তোমাতেই পূর্ণ আমি পর্ব -২২

#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -২২
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা

ছাদে পাতানো বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে চাঁদ দেখতে ব্যস্ত আমি ও তূর্য। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চাঁদের সৌন্দর্য বিলাসে মগ্ন চিরকুট লেখক। ওনার দিকে এক পলক তাকিয়ে আমি বলে উঠলাম,,,

–আমি কিছু বলতে চাই তূর্য।

মুখে মুচকি হাসি নিয়ে হাতে মাথা ঠেকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তূর্য। চোখে তার স্পষ্ট আমি কি বলতে চাই সেটা শুনতে চায় সে। মনে একটু সাহস জুগিয়ে বললাম,,,

–আমি যা বলব তাতে হয়তো আপনি রেগে যাবেন। তবে আমি চাই অতীতের কিছু বিষাদের স্মৃতি আপনাকে জানিয়েই আপনার সাথে নতুন পথে হাঁটতে ।

চাঁদের আলোয় দিব্যি দেখতে পাচ্ছি তূর্যর মুখে রাগ স্পষ্ট । নিচে রাখা তূর্যর হাতটা কাঁপা কাঁপা হাতে স্পর্শ করলাম আমি। নিমিষেই তূর্যর কঠিন চাহনি মোহনীয় দৃষ্টিতে পরিণত হল ।আমার হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলেন শক্ত করে। আজ বলতে চায় আমি তূর্য কে আমার জীবনের কষ্ট গুলো। এক চাপা কষ্ট চাপা আর্তনাদ থেকে মুক্তি পেতে চাই আমি। যা কেউ জানে না তা জানার অধিকার আছে তূর্যর। জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। তূর্যর দিকে তাকিয়ে করুন স্বরে বলতে শুরু করলাম,,,,

–বিয়ের প্রথম রাতেই আমি আপনার খালাতো ভাই আভাসের হাতে ধর্ষণ হয়েছি। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার সাথে জোর করে সম্পর্ক স্থাপন করা তো ধর্ষনই তাই না?

সাথে সাথেই উঠে বসলেন তূর্য। আমায় টেনে মিশিয়ে নিলেন নিজের বুকে। ওনার মুখের দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছি কথাটা বড্ড গেঁথেছে ওনার বুকে। হয়তো রক্তক্ষরণ ও হচ্ছে হৃদপিন্ডে। এটাই স্বাভাবিক। যেই মেয়েটা কে নিজের চোখে চোখে রেখেছে, পাগলের মতো ভালোবেসেছে সেই মেয়েটা কে অন্য কেউ কলঙ্কিত করেছে সেটা মেনে নেওয়া হয়তো খুবই কঠিন। বুকে মাথা রেখেই আমি আবার বলতে লাগলাম,,,

—– যেমনই হোক নিজেকে মানিয়ে সংসার করতে চেয়েছি আভাসের সাথে। ওনার মনে আমার জন্য হিংসা ব্যতীত কিছুই ছিল না। রাত দুপুরে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরা ছিল ওনার অভ্যেস। বিয়ের পর জানতে পারি সিমথী আপুর সাথে ওনার প্রেমের সম্পর্ক ছিল বহু আগে থেকেই। কিন্তু মা সেটা মেনে নেন নি।কারণ সিমথী আপুর আরো অনেক ছেলেদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিল যা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে রাজি ছিলেন না আভাস। বহু কষ্টে তাকে জোর করে মানানো হয় বিয়ের জন্য। বিয়ে তো ওনি করেন কিন্তু সিমথী আপুর সাথে রাত দিন ঘুরাঘুরি আরো বেড়ে যায়। মনের মাঝে ক্ষোভ নিয়ে নিজের দেহ চাহিদা মিটাতেন ওনি। প্রতিবাদ করতে গেলেই মারধর করতেন আমায়। জানেন,,তখন খুব মনে পড়তো আপনার কথা। মনে হতো আপনি আসবেন আমায় প্রটেক্ট করবেন। কতো যে নিদ্রাবিহীন রাত কাটিয়েছি আপনার স্মরণে তা হিসাব ছাড়া। সারাক্ষণ অপেক্ষা করতাম আপনার চিরকুটের। আশায় থাকতাম শুধু একবার, একবার হলেও যেন আমার নামে কোনো চিরকুট আসে। রাতের আঁধারে লুকিয়ে পড়তাম আপনার ভালোবাসার মাদকতায় ভরপুর পুরোনো চিরকুট গুলো। তিন মাসের মাথায় আমি শত কষ্টের মাঝে ও খুশির ঝলক খুঁজে পেয়েছিলাম। প্রত্যেকটা মেয়েই খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে যখন সে জানতে পারে তার গর্ভে বেড়ে উঠছে ছোট্ট একটা প্রাণ। জানেন তূর্য সেদিন প্রেগন্যান্সি কিটে যখন পজিটিভ আসে তখন খুশিতে ওয়াশরুমের দেয়ালে হেলান দিয়ে কেঁদেছিলাম দু ঘন্টা ধরে। ভুলে গেছিলাম সবকিছু। আভাস কে আমি ভালো না বাসলেও আমার গর্ভের সন্তান তো তার। সম্পর্ক যেমনই হোক বাচ্চাটার জন্য আরেকবার সুন্দর একটা জীবন গড়ার প্রত্যাশা ছিল আমার। ভেবেছি আভাস হয়তো জানতে পারলে সব খারাপ পথ ছেড়ে ভালো হয়ে যাবে। শুনেছি সন্তানের জন্য বাজে নেশাখোর ছেলেটাও আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে। কাউকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমে আভাস কেই জানাব। বন্ধুদের সাথে দশ দিনের ট্যুরে চলে যায় আভাস। আসলে তা তো মিথ্যা ছিল। সত্য তো এটা ছিল সিমথী আপু কে নিয়ে দশ দিনের জন্য বান্দরবান ঘুরতে যান ওনি। দশদিন পর যখন ওনি ব্যাক করেন হাসি মুখে ওনাকে সবটা বলতেই কোনো রিয়েক্ট না করে রুম থেকে বেরিয়ে যান । ভাবলাম হয়তো খুব বেশি খুশি হয়েছেন তাই প্রকাশ করতে পারছেন না ঠিক ভাবে। পাঁচ দিন পর আনুমানিক রাত ১ টা বাজে। বিছানায় আভাস কে না পেয়ে চমকে উঠলাম আমি। সিমথী আপুর রুমের সামনে এসে দাঁড়াতেই নিজের সন্তানের জন্য কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছিল আমার। নিজের চোখের সামনে আভাস ও সিমথী কে কিস করতে দেখে মাথায় চড়চড় করে রক্ত উঠে গেল। ওনার থেকে টেনে এনে সিমথী আপু কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম। কষিয়ে থাপ্পড় মারলাম ওনার গালে। কেন জানিনা সেই রাতে আমার সাহস টা বেড়ে গিয়েছিল অনেক। সন্তানের জন্য একবার লড়াই করার ইচ্ছে জাগল আমার মাঝে। চোখে জল গলায় কঠোর ভাব এনে আভাস কে বলে উঠলাম,,,

–এতো নিচ আপনি? সন্তানের জন্য মায়া লাগল না? আমি তো ভেবেছিলাম আপনি খুশি হয়েছেন! ভুল পথ ছেড়ে দিবেন। এতো নিকৃষ্ট মানুষ আমি কখনও দেখি নি। নিজের বউ নিজের অংশ কে ঠকিয়ে পরনারী তে লিপ্ত আপনি! জানোয়ার তো আপনি শুরু থেকেই ছিলেন আজ তা আরো ভালো ভাবে প্রমাণিত করলেন। আমার সন্তানের বাবা হওয়ার যোগ্যতা ও আপনার নেই। এমন জানোয়ার কোনোদিন ভালো হতেই পারে না।

কথাগুলো বলেই থু থু ছুঁড়ে মারলাম ওনার মুখে। আচমকা পিছন থেকে হ্যাঁচকা টানে খাটের উপর ছিটকে পড়লাম আমি। পেট গিয়ে ঠেকল খাটের একদম কোণায়। তখন মনে হচ্ছিল আমার দম কেউ আঁটকে দিয়েছিল খানিক সময়ের জন্য। ব্যাথায় চিতকার করে উঠলাম খুব জোরে। আমি অনুভব করেতে পারছিলাম তূর্য আবার,,আবারও কেঁড়ে নেওয়া হয়েছে আমার সুখের আরেকটা কারণ । মা এসে আমাকে দেখতেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন আমার পাশে। আভাস এগিয়ে আসতেই পর পর দুটো থাপ্পড় মেরে ক্ষান্ত হন মা। ড্রাইভারের সাহায্যে আমায় হসপিটাল নিয়ে গেলেন।


লাভ হয় নি তূর্য। ওরা খুন করেছে আমার,,,সসস। বাবা হয়ে পরনারীর জন্য,,,। একটু ও কষ্ট ছিল না ওনার চোখে। আর বলতে পারছি না আমি। তূর্যর বুকের খোলা অংশে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠলাম চিতকার করে। এতো দিনের জমানো এই কষ্ট টা বলার মতো মানুষ আমি পাই নি। আজ পেয়েছি সঠিক একজন মানুষ। যার ভালবাসায় নেই কোনো সার্থ যার কাছে অনাসয়ে মেলে ধরতে পারি আমি নিজেকে। যাকে বলা যায় সবকিছু নির্দ্বিধায় । যার বুকে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দেওয়া যায় আমার জীবনে সেই মানুষ টা তূর্য। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। তূর্যর কোনো নড়চড় নেই । তিনি যেন জমে গেছেন একদম । আমায় জড়িয়ে রেখেছেন শক্ত করে। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু। প্রচুর পরিমাণে রাগ জমল আমার মনে। মাথা উঠিয়ে তূর্যর কলার চেপে ধরলাম খুব জোরে। তূর্যর কোনো হেলদোল নেই। কলার টেনে চিল্লিয়ে বলে উঠলাম,,,

—কথা বলছেন না কেন আপনি?????আমার কথা শুনেছেন আপনি?কেন এমন করলেন তূর্য? কেন আসেন নি আপনি? চাচার মোবাইল দিয়ে আমি সেদিন অসংখ্য বার কল দিয়েছি আপনার চিরকুটে লিখে দেওয়া সেই নাম্বারে। কলেজ গেটে বসে কেঁদেছি আমি। এই আপনার ভালোবাসা? এই আপনার আগলে রাখা? খুব তো বড় বড় কথা বলতেন হৃদয় কুঠিরে লুকিয়ে রাখবেন! পেরেছেন?বরং মাঝ পথে একা ফেলে চলে গিয়েছেন। আপনি আসলে তো এমনটা হত না তূর্য। আমাদের তো সুখের একটা সংসার হত তাই না!

কাঁদতে কাঁদতে ঢলে পড়লাম ওনার বুকে। অস্ফুট স্বরে বললাম,,,

–কেন সেদিন বলললেছিলেন মেসেজে,,,আপপপনি ভভভালোবাসেন অন্য কাউকে। আআআআমি কিন্তু এটা বিশ্বাস করি নি তূর্য। বিয়ের দিন ও পালিয়ে এসে আমি দাড়িয়ে ছিলাম কলেজ গেটে আপনার অপেক্ষায়। আপনি আসেন নি। জোর করে মেরে আমমমায় মা বববিয়ে দিয়েছেন। আমমি পারি নি তূর্য। আপনাকে চিনতাম না।ঠিকানা ও জানতাম না যে চলে যেতাম আপনার কাছে।

একসময় নীরব হয়ে গেল শ্রেয়সী। শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চিতকার করে উঠল তূর্য । কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার চিতকারে হয়তো রাতের নিশাচর প্রাণী গুলো ও কেঁপে উঠেছে। শুভ্রপরীর এতো আর্তনাদ এতো কষ্ট কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না সে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। কেন সময় এমন এক কঠোর খেলা খেলল ওদের সাথে!! কেন সুখের বদলে বিষাদে ভরিয়ে দিল তার বুকে থাকা মেয়েটার জীবন! এমনটা না হলেও কি পারত না? শ্রেয়সীর শেষ পরীক্ষার দিন সে তো যাচ্ছিল তবে কেন নিয়তি এতটা কঠোর হল।

শ্রেয়সী কে কোলে নিয়ে পা বাড়াতেই আরিয়ানা কে ছাঁদের দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখল। আরিয়ানা আতংকিত হয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,,,

–শ্রেয়ার কি হয়েছে তূর্য? আর তোর চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?

তীব্র লাল হয়ে আছে তূর্যর চোখ। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল,,,

–আমার কলিজা ছিঁড়ে নেওয়ার খেলায় যে নেমেছিল তার জীবনে আগুন লাগিয়ে দিব আমি। তার কাছে নিজের বেঁচে থাকাটাই যন্ত্রণাদায়ক মনে হবে।

কথাটা বলে শ্রেয়সী কে রুমে এনে শুয়ে দিল তূর্য। গালে কান্নার ছাপ পড়ে আছে। অসহ্য যন্রণা এসে বাসা বাধল বুকে।ফুল গুলো খুলে একটা রুমাল ভিজিয়ে মুখটা মুছে দিল তূর্য। কপালে গালে অজস্র স্পর্শ দিয়ে শ্রেয়সীর হাত টা মুঠোয় নিয়ে বলে উঠল,,,

–তোমাকে ছাড়া নিজের ইচ্ছায় একটু ও স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই নি আমি শুভ্রপরী। তোমার শরীরে স্পর্শ করার সাধ্য ও ছিল না কারো। কিন্তু,,,। আমি ওই জানোয়ার মেয়ে সিমথী কে কখনও ছাড়ব না।

আর বলতে পারল না তূর্য। হাতে চুমু খেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল সে। আরিয়ানা কে রুমের বাহিরে দেখেই বলল,,,ভাবী অহমিকা কোথায়?

আতকে উঠল আরিয়ানা। ভয়ার্ত গলায় বলল,,

–আবার কি হয়েছে তূর্য?

–আপনার বোন কি আমার দুর্বলতার সুযোগ নেই নি ভাবী? যদি নিয়ে থাকে তাহলে তার পরিণাম তো আপনি জানেনই,,,

মুহুর্তেই আরিয়ানা জবাব দিল,,,

–অহমিকা যদি তোকে আর শ্রেয়সী কে আলাদা করার পিছনে জড়িত থাকে তবে ওকে আমি নিজে শাস্তি দিব তূর্য। আমি কখনোই চাই না শ্রেয়সী তোর থেকে দূরে থাকুক। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তোরা এক হতে পারিস নি। কিন্তু দিন রাত আমি এটাই পার্থনা করি শ্রেয়সী তোর হোক। তোর সাথে সুখে থাকুক।

চলবে,,,,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আজ কিন্তু দুইটা পর্ব দিয়েছি। ভুল হলে ধরিয়ে দিবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here