তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব -১৬

#তোমার_নিরব_অভিমানীনি(১৬)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
#সারপ্রাইজ_পর্ব
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

“যার বিয়ে তার খবর নেই পারাপরশির ঘুম নেই” কোমরে হাত রেখে এই কথা বলে নজরাত। রূপক হাই তুলে বলল,
—” যেই কুটনি মেয়েকে বিয়ে করতে চলেছি না জানি আমার কি হয়! তাই বিয়ে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হ‌ওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না আমি।
নজরাত মিছে রাগ দেখিয়ে বলল,
—” মোটেও আমার ননদিনী কুটনি না। ভীষণ ভালো একটা মেয়ে মা শা আল্লাহ। যাই হোক কিছুদিন পর তুমি এমনিতেই বুঝতে পারবে।
এখন তাড়াতাড়ি উঠ, যেতে হবে তো নাকি?
—” এতো ভোর বেলা! এখনো পর্যন্ত সূর্য মামা ও ঘুম থেকে উঠেনি বোধ হয়।
—” ঘড়ির দিকে নজর দাও দেখতে পাবে সূর্য মামা উঠেছি কি উঠেনি। আমি শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছি আর তুমি কিনা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছো? ভেরি ব্যাড ভাইয়া।

এরপরও রূপক আলসেমি করে শুয়ে থাকে, নজরাত উঠতে বললে সে বলে তাকে যদি নজরাত টেনে তুলতে পারে তবে সে উঠবে এর আগে নয়। ঠিক ছোট বেলার মতো। রূপক শুয়ে থাকলে পিচ্চি নজরাত নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ভাইকে টেনে তুলতো। তারপর রূপক তার সাথে কোন কাজে বা বেড়াতে যেত। এতে অন্যরকম একটা আনন্দ পায় রূপক। বোনটি রাগ করে যখন গাল দুটো ফুলিয়ে বসে থাকে তা দেখতে ভালো লাগে রূপক এর। তবে বোনের কোন ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেনি কখনো।
আজোও শক্ত পোক্ত শরীরটা টেনে তুললো নজরাত। তারপরেই রূপক বোনের গাল দুটো টিপে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে।
________
রাদ শাহমাত ঘুরে ঘুরে দেখছে ডেকোরেশন এর সব কিছু ঠিক ঠাক মতো করা হয়েছে কিনা। বরের স্ট্রিজ টা ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। রাহা কে পার্লারের মেয়েগুলো সাজিয়ে চলে যেতে রাদ শাহমাত বোন কে বধু বেশে কেমন লাগছে দেখতে আসে। রাহা লাল রঙা শাড়ি পরে লাল টুকটুকে বউ সেজে বসে আছে বিছানার মাঝ খানে। দৃষ্টি তার নত। ভাইকে দেখতে পেয়ে উঠে আসতে নিলে রাদ শাহমাত দ্রুত নিষেধ করে। এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে বোনের গালে হাত রাখে। ভারী কোমল, ভারী স্নেহময়ী স্পর্শ।
রাহার চোখ ছলছলে হয়ে এল। রাদ শাহমাত বোনের মাথাটা নিজের কাঁধে চেপে ধরে বলল,
—” কাঁদে না বোন। আজকে আরো একজন কে সারাজীবন পাশে পাবি যে কিনা সবচেয়ে ভরসার পাত্র হবে তোর। সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে উঠবে। দো’আ করি আল্লাহ যেন তোকে খুব সুখী করে।
রাহা কান্না রোধ করার জন্য ঠোঁট কামড়ে ধরে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। ভাবতেই বুক ফেটে কান্না আসছে। আজকের পর থেকে এ বাড়ির অতিথি হয়ে যাবে সে। মেয়েদের জীবনটাই এরকম।

সাজেদা চৌধুরী গহনার বক্স হাতে নিয়ে মেয়ের কাছে আসেন পরিয়ে দিবেন বলে। এসে দেখেন ছেলে মেয়ে দুটো কাঁদছে। তিনি যথাসম্ভব নিজেকে সংযত করে গহনা পড়িয়ে দিলেন রাহা কে। রাহা যখন জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো তখন আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলেন না সাজেদা চৌধুরী। চোখ দুটো ভিজে এলো তার। তবুও মেয়েকে শান্তনা বানী শুনিয়ে বুঝিয়ে বললেন শ্বশুরবাড়ি তে কিভাবে চলাফেরা করতে হবে না করতে হবে।
যোহরের সালাত আদায় করে বরযাত্রী আসে।রাদ শাহমাত ভেবেছিল নজরাত বুঝি তার ভাইয়ার বিয়েতে শাড়ি পরে সেজেগুজে আসবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে নজরাত সবসময়ের মতোই কালো বোরকায় নিজেকে আবৃত করে আসে। রাদ শাহমাত যত দেখছে তত‌ই মুগ্ধ হয়ে পড়ছে। তার বুঝে আসে না একটা মেয়ে এতটা ভালো হয় আজকাল?

খাওয়া দাওয়া সেরে বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। রাহা কে কবুল বলতে বলা হলে সে চুপ করে বসে থাকে। নজরাত তখন কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
—” তাড়াতাড়ি বলে দাও ওদিকে তো তোমার হবু বর সেজে গুজে বসে আছে কখন কবুল বলবে বলে।
নজরাত এর এহেন কথায় মুচকি হেসে কবুল বলে দেয় রাহা। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে বরের কাছে আসে এবার। রূপক এর কথা আর কি বলব? ছেলেদের বরাবরই লজ্জা জিনিস টা কম। তাই কয়েক সেকেন্ড এর মাথায় বলে দিল কবুল। এ কথা নজরাত রাহা কে বলে হাসতে হাসতে শেষ। রাহা তখন লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে থাকে।

কনে বিদায় বেলায় নজরাত কে সাজ্জাদ হোসেন এবং রূপক খুঁজ করলে নজরাত তাদের জানায় সে যাবে না তাদের সাথে। কারণ সে চলে গেলে সাজেদা চৌধুরী এবং রাদ শাহমাত কে দেখার মতো কেউ থাকবে না। তাই তারা আর জোর করে না যাওয়ার জন্য।
_______
বাড়ি থেকে একজন মানুষ চলে গেলেই মনে হয় বাড়িটা পুরো নিস্তব্ধ হয়ে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। চারিদিকে শূন্যতা বিরাজ করে। খুব মনে পড়ে যায় সেই মানুষটির কথা। শুধু মনে হয় ঐ মানুষটা থাকলে এখন ঘর জুড়ে হাটতো কথা বলতো। সেসব কথা মনে করে রাদ শাহমাত এর বুক ফেটে যাচ্ছে। বাসায় থাকতে না পেরে ছাদে গিয়ে বসে থাকে।
এদিকে মণি মনমরা হয়ে বসে আছে এক কোনায়। সাজেদা চৌধুরী তাজবি গুনছেন আর মেয়ের কথা মনে করে চোখের পানি ফেলছেন। মাঝখানে নজরাত কোন দিক সামলাবে ভেবে পায় না। তার বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বাবা ও তো সেদিন তাকে বিয়ে দিয়ে এমনি করে কেদেছিল নিশ্চয়ই? ভাইয়া বিদেশে ছিল। বাবাকে শান্তনা দেওয়ার মত কোন আপনজন ছিল না সেদিন। নিশ্চয়ই বাবার খুব কষ্ট হয়েছিল?
বাবার কথা ভাবতে নজরাত এর বুকটা ভারী হয়ে এল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে গেল। কথায় কথায় সাজেদা চৌধুরী বললেন,
—” ব‌উমা তুমি রাদ এর কাছে যাও। ছেলেটা বোনকে ভীষণ ভালোবাসে। হয়তো খুব কষ্ট পাচ্ছে।
নজরাত জ্বি, আচ্ছা বলে।
রুমে কোথাও রাদ শাহমাত কে দেখতে না পেয়ে মণি কে জিজ্ঞাসা করে। মণি জানায় রাদ ছাদের দিকে গিয়েছে। এ কথা শুনে নজরাত ছাদের দিকে যায়।
রাদ শাহমাত ছাদের ছাদের মাঝখানে বসে আছে। চারিদিকে শীতের মৃদু মন্দ হাওয়া বইছে। নজরাত ধীর পায়ে এগিয়ে এসে হাঁটু ভাঁজ করে পাশে বসে।
কিছুক্ষণ নিরবতা চলে দুজনের মাঝে। নিরবতা ভেঙ্গে নজরাত বিষাদ-মলিন একটু হেসে বলল,
—” আজ থেকে পাঁচ মাস আগে ঠিক এমন একটি দিনে রাহার মতোই একটি মেয়ে ব‌উ হয়ে চৌধুরী বাড়িতে পা রাখে। মেয়েটির এই বিশেষ দিনে তার একমাত্র ভাইটি দেশেই ছিল না। একা বাবা ছেড়ে এসেছিল শুধুমাত্র একজন মায়ের আবদার রক্ষাত্রে। ভবিষ্যত সম্পর্কে অবগত হয়েও নিজেকে সেদিন পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে দিয়েছিল মেয়েটি।
সম্পূর্ণ নতুন একটি ঘরে সারারাত জেগে বসে ছিল তার স্বামী নামক মানুষটার জন্য। রাত পেরিয়ে দিন গেল তা-ও সেই মানুষটির দেখা মিলেনি। ভাবুন কতটা যন্ত্রনা, পিরাদায়ক ছিল মেয়েটির জন্য! সেও তো কারো আদরের একমাত্র বোন ছিল। তার ও তো কতশত স্বপ্ন ছিল।

নজরাত আরো কিছু বলতে নিলে রাদ শাহমাত তার ওষ্ঠদ্বয়ে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বলল,
—” আর বলবেন না প্লিজ। আমি সহ্য করতে পারছি না।
তারপর পুনরায় নিজের মতো বসে থাকে। নজরাত ও কথা বারায় না। দৃষ্টি নত করে বসে থাকে। একটু পর রাদ শাহমাত বিরস মুখে বলে,
—” আমি ক্ষমার অযোগ্য তাই না?
নজরাত বার দুই ঢোঁক গিলল। একটা আবেগ তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। কান্না আসছে। আরো আড়ষ্ট হয়ে বসল।
রাদ শাহমাত একটু শব্দ করে হাসলো। বলল,
—” জানি আমি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না। তাই তো বার বার বলি আপনি চলে যান, নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন….
নজরাত কর্নধার চেপে ধরে বলল,
—” চুপ একদম চুপ! আর এসব শুনতে চাইছি না আমি। আমাকে একটু শান্তি দিন। দয়া করুন।

রাদ শাহমাত নজরাত এর অব্যক্ত ভালোবাসা বুঝে নিল। অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল,
—” আমি আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি?
নজরাত দিশেহারা হয়ে রাদ শাহমাত এর মুখের দিকে চেয়ে বলল,
—” আমি তো কখনো দেওয়াল তৈরি করিনি।
রাদ শাহমাত আর সময় নিল না। ঝাপটে ধরে বিকারগ্রস্তের মতো এলোমেলো অধরযুগল ছুঁয়ে দেয়।
তার আকস্মিক স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছে নজরাত।….

#চলবে.. ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here