে কিছুতো বলো, প্লিজ। একটা গালি দাও, তাতেই হবে। প্লিজ সামিয়া।”
“কে আপনি? আমার কাছে কী চান? কেনো এভাবে আমাকে বিরক্ত করছেন? আমি একজন বিবাহিত মেয়ে, জানেন না?”
“ওরে বাপরে! এত্ত প্রশ্ন, একসাথে! একটা কথা বলতে বলেছি, আর এতগুলো বলে ফেললে!”
“বাজে কথা না বলে যেগুলো বললাম তার উত্তর দিন।”
“আচ্ছা আচ্ছা, কোনটা আগে বলবো?”
“কে আপনি?”
“জীবন।”
“মানে?”
“আমার নাম জীবন।”
“আমার কাছে কী চান?”
“ভালোবাসা।”
“বললাম না, আমি বিবাহিত।”
“তাতে কী? ভালোবাসা দেওয়া যাবে না? ভালোবাসা দিতে বিবাহিত-অবিবাহিতোর কোন শর্ত আছে না কি?”

সামিয়া আর কোন কথার উত্তর দিলো না। খট করে ফোনটা কেটে দিয়ে নাম্বার ব্লক করে দিলো। চোখ বুঁজে, সোফায় হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো সেখানেই। দিনদিন ব্যাপারটা আসলেই সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, শাড়িটা নিলয় না আনলে, সেদিন সে মিথ্যে বললো কেন? সমস্ত হিসেব গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে সামিয়ার। নিলয় কী তবে কিছু জানে?
মোবাইলের রিংটোন আবারও বাজছে, ধীরে ধীরে সেই বাজনা আরো প্রকট হচ্ছে। প্রকট হতে হতে বন্ধ হয়ে গেল। সামিয়া আড় চোখে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। বেশ কয়েকবারই কলটা এসেছিল। সামিয়া এখনও চোখদুটো বুজে আছে। মোবাইল আবারও বাজতে শুরু করলো। এবার সামিয়া কিছুটা বিরক্তি নিয়েই কলটা রিসিভ করলো।

চোখ বুজেই কলটা রিসিভ করার ফলে সে কোন নাম্বার দেখতে পেলো না। ফোন কানে নিয়েই সে বললো,
“সমস্যা কী? এতবার ফোন করার কী আছে?”
ওপাশ থেকে নিলয় বললো,
“এতবার কই? আমি তো মাত্র কল করলাম। এই, তুমি ঠিক আছো তো? কোন সমস্যা হয়েছে? কেউ ফোনে বিরক্ত করছে?”
সামিয়া নিলয়ের কণ্ঠ পেয়েই কান থেকে ফোনটা চোখের সামনে ধরলো। নিলয়ের নাম্বার। সে আবারও নিজের উপর বিরক্ত হলো। শান্ত গলায় বললো,
“আরেহ না, চোখটা লেগে এসেছিল তো তাই কী বলতে কী বলেছি। কিছু বলবে?”
“না, এমনিই কল করলাম। একটু ফ্রি আছি তো তাই ভাবলাম তোমর একটু খোঁজ নেই। এরপরেই ব্যস্ত হয়ে পড়বো। মিটিং আছে অফিসে, বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হবে। তুমি খেয়ে নিও, আচ্ছা লক্ষ্মীটা!”

আস্তে করে “আচ্ছা” বলে কান থেকে ফোন নামালো সামিয়া।
নিলয় অফিস থেকে বেরিয়েছে আরো অধঘণ্টা আগেই।
সামিয়া ভাবলেশহীন ভাবে খানিকক্ষণ সোফাতেই বসে রইলো। ইদানিং ওর সাথে যেসব ঘটছে তার কিছুই ঠিক লাগছে না। আবার নিলয়ও ইদানিং বেশ রাত করে বাসায় ফিরছে। প্রায়ই বলছে অফিসে মিটিং। সবকিছুই কেমন গোলমেলে লাগে ওর কাছে। তার উপর এই ফুলের বুকে, চকলেট, চিরকুট, শাড়ি, ফোনকল, সবকিছুই খুব করে ভাবাচ্ছে ওকে। কিন্তু, কোন কিছুরই সমাধান বের করতে পারে না সে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here