তোমায় ছোঁয়ার ইচ্ছে পর্ব -২৯+৩০

#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_২৮
#সুমাইয়া_মনি

‘আপনাদের একত্রে ডাকার কারণটি আমি বুঝিয়ে বলছি। আপনারা জানেন ইসানা আমার ছেলে রাদের পি.এ। রাদ ইসানাকে পছন্দ করে। তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে এই সপ্তাহে। এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে হয়তো। সামান্য পি.এ হয়ে কোম্পানির মালিককে ইসানা পটিয়ে নিয়েছে। এমন অখাদ্য প্রশ্ন আপনাদের মাথা থেকে সরিয়ে ফেলুন। ইসানা আমার প্রিয় বান্ধবীর একমাত্র মেয়ে। হয়তো ওরা এক দেড় বছরের বড়ো-ছোট। এটা কোনো মেটার না। পারিবারিক ভাবেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। আপনারা এতদিন আমাকে এবং রাদেকে যে নজরে দেখেছেন, সম্মান-শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ইসানাও একই ভাবে দেখবেন। যেহেতু ইসানাও এই কোম্পানির দ্বিতীয় ওনার। আশা করছি আপনাদের মনে কোনো প্রশ্ন রইলো না। আপনারা এখন নিজ নিজ কাজে যেতে পারেন।’ বক্তব্য শেষ করে রেহানা আনসারী স্টেজ থেকে নেমে গেলেন। স্টাফরা নিজ নিজ স্থানে ফিরতে আরম্ভ করে। মুরাদ রেহানার সঙ্গে পা মিলিয়ে রাদের কেবিনের দিকে এগোয়। রাদের পরামর্শে সে এই মিটিংয়ের আয়োজন করেছিল। যাতে বিয়ের বিষয়টি উল্লেখ হয় এবং ইসানাকে নিয়ে কোনো প্রকার সন্দেহ না থাকে কারো অন্তরে।
‘মুরাদ কার্ড ছাপানোর ব্যবস্থা করো। আমি কোনো প্রকার হেলামি চাই না। হাতে সময় খুম কম।’ ব্যস্ততা দেখিনে বললেন তিনি। চেহারে বসার পর পরই মুরাদ মিনমিন স্বরে বলল,
‘একটা কথা বলার ছিল আন্টি।’
‘কী কথা?’ তিনি কিছুটা ভ্রু কোঁচকালেন।
মুরাদ রাদের পানে তাকিয়ে ইশারা করলেন। রাদ গম্ভীরতা ভাব ফেলে বললেন,
‘মুরাদ চাইছে আপনি ওর বাবার সঙ্গে আলাপ করে আমার বিয়ের মধ্যেই ওর আর সোহানার বিয়ে কথা জানান তাকে।’
‘মানে এক অনুষ্ঠানে দু’টি বিয়ে?’
‘হ্যাঁ!’ মাথা চুলকিয়ে হ্যাঁ সম্মতি জানালো মুরাদ।
‘অতি উত্তম প্রস্তাব। মুরাদ তোমার বাড়িতে চলো এক্ষুণি। এক দিনেই দু’টি বিয়ে হবে।’ খুশি হয়ে বললেন তিনি।
মুরাদ আগ্রহ প্রকাশ করে বলল,
‘চলুন আন্টি। আর শুনুন। আব্বু রাজি না হলে আপনি জোর করে রাজি করাবেন।’
‘অবশ্যই!’
মুরাদ খুশিতে আত্মহারা। তার এ খুশি ভাষায় প্রকাশ করা বড্ড দায়। দ্রুত পায়ে তারা কেবিন ত্যাগ করলেন। রাদ তার ফোনটি টেবিলের ওপর রেখে নাড়াচাড়া করছে। কাল রাতে কয়েকবার ইসানাকে টেক্সট করতে চেয়েছিল। কিন্তু সাহসে কুলোয় নি। হয়তো ভীষণ রেগে আছে। এজন্যই তার মনের সুপ্ত অনুভূতিকে বুকের মাঝে দমিয়ে রেখেছে। বিয়ের আগে সে কিছুতেই তার সম্মুখীন হবে না। যদি হতে হয় বিয়ের পরই হবে বলে ঠিক করে।
_
বিকেলের দিকে সিমাকে ঐ বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয়। সন্ধ্যায় মজলিস শুরু হয়েছে ড্রইংরুমে। ইসানাও ছিল। সিমা তাকে টেনেটুনে বসিয়েছে। বাড়িতে আসার পর ইসানার বিয়ের খবর শুনে সিমা বেশ খুশি। তারা বিভিন্ন আলোচনায় রাদকে নিয়ে কথা উল্লেখ করে। ইসানা মৃদু হাসি প্রধান করে চুপচাপ শুনে। শেষে মনজু সকলের উদ্দেশ্য বলল,
‘আমি যদি ভুল না হই রাদ ভাইয়াই পুলিশের মাধ্যমে কাল আমাদের গাড়ি আঁটকে ছিল।’
‘হতে পারে। এটা রাদ ভাইয়াই করেছে।’
‘তুই ঠিক বলেছিস সিমা। এটা আমার গুনধর ছেলের কাজ ছিল।’ রেহানা আওড়াতে আওড়াতে এগিয়ে এলো তাদের নিকট। চকিত চোখে তাকাল ইসানা। পরক্ষণে নজর সরিয়ে নিলো। বড়োলোক মানুষরা চাইলেই সব পারে। এটা তার বুঝতে সময় লাগে না। রেহানা সুরভীর কাছে এগিয়ে গিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
‘বিয়ে একটি নয়, সঙ্গে আরেকটি হবে। মুরাদ ও সোহানার।’
‘একই দিনে হবে?’ সিমা জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ! দু বন্ধুর বিয়ে এক দিনে হবে।’
সিমা সহ বাকিরাও খুশি হয়। এ দু দিনে সোহানা ও মুরাদ সকলের মনে জায়গা করে নিয়েছে। বিভিন্নভাবে তাদের সাহায্য করেছিল কাজে। তাই তাদের নাম বলা মাত্রই চিনে ফেলে। ইসানা নিজেও খুশি হয় বান্ধবীর বিয়ের কথা শুনে। মজলিস ছেড়ে রুমে এসে বান্ধবীর ফোনে কল দেয়। সোহানা ইসানার সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে কথা বলে। নিজের বিয়ের কথা শুনে সে মহা খুশি। সোহানার খুশিতে ইসানাও খুশি। মুহূর্তেই তার বিষণ্ণ মনে সুখের আভা ছড়িয়ে পড়ে।
_
পরদিন।
‘মা তোমার পেশারের ওষুধ শেষ হয়েছে আরো একদিন আগে। ইভান ভাইয়াকে বলোনি?’ শালিনী ঔষধ নাড়াচাড়া করে মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লেন।
‘না রে। ইভান সবে মাত্র চাকরি পেলো। টাকা হাতে আসেনি। তাই বলিনি।’
‘তাহলে আমাকে তো বলতে পারতে। আমি না হয় তোমার জামাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিনে আনতাম।’
‘আর কত দেখবি আমাদের। তোর নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাব।’
‘ফালতু কথা বোলো না তো। আমি তোমার জামাইকে বলছি ঔষধের কথা।’
‘আমাকে যতটা খেয়াল রাখিস। এমন নিজের শ্বাশুড়িরও যত্ন নিস।’
শালিনী কিছু বলতে উদ্যত হতেই ইভাবের আগমন ঘটে। ভাইকে দেখে শালিনী কথা বাড়ায় না। ইভান মায়ের কাছাকাছি বসলেন। চেহারায় তার ক্লান্তিভাব জড়িত।
তিনি তার ছেলের বাহুতে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘আজ কাজ একটু বেশি হয়েছে?’
মায়ের মুখের দিকে এক পলক চেয়ে বলল,
‘একটু তো কাজ থাকবেই।’
শুনে তিনি চুপ করে রইলো। ইভান মুখমণ্ডলে হাত বুলিয়ে বলল,
‘ইসানার বিয়ে ঠিক হয়েছে।’
তার মায়ের মুখে ঘোর অন্ধকার নেমে এলো সংবাদটি শুনে। পিছন থেকে শালিনী কান খাঁড়া করলো বাকি কথোপকথন শুনতে।
‘কার সঙ্গে?’
‘রাদ টেক্সটাইল কোম্পানির মালিকের ছেলের সঙ্গে।’
‘অনেক বড়ো ঘরে বিয়ে হচ্ছে তাই না?’
‘হ্যাঁ! রাদ বিয়ের প্রথম কার্ড আমাকে দিয়েছে। আমি বলেছি বিয়েতে যাব। ইসানার কাছে মাফ চাওয়ার সুবর্ণসুযোগ এটা।’
‘তাই করিস। আমার হয়েও মাফ চেয়ে নিস। অনেক কষ্ট দিয়েছি মেয়েটাকে।’
ইভান প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। তার বুক হাহাকার করছে তীব্র বেদনায়। নেই কাউকে দেখানোর সুযোগ!
_
ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে সময় অতিবাহিত হয়। দেখতে দেখতে ঘনিয়ে আসে বিয়ের দিন। আজ রাদ, ইসানা ও মুরাদ, সোহানার গায়ে হলুদ। দুই বিয়ে একই সেন্টারে হলুদ সহ বৌ-ভাতের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বড়ো স্টেজে চারজন কপোত-কপোতী বসে আছে। আত্মীয়রা একে একে তাদের হলুদ দিচ্ছে। দূরে লাউডস্পিকারে গান বাচ্ছে। সবাই ধুমছে এনজয় করছে। রাদ সুযোগ খুঁজছে ইসানার সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু সেই ওয়ে’টা খুঁজে পাচ্ছে না। যারা স্টেজে আসছে। হলুদ দেওয়ার সঙ্গে দশ-বিশ এরও বেশি সেলফি তুলছে। ইসানা সবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক ভাবে উপস্থাপন করেছে। রাগ-ক্ষোভ সব ভেতরে দাবিয়ে রেখেছে।
রাদ ও ইসানার সঙ্গে কথা না হলেও। মুরাদ, সোহানা একে অপরে একটু পর পর কানে কানে ফিসফিস করে কথা বলছে আর খিলখিল করে হাসছে। ওদের দেখে রাদের খুব ইচ্ছে জাগে ইসানার সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু তার এই ইচ্ছে বাস্তবে রূপ নেয় না। রাত তিনটা নাগাদ হলুদের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়। সেন্টারের পাশের হোটেলেই উঠেছে সকলে। হারিসে চড়ে সবাই সেখানে পৌঁছায়। ইসানা ত্যক্ত হয়ে সব খুলে ফেলে। সোহানার নিষেধাজ্ঞা শুনে না। তারা দু’জন এক কামরায় অবস্থান করছে।
‘আমাকে নিষেধ করবি না। তুই পড়ে থাক সারারাত।’
‘এমন করছিস কেন?’
‘বোইন আমি বিরক্ত!’
‘যা যা!’
ইসানা লেহেঙ্গা পরিবর্তন করে পাতলা থ্রিপিস পড়ে। আদলে চওড়া মেকআপ ধুয়ে প্রচুর স্বস্তি পাচ্ছে। সোজা বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। মেহেদী কাল দিয়েছে তারা দু’জন। তাই আজ ঝামেলা নেই। গায়ে কম্বল দেওয়ার সময় মেহেদী রাঙা হাতে নজর পড়ে। মুঠোবন্দী করা হাত মেলে তালুর পানে তাকায়। সেখানে ছোট অক্ষরে রাদ লিখা ছিল। পার্লারের মেয়েটিকে না করা সত্বেও নামটি জোরপূর্বক ভাবে লিখেছে।
ইসানা কিছুক্ষণের জন্য রাদের সঙ্গে পুরোনো স্মৃতিতে হারিয়ে যায়। প্রথম দেখা, তার সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করা। এক নির্জন রাতে আমেরিকার সুনশান রাস্তায় পথচলা সব স্মৃতিতে ঘুরে আসে ইসানা। আজ সেই রাদ তার বর! জীবনের এক অংশে পরিনত হয়েছে। সরু নিশ্বাস নিয়ে হাত মুঠোবন্দী করে ফেলে।
.
এ ক’দিনে দু’জনের মাঝে কথা হয় নি। রাদের তীব্র আগ্রহ থাকলেও ওয়ে ছিল না। ইসানা ভারী মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল কথা বলবে না দেখে। বুক আনচান করছে ইসানার সঙ্গে করা বলার জন্য তার। এরূপ ছটফটানি মুরাদ বুঝতে পারে। পাশে বসে পিঠ চাপড়ে বলল,
‘আর কয়েক ঘন্টা মাত্র। কাল রাতেই তাকে পুরোপুরি ভাবে পেয়ে যাবি। একটু ধৈর্য রাখ দোস্ত!’
‘তাই তো করছি। তবে আমি জানি ওনি আমাকে এত সহজে মেনে নিবে না।’
‘দেখ দোস্ত, এমনিতেই তুই তাকে ব্লাকমেইল করে বিয়ে করেছিল। এখন সে তোর। আগে তার মনে নিজের জন্য সফটলি কর্নার তৈরী কর। তার মনে যদি তোর প্রতি ভালোবাসা জন্মায় তবেই তুই তাকে স্পর্শ করতে পারবি। এভেন, সে তখন তোকে স্ত্রীর অধিকার নিজ থেকে দিবে। তবে, এর আগে তাকে জোরপূর্বক ছোঁয়ার চেষ্টা করিস না।’
রাদ মুরাদের কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করে। এবং সে বুঝতে পারে কাউকে হাসিল করতে হলে প্রথমে তার মন দখল করতে হয়। তবেই তাকে পরিপূর্ণ ভাবে পাওয়া যাবে।
.
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_২৯
#সুমাইয়া_মনি

‘বয়স হয়েছে ঠিকিই, কিন্তু বিবেক বুদ্ধির অভাব ছিল। লোভে পড়ে নিজের আত্মসম্মান বোধ বিসর্জন দিয়েছি। টাকার নেশায় অন্ধ ছিলাম। অন্যায় করেছি আমি। শাস্তিযোগ্য! সত্যি আল্লাহ ছাড় দেয়, কিন্তু ছেড়ে দেয় না। আমাকে ক্ষমা করে দিও ইসানা। তোমাকে গুরুতর ভাবে আঘাত করেছি আমি। মায়ের হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। তিনিও তার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত! নতুন জীবন সুন্দর ও সাচ্ছন্দ্য ভাবে কাটুক। শুভ কামনা তোমাদের জন্য।’ বলতে বলতে ইভান ফুলের বুফেটি ইসানার নিকট এগিয়ে দেয়। ইসানা বুফে হাতে তুলে নেয় ঠিকিই কিন্তু মুখে কিছু বলল না। ইভান স্টেজ থেকে নামতে উদ্যত হতেই পিছন থেকে নিচু কণ্ঠে ইসানা শুধালো,
‘খেয়ে যাবেন।’
ইভান ইসানার পানে চেয়ে মৃদু হাসি প্রধান করে চলে গেল। ইসানা দৃষ্টি নিবদ্ধ করল ফুলের বুফের ওপর। নিমিষেই অনুভব করে তার জীবনের পীড়াদায়ক চার বছরের দুঃখগুলো মুছে গেছে। থাকে না কোনো প্রকার আক্ষেপ। ইভানের মাফ চাওয়াতে ইসানার অন্তর ব্যাপক খুশি হয়। তবে সেটা কারো সামনে প্রকাশিত করল না। রাদ রক্তচোখে ইভানের কথাগুলো শ্রবণ করেছে। ইসানা ইভানকে শেষে এতটুকু কথা বলাতে রাদের অন্তরে জ্বলন সৃষ্টি হয়। ইসানার দৃষ্টি বুফের ওপর নিবদ্ধ দেখে রাগ ক্ষণে ক্ষণে বৃদ্ধি পাচ্ছে রাদের। আপাতত সবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখা ছাড়া উপায় নেই।

আশেপাশেই ফটোগ্রাফার সহ মিডিয়ার লোকদের দেখা যাচ্ছে। তারা ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ বাদে বিয়ে পড়ানো হয়। ওই সময় স্তব্ধ হয়ে ছিল ইসানা। বিশ মিনিট যাবত চুপ ছিল কবুল বলার সময়। পরিশেষে তাকে কবুল বলতে হয়। সে আজ পুরোপুরি অন্য কারো। নতুন জীবনের সূচনা তাদের হলো। চারজোড়া নতুন কপোত-কপোতীর ফটোশুট হচ্ছে। হৈ-হুল্লোড়ের পর বিদায়ের পালা। সোহানার বাবা-মা বুক পাথরে রুপান্তরিত করে মেয়েকে বিদায় জানায়।
কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সুরভী খাতুন ও ইসানা। ইমোশনাল দৃশ্যের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত হয়। গাড়িতে চড়ে তারা নিজের নতুন নিড়ে যাচ্ছেন। সেন্টার থেকে বাড়ি পৌঁছাতে আধাঘন্টা সময় লাগে।
গাড়ি থেকে নামার পর রেহানা আনসারী ইসানাকে রাদের রুমটিতে নিয়ে আসে। রাদ ও মুরাদ একত্রে বাহিরে বেরিয়েছে বন্ধুদের সঙ্গে। রেহানা আনসারী বের হয়ে যায়। তিনি রেস্ট নিচ্ছের পাশের রুমে। ইসানা বিছানার ওপর বসে চাদরের ওপর হাত রেখে পুরো রুমটিতে নজর বুলায়। হরেক রকমের ফুল দিয়ে সাজানো বাসর ঘরে বসে আছে। এটা তার জীবনে দ্বিতীয় বাসর। জীবন কতোই না বিচিত্রময়। একদিন বিনা পারমিশনে এই রুমে প্রবেশের ফলে জরিমানা দিতে হয়েছে। আর আজ এ বাড়ির মালকিন সে নিজেও। রয়েছে তার সমান অধিকার। বড়ো নিশ্বাস ছাড়লো। শ্বাশুড়ির দেওয়া সিল্কের শাড়ি পড়ে নেয় বিয়ের লেহেঙ্গা পরিবর্তন করে। চেহারার মেকআপ ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে ফ্রেশ হয়ে বের হবার পর রাদের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। ঘড়িতে তখন দুইটা ছুঁই ছুঁই।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সন্ধ্যার পর। শেষ হতে হতে রাত গড়িয়েছে। ইসানা নজর সরিয়ে নেয়। টাওয়াল বিছানার ওপর রেখে সোহানাকে টেক্সট দেয়। পিছন থেকে রাদ ইসানার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,
‘বিয়ের রীতি অনুযায়ী নামাজ পড়তে হয়। আপনি জানেন কিছু?’
ইসানা চোখ না তুলেই ফোনে টাইপিং করে রাদের ফোনে টেক্সট পাঠায়।
‘শোকরানা নামাজ বলে। এক সঙ্গে পড়তে হয়।’
রাদ ফোনের টেক্সটটি পড়ে কপাল কুঁচকে ফেলে। সামনাসামনি অথচ টেক্সট করে বলার লজিক মাথায় ঢুকছে না তার। ইসানা ফোন রেখে জায়নামাজ বিছায়। রাদ দ্রুত ওজু করে অপর জায়নামাজ বিছিয়ে একত্রে নামাজ পড়তে দাঁড়ায়। নামাজ শেষে রাদ দাঁড়াতেই ইসানা রাদের পা ছুঁয়ে সালাম করে বিছানার এ প্রান্তে এসে দাঁড়াল। ফোন হাতে নিয়ে রাদকে আবার টেক্সট করে।
‘কে খাটে বা সোফায় ঘুমাবে?’
রাদ ফোনের টোন শুনে হাতে নিয়ে টেক্সট দেখে ভ্রু কুঁচকে উৎকণ্ঠে কিছু একটা বলতে উদ্যত হয়েও থেমে স্বাভাবিক হয়ে বলল,
‘আমি সোফায় ঘুমাচ্ছি।’
কথাটা শোনা মাত্রই ইসানা খাটের ওপর উঠে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। এদিকে রাদ যে সবিস্ময় হয়ে দাঁয়িছে আছে এতে তার ভাবান্তর নেই। রাদ সরু নিশ্বাস ফেলে আলমারি থেকে কম্বল সোফায় রেখে বেলকনির দিকে এগোয়। সেকেন্ড কয়েক পরই মুরাদের কল আসলো। পীক করল সে,
‘বল।’
‘শা’লা’র বাসর ঘরের মা-বাবা।’ তীব্র রাগ নিয়ে গালি দিলো মুরাদ।
‘কেন?’
‘বাসর রাত নাকি কাল রাত হয়। এই বলে আমার দাদী ও সোহানার নানি রুম থেকে ঠেলে বের করে দিলো। এখন বারান্দায় আছি।’
‘সেইম!’
‘তোকে কে বলল আন্টি?’
‘অন্যটা হয়েছে আমার সঙ্গে।’
‘কী?’
‘সানা আমার সঙ্গে কথা বলছে না। যদিও বলছে টেক্সটের মাধ্যমে।’
‘চমৎকার!’
‘চমৎকারের কি দেখলি?’ মেকি রাগ নিয়ে বলল রাদ।
‘তোর, আমার কপাল এক। তাই চমৎকার না বলে পারলাম না দোস্ত।’
‘শুয়ে পড়।’
‘হ্যাঁ! যাচ্ছি।’
‘আমিও গেলাম।’
ফোন রেখে রাদ রুমে এসে দেখে ইসানা গভীর ঘুমে কাতর। তার চোখও জ্বলছে ঘুমের কারণে। সোফায় বসে কম্বল জড়িয়ে নিজেও ঘুমিয়ে যায়।
সকালে চুড়ির ঝনঝন শব্দে ঘুম ভাঙে। ইসানা দরজা খুলে বেরিয়ে যায় বাহিরে। রাদ উঠে বসে। ইসানার চুড়ির শব্দ দারুণ ছিল। ভেবে মৃদু হাসি প্রতিফলিত হয় ঠোঁটে। কিছুক্ষণ বসে থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়। ডাইনিং টেবিলে আগে থেকেই রেহানা ও ইসানা বসেছিল। রাদ এগিয়ে এসে প্রথম চেয়ার টেনে বসল।
একে অপরের সঙ্গে বাক্যবিনিময় বিহীন নাস্তা করছে তারা।
রেহানা হঠাৎ রাদকে সরাসরি প্রশ্ন করল,
‘রাদ তুমি হানিমুনে যাওয়ার পরিকল্পনা করে থাকলে ক্যান্সেল করে দেও। আগে নিজেদের মধ্যকার বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক তৈরী করো। তারপর হানিমুনে যাবে।’
রাদ দৃষ্টি নত রেখে খাবার খাচ্ছে। মামনির কথার পিঠে কথা সে বলতে চাইছে না। তবে মুখ খুলে এতটুকু বলল,
‘আমাকে একা না বলে তাকেও বলে দেও।’
‘সেটা তোমাকে বলতে হবে না।’
নিরব হয়ে পড়ে চারদিন। রেহানা পুনরায় বলল,
‘বিকেলে আমার ক’জন গেস্ট আসবে। তুমি বাড়িতে থেকো।’
‘মহিলা নাকি পুরুষ!’
‘মহিলা।’
‘থাকবো।’
‘ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’
‘তিন ঘন্টার জন্য হলেও যেতে হবে। আজ অন্য ফ্যাক্টরি থেকে কাপড় ডেলিভারি করা হবে।’
‘তাহলে যেও।’
‘ওনি যাবেন?’ ইসানার পানে আড়চোখে চেয়ে প্রশ্ন করলেন রাদ।
‘নাহ! ও তোমার পি.এ নয় এখন। তুমি একা যাও।’
‘তাহলে কী নতুন পি.এ নেওয়ার ব্যবস্থা করব?’
‘অবশ্যই!’
সম্মতি জানিয়ে আরো দু’টো পাউরুটি খেয়ে রাদ উঠে যায়। ড্রেসআপ চেঞ্জ করে ফ্যাক্টরির উদ্দেশ্যে বের হয়। এই প্রথম ইসানাকে রেখে একা ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছে। তবে এটা ভেবে তার শান্তি অনুভব হয় সে তার বউ!
নতুন দু’জন সার্ভেন্ট দিয়ে সারা ঘরের পর্দা পরিবর্তন করায় রেহানা আনসারী। এখন থেকে ইসানার কাজ রাদের যত্নআত্তি রাখা ও রান্না করা। বাকি কাজের জন্য নতুন সার্ভেন্ট নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। ইসানা রাদের আলমারি এক পাশ খালি করে। এ পাশে তার এবং নিজের কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখে। শেষে ছোট্ট চিরকুটে এই বিষয়টি উল্লেখ করেও দেয়। রাদের প্রত্যেকটি জিনিসের পাশাপাশি নিজের জিনিসগুলো এডজাস্ট করেছে।
রাদ দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরে রুমের এরূপ পরিবর্তন দেখে রাগ হবার বদলে বিস্মিত হয়। টাওয়াল হাতে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম খোলার সময়ে ইসানা রুমে প্রবেশ করে। রাদ মৃদু হেসে ইসানার উদ্দেশ্যে বলল,
‘থ্যাংক’স! এত দ্রুত এ বাড়ির ও রুমের নতুন সদস্য হয়ে উঠার জন্য।’
বিনা জবাবে ইসানা রুম প্রস্থান করে। নাকের ডগায় তার কিঞ্চিৎ রাগ ফুটে উঠে। সে ভেবেছিল সব কিছু এডজাস্ট করার ফলে রাদ ভীষণ রাগ হবে। তবে হলো সব উল্টো! বরঞ্চ খুশি হয়েছে। খাওয়া শেষে রাদ ল্যাপটপ নিয়ে বসল।
গলার আওয়াজ উঁচু করে ইসানাকে কফি বানানোর বার্তাটি জানালো। শ্বশুড়ির রুম থেকে বেরিয়ে রাদকে কফি বানিয়ে দিয়ে ফের তার রুমে এলো।
দুপুরের দিকে পাঁচজন মহিলা এলো। অতিথিদের সামনে রাদ ও ইসানা একত্রে বসেছে। ছেলের বউকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আলাপনে ব্যস্ত হন তারা। ইসানাকে তারা উপহার সরূপ দামী শাড়ি ও গহনা দেয়। ছয়টার দিকে তারা চলে যায়। ইসানা তাদের দেওয়া গহনা আলমারিতে রাখছিল। ঠিক সেই সময়ে রাদ রুমে প্রবেশ করে জিজ্ঞেস করল,
‘কাল আমরা নন্দন পার্কে যাচ্ছি।’
ইসানা ফোন হাতে তুলে টাইপিং করে লিখলো,
‘আমি যাচ্ছি না।’
রাদ ফোন চেক করে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
‘কারণ?’
ইসানা পুনরায় লিখলো,
‘ইচ্ছে নেই।’
‘মামনি কি বলেছে সকালে নিশ্চয় আপনি শুনেছেন?’
‘হ্যাঁ! আমি ব’য়’রা নই!’
এমন ত্যাড়া বার্তা দেখে রাদ মেকি রাগ নিয়ে বলল,
‘মুখে কথা বললে কী হবে?’
‘ফোঁসকা পড়বে।’
ফের ত্যাড়া জবাব দেখে রাদ ক্ষোভিত চোখে তাকালো। বলল,
‘সরাসরি কথা বলুন। টেক্সট বন্ধ করে।’
‘পারব না।’
‘মামনি, মামনি? এখানে এসো।’ চিল্লিয়ে ডাকলো রেহানা আনসারীকে রাদ। তিনি ছেলের ডাক শুনে এগিয়ে এলো রুমে।
‘কী হয়েছে?’ প্রশ্নটি করতে করতে তাদের কাছাকাছি আসলো।
রাদ ইসানার পানে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
‘কাল রাত থেকে ওনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন না। প্রশ্ন করলেই টেক্সটের মাধ্যমে জবাব দিচ্ছে। তার মুখে কি সমস্যা, জিজ্ঞেস করো?’
রেহানা ছেলের বিচার সরূপ বাক্যগুলো শুনে ইসানার পানে তাকায়। শান্ত স্বাভাবিক দৃষ্টি দেখে পরক্ষণে ছেলের পানে চেয়ে বলল,
‘কথা টেক্সটে বলুব বা মুখে একটা হলেই হলো। তোমার যদি মন চায় তাহলে তুমিও টেক্সট দিয়ে প্রশ্ন করো।’
মায়ের এরূপ আদেশ বার্তা কথা শুনে রাদ হতবাক! বলল,
‘কী বলছো তুমি মামনি?’
‘দেখো, তোমাদের মধ্যকার খুটিনাটি ঝগড়া’বিবাদ আমাকে না বললে ভালো হয়। আমি তোমাদের মাঝে আসতে চাই না ব্যস! ফের আমাকে ডাকবে না।’ বলেই তিনি চলে গেলেন।
ইসানার হাসতে ইচ্ছে করছে রাদের আদলের রিয়াকশন দেখে। কিন্তু এ মুহূর্তে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সে-ও রুম ত্যাগ করল। রাদ আহাম্মক হয়ে তখনো দাঁড়িয়ে আছে। মাথার ওপর থেকে যাওয়ার ন্যায় ঘটনাটি ঘটেছে পুরোটা।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here