তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব -২৭

#তোমার_নিরব_অভিমানীনি(২৭)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

“ব‌উকে পরে আদর করবে আগে আমার ট্রিট দাও”?
রাহার এহেন কথায় রাদ নজরাত কে ছেড়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে বলল,
–” তবে রে!

রাহা দৌড়ে পালায়। ভাই বোনের এই খুনসুটি দেখে নজরাতের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। রাদ হেসে তার দিকে ঘুরে বসে, নজরাত এর উজ্জ্বল হাসিমাখা মুখশ্রী দেখে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। গাল দুটো আঁকড়ে ধরে বলল,
–” তুমি এতোটা কঠোর মনের কিভাবে হলে বলো তো? এমন একটা খবর জেনেও চেপে রেখে দিয়েছিলে? তোমার মন উসখুস করেনি যে খবরটা সবাইকে জানাই অন্তত আমাকে জানাতে পারতে?

নজরাত দৃষ্টি নত করে ধরা গলায় বলল,
–” ভাইয়ার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তখন। তাই তখন খুশি হতে পারিনি আমি।

রাদ তার বাম হাতখানা নজরাত এর গলার দিকটায় ধরে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে গাল ছুঁয়ে, তীব্র স্থির চোখে তার দিকে চেয়ে থেকে বলল,
–” এ ছাড়াও তোমার হৃদয় নরম হলেও শরীরটা বড্ড শক্ত হাতুড়ে গড়া!

নজরাত এবার রাদ এর চোখে চোখ রেখে বলল,
–” যদি সবটাই নরম হতাম তাহলে বিভিন্ন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে যেতাম! ছেলেদের বিভিন্ন কু-মন্ত্রনায় জড়িয়ে যেতাম। আপনি জানেন? আমাকে সামনাসামনি দেখতে না পেয়ে বিভিন্ন কৌশলে চেয়েছে আমার ছবি যেন অন্তত দেখতে পারে! যখন সে পথেও দেখতে পায়নি তখন তারা আমাকে উপাধি দিয়েছে, অহং’কারী, দাম্ভিক, শক্ত মন, কাঠের তৈরি হৃদয় ইত্যাদি ইত্যাদি… এছাড়াও যাদের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছি তারা উঠে পড়ে লেগেছিল আমার বিয়ের ঘর ভাঙ্গার জন্য! আপনার মা বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পূর্বে তিনটি বিয়ের ঘর ভাঙ্গিয়েছে! আমার নামে কুটনা রটিয়ে।

রাদ সকৌতুকে মুখচোখে বিহ্বল ভাব ফুটিয়ে তোলে বলল,
–” নিশ্চ‌ই তারা তোমাকে অনেক লাভ করতো! তুমি বুঝলে না তাদের..

নজরাত রাদ কে চুপ করিয়ে গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,
–” আমি অত বোকা ন‌ই যে বুঝতে পারবো না। আপনার কি মনে হয়? একটা মেয়েকে না দেখে তার জন্য পাগল হবে! তাও আবার আজকালকার যুগের ছেলেরা? মোটেও না। তারা আমার বাবার টাকা পয়সার লোভে এরকম করেছে!

রাদ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলল,
–” খারাপের মাঝেও কিছু ছেলে আছে যারা প্রকৃতপক্ষেই ভালোবাসতে জানে। কয়েকটি কীটের জন্য সবাইকে এক‌ই খেতাব দিতে পারো না তুমি।

রাদ এর কথায় বিদ্রুপ হাসে নজরাত। সে ক্লান্ত, তবু শান্ত স্বরেই বলল,
–” ভালো ছেলেরা কখনো স্ত্রী ব্যতিত অন্য কোন নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয় না। অন্য নারীদের দেখলে ভালো ছেলেদের দৃষ্টি নত করে ফেলে। ভালো ছেলেরা কখনো স্ত্রী ব্যতিত অন্য কোন নারীর পিছনে সময় নষ্ট, টাকা নষ্ট করে না।

নজরাত এর কথায় রাদ দমে গেল! বারবার উশখুশ করে উঠছে একটা অস্বস্তি। মুখখানা চিন্তিত।
নজরাত খেয়াল করে রাদ এর বক্ষপটে মাথা রেখে ধীর স্বরে বলল,
–” আমি তোমাকে কোন ভাবেই ছোট করতে এ কথা গুলো বলছি না। বলছি এ কারণে যে, আল্লাহ চায়েতো ভবিষ্যতে তুমি বাবা হবে, মামা হবে, দাদা হবে আরো কত কিছু। তখন যেন নতুন প্রজন্মকে ইসলামের এই দিক গুলো শিখাতে পারো সে কারণে বলছি।
–” আচ্ছা হারাম রিলেশনশিপে থাকা অবস্থায় সালাত সহ সব ধরণের ইবাদত এবং দোয়া কবুল হবে কি?
–”

ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ বহির্ভূত তথাকথিত রিলেশনশিপ বা প্রেমের সম্পর্ক সম্পূর্ণ হারাম।
একে অপরের সাথে কামনা-বাসনা সহকারে কথাবার্তা, নির্জনে দেখা-সাক্ষাত, ডেটিং, চ্যাটিং, স্পর্শ, হাসাহাসি, দুষ্টামি সবই নিষিদ্ধ।

এই রিলেশনশিপ মূলত শয়তানের ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে নারী-পুরুষ উভয়ে জিনার দিকে ধাবিত হয়-যার পরিনতি খুবই ভয়াবহ।

তাই তো মহান আল্লাহ আমাদেরকে জিনার নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন।

আল্লাহ তা’আলা বলেন,
“আর জিনার কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। [১]

তবে দয়াময় আল্লাহ বৈধ উপায়ে বিয়ের মাধ্যমে নিজেদের ভালবাসা প্রকাশ ও জৈবিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ দিয়েছেন।

সুতরাং মানুষের কর্তব্য, বিয়ের পূর্বে হারাম সম্পর্কের দিকে পা না বাড়িয়ে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিয়ে করা।

তবে হারাম রিলেশন (অবৈধ প্রেম) গুনাহের কারণ হলেও তা শিরক, কুফরি বা মুরতাদ হওয়া মত গুনাহ নয় যে, এ কারণে তার সকল আমল বরবাদ হয়ে যাবে বা তার আমল কবুল হবে না।

বরং এ অবস্থায়ও তার সালাত, সিয়াম, দান-সদকা, দুআ, কুরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য নেকির কাজি বরবাদ হয়ে যাবে না।

বরং এগুলো সে যদি খালিস নিয়তে যথানিয়মে সম্পাদন করে তাহলে মহান আল্লাহ তা কবুল করবেন বলে আশা করা যায়।

কিন্তু হারাম রিলেশনের কারণে গুনাহগার হবে।
এ ক্ষেত্রে করণীয় হল, অনতিবিলম্বে তওবা করে এ পথ থেকে ফিরে আসা।

আল্লাহ আমাদেরকে সর্বপ্রকার পাপাচার থেকে তওবায়ে নাসূহা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ তাআলার কাছে তওবায়ে নাসূহা তথা আন্তরিক তওবা করো।
আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। [২]

তওবায়ে নাসূহা অর্থঃ
খাঁটি ও নির্ভেজাল তওবা, একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতাপূর্ণ তওবা।
অর্থাৎ এমন আন্তরিকতা ও দৃঢ় প্রত্যয় সহকারে তওবা করা যে, তওবা কারী আর কখনো জেনে-বুঝে উক্ত গুনাহে লিপ্ত হবে না।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরণের হারাম সম্পর্ক থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।

হারাম রিলেশন এবং ইবাদত কবুল হবে কিনা এ সম্পর্কে উত্তর দিয়েছেন,
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
_______

রাহা দরজায় নক করে বলল,
–” ভিতরে আসতে পারি?
তার কথা শুনে নজরাত আর রাদ একটু দূরত্ব নিয়ে বসে। তারপর তাকে ভিতরে আসতে বলে।
রাহা ট্রেতে করে বিভিন্ন রকম ফল কেটে নিয়ে এসেছে। নজরাত এর কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে বলল,
–” এখন থেকে খাবারের অনিয়ম একদম চলবে না। ভাইয়া জানো তোমার ব‌উ কি কান্ড ঘটিয়েছে? আমি তো সবটা বলিনি তোমাকে!

রাদ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কি ঘটিয়েছে?
রাহা বলতে নিলে নজরাত মুখ ফ্যাকাসে করে বলল,
–” প্লিজ বলো না ভাবীমণি।
রাদ সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
–” বলবে না কেন? রাহা কি হয়েছে বল তো?
রাহা চোখে ইশারা করে বলল,
–” দেখ না কপালের অবস্থা? খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করেনি বলে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়েছিল গার্ডেনে! আমরা ঘরে থেকে কিভাবে জানবো বলো? তারপর ধনু কাকা এসে আমাদের খবর দিলেন যে, এমন বিপদ ঘটেছে।

সবকিছু শুনে রাদ খুব রে’গে গেল। গম্ভীর মুখভঙ্গি করে বলল,
–” সত্যি বলবে?
নজরাত জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে রাদ অত্যন্ত কঠোরতার সঙ্গে বলে,
–” প্রেগন্যান্সির খবরে তুমি কি খুশি ন‌ও?
রাদ এর কথায় নজরাত বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। সে মা হতে চলেছে। এর থেকে খুশির সংবাদ দ্বিতীয়টি আছে নাকি? চোখের কোল ভারী হয়ে এল কান্না রোধ করতে না পেরে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। এর মধ্যে রাদ আবার বলল,
–” এতোটা ইরেসপনসিবিলিটি কিভাবে হলে তুমি? মানছি রূপক এর খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই বলে তুমি না খেয়ে থাকলে তার খবর চলে আসবে?

রাহা ভাইকে শান্ত করতে বলল,
–” ভাইয়া শান্ত হ‌ও। ভাবীমণি এমনিতেই অসুস্থ, আর বকা দিও না প্লিজ।

রাদ উঠে চলে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায় সব গুলো ফল যেন নজরাত খায়। একটাও যদি অবশিষ্ট থাকে তবে তার খবর আছে!
রাদ চলে গেলে রাহা বসে নজরাত এর চোখের পানি মুছে দিয়ে ফল গুলো খেয়ে নিতে বলে। তখন নজরাত হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে,
–” খাবো না আমি। আমার সন্তানের আগমনের সংবাদে আমি অখুশি! উনি এভাবে আমাকে বলতে পারলেন?
–” আসলে ভাইয়া মন থেকে কিছু বলেনি ভাবীমণি। তোমার শরীরের কন্ডিশনের কথা ভেবেই বলেছে। খেয়ে নাও প্লিজ প্লিজ প্লিজ?
_______

মাস খানেক পর,
রাহা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে নজরাত খাবার থেকে শুরু করে সবকিছুর দায়িত্ব নেয় রাদ। সে যখন অফিসে থাকে তখনো কল করে করে নজরাত কে খাবারের কথা মেডিসিন নেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাছাড়া সাজেদা চৌধুরী এবং মণি ও খুব খেয়াল রাখে নজরাতের।

সবকিছুর ফাঁকে ফাঁকে নজরাত ডায়েরী নিয়ে বসে লেখালেখি করতে। তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে আর বেশি সময় বাকি নেই ইনশা আল্লাহ। কিছুদিন পর ই কিছু একটা হতে চলেছে!….
_________
রেফারেন্সঃ
[১]সূরা ইসরা: ৩২
[২]সূরা তাহরীম: ০৮
_______

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here