তৃতীয় ব্যক্তি,পর্ব:৫

#তৃতীয়_ব্যক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ৫

সন্ধ্যার আকাশ দেখতে চমৎকার লাগে, কেমন রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। থেকে থেকে আবার কিছু ধূসর মেঘও দেখা যায়। আবার কিছুটা কালছে। সমস্তটা মিলিয়েই এক চমৎকার অনুভূতি তৈরি হয় সেই আকাশ কে ঘিরে। আকাশের আলো নিভিয়ে যেতে যেতেই পৃথিবীর পরিবেশটাও কেমন শীতল হয়ে যায়। সারাদিনের তাপদাহ গরম কেটে কেমন একটা শীতল হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। পাখিরাও কিচিরমিচির করতে করতে ছুটে চলে আপন ঠিকানায়। কর্মব্যস্ত মানুষেরাও নিজেদের কর্মস্থল ছেড়ে আপন ঠিকানার যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে রাজপথে। সবটা মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য ফুটে উঠে।

সামিয়া একটা কফি হাউজে বসে আছে। কফি হাউজটা ওদের বাড়ি থেকে বেশ কাছে। হাতের ডান দিকের রাস্তা দিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই পৌঁছনো যায় সেখানে। সে প্রায়ই সন্ধ্যা বেলায় এখানটায় আসে, একা একা খানিকক্ষণ বসে থাকে। সারাক্ষণ বাসায় একা থাকলেও, এই কফি হাউজে একা বসে কফিতে চুমুক দিতে তার বেশ লাগে। নীড়ে ফেরা কর্মব্যস্ত সকল প্রাণীকে একসাথে দেখতে পাওয়া যায়। পাখিদের কলকাকলি শুনতে পাওয়া যায়। রাস্তায় বিভিন্ন দৃশ্য উপভোগ করা যায়। আকাশের উপূর্ব দৃশ্য একান্তে উপভোগ করা যায়। এসব কিছুই ওর কাছে বেশ লাগে।

আজ অবশ্য সে একা থাকবে না। সামিয়া মূলত আজ সেই লোকটার সাথে দেখা করবে বলেই এসেছে। লোকটা এভাবে কেনো তার পিছু নিয়েছে সেটা জানতেই আজ এসেছে সে।
অনেক্ষণ যাবত সে বসে আছে তবুও লোকটির দেখা মিলছে না।
বসেবসে সে দু’কাপ কফি শেষ করেছে, তবুও লোকটির দেখা নেই। এবার খানিক বিরক্তি অনুভূত হচ্ছে সামিয়ার। একজন মানুষের জীবনের আসল হচ্ছে তার জবান। তার মুখের কথা যদি ঠিক না থাকে, তবে তার কোন কিছুরই ঠিক থাকবে না। যে মানুষ কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে না, সে কোনভাবেই একজন ভালো মানুষ হতে পারে না। এটা সামিয়ার বিশ্বাস। কাজের জন্য বা বিভিন্ন কারণে মানুষের দেরি হতেই পারে; কিন্তু, কাউকে অপেক্ষায় রেখে নিজের কার্য সম্পাদন করাও তো অনুচিত। সময় মতো আসতে না পারলে, এটলিস্ট সেই খবরটা তো জানানো যায়। ফোন করে বলা তো যায়, আমার আসতে একটু দেরি হবে।

এমনটা কেন করে যে জানে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সামিয়া। কফি হাউজের সামনের ফাঁকা জায়গায় বসে ছিল সে। চেয়ার থেকে সরে আসতেই দূরে একটা সাদা গাড়ি দেখতে পেলো সামিয়া। এই গাড়িটা সেদিন সে বাসার সামনে দেখেছিল। তারমানে ওই লোকটি এসেছে। সামিয়া সেখানটাতে দাঁড়িয়ে রইলো আরো কিছুক্ষণ। হ্যাঁ, সে যা ভেবেছিল তাই ঠিক। ওই লোকটি এসেছে। লোকটিকে দেখে সামিয়ার বেশ বিরক্তি বোধ হলো। চোখ-মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলো সামিয়া। লোকটি সামিয়ার সামনে এসে একগাল হেসে বললো,
“আমি দুঃখিত, আমি আসলেই দুঃখিত। আমার একটা জরুরী কাজ পড়ায় আমি সময় মতো আসতে পারিনি। প্লিজ কিছু মনে করো না।”

সামিয়া এই কথার কোন প্রতিত্তর করলো না, ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটি একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
“এই, তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বসো, বসে কথা বলি।”
সামিয়া দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় বললো,
“আমি এখন চলে যাবো, অনেকটা সময় বাইরে ছিলাম।”
“ইশ, আসলে আমারই দোষ। আমিই তো আসতে দেরি করে ফেললাম। প্রথম দিনেই আমি কেমন তোমার কাছে অপদার্থ হয়ে গেলাম!”

সামিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। সামিয়া আড় চোখে লক্ষ্য করলো, লোকটি বেশ ঘেমে গেছে। কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। শার্টও কিছু কিছু জায়গায় ভিজে গেছে।
“এখানটায় বেশ গরম তাইনা।” কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ছেলেটি বললো।
সামিয়া মৃদু স্বরে বললো,
“আপনি চাইলে ভেতরে গিয়ে বসতে পারেন।”
“না, থাক। এখানেই ঠিক আছি, সমস্যা নেই।”
মিনিট পাঁচেকের নীরবতা ভেঙে সামিয়া বললো,
“আমাকে কেনো ডেকেছিলেন?”
“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনবে?”
সামিয়া আবারও চেয়ার টেনে বসে পরলো। লোকটি মৃদু হেসে বললো,
“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। যদিও রোজই তোমাকে সুন্দর লাগে, তবে আজ যেন একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। সামনে থেকে দেখছি বলে হয়তো!”

লোকটির কথায় সামিয়া খুব একটা খুশি হতে পারলো না। অন্যের মুখে এমন প্রশংসা, তাও আবার সামনাসামনি কেমন যেন লাগছে। বিশেষ করে লোকটির হাসি দেখে সামিয়ার শরীরে কেমন যেন করছে। অদ্ভুত রকমের ফিল হচ্ছে। শরীর জ্বলছে হালকা, আবার কিছুটা বিরক্ত আবার কিছুটা ভয়, কিছুটা সংশয়। সামিয়া হালকা ঢোক গিলে বললো,
“এবার বলুন কেনো ডেকেছেন। আমি এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। নিলয় আসবে।”

সামিয়ার কথা শুনে লোকটি হাহা করে হেসে উঠলো। সেই হাসি যেন সামিয়ার শরীরে আরো আগুন জ্বালিয়ে দিলো। সামিয়া কিছুটা উগ্র মেজাজের। একটুতেই মেজাজ গরম হয়ে যায় ওর। সে রাগান্বিত স্বরে বললো,
“আমি এখানে ফাইজলামি করতে আসিনি। আপনার কাছে ফাইজলামি মনে হলে আমি উঠছি।”
সামিয়ার কথায় লোকটি হাসি থামিয়ে উল্টো মুখটা কাচুমাচু করে বললো,
“দুঃখিত। প্রথমেই মনে হয় আমাদের পরিচিত হওয়া উচিত। কী বলো?”

সামিয়া কথার কোন উত্তর দিলো না। সামিয়া কে নিঃশ্চুপ দেখে লোকটি বললো,
“আমি সুমন।সামিয়া-সুমন সুন্দর না?”
কথাটা বলে আবারও হাহা করে হেসে উঠলো সুমন। সুমনের হাসি দেখে সামনের দিকে ক্যাটক্যাট করে তাকালো সামিয়া। সুমন হাসি থামিয়ে বললো,
“জোক্স অ্যা পার্ট। আমি সুমন, ঢাকার বাসিন্দা। উত্তরায় থাকি, একটা কোম্পানিতে জব করি। ওই-যে গাড়িটা দেখছো, ওইটা অফিস থেকে দিয়েছে। অফিসের গাড়ি দিয়ে ফুটানি করি।” বলেই আবারও হেসে উঠলো সুমন।
সামিয়া এবার কিছুটা উচুঁ স্বরে বললো,
“বুঝলাম। তো, আমার পেছনে কেনো পড়েছেন? এই দেশে অবিবাহিত মেয়েদের অভাব পড়েছে না-কি?”

সুমন আদ্র গলায় বললো,
“মেয়ে তো অনেক আছে, আমার যে তোমাকেই চাই।”
সামিয়া সুমনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়েই বললো,
“কেনো চান?”
সুমনও সামিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“জানিনা। তবে চাই, যেভাবেই হোক তোমাকেই আমার লাগবে।”
সুমনের কথায় এবার বিরক্তির বদলে হাসি পেলো সামিয়ার। সে হেসে বললো,
“আপনি চাইলেন আর আমি গেলাম? আমার স্বামী আছে, সংসার আছে, দু’দিন পর আমার সন্তান হবে। কী করে ভাবলেন আমি আপনার কাছে চলে যাবো?”
সুমন দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার ভালোবাসার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে, আর বাকিটা আমার নসিব।”

সুমনের কথায় সামিয়া কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। কী একটা ভেবে এক’পা এগিয়ে দিলো বাইরের দিকে। সুমন বসা থেকেই বললো,
“সামিয়া, সত্যিই তুমি একদিন আমার হবে। আমি জানি তুমি নিলয়কে ভালোবাসো। তবে এ ভালোবাসা বেশিদিন থাকবে না। আমি চাইও না বেশিদিন থাকুক। নিলয় তোমার যোগ্য না সামিয়া।”
সামিয়া সেখানটায় আর এক মুহুর্ত দেরি করলো না। সে রাস্তায় নেমে এলো। আনমনে হাঁটছে আর সুমনের বলা কথাগুলো ভাবছে। সুমন কেন এভাবে ওর পিছু নিয়েছে সেসব ভাবছে। নিলয়কে সে জীবন দিয়ে ভালোবাসে। সেই ভালোবাসা কী করে শেষ হয়ে যাবে! অদ্ভুত!
সমস্তটাই তার কাছে এলোমেলো লাগে। কিছুই মাথায় খেলে না।

সুমন তখনও কফি হাউজে বসা। সেখানে বসে থেকেই সে কাকে যেনো কল করলো। ওপাশ থেকে কোন কথা শোনা যাচ্ছে না। শুধু সুমনের কথা শোনা যাচ্ছে। সুমন বললো,
“কাজ মনে হচ্ছে হয়ে যাবে। খুব বেশিদিন আর অপেক্ষা করতে হবে না। পাখি খাঁচায় এসে বন্দী হবে নিজ থেকেই।”
কথাটা বলেই সে হাহা করে হেসে উঠলো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here