তোমায় চেয়েছি পুরোটাই পর্ব -৪৭+৪৮

#তোমায়_চেয়েছি_পুরোটাই
#পার্টঃ৪৭
#জয়ন্ত_কুমার_জয়

ছাঁদের এক কোনে বিষন্ন চুপচাপ বাবু হয়ে বসে আছে।তার সামনেই মিষ্টিই কো’মড়ে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে।বিষন্ন দুই হাত দিয়ে দুই গালের ওপর রেখে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিষ্টির দিকে।বিষন্নর বাচ্চা বাচ্চা মুখটা দেখে মিষ্টির মন খারাপ হয়ে গেলো।বিষন্নর চকচকে চোখে তাকিয়ে থাকা দেখে মিষ্টি মনে মনে ভাবলো, ছেলেটাকে শুধু শুধুই মা’রলাম,খুব ব্যাথা পাইছে মনে হচ্ছে।কিন্তু কি আর করবো,সব ওর দোষ,সবসময় আমাকে রাগিয়ে দেয়।এইসব ভাবতে ভাবতেই মিষ্টি বিষন্নর সামনে বসলো।মিষ্টির চুপচাপ বসা দেখে বিষন্ন আরো গুটিশুটি মেরে অন্য দিকে তাকালো।মিষ্টি তাকিয়ে আছে ভয় পাওয়া বিষন্নর দিকে।ছেলেটাকে ভয় পেলে তো দারুণ লাগে।

মিষ্টি বিষন্নর গালে আলতোভাবে হাত রেখে টেনে টেনে বললো

” সরি রে,খুব লেগেছে না? ”

বিষন্ন এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিয়ে মুখ গম্ভীর করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।মিষ্টি আবারো বিষন্নর গালে হাত রেখে অপরাধ ভঙ্গিতে বললো

” আরে বাবা সরি বলছি তো।আর এমন হবে না,প্রমিজ।”

বিষন্ন এবারেও হাত সরাতে চাইলো কিন্তু মিষ্টি শক্ত করে হাত রাখায় সরাতে না পেরে কপাল কুঁচকে মায়াবী স্বরে বললো

” এইভাবে কেউ মারে? ”

” খুব লাগছে? ”

বিষন্ন চোখ মুছতে মুছতে বললো ” হু “।

বিষন্নর কান্না দেখে মিষ্টির ও কান্না পেতে লাগলো।বিষন্নর হাতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো

” এই এই বিলু,কাঁদিস না প্লিজ,তোর কান্না দেখলে কিন্তু আমিও কেঁদে দিবো,এতো বড় হয়েও বাচ্চাদের মতো কেউ কাঁদে?”

বিষন্ন চোখ কচলাতে কচলাতে বললো ” একদম বিলু ডাকবা না।আর তুমি আমারে কথায় কথায় মা’রো,”

” আর মা’রবো না,এই দেখ কানে ধরছি,”

” কান কই ধরছো,চুল ধরছো ”

মিষ্টি মুখ কুঁচকে কান ধরলো।এইবার যেন বিষন্নর সাহস বেড়ে গেলো।বসা থেকে উঠে দাড়ালো,রেলিঙের ওপর পায়ে পা তুলে বসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো

” তোমার সাহস দিন দিন বেড়েই চলছে,আমাকে মা’রতে তোমার একটুও হাত কাঁপে না।কারন কি? ”

মিষ্টি মুখ ভোতা করে বললো ” পাকনামি করলে তো মা’র খেতেই হবে ”

” চুপ,তুমি ভুলে যাচ্ছো তুমি একজন সুইমিং চ্যাম্পিয়ন,মিউজিক স্পেশালিষ্টের সামনে দাড়িয়ে কথা বলছো।ওহহ না, বসে কথা বলছো ”

মিষ্টি কান ধরে ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে বললো ” উপপস,সরি,সরি ”

” এখন বলো আমার দোষ কি?কেন মা’রছো? বেশি কথা বলবে না,অল্প কথায় জবাব দিবে,বেশি কথা আমার পছন্দ না ”

” মেয়েদের কেন দেখো? ”

” মেয়েদের দেখলাম কখন,নাচ দেখছি ”

” ড্যাবড্যাব করে কেন দেখবা? আমার হিংসে হয়না বুঝি?”

” আর তুমি যখন বলো ছেলে পটাবে,সেটা কি? ”

” আমি তো মজা করে বলছি,”

” মজা না তামাশা ওসব আমি বুঝিনা।দোষ করছো শাস্তি পেতে হবে ”

মিষ্টি ঠোঁ’ট বাঁকিয়ে বললো ” কি শাস্তি?”

” হা করে থাকো,যতক্ষণ আমি না বলবো ততক্ষণ মুখ হা করে রাখবা ”

মিষ্টি চোখ বড়বড় করে বললো ” এইটা কেমন শাস্তি? ”

” চুপ,বলি নাই বেশি কথা বলবে না? ”

ধমক শুনে মিষ্টি মুখ হা করলো।প্রথম কয়েক সেকেন্ড মনে হলো এইটা কোনো শাস্তিই না।কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পার হলেই মিষ্টি হারে হারে বুঝতে পারলো হা করে থাকা খুবই কষ্টকর একটা বিষয়।চোয়াল ব্যাথা করতে শুরু করেছে।মিষ্টি হা করেই বলতে চেষ্টা করলো

” মুখ ব্যাথা করছে,এখন…..”

পুরো কথা শেষ না হতেই বিষন্ন আবার ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো।কিছুক্ষণ পর বললো ” শাস্তি থেকে বাঁচার একটা শর্ত আছে ”

মিষ্টি অস্ফুটে স্বরে বললো “কি?”

” আমি বসে থাকবো।আর তুমি নিজে এসে আমায় কিস করবা ”

মিষ্টি চোখ অন্যদিকে করে রইলো।এর অর্থ সেই শর্তে মিষ্টি রাজি নয়।কিন্তু চোয়ালের ব্যাথাও আর সহ্য করা যাচ্ছে না।বাধ্য হয়েই মিষ্টি মুখ বন্ধ করলো।বেশ কিছুক্ষণ মুখে হাত রেখে ব্যাথা প্রশমনের চেষ্টা করে তাকালো বিষন্নর দিকে।দেখলো বিষন্ন গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।মিষ্টির তাকানো দেখে বিষন্ন হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকলো।মিষ্টিও বাধ্য মেয়ের মতো উঠে দাড়ালো।এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বিষন্নর কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো।ঠোঁ’ট কাছে আনতেই নীলুর স্বর শুনতে পেলো,নীলু বলছে ” কিরে বিলু,তোরা এখানে? “।

নীলুর কথা শুনে মিষ্টি শক খাওয়ার মতো সরে দাড়ালো।চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো নীলুর দিকে।নীলু বুঝতে পারলো এখানে কি চলছিলো এতোক্ষণ। ঠোঁ’টে হাসি চেপে নীলু বললো ” তোদের রোমান্সের কি আর সময় পেলি না? আমার গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান, আর তোরা উপরে এসে রোমান্স করছিস? “।

নীলুর কথায় মিষ্টির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।দুইহাতে মুখ ঢেকে এক দৌড়ে নিচে চলে গেলো।যাওয়ার সময় টবের সাথে ধাক্কাও খেয়ে ” আউউউ ” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। নীলু বিষন্নর দিকে তাকিয়ে রাগি স্বরে বললো ” তোকে কি কোলে করে নিয়ে যেতে হবে?”

বিষন্ন মুখ ভোতা করে বললো ” দেখতে পাচ্ছিস না আমি লজ্জা পাচ্ছি? তুই আগে যা, তারপর যাবো,”

” এহহ,লজ্জায় ঢলে ঢলে পড়তেছে।যত্তসব ঢং ”

*

গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান শেষ পর্যায়ে।গিটার প্লে করে বিষন্ন গান গাইছে,আর সেই গানে পরিবারের সবাই নাচছে।দেখার মতো বিষয় হলো নীলুও নাচছে।প্রথম প্রথম লজ্জা পাচ্ছিলো,বারবার চলে যাচ্ছিলো,কিন্তু এখন আর লজ্জা পাচ্ছে না,কোনো সংকোচ ও লাগছে না,মনের আনন্দে কত সুন্দর সবার সাথে নাচছে।বিষন্ন গান গাইছে আর মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীলুর দিকে।কত সুন্দর লাগছে তাকে,মনে হচ্ছে রাজকন্যা।এই রাজকন্যার মতো বোনটা কাল চলে যাবে,আর তার সাথে ঝগড়া করতে পারবো না।এতোদিন দূরে থাকার পর যখন কাছে এলাম,তখনই আমার বোনটা চলে যাচ্ছে।

সবাই ঘুমুতে গেলো অনেক রাতে।মিষ্টি থেকে গেলো নীলুর সাথে।আজ রাতে তারা সব বান্ধবীরা একসাথে থাকবে।হাসিমজায় মেতে থাকবে আজ রাতের নীলুর ঘরটা।হয়তো কাল থেকে এই ঘরটা পড়ে থাকবে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে।আর নীলু অন্য একটা ঘর আলো করে সেখানে থাকবে।সেটাই গবে তার দ্বিতীয় বাড়ি।

চারটা বাজে।এখনো নীলুর ঘরে হি হি,হো হো করে হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে।তবে নীলুর খুব মন খারাপ লাগছে।তার ইচ্ছে করছে আজকের রাতটা বাবা,মায়ের মাঝে শুয়ে কাটাতে।নীলু উঠে বাবার দরজার সামনে দাড়ালো। দাঁড়াতেই চোখ ভিজে উঠলো অশ্রুতে।অশ্রু মুছে দরজায় কড়া নাড়তেই নীলুর মা দরজা খুললো।

” মা আজকের রাতটা তোমার সাথে শুতে দিবে?তুমি আমার চুলে বিলি কেটে দিবে আর আমি তোমায় জরিয়ে ধরে খুব খুব খুব কান্না করবো” এইসব কথা বলতে চেয়েও নীলু কিছুতেই বলতে পারলো না।মুখে হাসি এনে বললো

” তোমরা ঘুমাওনি? ”

নীলুর মা নীলুর মুখে আদর করে বললো ” না রে মা।মেয়ের বিয়ে,আনন্দে আমার চোখে ঘুম আসছে না ”

” বাবা কি করছে?”

” একটু আগে ঘুমিয়েছে, কিছু বলবি?ডেকে দিই?”

” না থাক,কিছু বলবো না।তুমিও ঘুমাও মা,”

বলেই নীলু চলে গেলো।নীলুর মা বিছানায় শুয়ে কাঁদছে। এই কান্না আনন্দের।তবে তার একটা ভুল ধারনা রয়েই গেলো।সে মনে করেছিলো নীলুর বাবা ঘুমাচ্ছে। কিন্তু তার ধারণা ভুল।নীলুর বাবা জেগে আছে।তিনিও নীরবে চোখের জল ফেলছেন।মেয়ের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা কেউ বুঝতেই পারলো না।মায়েরা নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে ভালোবাসে, বাবারা নিজের কষ্ট লুকাতে ভালোবাসে।

নীলু ঘরে গেলো না।ছাঁদে উঠে কিছুক্ষণ হাটতে ইচ্ছে করছে।ছাঁদে গিয়ে দেখলো আধো-অন্ধকারে কেউ দাড়িয়ে আছে।বেশ বুঝতে পারলো এটা বিষন্ন। নীলু নীরবে বিষন্নর পাশে দাঁড়ালো। বিষন্ন কাঁদছে। নীলুকে দেখে সে চোখের জল আড়াল করলো না,বিষন্নর কান্না দেখে নীলুর চোখের কোনেও জল জমতে লাগলো।বিষন্নর কাঁধে মাথা রেখে নীলু বললো

” আচ্ছা বিষন্ন বলতো,বাবা আমাদের কেমন ভালোবাসে? ”

বিষন্ন চোখের জল মুছে বললো ” বাবার ভালোবাসা কখনো আমি পাইনি,”

” বাবা আমাদের ভয়ঙ্কর রকম ভালোবাসে।আচ্ছা তুই বাবার চোখে জল দেখেছিস কখনো? ”

” বাবার চোখে জল? কক্ষনো না ”

” আমিদ দেখেছি,যখন আমায় সাজিয়ে দিচ্ছিলো তখন বাবা একটু পর পর আড়ালে দাঁড়িয়ে আমায় দেখছিলো,আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম বাবার চোখে জল।আমার কি মনে হয় জানিস? ”

“কি? ”

” মায়ের থেকে বাবা আমাদের বেশি ভালোবাসে ”

” কিভাবে বুঝলি?”

” বাবার ঘরে গিয়েছিলাম।কড়া নাড়তেই মা দরজা খুলে দিলো।বললো, বাবা ঘুমিয়েছে আর মা নাকি জেগে আছে। এটা কি তোর বিশ্বাস হয়?”

” হু হয়,”

” তুই এখনো ছোট আছিস রে বিলু,”

” মানে?”

” আমি জানি,এতো রাত অব্ধি মা জেগে ছিলো না।আমার কড়া নাড়ার শব্দে জেগে উঠেছে।অথচ বললো জেগেছিলো।বাবা নাকি ঘুমিয়েছে,অথচ আমার মনে হয় বাবা জেগে আছে,হয়তো কান্না করছে।সেই কান্না একজন মেয়ে হয়ে আমি বুঝতে পেরেছি ”

” তোকে খুব মিস করবো রে ”

” ধূর বোকা, কাঁদিস না তো।তোরা কাঁদলে আমি কিভাবে ঠিক থাকবো বলতো? ”

বিষন্ন কিছু বললো না।নীলুকে জরিয়ে ধরে কাদছে।নীলুও কাঁদছে।দু’ভাই বোন যেন কান্নার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

*

দুপুর একটা বাজে।মিষ্টি মনে মনে বিষন্নকে খুঁজছে কিন্তু পুরো বাড়িতে কোথাও বিষন্নকে পাওয়া গেলো না।কয়েকবার ফোন দিলে ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। মিষ্টির কেন জানি খুব ভয় হচ্ছে,মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে গেছে।বিষন্নর বাবাকেও কেমন যেন গম্ভীর দেখাচ্ছে, তিনি সকাল থেকে ছাদে বসে আছেন।কারোর সাথে কথা বলছেন না……

চলবে?#তোমায়_চেয়েছি_পুরোটাই
#পার্টঃ৪৮
#জয়ন্ত_কুমার_জয়

মিষ্টির অস্থির মন আরো অস্থির হয়ে পড়ছে ক্রমশ।বিষয়টা জানার জন্য এল পা এক পা করে ছাঁদের দিক যাচ্ছে মিষ্টি। তার কেন জানি মনে হচ্ছে সে যা শুনবে সেটা খুব ভয়ঙ্কর কোনো কথা।ছাদে গিয়ে দেখলো বিষন্নর বাবা ইজি চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন।তার মুখে হতাশার ছাপ। মিষ্টি কাছে গিয়ে কোমল গলায় বললো

” আঙ্কেল কেমন আছো ”

বিষন্নর বাবা চোখ মেললেন।মিষ্টিকে দেখে তিনি খানিকটা নড়েচড়ে বসলেন।চশমা ঠিক করতে করতে বললেন

” ভালো আছি মা,তুমি এখানে, কিছু বলবে? ”

” জি বলবো ”

” বলো ”

” আঙ্কেল আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কোনো একটা গন্ডগোল হয়েছে,কিছু একটা নিশ্চই হয়েছে,সেটা আমি জানতে চাই ”

তিনি ইতস্তত করে বললেন ” কি আবার হবে?সব তো ঠিকটাক ই আছে,সব ঠিকঠাক ”

” না আঙ্কেল,কিচ্ছু ঠিকঠাক নেই,তুমি খুবই চিন্তায় আছো।এক কথা দু’বার বলছো ”

তিনি উঠে দাঁড়ালেন।স্বাভাবিক ভাবেই বললেন ” মেয়ের বিয়েতে বাবার চিন্তা তো থাকবে,এটাই স্বাভাবিক ”

” আমায় প্লিজ বলো না,কি হয়েছে? আমি কথা দিচ্ছি কাউকে বলবো না ”

তিনি চশমা সরিয়ে মিষ্টির দিকে তাকালেন।মিষ্টি অবাক হয়ে দেখলো তার চোখে জল,তিনি কাঁদছেন।মিষ্টি ব্যাকুল হয়ে বললো

” আঙ্কেল কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো তুমি? ”

তিনি চোখের জল মুছে বললেন ” নীলু কি করছে? ”

” ও হাতে মেহেদী দিচ্ছে, ”

” ও খুব খুশি, তাই না? ”

” হু,প্রচন্ড খুশি।কিন্তু কি হয়েছে সেটা বলবে? ”

” সমুদ্র ফোন করেছিলো, বলেছে আজকেই তার ফ্লাইট ”

” তারমানে বিয়ে করে আজ রাতেই চলে যাবে? ”

” না,সে একাই যাবে।বলেছে সে নীলুকে বিয়ে করতে পারছে না,আমি যেন ওকে ক্ষমা করে দিই ”

কথাটা শুনে মিষ্টি প্রচন্ড ধাক্কার মতো খেলো।তার মানে কি? সমুদ্র ভাইয়া তাহলে বিয়ে করতে আসবে না?কিন্তু কেন?যদি না আসে তাহলে নীলুর কি হবে? এই ব্যাথা তো নীলু কিছুতেই সামলাতে পারবে না।মিষ্টি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।বিষন্নর বাবা শিশুদের মতো রেলিং ধরে কান্না করছেন।মিষ্টি কি করবে বুঝতে পারছে না।বিষন্নর বাবার পিঠে হাত রেখে বললো

” তাহলে তো আমাদের কিছু করার দরকার,ওনাকে আটকানো প্রয়োজন।সবটা তো এতো সহজেই শেষ হয়ে যেতে পারে না ”

” তা সম্ভব নয়,আর আধাঘন্টা পরেই ওর ফ্লাইট।বিষন্ন গিয়েছে ওকে নিয়ে আসতে।মনে হচ্ছে তাতে কোনো লাভ হবে না ”

মিষ্টি চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখছে।আর তো কিছুক্ষণ বাদেই বিয়ে।এই খবরটা নীলু জানলে বেচারি সহ্য করবে কিভাবে এই ভেবে মিষ্টির হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।মিষ্টি ক্ষীণ স্বরে বললো

” আঙ্কেল আমাদের বিষয়টা তো বাড়ির সবাইকে জানানোর প্রয়োজন ”

” আগেই কিছু বলার প্রয়োজন নেই,দেখি বিষন্ন কিছু করতে পারে কি না ”

” আমাদের পুলিশকে খবর দেওয়া উচিত,শুধু বিষন্ন তো কিছু করতে পারবে না ”

” আমি তাদেরকেও বলেছি ”

মিষ্টি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বিষন্নর বাবা চোখ মুছতে মুছতে বললেন ” মিষ্টি মা,তুমি নীলুর কাছে যাও,এইসবের কিছু আগেই কাউকে বলার প্রয়োজন নেই ”

নীলু কিছু না বলে নীরবে চোখের জল মুছে চলে এলো নীলুর ঘরে।খয়েরী রঙের লেহেঙ্গাতে নীলুকে পরীর মতো লাগছে।মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা পরী ঘরে বসে আছে।মিষ্টির খুব কান্না পাচ্ছে নীলুর জন্য।কান্না আঁটকে মিষ্টি নীলুকে দেখছে। নীলু হাসছে,সবসময়ই হাসছে।নীলুকে এতো খুশি এর আগে কখনো দেখা যায়নি।মিষ্টিকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীলু চোখের ইশারায় কাছে ডাকলো।মিষ্টি স্বাভাবিক ভাবেই কাছে এসে দাঁড়ালো।নীলু বললো

” তুই এখনো এভাবে ঘুরছিস কেন?তোকে তো কাজের মেয়ের মতো লাগছে।সাজবি কখন? ”

মিষ্টি হেসে বললো ” এইতো এখনি সাজবো।তোর হাতের মেহেদী দেওয়া শেষ দেখছি! ”

” হু,তবে ওরা দিতে পারেনি,বেশ কয়েকটা যায়গায় থ্যাবড়া বানিয়ে ফেলেছে।লিখতে বলেছিলাম এস+এন।আর ওই গাধা মহিলা এমন ভাবে এস লিখেছে যে দেখে মনে হচ্ছে নয় লিখেছে।”

নীলু অপ্রয়োজনীয় কথা বেশি বলছে।তাকে দেখেই মনে হচ্ছে চিরসুখের সময়টা সে পার করছে।অথচ সে জানতেই পারছে না তার সাথে যে ছেলেটার বিয়ে হবে সে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে ভিন্ন একটা দেশে রওনা দিচ্ছে।এই খবর শোনার ওর নীলুর অবস্থাটা কেমন হবে?সে কি হাউমাউ করে কাঁদবে? না চোখ মুখ স্থির করে বসে থাকবে, কোনটা? অধীক কষ্টে নিশ্চই কেউ কখনো হাউমাউ করে কাঁদে না।

বিষন্নদের বাড়িটা যেন একটা মৃত বাড়ি হয়ে ওড়ে আছে।এরমধ্যেই বিষন্নর মা’কে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে।তার জ্ঞান ফেরা মাত্রই চিৎকার করে নীলু বলে আবারো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।বিষন্নর বাবা একটার পর একটা কল করছে।বিয়েতে উপস্থিত সবাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।মিষ্টি সোফায় বসে আছে,তার সাথে বসে আছে তার বান্ধবীরাও।নীলুকে তেমন উত্তেজিত লাগছে না।সে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বিয়ের সাজে রান্নাঘরে গিয়ে চা বানাচ্ছে,গুনগুগ করে গানও গাইছে।এই দেখে মিষ্টি বেশ ভয়ে ভয়ে আছে, সবসময় দূর থেকে নীলুকে নজরে রাখছে।নীলুর সাথে থাকতে চাইলে নীলু বললো ” আমি একদম ঠিক আছি,তোমরা চিন্তা করো না,আমি বিষ টিস খাওয়া,আ’ত্নহ’ত্যা এইসব করবো না।আমার খুব চা খেতে ইচ্ছে করছে।বাবা তুমি চা খাবে?”।নীলুর কথায় বিস্মিত হয়ে নীলুর বাবা হ্যাসূচক মাথা নাড়লেন।তারপর থেকেই নীলু রান্নাঘরে গিয়ে চা বানাচ্ছে। নীলুর ভেতরের অবস্থাটা মিষ্টি বুঝতে চেষ্টা করছে।এই কষ্ট আদৌও কি বোঝা সম্ভব?

নীলু এখন অব্ধি স্বাভাবিক। সবাইকে চা দিচ্ছে। নিজেও দুই কাপ চা খেয়ে একটা উপন্যাসের বই খুলে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।নীলুর এই স্বাভাবিক কর্মকান্ড সবার কাছে প্রচন্ড অস্বাভাবিক লাগছে।অধীক কষ্টে কি নীলুর কষ্ট পাওয়ার অনুভূতিই নষ্ট হয়ে গেছে? নইলে এতো স্বাভাবিক আছে কিভাবে?।

মিষ্টির কানে বিষন্নর বাবার ধমকের স্বর ভেসে আসছে।তিনি তিব্র রাগি স্বরে ফোনে বলছেন ” একজন মানুষকে আপনারা খুঁজে বের করতে পারেন না? কিসের পুলিশ আপনারা “।মিষ্টি কাছে গিয়ে বিষন্নর বাবাকে বললো

” আঙ্কেল,কিছু জানতে পারলে? ”

তিনি দুঃখিত গলায় বললেন ” মনে হচ্ছে আর সম্ভব না ”

” আঙ্কেল নীলু কিন্তু প্রচন্ড মানষিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, আমি বুঝতে পারছি ও এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক আছে কিভাবে। ওর আশেপাশে কাউকে থাকতে দিচ্ছে না,শুধু বারবার বলছে ও ঠিক আছে,ওর কিচ্ছু হয়নি ”

” ওই ছেলেকে আমি ছাড়বো না।আমাকে চিনে না ওই ছেলে,ওর জীবন আমি শেষ করে ছাড়বো ”

” আঙ্কেল এখন উত্তেজিত হওয়ার সময় না।বিষন্নকে ফোনে পেয়েছো? ”

” না, ওই গাধার ফোন তখন থেকে বন্ধ ”

” পুলিশ ও কিছু করতে পারলো না? ”

” যতক্ষণে পুলিশ স্টেপ নিয়েছে তার আগেই ফ্লাইট ছেড়ে দিয়েছে, এদের দারায় সময় মতো কিচ্ছু হয় না।আমেরিকা তাই না,ওর এমন ব্যবস্থা করবো যে সারাজীবন আমেরিকার জেলে পঁ’চে ম’রতে হবে। আমায় চিনে না,এইবার চিনবে ”

কথাবার্তার এই পর্যায়ে এসে হাসির শব্দে বিষন্নর বাবা,মিষ্টি সহ উপস্থিত মিষ্টির বান্ধবীরা সবাই চমকে তাকালো দরজার দিকে।তারপর যা দেখলো সেটা দেখে স্থির থাকার মতো অবস্থা রইলো না।সবাই দেখছে সমুদ্রর কাঁধে হাত রেখে বিষন্ন আর সমুদ্র হাসতে হাসতে আসছে।বিষন্নর বাবা ফোন নামিয়ে রেখে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন।তাকে দেখে বিষন্ন, সমুদ্র দু’জনই হাসি বন্ধ করলো।সমুদ্র এসে বিষন্নর বাবার পায়ে কদমবুসি করলো।মিষ্টির কাছে পুরো বিষয়টা যেন একটা ঘোরের মতে লাগছে।বিষন্নর দিকে তাকাতেই বিষন্ন হেসে চোখ টিপ দিলো।রান্নাঘর থেকে নীলু বেড়িয়ে এলো হাতে চায়ের কাপ নিয়ে।সমুদ্রকে দেখে নীলু স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো।উপস্থিত সবাই যেন থেমে আছে,সময় যেন অনন্তকালের জন্য হঠাৎ থেমে গেছে।এতোক্ষন বাদে নীলুর চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে মেঝেতে পড়লো।

*

সমুদ্র বুঝতে পারছে না নবু বধুর কান্নাকে কিভাবে থামাতে হয়।বাসর ঘরে আসা থেকেই সে দেখছে নীলু পাগলের মতো কাঁদছে।নীলুর সামনে হাটুমুড়ে বসে দুই হাতে মুখ চেপে রেখে ভয়ঙ্কর এই কাঁদার দৃশ্য সমুদ্র দেখছে।নীলুর এই কষ্টকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো শব্দই বাংলা অভিধানে এখনো যুক্ত হয়নি।সমুদ্র বেশ মনোযোগ দিয়েই নীলুর কান্নার দৃশ্য দেখছে।খুব যে খারাপ লাগছে তা না।কাঁদুক না,এই কান্নাই হবে তার শেষ কান্না।সমুদ্র নীলুর দিকে চেয়ে প্রতিজ্ঞা নিলো, আর যাই হয়ে যাক,নীলুর চোখে সে কখনো জল আসতে দিবে না।শেষ বারের মতো মিষ্টি একটা মেয়ে,যে এখন তার স্ত্রী,তার কান্না অপলকে দেখছে সমুদ্র।

মাঝরাতে বাড়িতে আবারো যেন ভোরের হাওয়া বইতে লাগলো।বিষন্নর বাবা গাড়ি পাঠিয়ে সব আত্নীয়দের নিয়ে এসেছেন।বিষন্নর মা’কেও দেখা যাচ্ছে হাসি মুখে চা বানাচ্ছেন।বক্সে ফুল সাউন্ডে রোমান্টিক গান বাজছে।মৃত বাড়িটার মধ্যে আবারো যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

বিষন্নর ঘরে ঢুকে মিষ্টি ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলো।বিষন্ন লাইটের আলোতে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো মিষ্টির দিকে।মিষ্টির প্রথমে ইচ্ছুক করছিলো বিষন্নকে খুব করে বকে দিতে যে কেনো ফোন বন্ধ করে রেখেছিলো।কিন্তু সেই রাগ বেশিক্ষন টিকলো না।বিষন্ন বিছানায় শুয়ে আছে, তার ওপরেই মিষ্টি লাফিয়ে পড়লো।দু’জনার মাথা একসাথে লেগে দু’জনই বেশ ব্যাথা পেলো।মাথায় হাত রেখে মুখ বিকৃত করে দু’জনই হাসলো।মিষ্টি আনন্দ সামলাতে না পেরে বিষন্নকে জড়িয়ে ধরলো।বিষন্ন ছাড়িয়ে দিয়ে বললো

” এই কি করছো তুমি,বিয়ের আগে এইসব করা একদম ঠিক না ”

” করবো,একশো বার করবো,হাজার বার করবো।এদিকে আয়, তোর গালে একটা চু’মু দিয়ে দিই ”

বিষন্নর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বিষন্নর মুখ টেনে নিয়ে গালে চু’মু দিয়ে মিষ্টি বললো

” এই প্রথম তুই একটা কাজ করেছিস,উফফ আমি যে আজ কি খুশি,চল নাচবো ”

বিষন্ন চোখ বড়বড় করে বললো ” আসার সময় কো’মড়ে ব্যাথা পাইছি,নাচতে পারবো না।একটা কাজ করো,কো’মড়টা মালিশ করে দাও ”

মিষ্টি মলমটা হাতে নিয়ে বিষন্নর ওপর চড়ে বসলো।কো’মড়ে মলম দিতে দিতে বললো

” আচ্ছা বিষন্ন, তুই সমুদ্র ভাইকে কোথায় পেলি? আঙ্কেল তো পুলিশকে জানিয়েছিলো,তারাও পায়নি ”

” এরকম হাজারটা সমুদ্রকে খুঁজে বেড় করা আমার কাছে কোনো ব্যাপার নাকি? ”

*

” তার মানে তুমি জবটা ছেড়ে দিয়েছো? ”

নীলুর কথায় সমুদ্র হেসে বললো ” হু,শুধু ছেড়েই আসিনি,দুই সালা আর জামাইবাবু মিলে বারোটা বেজে দিয়েছি ”

” মানে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ”

” এক কাজ করো,দুই কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় আসো,তারপর সবটা বলবো।এতক্ষণ কান্না করে নিশ্চই গলা ব্যাথা করছে,তাই না? ”

নীলু কিছু বললে না।মুচকি হেসে গেলে চা আনতে।ট্রে-তে করে দুই কাপ চা নিয়ে বারান্দায় দু’জন বসলে।সমুদ্র বললো, দুইটা কাপ কেন? আজ থেকে একটা কাপেই দু’জন খাবো,এতে ভালোবাসা বাড়ে, বুঝছো?।

দু’জনই একটা কাপে চুমুক দিচ্ছে।প্রথম চুমুক দিলো নীলু,কাপে নীলুর লিপস্টিকের হাল্কা দাগ ওড়লো,সমুদ্র খুব তীক্ষ্ণ চোখে সেই দাগ পর্যবেক্ষন করে সেই যায়গাতেই ঠোঁ’ট লাগিয়ে চুমুক দিলো।এটা দেখে নীলু লজ্জায় সমুদ্রের বু’কে মাথা রাখলো।সমুদ্র বলা শুরু করলো

” তোমার সাথে কথা বলার পর পরই চলে গেলাম অফিসে।অফিস থেকে আসতে বলেছিলো।গিয়ে বুঝতে পারলাম আজকেই আমার যেতে হবে।বিয়েতে যেন না করে দিই।আমি রাজি হলাম না।বললাম আমার চাকরির প্রয়োজন নেই।তখনি জুনায়েদ নামের ছেলেটা পেছন থেকে একটা পিস্তল বেড় করলো। বিয়ে করতে পারবো না, এটা বলাতে বাধ্য করালো। ওখানে দাঁড়িয়েই আমি তোমার বাবাকে,মানে আমার শ্বশুর মজাইকে ফোন করে বললাম আমি বিয়েটা করতে পারছি না। ”

নীলু বিস্মিত স্বরে বললো ” থামলে কেনো? তারপর? ”

” তারপর ওখান থেকে চলে আসলাম বাড়িতে।বাড়িতে এসে আমার সালাবাবুকে ফোন করে পুরো বিষয়টা বললাম।ফোন পেয়ে সালাবাবু চলে আসলো আমার বাড়িতে।জুনায়েদের নাম বলতেই সে অনেক কিছু বললো।তার সাথে নাকি জুনায়েদের পূর্বের শত্রুতা আছে।তখনি বিষয়টা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলাম।বিয়ের দিন কোনো ঝামেলা করতে চাচ্ছিলাম না,কিন্তু তোমার ছোটো ভাইকে কে আটকাবে?এইসব শুনে তো ও প্রায় পাগল পাগল হয়ে গেলো।শুধু বলতে লাগলো,কি হয় হবে,সে জুনায়েদকে ছাড়বে না।আমি অনেক বুঝালাম যে আজকে কোনো ঝামেলায় না যেতে, কিন্তু কে শোনে কার কথা।বাধ্য হয়েই আমি ফোন করলাম পুলিশকে ”

সমুদ্রের বু’ক থেকে মাথা তুলে নীলু বললো ” পুলিশ কেন? ”

সমুদ্র ভ্রু কুচকে বললো ” বলছি তো,কথার মাঝে ডিস্টার্ব করলে বলার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়।চুপ থাকো ”

নীলু মুখ ভোতা করে বললো ” জানতে না চাইলে পুরোটা বুঝবো কিভাবে? ”

সমুদ্র এখনো ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে নীলুর দিকে।সমুদ্রর তাকিয়ে থাকা দেখে নীলু বললো ” সরি,আর কথা বলবো না,তুমি শুরু করো ”

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here