তোমায় ছোঁয়ার ইচ্ছে পর্ব -২৭+২৮

#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_২৬
#সুমাইয়া_মনি

হলুদের অনুষ্ঠান হচ্ছে। একে একে সবাই হলুদ দিচ্ছে সিমাকে। রাদ ও মুরাদ স্টেজের অপর প্রান্তে সোফায় বসে রয়েছে। তার পাশেই বসেছিল রেহানা আনসারী। ইসানা কাল তাকেও নিমন্ত্রণ করেছে। সুরভী খাতুন তাকে সময় দিচ্ছে। দু’জনে খোশগল্পে মসগুল। অন্য পাশে অতিথিদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে কাজকর্ম লিয়াকত আলী ও মানিক সামলাচ্ছে। সিমা স্টেজে বসে ইসানাকে কাছে ডাকে। তার কাছে এগিয়ে গেলে গালে হলুদ লাগিয়ে দেয় মজার ছলে। ইসানা এক চিনটি হলুদ নিয়ে কপালে ছুঁয়ে দেয়। সিমার সঙ্গে সেখানে বসে সুন্দর কিছু ছবি ক্লিক করে। রাদ দূর থেকে ইসানাকে দেখছিল। শেষ বসা থেকে উঠে স্টেজের নিকট এগোয়। রাদকে আসতে দেখে ইসানা উঠতে চাইলে সিমা হাত ধরে বসিয়ে রাখে। আস্তেধীরে নিজেকে ছাড়ার কথা বললেও সিমা ওঁকে ছাড়ে না। রাদ সিমার মুখোমুখি দাঁড়ায়। আলতো ঝুঁকে এক চিমটি হলুদ নিয়ে সিমার কপাল ছোঁয়। পকেট থেকে একটি ডায়মন্ডের রিং বের করে সিমাকে উপহার দেয়। যাওয়ার পূর্বে ইসানার চোখের দিকে চেয়ে মৃদুহেসে বলে,
‘আপনাকে সুন্দর লাগছে!’
ইসানা লজ্জায় নজর সরিয়ে ফেলে। সিমার সামনে বলাতে আরো বেশি লজ্জা অনুভব হয়। ফিসফিস করে সিমা ইসানার কাছে জিজ্ঞেস করে,
‘এটা দুলাভাই নাকি আপু?’
রাগান্বিত চোখে তাকাতেই সিমা ছোট্ট করে জবাব দেয়,’ স্যরি আপু।’
ইসানা স্টেজ থেকে নামে। রাদ, মুরাদ, সোহানা ও রেহানা আনসারী দের ঘরেই খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। একত্রে খেয়ে তারা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। মুরাদ আজ রাদের বাড়িতেই নিশিযাপন করবে। সোহানাকে রেখে দেয় ইসানা। বাড়িতে যেতে দেয় না। রাতে সিমাকে মেহেদী পড়ানো হয়।
বোনের বিয়ের উপলক্ষে ইসানা নিজেও মেহেদী পড়ে দু হাত রাঙিয়ে। গভীর রাত হয়ে যায় মেহেদী লাগাতে লাগাতে।
সিমা ঘুমানোর আগে তার হবু স্বামীর সঙ্গে আলাপন সেরে নেয়। তিনজন একত্রে ঘুমায়। খুব কাছের আত্মীয়-স্বজনরা পাশের রুমটিতে ঘুমিয়েছে।
সকালে সবার আগে ইসানা ঘুম থেকে উঠে। সিমাকে গোসল করিয়ে পার্লারে পাঠায়। এখন তার আর কোনো কাজ নেই। বাকি কাজ সব সেন্টারের লোকদের।
ইসানা কিছুক্ষণের জন্য ফুরসত পেয়ে যায়। কাল রাতের তোলা ছবি গুলো দেখতে থাকে সোহানার ফোনে। তখনই তার ও রাদে পরস্পর দৃষ্টি প্রেক্ষাপটের দৃশ্যটি দেখতে পায় চিত্র আঁকারে। কিছুক্ষণের জন্য ছবিটির পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলেও পরক্ষণে কটমট চোখে তাকায় সোহানার দিকে।
সোহানা বুঝতে পেরে ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে নেয়। দাঁত বের করে হেসে কেঁটে পড়ে। ইসানা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
বাড়ির বাকি কাজকর্ম গুলো সেরে ইসানা রেডি হয়ে সেন্টারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।
একটার দিকে সিমা পার্লার থেকে ফিরে। ওঁকে নিজ হাতে খাইয়ে নিজেও খেয়ে নেয়। ইতিমধ্যে আত্মীয়দের খাওয়াদাওয়া অর্ধেক প্রায় শেষ। বরপক্ষের আসার সময় হয়েছে। ইসানা স্টেজ থেকে নেমে সেন্টারের বাহিরে এসে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কারণ এখনো রাদ ও মুরাদ আসে নি। রেহানা আনসারী আধা ঘণ্টা হলো এসেছেন। কল দিবে কি দিবে না ভেবে দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায়। শেষে মুরাদকে কল দিতে উদ্যত হতেই রাদের নাম্বার থেকে কল আসে। ধক করে উঠে ইসানার বুক। সেকেন্ড কয়েক ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে কল পীক করে।
‘হ্যালো?’
অপর পাশ থেকে গুরুগম্ভীর আওয়াজ ভেসে আসে,
‘গ্রিন গার্ডেন হোটেলের ৩০২ নাম্বার রুমে চলে আসুন।ওয়েটিং ফর ইউ!’ ইসানাকে বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দেয় রাদ। ইসানা মিনিট কয়ে চুপ থেকে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে তিনটা বেজে ছত্রিশ মিনিট। বরপক্ষ আসলো বলে। এই মুহূর্তে সেন্টার ত্যাগ করলে মামা-মামী খুঁজে বেহাল হয়ে যাবে। তবুও রাদের নির্দেশ সে অমান্য করতে চায় না। নেহাৎ তার আন্ডারে কাজ করে বলে। ভেতরে এসে মামিকে বলে বাহিরে এসে দ্রুত রিকশায় চড়ে বসে। রওয়ানা হয় গ্রিন হোটেলের উদ্দেশ্যে।
.
‘রাদ এটা কি আদৌও ঠিক হবে? যেখানে আন্টির কোনো আপত্তি নেই। সেখানে এসব করা অহেতুক!’ মুরাদ সরস স্বরে বলল রাদকে।
‘আমি আমার জেদ এবং কথা রাখতে চাই। যেটা আমি আগেই জানিয়ছিলাম তাকে।’ রুক্ষ ভাষায় বলল রাদ।
‘কথা নয়, জেদ বল। তোর জেদের বশে বড়ো মসিবতে না পড়িস পরে!’
রাদ প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। মুরাদ বিরক্ত হয়ে বলল,
‘যা করার কর আমি গেলাম।’ বলে রুম প্রস্থান করল। মুরাদ চলে যাওয়ার তিন মিনিট অতিবাহিত হতেই ইসানা কক্ষে প্রবেশ করে। রাদ তখন সোফায় বসে ছিল। ইসানাকে আপাদমস্তক দেখে নেয়। ব্লু রঙের লেহেঙ্গা সঙ্গে হালকা পরিপাটি সাজসজ্জা আদলে। দেখতে চমৎকার লাগছে।
ইসানা রাদের চোখের পানে চেয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
‘এখানে ডেকে আনার কারণ জানতে পারি কী?’
রাদ তার পাশের টি-টেবিল থেকে একটি পেপার হাতে নিয়ে ইসানার দিকে তুলে ধরে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘পেপারটি পড়ে সাইন করে দিন।’
ইসানা হাত থেকে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পেপারগুলো পড়ে। হঠাৎ সে নিজেকে শূন্য অনুভব করে। মাথায় যেন বিশাল বড়ো আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। চোখেমুখে ক্রোধ নিয়ে তেজি কণ্ঠে বলল,
‘এসবের মানে কি?’
‘কাবিনের পেপার পড়ে এখনো বুঝতে পারেন নি মানে কী?’
‘নাহ! ক্লিয়ার করে বলুন।’
‘কোট ম্যারেজ হবে আমাদের। সাইন করুন সানা।’
‘অসম্ভব! আপনি কীভাবে ভাবলেন আমি এই পেপারে সাইন করব?’
‘খুব সহজেই বুঝে নিয়েছি। আপনাকে ছোট্ট একটি গল্প বলি। একটি মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। বেশ ধুমধাম করে। গায়ে হলুদ শেষ। পরদিন বরপক্ষে আসবে। হঠাৎ জানা গেল বরপক্ষ কোনো কারণে আসবে না। বিয়েটা ক্যান্সেল হয়ে যাবে। তখন বউ সাজ সজ্জিত সেই মেয়েটির কী হবে? সমাজে তার স্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সবাই তাকে কটুক্তি করবে, অসম্মান করবে। নিচু চোখে দেখবে সে-ই পরিবারকে।’
‘আমাকে কেন বলছেন এসব?’ উগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ইসানা।
রাদ ইসানার চোখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ক্ষীণ হেসে বলল,
‘সেইম ঘটনা যদি আপনার মামাতো বোনের সঙ্গে ঘটে? অথবা সে-ই পরিবারটি যদি আপনার হয়, তখন?’
ইসানার দম বন্ধ হয়ে আসছে রাদের কথা শুনে। শরীর ঈষৎ কেঁপে উঠে। কাঁপা গলায় ঘনঘন চোখের পলক ফেলে বলল,
‘কী বলতে চাইছেন আপনি?’
‘সিম্পল! যদি পেপারে সাইন না করেন তাহলে সেইম ঘটনা ঘটবে আপনাদের সঙ্গে।’
‘আপনি এভাবে আমাকে ফোর্স করতে পারেন না।’
‘আমি আপনাকে ফোর্স করছি না। জাস্ট যেটা হওয়ার সেটা উল্লেখ করছি সহজ ভাবে।’
চোখের জলে ঘোলাটে হয়ে আসছে চোখ তার। বাকরূদ্ধ সে! বরপক্ষদের দেরিতে আসার পিছনে রাদের কূটকৌশল রয়েছে এটা তার বুঝতে অসুবিধা হয় না। কর্কশ গলায় বলল,
‘আপনি এটা করতে পারেন না।’
‘রাদ কি করতে পারে, সেটা এখনো আপনার অজানা! বরপক্ষ আসে নি তাই না? আসবে বলে মনে হচ্ছে না।’ ঘাড়ে দ্রুত হাত চালিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল রাদ।
ইসানার চোখের জল এইবার গাল বেয়ে পড়ে। ঠোঁট বরাবর আসতেই মুছে নিয়ে অনুরোধ স্বরে বলল,
‘এমনটা করবেন না। আমার ছোট বোনের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।’
‘করব না। সাইন করে দিন তাহলে!’ দু কাঁধ উঁচু করে বলল সে।
‘আপনার আমার বিয়ে হয় না, হতে পারে না। ঠিক না।’
‘অহেতুক কথাবার্তা শুনতে ইচ্ছুক নই। সাইন করলে, তবেই বরপক্ষের গাড়ি সেন্টারে পৌঁছাবে।’ নাকের পাটা ফুরিয়ে বলল রাদ।
ইসানার চোখ থেকে ঘনঘন জল ঝড়ছে। দৃষ্টি নত রেখে মৌনব্রতে মন দোটানায় পড়ে রয়। ফোনের রিংটোনের শব্দে মৌন্যতা কেটে যায় তার। স্ক্রিনে কলদাতার নাম দেখে নিজেকে স্বাভাবিক বানিয়ে ফোন পীক করে,
‘মামি বলো।’
‘আসছিস না কেন? এখানে তুই নেই, বরপক্ষ’রা আসছে না। তোর মামা অস্থির হয়ে আছে।’ বিচলিত কণ্ঠে বললেন সুরভী খাতুন।
‘আমি আসছি।’ ছোট্ট জবাবে ফোট রেখে দেয়। দৃষ্টি স্থাপন রাখে পেপারের দিকে। অতিরিক্ত কান্না চাপিয়ে রাখায় ঠোঁট কেঁপে উঠে তার। প্রথম বিয়েতে জোরপূর্বক কবুল বলতে হয়েছিল। আর এখন সেটাই হচ্ছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে দ্বিতীয় বারের মতো হার মানতে হবে। তার বোনের জন্য! দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চোখ বুঁজে নেয় সে। রাদ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে ছিল বিধায় ইসানার মায়াময় অশ্রুসিক্ত আদল নজরে আসে নি। সে বেশ আটঘাট বেঁধে তবেই নেমেছে। ইসানাকে নিজের করার জে’দ রক্ষার্থে সে যে-কোনো কিছু করতে প্রস্তুত আছে!
গাল বেয়ে আসা অশ্রুটুকু মুছে হাতে কলম তুলে নেয়। কাঁপা হাতে নিজের নামের অক্ষরটি সুস্পষ্টভাবে লিখে দেয়। রাদ নজর তাক করে ইসানার হাতের ওপর। লেখা শেষে ইসানা চলে যেতে উদ্যত হতেই রাদ থামিয়ে ফোন টেবিলের ওপর রেখে এগিয়ে যায়। ইসানার মুখোমুখি হয়ে কোটের পকেট থেকে আংটিটি বের করে অনামিকা আঙুলে পড়িয়ে দেয়। ইসানা নিরব দর্শকের মতো চেয়ে দেখছে। তার বুকের অনুভূত মৃ’ত! আচমকাই যেন তার মৃ’ত্যু ঘটেছে।
রাদ ইসানার আঙুলের ওপর নজর রেখে কোমলভাবে বলল,
‘বলেছিলাম রিজেক্ট করা জিনিসের ওপর ঝোঁক একটু বেশিই আমার। আজ থেকে আপনি আমার লিগ্যাল ওয়াইফ মিসেস.সানা আনসারী। আই এম ইউ’র লিটেল হাসবেন্ড রাদ আনসারী।’
ইসানা চোখ জোড়া শক্ত করে বুঁজে নেয়। পরক্ষণে রাদের পানে ক্রুদ্ধা দৃষ্টি ফেলে বলল,
‘বিয়ে নয়, এটাকে ব’লি’দা’ন বলে। নিজেকে আপনার কাছে ব’লি’দা’ন করেছি।’ হাত ঝামটা দিয়ে সরিয়ে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে। এতক্ষণ কান্না আঁটকে রাখলেও এখন বাঁধভাঙা অশ্রু বর্ষিত হচ্ছে নয়ন জুড়ে। উঁচু স্বরে কাঁদতে কাঁদতে হোটেল থেকে বেরিয়ে যায়। আশেপাশের লোকজন তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালেও এতে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
ইসানা সেন্টারে পৌঁছাবার পর পরই বরপক্ষের গাড়ি উদয় হয়। সবাই নতুন জামাইকে বরন করার জন্য এগিয়ে যায়। ইসানা ফাঁকা স্থানে নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখনকার রেশ এখনো কাঁটেনি। যেন সব দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। কিন্তু নাহ! বাস্তবে ঘটেছে এমন। ছোট বোনের আগে তার বিয়ে হয়েছে। তার চেয়ে দু’বছর কম একটি যুবকের সঙ্গে। কিছুক্ষণ বাদে গেট থেকে সব মেহমান সরে যায়। আগত হয় রাদ। ইসানার ব্লু লেহেঙ্গার সঙ্গে ম্যাচিং করে গর্জিয়াছ পাঞ্জাবি, পায়জামা পড়েছে। তার সুদর্শন লুক দেখে বাকিরা মোহিত হলেও ইসানার অনীহা লাগছে। নজর সরিয়ে নিতেই সোহানা তার পার্শ্বস্থিত দাঁড়ালো। হাসিমুখে বলল,
‘বাহ! রাদকে দেখতে নয়া জামাই, নয়া জামাই লাগছে।’
ইসানার বিতৃষ্ণা চলে আসে জামাই শব্দটিতে। দ্রুত অন্য পাশে সরে দাঁড়ায়। এবং দূর থেকেই তার মামাতো বোনের বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ সচক্ষে দেখে। একটি মেয়ের জীবনে বিয়ে নিয়ে কতশত স্বপ্ন থাকে৷ কিন্তু তার জীবনে বিয়ে নামক শব্দটি বিষের সমতূল্য!
.
.
.#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_২৭
#সুমাইয়া_মনি

সেন্টারের পরিবেশ থমথমে সৃষ্টি হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে সিমাকে বিদায় জানিয়েছে সকলে। মেয়েকে বিধায় জানানোর সময় আবেগে কেঁদে ফেললেন সুরভী খাতুন ও লিয়াকত আলী। মানিকের চোখেও জল জমেছিল। ইসানা তাদেকে সান্ত্বনা দেওয়ার বশে নিজের চোখের জলকে লুকায়িত রেখেছে। সিমার বিদায়ের সমকালীন কিছু আত্মীদেরও বিদায় হয়। রয়ে যায় কিছু কাছের আত্মীয় স্বজনরা। মুরাদ রেহানা আনসারীকে তার ছেলের দুঃসাহসের কথা জানায়। তিনি ছেলের ওপর ক্ষিপ্ত। এবং তৎক্ষনাৎ বিষয়টি সুরভী খাতুন ও তার স্বামী লিয়াকত আলীকে জানান। এক কান দু কান হতে হতে খবর ছড়িয়ে পড়ে সবার কাছে। ব্লাকমেইল করিয়ে ইসানার বিয়ে হয়েছে কানাখোষা আরম্ভ হয়। সঙ্গে ছেলে ওর থেকে বয়সে বড়ো এই বিষয়টি তো আছেই!
ইসানা সেন্টার ত্যাগ করে। কেননা তার দ্বারা এসব শোনা বড্ড পীড়াদায়ক! আগে থেকেই মানুষের কম খোঁটা শুনেনি। এখন আবার নতুন করে শুনতে হবে। রাদ দৃষ্টি নত রেখে শক্ত আদলে দাঁড়িয়ে আছে। থমথমে পরিবেশকে উপেক্ষা করে লিয়াকত আলী বললেন,
‘আমরা এই বিয়েতে আপত্তি করতাম না। কিন্তু রাদ যেটা করেছে ইসানা সহজে মেনে নিবে নাকি জানি না।’
‘এ ঘটনা ছাড়াও আপনার ভাগ্নি আমাকে সহজে মেনে নিতো না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে এই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।’ চোয়াল শক্ত করে বলল রাদ।
রেহানা আনসারী গমগম আওয়াজে ছেলেকে বললেন,
‘চুপ করো। তোমার সাফাই শুনতে চাইনি। আমার তোমার রিলেশনে কোনো আপত্তি ছিল না জেনেও, এমন বোকার মতো কাজ তোমার দ্বারা আশা করিনি আমি।’
‘বোকামি করার জন্য স্যরি মামনি। তবে, আমার কাছে যেটা ভালো মনে হয়েছে আমি সেটাই করেছি।’ তেজি কণ্ঠে বলল।
‘মুরাদ ওঁকে এখান থেকে চলে যেতে বলো।’ কাঠ কাঠ কন্ঠে বললেন।
রাদ মায়ের কথা শোনা মাত্রই প্রস্থান করল। রয়ে গেলো শুধু তারা। সুরভী খাতুন মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখন নিজের মেয়ের জন্য নয়। বরং বাবা-মা হারানো এতিম ইসানার জন্য মন পুঁড়ছে। ইসানাকে যতটুকু চিনে, একবার মনে দাগ লাগলে সেটা কখনোই তাকে সুখ দেয় না। বিষে বিষিয়ে দেয়!
রেহানা আনসারী সুরভী খাতুনের নিকট এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘মাফ করিস সুরভী। আমার ছেলে এমনটা করবে আমি ঘুনাক্ষরেও জানতাম না।’
তিনি চোখ তুলে তার ছোট বেলার বান্ধবী রেহানা আনসারীর দিকে তাকায়। আহত কণ্ঠে বলে,
‘তোর ছেলে যেটা করেছে ওর দিক থেকে ঠিক হলেও, ইসানার দিক থেকে ঘোর অন্যায়। আমি জানি ইসানা রাদকে কক্ষণো মেনে নিতো না। কিন্তু এখন? জানি না ইসানার কি করবে? কি চলছে ওর মনে।’
‘আমি ইসানাকে বুঝাবো। একটা সুযোগ তো পেতে পারি।’
সুরভী চোখের পলক ফেলে মাথা মৃদু ঝাঁকাল। হালকা হাসলেন রেহানা। তিনি আশ্বাস দিলেন সব ঠিক হয়ে যাবে। দু’জনকে পুনরায় বিয়ে দিবে।
.
বিছানার ওপর হাঁটু ভাজ করে বসে আছে ইসানা। চোখের কাজল অতিরিক্ত কান্নার ফলে লেপ্টে গেছে। খোঁপা করা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পিঠ ছুঁয়েছে। ওড়না পড়ে আছে ফ্লোরে। বাঁধভাঙা কান্না থামছে না। বাবা-মায়ের কথা, প্রতিটা কষ্টের কথা অনুভব করে কাঁদছে। বুকের মধ্যে একটাই ভ’য় ধীরেধীরে জাগ্রত হচ্ছে, সমাজ কী বলবে? কীভাবে মেনে নিবে এ সম্পর্ক?
নিরব পায়ে এগিয়ে আসলেন রেহানা। ইসানাকে অনেক অজানা কথা বলার আছে তার। যা আজ বলবেন তিনি। সেসময় আজ এসেছে। তিনি পাশে বসে মাথায় হাত রাখলেন। ইসানা চোখ তুলে তাকায়। রেহানা আনসারীকে দেখে ওড়না খুঁজতে ব্যস্ততা দেখায়। তিনি বাঁধা দিয়ে বলল,
‘খুঁজতে হবে না। আমি তো আর পরপুরুষ নই।’
ইসানা ফুঁপানো থামিয়ে হাঁটু বুকের কাছে রেখে বসল। রেহানা তার ফোনের মধ্যে একটি ছবি বের করে ইসানাকে দেখালো।
‘এই ছবিটি নিশ্চয় তুমি চিনো?’
ইসানা চোখ মুছে ফোনটি হাতে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর উৎকণ্ঠে শুধালো,
‘হ্যাঁ! এই ছবিটি আপনার কাছে কেন?’
রেহানা ইসানার মুখোমুখি বসে মৃদু হেসে বলল,
‘আমার এবং আমার বান্ধবীদের ছবি আমার কাছে থাকবে না, এটা হয় নাকি।’
কপালে চিকন ভাজ পড়লো ইসানার। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখ খোলার আগেই রেহানা বলল,
‘প্রথমটি তোমার আম্মু। দ্বিতীয়টি তোমার মামি। তৃতীয় জন আমি। মিলিয়ে দেখো আমার যুবতী বয়সী ছবির সঙ্গে আমাকে।’
ইসানা কপাল কুঁচকে ফোনের পানে পলক ফেলে তৎক্ষনাৎ রেহানার পানে তাকায়। চেহারায় অমায়িক মিল রয়েছে। এটা যে তিনি সেটা নিশ্চিত! ইসানা জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি আমার আম্মু ও মামির বান্ধবী ছিলেন?’
‘ছিলাম না। এখনো আছি। হয়তো তোমার আম্মু আমার সঙ্গে নেই। কিন্তু ও আমার প্রিয় বান্ধবী ছিল এবং চিরজীবন থাকবে।’
ইসানা থতমত খেলো। ছোট থেকে তার নাম জানতো। কিন্তু ঘুনাক্ষরেও জানত না এই রেহানা তার মায়ের প্রিয় বান্ধবী ছিল। জীবন যুদ্ধে, ডিপ্রেশনে মাথা থেকে এই বিষয়টি বেরিয়ে গিয়েছে। খেয়ালই করেনি সে তার অতি কাছের কেউ। রেহানা ইসানাকে নিরুত্তর দেখে বলল,
‘ছোট বেলায় আমাদের তিন বান্ধবীর একটা ইচ্ছে ছিল। আমাদের যদি ছেলেমেয়ে হয়, তাহলে তাদের একে অপরের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করব। কিন্তু দিন শেষে সেটা হয়ে ওঠেনি। স্বামী মারা যাওয়ার পর তার এতবড় বিজনেস আমাকে সামলাতে হয়। ব্যস্ততায়, পরিশ্রমে দিন কাঁটছিল আমার। এক সময় সুরভীর মাধ্যমে জানতে পারি তোমার বাবা-মা দু’জনই পৃথিবীতে নেই। আফসোস হয় খুব। এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে তোমাদের খোঁজখবরও নিতে পারিনি আমি। যখন জেনেছি তখন তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। তখন থেকেই সুরভী সঙ্গে রোজ কথা হতো। সুরভী আমার কাছে তার গোপনীয়তা জানাত না। বলতো না তোমার মামার জোয়া খেলার বিষয়টি। ফোনালাপে নিজেকে যথেষ্ট হাসিখুশি ভাবে উপস্থাপন করতো। একদিন সব নিজ থেকে বলে। তখন তোমাদের মামার পরিবারকে সাহায্য করতাম আমি। চার বছর পর তোমার যখন ডিভোর্স হলো। তুমি চাকরি নিতে আমারই কোম্পানিতে গেলে। আমি এটা জানতাম না। যদি না সেদিন মুরাদকে কল দিতাম। তোমার নাম আমি আগে থেকেই জানতাম। মুরাদ যখন সার্টিফিকেটের ছবি আমাকে পাঠালো, তোমার বাবা-মায়ের নাম দেখে আমি জানতে পারি তোমার আসল পরিচয়। সিলেট থেকে দ্রুত ঢাকায় ব্যাক করি। রাদকে মানিয়ে তোমাকে রাদের পি.এ ও সার্ভেন্ট বানাই। এটা সুরভীই আমাকে বলেছিল। তোমাকে যেন যেভাবেই হোক আমাদের কোম্পানিতে জব দেই। তোমায় জব দিয়ে আমি নিশ্চিতে থাকি। রাদকে নিয়ে বার্তি টেনশনে পোহাতে হয় না। তুমি ঘরোয়া মেয়ে ছিলে। ভালো-খারাপ সবই বুঝতে।’ বলতে বলতে ইসানার মাথায় হাত বুলালেন। ইসানা নিরব স্রোতার মতো রেহানার কথা শুনছে। সে ফের বলে,
‘আমি কিন্তু সিমার বিয়ের দাওয়াতে এসেছি। তোমার মামি আমাকে আগেই দাওয়াত দিয়েছে। আমি চেয়েছিলাম তোমার সঙ্গে রাদের বিয়ে দিতে। এটা সুরভীকে জানাই। সে প্রথমে আপত্তি করলেও পরে আমার জোরাজোরিতে রাজি হয়। তারপর থেকে মুরাদ আমাকে তোমাদের বিষয়ে সব খবরা-খবর জানাতো। মুরাদ আগে থেকেই বিয়ের বিষয়টি জানতো। তবে তোমাদের বলেনি। মুরাদ যখন জানায় তোমাকে ভালোবাসে রাদ তখন আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম। আর সেদিন প্রপোজাল রিজেক্ট করেছো শুনে আমারও খারাপ লেগেছিল। তবে তুমি তোমার মনের কথা বলেছো। যেটা তোমার কাছে ঠিক মনে হয়েছে। রাদের অনেক অভিমান জমে আছে আমার ওপর। ছোট বেলা থেকে ওঁকে সময় দিতে পারিনি। তাই একরোখা, উগ্র মেজাজি স্বভাবে বেড়ে উঠে। কিন্তু তুমি আসার পর ওর স্বভাবে পরিবর্তন এসেছে। আমার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে শুরু করেছে। এর মূল উৎস তুমি। আমি চাই না রাদ আগের মতো হয়ে যাক। জেদের বশে তোমাকে বিয়ে করলেও ও তোমাকে মন থেকে ভালোবাসে। জানি মেনে নিতে তোমার কষ্ট হবে।’
ইসানা দৃষ্টি সরিয় নেয় একথা শুনে। তার বলারই বা আছে কি? তিনি চোখ বুঁজে বড়ো নিশ্বাস নিয়ে বললেন,
‘আজকাল যুগের ভালোবাসা বয়স, জাত-ধর্ম দেখে হয় না। সমাজের কিছু নিচু শ্রেণীর লোক এসবকে নিন্দাসূচক দৃষ্টিতে দেখে। দেখো ইসানা, জন্ম, মৃ’ত্যু, বিয়ে। এই তিনটি আল্লাহর হাতে। অন্যভাবেও হয়তো তোমাদের বিয়ে হতে পারতো। কিন্তু আল্লাহ যা লিখে রেখেছে সেটা তো আর খণ্ডানো যায় না।’
ইসানা আধো স্বরে বলল,
‘আমি তাকে কীভাবে মেনে নিবো ম্যাম?’
‘মানুষ অভ্যাসের দাস! একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি শুধু আমার ছেলেটিকে আগলে রেখো অধিক পরিমাণ ভালোবাসা দিয়ে। সমাজের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। বিপদে পড়লে পরিবার ব্যতীত সমাজের লোকজন এগিয়ে আসবে না সাহায্যের জন্য। এটা মনে রাখবে। আর হ্যাঁ! রাদ যেটা করেছে তার জন্য আমি নিজেও অনুশোচনায় ভুগছি। ওঁকে ক্ষমা করে দিও। দিবে তো ইসানা?’ কথাটা বলে ইসানার থুতনিতে হাত রেখে উঁচু করে আদল। ইসানা ঘনঘন পলক ফেলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ওঁকে নিরুত্তর দেখে রেহানা বললেন,
‘আমি তোমার আর রাদের বিয়ে দিবো নতুন করে। আমাদের বান্ধবীদের বন্ধন মজবুত করব। আশা করছি এতে তোমার কোনো আপত্তি থাকবে না?’
ইসানা নজর নিচু করে ফেলে। তার নিরবতায় ‘হ্যাঁ ‘সম্মতি পেয়ে খুশি হয় রেহানা। শেষ বারের মতো মাথায় হাত চালিয়ে বলে,
‘কে কি বলল তাতে কান দিবে না। তুমি তোমার মতো থাকবে। অনেক শুনেছো এবং দেখেছো সমাজের রীতি। এখন থেকে নিজের মতো বাঁচবে। আর হ্যাঁ! আমাকে মামনি বলে ডাকবে। ম্যাম বলবে না।’ পুরো কথা বলে তিনি চলে গেলেন। ইসানা আলতোভাবে বালিশে মাথা রাখলো। হাজার চিন্তাভাবনা তাকে ঘিরে ধরেছে। ক’বার বড়ো বড়ো নিশ্বাস টেনে মনে মনে বলল,
‘আপনি যা করেছেন, তা আমি মেনে নিলাম মি. রাদ আনসারী। তবে কষ্টে ভুগিয়ে দখল করেছেন আমাকে। এর শাস্তি আপনাকে পেতে হবে।’

জানালার সামনে দাঁড়িয়ে মৌন হয়ে ইসানার কথা ভাবছে রাদ। জেদ রক্ষার্থে ইসানাকে আপন করে নিলেও তার কষ্টে পীড়িত সে নিজেও! এক পর্যায়ে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘নিজের জেদের কাছে হারতে পারিনি আমি। আই এম স্যরি সানা।’
_
‘আমাদের গাড়ি মাঝ রাস্তায় পুলিশ আঁটকে দেয়। প্রায় এক ঘন্টা যাবত বিনাকারণে আমাদের গাড়ি আঁটকে রেখেছে। আব্বু ত্যক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেও তারা কারণ বলতে নারাজ ছিল। বুঝোই তো পুলিশের সঙ্গে তর্কবিতর্কে গেলে ক্ষতি আমাদেরই হবে। চারটার দিকে হঠাৎ আমাদের যেতে দেয় তারা। এতটা রাগ হচ্ছিল তখন। বলার বাহিরে।’ পুরো ঘটনাটি বাসর ঘরে তার নতুন বউ সিমাকে বর্ননা করল মনজু। সিমা পুরো কথা শুনে বলল,
‘আমাদের পরিবারের সবাই অনেক চিন্তিত ছিল। ভেবেছিল হয়তো তোমরা আসবে না।’
‘আরে এমন কারণ ছিল না। ঐ শা’লা’রা কারণবিহীন আমাদের আঁটকে রেখেছিল।’
‘আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তুমি আমার ফোনটাও ধরছিলে না। খুব চিন্তা হচ্ছিল।’
‘যাক বাদ দেও। অবশেষে আমরা এক হলাম। এর চেয়ে খুশি আর কী আছে বলো?’
‘হুম।’ মুচকি হেসে জবাব দিলো।
‘তারপর?’ দুষ্টু হাসি ঠোঁটে এঁকে বলল মনজু।
‘তারপর আমাদের নতুন জীবনের সূচনা হবে আজ।’ কথাটা বলে সিমা লজ্জায় পড়ে যায়। মনজু তার বউকে বুকে টেনে নেয়। তাদের জীবনের নতুন এক অধ্যায় উদ্ভোদন হবে আজ থেকে।
.
.
.
.
#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here