তোকে দিয়েছি মন পর্ব ৪৫+৪৬

তোকে_দিয়েছি_মন❤
৪৫.৪৬
পর্ব – ৪৫
Writer: Sidratul muntaz

🍂
সদর দরজাটা সম্পুর্ন খোলা। বাড়ির সবাই এখন দুই লাইনে ভাগ হয়ে আছে। আমার ঠিক সামনের সারিতে ডায়না রাকেশী বাবর্চি আঙ্কেল মালী আঙ্কেল এবং বাদবাকি সবাই হাতে অনেক কিছু ভার নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। যেমন ফুল মিষ্টি ছুরি কাচি কেক ইত্যাদি জিনিস। আমি তাদের বিপরীত সারিতে মা আর বুড়ির মাঝ বরাবর দাড়িয়ে আছি। আমাদের সাথে আরো আছে অয়ন্তি আপু আয়মান ভাইয়া আর সাফিন ভাইয়া। এরা তিনজন বেশ হৈ চৈ করছে। আর ওদের প্ল্যান শুনে আমার তো হাসিতে গড়াগড়ি করতে ইচ্ছে করছে। প্রায় তিন চারটার মতো পার্টি স্প্রে লুকিয়ে রেখেছে ওরা। সাথে জরি আর লিকুইড কালার। মনে হচ্ছে গাড়িটা গেইট দিয়ে ঢুকতেই শুরু হবে ছুড়াছুড়ি। আমার এবার ভয় হচ্ছে। শেষ মেষ শ্বশুর শাশুড়ীর মুখ দেখার সৌভাগ্য হবে তো? নাকি তার আগেই এরা ভুত বানিয়ে দেবে? অবশ্য ঈশানের ল্যাপটপে আমি দুজনকেই দেখেছিলাম। ছবিতে তো বেশ ভালোই লেগেছে। এখন বাস্তবে কেমন সেটাই দেখা যাক। হঠাৎ বুড়ি আমার গোলপী শাড়ীর আচল ধরে টান দিলেন। আমি ভ্রু কুচকে পেছনে তাকালাম–

কি হয়েছে?

এইহানে এই রইদের মইদ্দে আর কতখান খাড়ায় থাকমু? তোর শউর শাউরি আয়েনা কেরে?

বুড়ির শ্বশুর উচ্চারণ টা শুনে হতাশ হলাম আমি। এই বুড়ি যে কবে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা শিখবে? মা বুড়িকে উদ্দেশ্য করে বললেন–

আপনার ভালো না লাগলে আপনি চলে যান না মা! ভেতরে গিয়ে বসে থাকুন।

ভিতরে এলকা গিয়া আমি কি করুম? এতো বড় বাইত কোন তে কই যাওন লাগবো হেইত্তো দিশা পাইনা। ( মুখ কুচকে)

মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন– তারু কাউকে একটু বল না তোর দাদীকে নিয়ে যেতে। এখানে থাকলে জালিয়ে মারবে।

আমি বাবর্চি আঙ্কেলকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে গিয়ে দেখলাম উনি প্লেট দিয়ে মুখ ঢেকে আছেন আগে থেকেই। ব্যপারটা রাকেশী খেয়াল করে হালকা হাসল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল– ম্যাম আমি নিয়ে যাই।

আমি কোমরে এক হাত রেখে বললাম– নিয়ে যাও না প্লিজ। উনাকে রুম পর্যন্ত পৌছে দিয়ে আসলেই হবে।

ওকে ম্যাম।

বুড়িকে নিয়ে রাকেশী ঘরে ঢুকে গেল। তার কয়েক মিনিট পরই শোনা গেল গাড়ির পিপিপ শব্দ। মনের মধ্যে যেন তুফান শুরু হয়ে যাচ্ছে। কেমন এক অজানা ভয় কাজ করছে। একটা অন্যরকম উত্তেজনা। হাত পা কাপছে সেইসাথে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। গাড়িটা ঠিক গেইটের সামনে এসে স্থির হলো। ভেতরে ঢোকার কোনো সুযোগ নেই কারণ লাল ফিতা দিয়ে গেইট বাধাই করে রাখা হয়েছে। সবাই তো রীতিমতো শোরগোল বাধিয়ে দিয়েছে। উল্লাসের সাথে চিৎকার করছে সবাই। আর আমি শুধু অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন গাড়ি থেকে কেউ নামবে। প্রথমেই বামসাইডের দরজা খুলে ভাইয়া নামলো। ভাইয়াকে দেখে সাফিন ভাইয়া বলে উঠল–

ওই তুই ক্যান? সাইড ক্যারেক্টার সামনে থেকে সর।

তারিফ ভাইয়া দাত কেলানো হাসি দিয়ে ফিতা ডিঙিয়ে ভেতরে এসে পড়লেন। আয়মান ভাইয়া ফোন বের করলেন ছবি তোলার উদ্দেশ্যে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে একজন বিশাল হাইটের সুন্দরী মহিলা গাড়ির দরজার খুলে বের হলেন। সবার আগে আমার চোখ গেল উনার জুতার দিকে। পাহাড় সাইজের হিল পড়ে আছেন উনি। দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি উল্টে পড়ে যাবেন। পেস্ট কালার শাড়ির সাথে স্লিভলেস ব্লাউজ আর কার্ল করা ব্রাউনিশ চুল। চুলগুলো ঘাড়ের এক পাশে আনতে আনতে মুখে মুচকি হাসির ঝলক নামালেন উনি। তাইনা দেখে আয়মান ভাইয়া বলে উঠলেন —

হায় আন্টি!! আপনাকে পুরো ঐশ্বরিয়া লাগছে।

সাফিন ভাই বললেন— এই লুক দেখে সিঙ্গাপুরের না জানি কত নিরীহ মানুষ হার্ট অ্যাটাক করেছে। আমার তো এবার আফসোস হচ্ছে আন্টি!

শাশুড়ী মানে মা মৃদু হেসে বললেন–

আফসোস তো আমারও হয়। সবার এতো এতো প্রশংসা পাওয়ার পরও যখন তোমাদের আঙ্কেলের কাছ থেকে ওই একটা ওয়ার্ড শুনি। সেটা হল পারফেক্ট।

আয়মান ভাইয়া বললেন– আঙ্কেল তো ঠিকই বলে আন্টি৷ আপনি তো আসলেই পারফেক্ট।

তারপরই পেছন থেকে আসলেন আমার শ্বশুর মশাই মানে বাবা। পরনে কালো ব্লেজারের নিচে সাদা শার্ট। উনি অবশ্য আমার শাশুড়ীর থেকেও দিগুন লম্বা। দেখে মনে হচ্ছে যুবক বয়সে সেইরকম সুদর্শন ছিলেন। তবে ফিগার ফিটনেস দুজনের এখনো খুব হাই। মনে হচ্ছে হেব্বি কন্ট্রোলে থাকেন। অয়ন্তি আপু শ্বশুরমশাই কে উদ্দেশ্য করে বললেন–

এইতো এসে গেছেন আমাদের পারফেক্ট হিরো সালমান খান!!

আয়মান ভাইয়া অয়ন্তী আপুর মাথায় চাটি মেরে বললেন– ওই সালমান খান কিরে? অভিশেখ বচ্চন বল!

বাবা সবাইকে একবার দেখে নিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললেন—

আচ্ছা আগে ফিতাটা কেটে নিলে হয়না?

মা ভ্রু কুচকে বললেন– আরে একটু ওয়েট করো। ছবি টবি তুলতে দাও ওদের।

সাফিন ভাই বললেন– হ্যা আন্টি আপনারা প্লিজ একটু একসাথে দাড়ান।

আয়মান ভাইয়া বললেন— আঙ্কেল আপনি আন্টির কাধে হাত রাখুন।

উনাদের এই ছবি তোলার অত্যাচারে আমার শ্বশুরমশাই মহা বিরক্ত সেটা বোঝা যাচ্ছে। তবে শাশুড়ী মা বেশ উৎসাহ নিয়ে নানান পোজে ছবি তুলে যাচ্ছেন। আবার বাবাকেও পোজ নেওয়া শেখাচ্ছেন। ঈশান এখনো গাড়ি থেকে নামেনি। হয়তো একদম গ্যারাজে গাড়ি পার্ক করে তারপর নামবেন। কিছুসময় পর উদ্ভোধনী অনুষ্ঠান শেষ হলো। ফিতা কেটে ভেতরে ঢুকলেন তারা। কিন্তু কেউই আমার কথা জিজ্ঞেস করছে না কেনো? আমার নিজের মা আমাকে খোচা মেরে বললেন উনাদের সালাম করতে। কিন্তু আমার কেমন যেন আনইজি লাগছে। এই আনইজি ফিলটা বেশিক্ষন থাকল না। হঠাৎ শাশুড়ী মা আমার দিকে তাকালেন। আর আমি নর্ভাস হয়ে গেলাম। উনি মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। মাকে আমার পাশে দেখে সালাম দিলেন। মা সালামের উত্তর নিতেই উনি মাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন—

কেমন আছেন আপা?

মা হাসিমুখে উত্তর দিলেন– আলহামদুলিল্লাহ আপা। ভালো। আপনি?

খুব ভালো। ( ভাইয়ার দিকে ইশারা করে) আপনার ছেলেটা কিন্তু খুব স্মার্ট। আমার তো তারিফকে বেশ পছন্দ। আপনাদের বর্ণনা এমনভাবে আমায় দিয়েছে ও…যে আমি প্রথম দেখেই চিনে গেছি আপনাকে।( আমার দিকে তাকিয়ে) আর তারিন। তোমার মুখ তো আমার আগে থেকেই চেনা। দুই বছর ধরে দেখে আসছি। একদম ব্রেইনে সেট হয়ে গেছে।

আমি উনার কথা বুঝতে পারলাম না। হালকা ভ্রু কুচকালাম। শাশুড়ী মা আমার হাত ধরে বললেন–

চলো বাকি কথা ভেতরে গিয়ে হবে।

আমিও মাথা দুলালাম। কিন্তু সেই পরিকল্পনা সফল হওয়ার আগেই শুরু হল উরাধুরা অত্যাচার। পেছন থেকে আচমকা স্প্রে আর লিকুইড রঙ ছোরাছোরি করতে লাগল ভাইয়া আর ভাইয়ার ফেন্ডরা। ঈশানকে তো রীতিমতে কলার ধরে নামিয়ে নিয়েছে গাড়ি থেকে। অয়ন্তি আপু মুঠোভর্তি কেকের ক্রিম নিয়ে ঠেসে দিচ্ছে ঈশানের গালে। এসব দেখে আমার শাশুড়ী মায়ের মনে আতঙ্ক চেপে বসল। এর আগে উনার যত্নে গড়া চুলের কোনো ক্ষতি না হয়ে যায় তাই উনি আমাকে ঢাল বানিয়ে পেছনে দাড়িয়ে গেলেন। আর সব ঝড় এসে পরল আমার গায়ের উপর। আমি তো পারলে এখনি ছুটে পালাই। কিন্তু শাশুড়ী মাকে ধাক্কা দিয়ে তো আর পালানো যায়না! তবে বাবা নিজেকে খুব লুকিয়ে বাচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ শাশুড়ীমা আমায় ইশারা করে বললেন আয়মান ভাইয়ের হাত থেকে রঙের বোতলটা এনে দিতে। আমি প্রথম ইশারায় না বুঝলেও দ্বিতীয় ইশারায় ঠিক বুঝে নিলাম। শাশুড়ী মায়ের হাতে বোতল চালান হতেই উনি আচমকা শ্বশুর মশাইয়ের সব চেষ্টায় জল ঢেলে থুরি রঙ ঢেলে দিলেন। বেচারার ব্লেজার ভিজে একাকার অবস্থা। শাশুড়ী মায়ের কি আনন্দ তখন! ডায়নার হাতে থাকা কেকের প্লেট থেকে ক্রিম নিয়ে বাবার গালে মালিশ করে দিলেন। এক হাত দিয়ে বাবার দাড়িভর্তি গাল চেপে ধরে দুষ্টমী হাসিতে মেতে উঠলেন। বাবার অতি যত্নের সেট করা চুলগুলো এক হাতে এলোমেলো করে দিয়ে খিলখিল করে হাসলেন শাশুড়ী মা। সবাই এবার মজা নিচ্ছে। আর শ্বশুরমশাই রাগে ফুসছেন। হঠাৎই উনি শাশুড়ী মায়ের হাত চেপে ধরে নিজের গালের সাথে মায়ের গাল ঘষে দিলেন। অবশিষ্ট রঙটা কেড়ে নিয়ে মায়ের রঙিন করা চুল আরো রাঙিয়ে দিয়ে এবার ভুবন কাপানো হাসিতে ফেটে পড়লেন বাবা। এই সিন দেখে সবাই হু হা করে চেচিয়ে উঠল। হাসির রোল পড়ে গেল চারদিকে। হাত তালি দিয়ে সেলিব্রেট করছে সবাই। আর আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এই বয়সে এসেও তাদের এতো খুনশুটি আর রোমান্টিকতা দেখে আমি মুগ্ধ !! কারো নজর না লেগে যায় এসবে। উনাদের এতো ফ্রেন্ডলি দেখে বেশ আনন্দ লাগছে আমার। এতো বয়স বাড়ার পরেও যৌবন টা যেন ধরে রেখেছেন উনারা। শুধু শারীরিক দিক থেকে না মানসিক দিক থেকেও উনারা এখনো যুবক–যুবতী। মনে হচ্ছে আমি আমার আর ঈশানের ফিউচার দেখতে পাচ্ছি। মুখে হাত দিয়ে হেসে উঠলাম আমি।
🍂

তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – ৪৬
Writer: Sidratul muntaz

🍂
হলুদ রঙের লেহেঙ্গার সাথে লাল রঙের ব্লাউজ। ওরনাটাও হলুদ। তবে বেশ ভারি। আমার ওজনের থেকে এই লেহেঙ্গার ওজনই বেশি হবে। এইটা ঈশান আমার জন্য এনেছেন রিসিপশনে পড়তে। এতো রঙ ছেড়ে হলুদ কেনো আনলেন সেটাই বুঝতে পারছি না আমি। আজ এটা পড়লে সবাই রিসিপশন নাকি গায়ে হলুদ এই নিয়েই হয়তো কনফিউশনে পড়ে যাবে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে লেহেঙ্গাটা উল্টে পাল্টে দেখছিলাম। এমন সময় ভেতরে ঢুকলো ডাইনি আর রাক্ষসী। সাথে আরো কয়েকজন অচেনা মুখ। তার মধ্যে একটা বেশ সুন্দর। আমি এদের চিনতে না পেরে ডায়না আর রাকেশীকে জিজ্ঞেস করলাম—

এরা কারা?

ডায়না বলল– ম্যাম,, ওরা বিউটিশিয়ান এসেছে। আপনাকে এখন মেকআপ করানো হবে।

আমি চোখ গোল করে তাকালাম। আমাকে মেকআপ করাতে এতোজন লাগবে? আল্লাহ মালুম কি না কি সাজাবে আমাকে। ডাইনি আর রাক্ষসীর মতো মুখে ভারী মেকআপের প্রলেপ আর মাথায় উচু খোপার ভার নিয়ে আমি চলতে পারবো না। অসম্ভব। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাড়ালাম আমি। দেয়াল থেকে ঈশানের রেকেট ব্যাট খুলে নিলাম। আমার কান্ড দেখে সবার চোখমুখে বিস্ময়। কেউই হয়তো আন্দাজ করতে পারছে না যে আমি কি করতে চলেছি।

রাকেশী আর ডায়না ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে আর উচ্চারণ করছে– ম ম্যাম….

ওদের পেছনে থাকা একদল শাকচুন্নি গুলোও ভয়ে কাবু। আমি এসবের তোয়াক্কা না করেই রেকেট ব্যাটটা ঘুরাতে ঘুরাতে ওদের সামনে এসে যেই ঘর কাপানো একটা চিৎকার টেনে বারি লাগাতে যাবো…ওমনি ওরা আমার থেকে দিগুন শব্দে চিৎকার করে অন দ্যা স্পট দৌড় লাগাল একদম দরজার বাহিরে। আর আমি এবার ভুবন ভোলানো হাসিতে মত্ত হলাম। সেইরকম মজা লাগছে। কিন্তু আমার হাসি থেমে গেল যখন দেখলাম দরজার সামনে মা মুখ হা করে দাড়িয়ে আছেন। মা বলতে আমি শাশুড়ী মা কেই বোঝাচ্ছি। উনাকে দেখে তৎক্ষণাৎ রেকেট ব্যাট পেছনে লুকিয়ে ইনোসেন্ট ফেস করে দাড়িয়ে পড়লাম আমি। মা কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠলেন। মায়ের হাসি দেখে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। ভদ্রমহিলা এতো সুন্দর করে হাসেন কেনো? উনাকে দেখলেই আমার ঈশানের কথা মনে পড়ে। মনে হয় যেন ঈশানের ফিমেল ভারসন আমার সামনে দাড়িয়ে। কেমন অদ্ভুত একটা ফিলিং। আমিও মায়ের হাসিতে সায় দিয়ে হাসতে লাগলাম। যদিও আমি এটাই জানিনা উনি কেনো হাসছেন। মা আমার কাছে এসে আমার চিবুক স্পর্শ করে বললেন—

তুমি কি সাজগোজ পছন্দ করো না?

আমি অসহায় মুখ করে মাথা নাড়লাম–

না আন্টি….. আমার অস্বস্তি ফিল হয়।

উনি আরেকবার হেসে বললেন— আমারো হতো। প্রথম প্রথম। কিন্তু এখন একদম অভ্যাস হয়ে গেছে। বরং এখন সাজগোজ না করলে অস্বস্তি লাগে। তবে আমি চাইনা তুমি অস্বস্তি নিয়েও জোর করে সাজতে বসো। তোমার যেভাবে ইজি লাগবে তুমি নিজের মতো করে সেভাবেই সাজো।

কিন্তু আন্টি আমি তো কখনো সেভাবে সাজগোজই করিনি। শুধু কাজল আর লিপস্টিক ছাড়া কিচ্ছু জানিনা।

মা এবার আমার গাল টিপে দিয়ে বললেন– ওরে পিচ্চি মেয়ে বলে কি! আজ কালকের মেয়ে হয়ে মেকআপ করা জানোনা? আমার একটা ছোট ভাগ্নী আছে। এইটুকু একদম বাচ্চা। বয়স পাচ বছর। মেকআপের এ টু যেট সব তার মুখস্ত। ভীষণ পাকনা বুঝেছো? আজকে অনুষ্ঠানে আসবে। তোমার সাথে আলাপ করিয়ে দিবো।

আমি মাথা হেলিয়ে বললাম — আচ্ছা আন্টি!

মা এবার আমার হাত ধরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে আনলেন—

এসো তো দেখি! আমি তোমাকে সাজাতে পারি কিনা।

জি আন্টি আপনি?

হ্যা! তো কি হয়েছে? আমি কি পারবো না নাকি? বিউটিশিয়ানের থেকে হাজার গুণ ভালো পারব আমি দেখে নিও।

না আন্টি সেটা না আসলে…..

হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। আমি জানি তো তুমি কেনো লজ্জা পাচ্ছো। কিন্তু লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই মা। তুমি বসো তো!

আমাকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন উনি। আর আমিও বাধ্য মেয়ের মতো বসে রইলাম। সারাটাসময় টু শব্দটিও করলাম না।

.

.

আমি শাশুড়ী মায়ের পাশের চেয়ারটায় বসে আছি। এতোক্ষণ স্টেজে বসেছিলাম।কিন্তু স্টেজ থেকে নামানো হয়েছে আমাকে। ভারী লেহেঙ্গা নিয়ে নড়াচড়া করতেও বেশ কষ্ট। তার মধ্যে কিছুক্ষণ পর পর নতুন নতুন অপরিচিত মুখের সাথে দেখা হচ্ছে। বারবার সালাম আর কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতে করতে আমি ক্লান্ত। অনুষ্ঠানে এতো মানুষ আসে কেন বা*? সত্যিই অসহ্য লাগছে এবার। চোখ ফেটে ঘুম আসছে। তার উপর আমার চঞ্চলাবতী শাশুড়ী মায়ের বকবক আমার ঘুমের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে ভদ্র মহিলা বেশ হাসিখুশি এটা মানতে হবে। বয়স্ক টাইপ মেন্টালিটি একদমই নেই উনার। বরং উনার সাথে থাকলে মনে হয় সমবয়সী কারো সাথে আছি। কিন্তু ঈশানের সাথে আমার এখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। ছেলেটা আদৌ বেচে আছে তো? বিরক্ত লাগছে আমার। কখন দেখবো ঈশানকে? আমার বিরক্তির মাত্রা বেড়ে গেলো যখন দেখলাম চারদিকের লাইট অফ করে দেওয়া হয়েছে। সবাই বিড়বিড় করে আশেপাশে তাকাচ্ছে। হঠাৎ আলোর বিস্ফোরণ শুরু হল স্টেজের উপর। স্টেজের পর্দা সরতেই দেখলাম একজন কালো ব্লেজার পড়া ছেলে গিটার হাতে উল্টোদিকে মুখ করে দাড়িয়ে আছে। গিটারের টিউনের সাথে তাল মিলিয়ে ছেলেটা শিষ বাজাচ্ছে। এই মিউজিক টা আমার পরিচিত। আমি কৌতুহল নিয়ে দেখতে লাগলাম। ঈশান এবার মুখ ঘুরিয়ে সামনে তাকালো।একদম আমার দিকে নিক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিয়ে । সঙ্গে সঙ্গে একঝাক আলোর ঝলকানি এসে পড়লো আমার মুখের উপর। আমার ভীষণ অপ্রস্তুত লাগছে। সবার দৃষ্টি এবার আমার দিকে স্থির। ঈশানের গিটারের সুরে তাল মিলিয়ে ভাইয়া অয়ন্তী আপু সাফিন আয়ময়ান ভাইয়া সবাই চুটকি বাজাচ্ছে। ঈশান এবার গান শুরু করল তাও আমার দিকে আঙুল ইশারা করে —

বান জা তু মেরি রানি
তেইনু মেহেল দেওয়া দুঙ্গা
বান মেরি মেহবুবা
ম্যায় তেইনু তাজ বাওয়া দুঙ্গা (২)

সুন মেরি রানি রানি…..
বান মেরি রানি রানি…. ( আমার সামনে এসে হাটু গেড়ে বসে হাত বাড়িয়ে দিলেন)

সবাই এবার শিষ বাজিয়ে হাত তালি দিচ্ছে। আমাকে ইশারা করছে ঈশানের হাত ধরার জন্য। ভাইয়া শাশুড়ীমা বাবা নিজের মা সবার সামনে আমার অসম্ভব লজ্জা লাগছে। ইচ্ছে করছে উল্টো দিকে দৌড় লাগাতে। কিন্তু সেটা হল না। ঈশান আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলেন স্টেজে। আবার গান শুরু–

শাহজাহান ম্যায় তেরা
তেইনু মমতাজ বানা দুঙ্গা..
বান জা তু মেরি রানি
তেইনু মেহেল দেওয়া দুঙ্গা…

দর্শকের দৃষ্টি স্টেজের দিকে আর আমি মুখে হাত রেখে দাড়িয়ে আছি। ঈশান আমার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে গান গাইছে।

বাদান তেরি দি খুশবু
মেইনু সোন না দেভে নি( আমার হাত টেনে ধরে চুলে মুখ রেখে)
রাতান নু উঠ উঠকে সোচা
বারে তেরে নি (২) (আমার হাত ছেড়ে দিলেন আর আমি ঘুরতে লাগলাম)

সুন মেরি রানি রানি….
বান মেরি রানি রানি…..( এবার সামনে ভেসে উঠল আমার সেই হলুদ জামা পড়া ছবি বিশাল স্কিন জুড়ে)

সবাই আরেকবার চেচিয়ে উঠল। আর তব্দা লেগে দাড়িয়ে আছি।

হ্যা কারদে তু মেইনু
ম্যায় দুনিয়া নু হিলা দুঙ্গা….( আমাকে টেনে নিজের কাছে আনলেন)
বান জা তু মেরি রানি
তেইনু মেহেল দেওয়া দুঙ্গা…..( আমার কোমড়ে হাত রেখে কাপল ড্যান্স করতে করতে)

পুরোটা সময় আমি ঈশানের ঈশারায় নেচেছি। একদম ঘোর লাগানো সময় কাটছিল আমায়। আর এখন আমি ক্লান্ত। ভীষণ ক্লান্ত। তাই বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছি। চোখ বন্ধ রেখে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু সেই প্রস্তুতি পুর্ণতা পাওয়ার আগেই ঈশান এসে জাপটে ধরলেন আমায়। আমি ঘুমো ঘুমো কণ্ঠে বললাম–

ঈশান কি করছেন? ছাড়ুন তো আমার ঘুম আসছে।
ছাড়া যাবেনা। কিছুতেই না।

মানে?

ঈশান এবার মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন–

মানে আই লভ ইউ। ( কপালে কিস দিয়ে)

আচ্ছা হয়েছে এবার উঠুন। আমাকে ঘুমাতে দিন।

আমার ঘুম না আসা পর্যন্ত তুমিও ঘুমাতে পারবে বেবি। এক্সট্রিমলি সরি।

বলেই আমার পেটের উপর মুখ গুজলেন উনি। আর আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম। যন্ত্রণাময় সুরসুরি অনুভুত হচ্ছে…….

.
.

আমি জায়মার বেডের সামনে চেয়ার টেনে বসে আছি। জায়মা শুয়ে ছিল আমায় দেখে উঠে বসেছে কিছুক্ষণ আগে। পরিবেশটা বেশ খোলামেলা। আর রুমটাও আলিশান। টিভি আছে এসি আছে….. এডজস্ট ওয়াশরুমের সাথে কিচেনও আছে ছোট্ট করে। এইখানে থাকতে অসুবিধা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি পায়ের উপর পা তুলে বসলাম। দুই হাত দিয়ে হাটু জড়িয়ে ধরে এক পা নাড়াতে নাড়াতে জিজ্ঞেস করলাম —

কেমন আছিস?

জায়মা মলিন মুখে হেসে বলল— তুই যেমন রেখেছিস! কিন্তু আমাকে এখানে আটকে রাখার কি কারণ বুঝতে পারলাম না। ভয় পেয়েছিস নাকি আমাকে?

তোর মতো কালসাপকে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।

জায়মা মাথা নিচু করে হাসল– ভালোই কিন্তু হয়েছে তারু। এমনিতেই আমার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। এই অবস্থায় বাসায় কিভাবে যেতাম? তার থেকে এটাই ভালো হয়েছে যে একটা মাথা গোজার ঠাই পেয়েছি।

জায়মা শোন। আমি তোকে সেদিন বাচ্চাটা ফেলে দেওয়ার কথা বলেছিলাম তাইনা? এখন বলছি তুই বাচ্চাটা ফেলবি না। বরং জন্ম দিবি। ওকে মানুষ করবি। তোর একলা জীবনের সঙ্গী হবে ও। ওকে আকড়ে ধরে তুই নিজেও বেচে থাকবি।

সেটা কি আদৌ সম্ভব? ওকে আমি খাওয়াবো কি? রাখবো কোথায়? নিজেরই যাওয়ার জায়গা নেই আবার বাচ্চা……

আমি তোকে সাহায্য করবো। দরকার হলে তোর নামে পুরো একটা ফ্ল্যাট লিখে দিবো। মাসে মাসে টাকাও দিবো।

ও তাই নাকি? আমি তো ভুলেই গেছিলাম। তোর তো এখন অনেক টাকা তাইনা তারু? কোনোকিছুর অভাব নেই তোর।

হ্যা ঠিকই বলেছিস। আমার সত্যিই কোনো কিছুর অভাব নেই। তবুও আমি শুন্য। নিজেকে তোর কাছেই বড্ড অভাবী মনে হচ্ছে আমার।

মানে? আমার কাছে তুই অভাবী? কি করে? তোর কি এমন নেই শুনি? সবথেকে ইম্পোর্টেন্ট ঈশানই তো তোর কাছে আছে। আর কি লাগে?

আমি উত্তর দিলাম না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উঠে দাড়ালাম। জানালার কার্নিশে হাত রেখে বাহিরের দিকে দৃষ্টি রেখে বললাম—

শোন জায়মা। বাচ্চাটাকে ফেলিস না। একটা বাচ্চা যে কতটা ইম্পোর্টেন্ট যার নেই সেই কেবল বোঝে। মা হওয়ার ক্ষমতা আল্লাহ সবাইকে দেয়না। যে এই সুযোগ পায় সে খুব সৌভাগ্যবতী। যেমন তুই।

জায়মা ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চোখের কোণটা মুছে স্মিত হাসলাম। জায়মা বেডের উপর বসতে বসতে বললাম–

সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সবকিছু দেয়না। তাই সৃষ্টিকর্তার দেওয়া জিনিস কখনো ফেরাতে হয়না। যেই পরিস্থিতিতেই হোক। মেনে নিতে হয়। তোর বাচ্চাটাও সৃষ্টিকর্তার দেওয়া এক অমুল্য উপহার। এর অমর্যাদা করিস না।

জায়মা এখনো শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। ওর ওই চোখে আমি নিজের জন্য ক্ষোভ দেখতে পাচ্ছি। ঘৃণা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তাতেও আমার কিছু যায় আসেনা। আমি জায়মার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। চোখমুখ কঠিন করে বললাম–

তুই না চাইলেও বাচ্চাটা তোকেই জন্ম দিতে হবে জায়মা। কিন্তু…( জায়মার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে) ঈশান যদি কোনোভাবে জানতে পারে যে এইটা তার বাচ্চা! তাহলে সেদিনই তোর জীবনের শেষদিন হবে মনে রাখিস। তোর বাচ্চা বেড়ে উঠবে পরিচয়হীনভাবে। যেই নোংরা খেলা তুই নিজে শুরু করেছিলি তার ফসল আজীবন এভাবেই বয়ে বেড়াতে হবে তোকে। আর এটাই তোর উপযুক্ত শাস্তি।

জায়মা রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে আমাকে দেখছে। আমি সেই তেয়াক্কা না করে চেয়ার থেকে ব্যাগটা কাধে তুলে নিলাম। জায়মার উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এলাম কেবিন থেকে। হাতে বেশি সময় নেই। জলদি বাড়ি ফিরতে হবে। হসপিটালের বাহিরে পা রাখতেই ডায়না আটকালো আমায়। ডায়নার চোখমুখ লাল হয়ে আছে। হাত পা কাপছে। মনে হচ্ছে খুব আতঙ্কে আছে মেয়েটা। আমি ডায়নার দুই হাত চেপে ধরে ভ্রু কুচকে বললাম—

কি হয়েছে ডায়না? এমন করছো কেনো??

ম ম্যাম…… ( বাহিরে ইশারা করে)

আমি তৎক্ষণাৎ ডায়নাকে ছেড়ে দিয়ে বাহিরে উকি দিতেই দেখলাম ঈশান গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে সোজা হয়ে দাড়ালেন উনি। আমাকে আঙুলের ইশারায় সামনে আসতে বললেন। আর এদিকে আমার অন্তরাত্মা কাপাকাপি শুরু করে দিয়েছে। টলমল চোখে ডায়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটা কাদছে। কিন্তু আমি যে কাদতেও পারছি না। হাত পায়ের সাথে সাথে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে আমার। আরেকবার ভীত দৃষ্টি নিয়ে বাহিরে তাকাতে গিয়ে চমকে উঠলাম আমি। ঈশান এবার আমার সামনে দাড়িয়ে আছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে গেলাম কয়েক পা। ঈশানের চোখের দিকে তাকানোর যাচ্ছে না। দেখে বোঝাই যাচ্ছে ভয়ানক রেগে আছেন উনি। আচমকা আমার দিকে এগিয়ে এসে সশব্দে আমার বাম গালে চড় বসালেন ঈশান। আমি ছিটকে গিয়ে ডায়নার গায়ের উপর পড়লাম। ডায়না আমায় শক্ত করে ধরে ফেলল।
🍂

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here