তোমাকে ঘিরে পর্ব -০১

১.
নিজের ১৮ তম জন্মদিনেই যে নিজের বিয়ে হয়ে যাবে ভাবতেই তূরের গা শিউরে উঠলো সেই সাথে ভীষণ অবাকও হলো।

তূরকে ওর মা আর বোন সাজিয়ে চলে গিয়েছে। তূর পুতুলের মতো বসে আছে!মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ওর। ওর বিয়ে আর ও মাত্রই জানলো?ওর বিয়ে ঠিক করেছে একটা বার এটা ওকে জানালে খুব কি ক্ষতি হতো?ওরও তো মত/অমত এর ব্যাপার আছে!

এর মাঝেই নিচে থেকে শোনা গেলো বর পক্ষ চলে এসেছে!তূর বিছানায় শক্ত হয়ে বসলো। তূরের ছোট বোন তোহা এসে তূরকে তাড়া দিয়ে বলে,”আপু জলদি উঠ!বরপক্ষ এসে পরেছে।”

তূর অশ্রুসিক্ত নয়নে তোহার দিকে তাকিয়ে বলল,”তোহা বলবি আমায়?আমি কি এতোটাই পর হয়ে গিয়েছি যে ছোট মা আর বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।”

” কখনো পর হয়ে গেলেই কেউ বিয়ে দেয় না তূর তাই বলছি এইরকম বাচ্চামো ছেড়ে নিচে যাও!”

গম্ভির স্বরে কথাটা বলে এগিয়ে আসলেন তূরের বাবা তাহের। তূর উনার জবাবে কিছু বলল না তূরের জবাব না পেয়ে তাহের রাগি গলায় বললেন,”আমার কিথা কি তোমার কানে যায় না?এক কথা বার বার বলতে আমার ভালো লাগে না জানো না তুমি?”

তাচ্ছিল্য হাসলো তূর। তোহার হাত ছাড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে বলল,”আমার মত/অমতের মূল্য কখনো দিয়েছেন আপনি ও ছোট মা?মা থাকা কালীন কখনো মাকেই তো মূল্য দেন নি সেইখানে আমি তো কিছুই না।ঠিক আজও নিজেকে বলি দিতে হবে না চাইতেও!”

তূরের কথায় তাহের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে মারলেন তূরের দিকে,বললেন,”বেশি কথা বলতে শিখে গিয়েছো তুমি!”

তূর হাসলো,তাহের তূরের দিক থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে বললেন,”দ্রুত নিচে আসো!”

বলেই তোহা দিকে তাকিয়ে বললেন,”তোহা তোর বোনকে নিয়ে নিচে আয়।”

কথাটা বলেই গটগট পায়ে চলে গেলেন তূরের রুম ছেড়ে। তূর ফস করে নিশ্বাস ছাড়লো,তোহা তূরকে একটা ঘোমটা টেনে দিলো ওকে সাথে নিয়ে নিচে এসে তূরের হবু বরের পাশে বসালো। কাজী সাহেব তাড়া দিয়ে বললেন,”জলদি করুন!আমার কারো বিয়ে পড়াতে যেতে হবে।”

কাজী সাহেবের কথায় তাহের বললেন,”জ্বী আপনি শুরু করুন।”

কাজী সাহেব অনুমতি পেয়ে বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। তূরকে কবুল বলতে বললে তূর কিছু সেকেন্ড চুপ থেকে কবুল বলে দেয়। তূরের হবু বরকে বলতে বললে সেও কোনো সময় ব্যয় না করে তিনবার কবুল বলে দেয়।

সবাই একসাথে ‘আলহামদুল্লিল্লাহ’ বলে উঠে। তূর বরফের ন্যায় বসে রয়েছে। এই মুহুর্তে নিজের মাকে কাছে পেলে তাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে পারলে যেনো ও শান্তি পাবে।

এর মাঝেই কিছু কাজিনদের কথা কানে এলো তূরের। ওর কাজিনদের মধ্যে একটা মেয়ে বলে উঠে

“তূরের জামাইটাকে দেখছিস তরী?কত সুন্দর!এমন জামাই যদি আমার থাকতো,ইশ!”

ওদের ফিসফিসানি কথা শুনতে শুনতে যেনো তিক্ত হয়ে উঠেছে তূর। বরসহ সবাই খাওয়া দাওয়া করতে যায়,সবার যেতেই তোহা তূরের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,”জানিস আপু?দুলাভাইয়ের নাম হলো অয়ন রেদওয়ান।”

বরের নাম শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় তূর। এই মানুষটিকে ও কোনো এক কারণে ঘৃণা করে আর সেই কিনা এই মানুষটির সাথেই এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে?যাকে ঘৃণা করে তার সাথে সারাজীবণ কিভাবে সংসার করবে ও!তূরের ভাবনার মাঝে তূরকে কেউ ডাকলো,বুঝতে পারলো ওর ছোট মা ডাকছে,ও নিরুত্তর বসে রইলো। তূরের ছোট মা এসে ওকে বলে,”তুই কি এখন খাবি?”

ঘোমটার ভিতর থেকে ক্ষিপ্ত গলায় তূর বলে,”খাবো না।”

শবনাম কিছুটা রাগলো,চোখ দিয়েই পারলে তূরকে গিলে ফেলে। এই মেয়ের সাহস কি করে হয় উনার মুখের উপর জবাব দেওয়ার?আশেপাশে মানুষ আছে দেখেও কিছু বলতে পারছে না কড়া দৃষ্টিপাত তূরের দিকে নিক্ষেপ করে চলে গেলেন।

তূর আগে ন্যায় হয়ে বসলো। সকলে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আসলো। একজন বয়স্ক লোক বললেন,”খাওয়া দাওয়া শেষ যেহেতু হয়েছে তাহলে এখন যাওয়া যাক বাড়ির উদ্দেশ্যে।”

তাহের সাহেব হাসি হাসি মুখে উনাকে বললেন,”এখন’ই যাবেন বেয়াইন সাহেব?”

উনাদের দুইজনের কথা শুনে বুঝতে পারলাম উনি অয়নের দাদা।

তাহের সাহেব কিছুক্ষন থাকার জন্য জোর করলেন কিন্তু অয়নের দাদা প্রতিবারই নাকচ করলেন তাই উনিও হার মেনে রাজী হয়ে গেলেন। তূরের ঘোমতা সরিয়ে তোহা তূরকে ধরে গাড়ির সামনে নিয়ে গেলো এতে মনে মনে তূর বেশ বিরক্ত হলো ওকে এমন ভাবে ধরেছে মনে হয় ও অসুস্থ রোগী ওকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এখন!

তূরের হাত ছাড়তেই তূর দ্রুত গতিতে গাড়িতে উঠে বসে পড়লো। ফিরেও সেই মানুষদের দিকে তাকালো না যারা সারাজীবণ ওকে অবহেলা করে আসছে!চোখের কোণে জল এলেও মুছে নিলো নিজের অশ্রু কাউকে দেখাতে চায় না!আদৌও কি এই অশ্রুর কদর আছে ওদের কাছে?

তূরের ভাবনার মাঝে বয়স্ক লোকটি অর্থাৎ অয়নের দাদাজান ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বললেন,”সাগর গাড়ি স্টার্ট দেও।”

ড্রাইভার অনুমতি পেয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

তূরের কিছুটা হলেও কষ্ট হচ্ছে হবারই কথা এতো বছর এই বাড়িতে ছিলো আর আজ ছেড়ে যাচ্ছে এই বাড়িটা।

২.
দীর্ঘ কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে তূর নিজের শশুড় বাড়ি অর্থাৎ রেদওয়ান ম্যাশনের সামনে এসে ওদের গাড়ি থামলো। ওরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে ঢুকলো। তূর একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল বাড়িটাকে, পুরো বাড়িটাই নিরব,ও জানতো না যে বিয়েরদিন কারো বাড়িতে কোনো মেহমান থাকে না,নিরব থাকে বাড়িটা।

অয়নের দাদাজান অয়নকে বললেন,”অয়ন তুই বউমাকে নিয়ে রুমে যা।”

অয়ন নামটা শুনে তূর অয়নের পানে তাকালো। এতোক্ষনে ও মাত্রই অয়নের দিকে তাকালো। অয়ন তূরের চাহনি খেয়াল করেও উপেক্ষা করে নিজের দাদাকে বলল,”জ্বী দাদু,তুমি রুমে যেয়ে বিশ্রাম করো।”

অয়নের দাদু মুচকি হেসে চলে যান। অয়ন তূরের দিকে এক নজর তাকিয়ে ওকে ওইখানে ফেলেই চলে যায়। অয়নের এহেন কাজে তূর বেশ চমকালো। অয়নের পিছে পিছে তূরও যায়। অয়ন নিজের রুমে এসে সব জ্বালালো,তূর অয়নের রুমের চারদিকে একবার তাকাতেই হা হয়ে গেলো। এতোটা সুন্দর করে সাজানো সব কিছু এইরকম রুম জীবণের প্রথম দেখছে,অয়নকে বেশ সৌখিন মনে হলে তূরের। অয়ন গম্ভির হয়ে বলে,”হা করে না থেকে ফ্রেশ হয়ে আসুন!”

অয়নের এমন কথায় তূর চটজলদি নিজের মুখ বন্ধ করলো আর এমন ভান করলো যেনো কিছুই হয়নি ও কিছুই বুঝে না।

অয়ন তূরকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। অয়নের যেতেই যেনো তূর স্বস্তি পেলো। পরপর কয়েকবার শ্বাস ফেলে বিছানায় বসলো।

ভেবেছিলো সোফায় ঘুমাবে কিন্তু এইখানে চারদিকে কোনো সোফাই ও দেখতে পাচ্ছে না আপাতত নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে তূরের।

অয়ন চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। তূর একবার অয়নের দিকে নিজের দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত অয়নকে দেখে দ্রুতই চোখ সরিয়ে নিলো তা অয়নও খেয়াল করেছে। অয়ন এগিয়ে আসতে আসতে তূরকে বলে,”ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

তূরের এইবার বেশ রাগ লাগলো কেনো জানি!কিছুটা কড়া গলায় বলল,”পড়ার জন্য কি আপনার ড্রেস দিবেন?”

তূরের কথায় অয়ন বোকা বনে গেলো। মুহুর্তেই নিজেকে সামলে বলে উঠে,”আপনার ড্রেস নেই?মানে আনেননি?”

অয়নের এই কথায় যেনো তূরের মেজাজ আগের থেকে আরো বিগড়ে গেলো। অয়নকে শাসিয়ে বলে উঠল,”আপনি কি দেখেছেন আমি সাথে করে কোনো ব্যাগ এনেছি তাহলে এইরকম বোকার মতো কথা কেনো বলছেন।”

অয়নের রাগ হলো ওকে ‘বোকা’ বলার জন্য। ছোট বেলা থেকেই এই বোকা শব্দটা ওর শত্রু!এই শব্দটা ও কোনো ভাবেই শুনতে পারে না। নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে আলমারি থেকে নিজের শার্ট আর টাউজার বের করে তূরের সামনে রেখে বলল,”আজ আমারটাই পরুন আগামীকাল আপনার জন্য ব্যবস্থা করে দিবো।”

তূরও আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো……

#চলবে

#তোমাকে_ঘিরে
#সূচনা_পর্ব
#আয়ানা_আরা (ছদ্মনাম)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here