তোমার পিছুপিছু পর্ব -২৫+২৬

#তোমার_পিছু_পিছু
পর্ব-২৫+২৬

তামান্না একদৃষ্টিতে সামনে বসা নীলময়ীর দিকে তাকিয়ে আছে। নীলময়ী খুব আয়েশ করে হাতের বার্গারে কামড় দিচ্ছে……এটা ওর তিন নাম্বার বার্গার চলছে…. তামান্না একটা ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। এভাবে কি তামান্না নিজের দিনটা প্লান করেছিলো!!! অবশ্যই না,,,,,,
তাহলে আবার কেনো!!! কেনো!!…….এভাবে ফেসে গেলো!!!!
তামান্না খুব বড় করে একটা দম নিলো…. শুধু কয়েকটা ঘন্টা……. কয়েকটা ঘন্টা চালিয়ে যেতে পারলেই ছাড়া পেয়ে যাবে…..
-তোহ,,,মিস তামান্না…. শুনুন আজকে সারাদিনের আমি একটা ঝাকানাকা প্লান করেছি….. এবং আজ সারাদিন আপনার সাথে আমি জোকের মত লেগে থাকবো….. আজ আপনাকে আমি ছাড়ছি না….
নীলময়ীর ঠোঁটে মিচকা হাসি স্পষ্ট……. তামান্না মাথায় দিলো……. আজ ওর কপালে কি কি আছে এক উপরে আল্লাহ’ই জানেন……..

👇👇👇
তামান্না ভেবে পাচ্ছে না….. এতবড় একটা মেয়ে কি করে একটা ১১ বছরের বাচ্চার পিছনে দৌড়াতে পারে!!!! তাও আবার সামান্য একটা ললিপপের জন্য!!! কিন্তু এখন তামান্নার পায়ে একদম শক্তি নেই,,,,যে ও যেয়ে নীলময়ীকে থামাবে………. সারাদিন ঘোরাঘুরির কথা থাকলেও,,,,তামান্নার দিনটা দৌড়াদৌড়ি করে কেটেছে…… সম্পুর্ণ সকাল নীলময়ীর পিছন পিছন চিড়িয়াখানায় ঘুরঘুর করার পর…..আবার আসতে হয়েছে ঢাকা জাতীয় শিশুপার্কে…….. এবং গুনে গুনে এর ভিতরে প্রত্যেকটা রাইডে উঠতে হয়েছে………. তামান্নার এখন মন চাইছে সেদিনের মত দৌড়ে বাসায় চলে যেতে……।
…… কিন্তু এই মেয়ে যেই সাংঘাতিক,,,,, দেখা যাবে পরে মাঝরাতেই তামান্নাকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে গেছে…………।
তামান্নার পাশে এসে নীলময়ী ধপাস করে বসে পড়ল……
-দেখলেন নিয়েই এলাম…. আমাকে চিনে না ওই পুচকা!!!! হুহ…. এত সহজ নাকি আমার জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া।……
তামান্না নীলময়ীর থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে সামনে তাকালো……. এই পার্কটায় এতো বাচ্চা ছেলেমেয়ে কেনো!!!!
-চাইল্ড হুড!!!! আপনার জীবনের কিছুখানিক মুহুর্ত যেখানে আপনি….. কেয়ারলেসলী সবকিছু উপভোগ করতে পারেন……..
-হুম…………..
-মিস তামান্না,,, আপনাকে যদি আরো একবার সুযোগ দেয়া হয়,,…….. আপনি কি ফিরে যাবেন আপনার ছোটবেলায়?
-হুম…. অবশ্যই………. বড়বেলা কার ভালো লাগে বলুন!?…….
-কিন্তু আমি ফিরে যেতে চাইবো না……….
-……………………………….
-কারন জানতে চাইবেন না!?
-আপনি কি আমায় কারন বলতে চান!?…….
-…………………মিস তামান্না,,,, জানেন……. সুখস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নগুলো মানুষের স্পষ্ট মনে থাকে…….. কারন সুখস্বপ্ন কখনো পিছু নেয় না…… দুঃস্বপ্নগুলোই হানা দেয়…….
-কারন দুঃস্বপ্নগুলোই যে বাস্তবতা……
-একজেক্টলি……… এতোটাই বাস্তব যে….. তা খুব ভয়ানকভাবে বিধতে শুরু করে…….তাই আমি ফিরে যেতে চাই না ছোটবেলায়………. যেখানে দিনের পর দিন অবহেলিত হয়ে আমি বাস্তবতা দেখেছি………..
-আর এখন…….!!!!!
-খুব ভয় হয় জানেন………..এখন যখন কেউ একজন খুব বেশি মুল্যায়ন করছে তখন ভয় হয়…… এর যোগ্যও কি আমি!!!!
-নীলময়ী……….. আমাদের আশেপাশের এইসব ভেজাল মানুষগুলোর মধ্যে,,,,জানেন কিছু শুদ্ধ মানুষ আছে……. যাদের শুধু মনটাই না….. আত্মাটাও সম্পুর্ণ শুদ্ধ……. তারা নিজেদের মনের অজান্তেই তাদের প্রিয় মানুষগুলোকে এতোটা সম্মানসহিত ভালোবাসে……আপনি টেরই পাবেন না…. কখন তারা আপনাকে নিজেদের ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে………….. আর এমন একজন মানুষ হলেন বর্ন সাহেব………. এরপরও কি আপনার ভয় হয়!!!!
নীলময়ীর চোখ ছলছল করছে……. নাকের ডগা লাল হয়ে আছে….. ঠোঁট কাপছে….. পড়ন্ত বিকেলের আলো এসে পড়েছে ওর মুখে……. তামান্নার কাছে এই পাগলী মেয়েটাকে কেনো যেনো অনেক সুন্দর লাগছে……
নীলময়ী কাপা কাপা গলায় জিজ্ঞ্যেস করল……
-যদি আমি আবার অবহেলিত হই!!!! যদি আবার হেরে যাই?
তামান্না মিষ্টি করে হেসে জবাব দিলো……
-আপনি ভালোবাসতে পেরেছেন তাতেই তো আপনার জয়…….. কয়জন মানুষ পারে এভাবে ভালোবাসতে বলুন!!

(আসছে)

#তোমার_পিছু_পিছু
পর্ব-২৬

মাহমুদ সাহেব বারবার কফির মগটা মুখের সামনে নিচ্ছেন…. কিন্তু চুমুক না দিয়ে তা আবার নামিয়ে টেবিলে রেখে দিচ্ছেন…… ওনার ঠিক সামনের চেয়ারে বসে আছে বর্ন……. বর্ন খুব ছোট ছোট করে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে ঠিক কিন্তু দৃষ্টি রেস্টুরেন্টের কাচের দেয়াল ভেদ করে স্থির হয়েছে রাস্তায়…….
মাহমুদ সাহেব একটা পয়েন্ট খুজচ্ছেন…… যেখান থেকে আলোচনা শুরু করা যায়……… কিন্তু কোনভাবেই এগুতে পারছেন না……….বেশকয়েকবার চেষ্টা করেছেন………. আজ এই কথাগুলো না বললেই নয়…… তাই শুরু করা প্রয়োজন…..
তিনি হালকা গলা খাকারি দিলেন…… তাতে কাজ হলো কিছু একটা….. বর্নর দৃষ্টি ফিরল…..
-বর্ন,,,,,আজ হঠাৎ করে তোমাকে এখানে ডাকার পিছনে একটা কারন আছে……… তা অবশ্যই বুঝতে পারছো!?…..
-জ্বী……….
-তো…. হুম….. আমি তোমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ন বিষয় সম্পর্কে অবগত করতেই…… আজ ডেকেছি……..
-জ্বী বলুন…….
-বর্ন…… আমি ঠিক জানি না….. তোমার আর নীলময়ীর মাঝের পরিচয় কতটুক!!!,….. কিন্তু আমি চাই….. তুমি যদি ওর সাথে কোন প্রকার সম্পর্কে জড়াও,,,,,,, তাহলে নীলময়ীর অতীত সম্পর্কে অবগত হয়েই জড়াও………
বর্ন কোন সাড়াশব্দ করল না…… শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মাহমুদ সাহেব তাই আবার শুরু করলেন
-আমি জানি এই কথাগুলো বলার স্থানটা আমার নয়…… কিন্তু আমি চাই না আমার মেয়েটা আবার কোন কারনে সাফার করুক…..….……নীলময়ী…….. ওর লাইফে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি….. স্ট্রাগল ছিলো……. মানে……. শুরু থেকেই মেয়েটা আমার শুধু কষ্টই পেয়ে গেছে…….. একদম ছোট থেকে………নীলময়ী হওয়ার পর পর….. নীলময়ীর মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলো……. কারন ওর কাছে আমাদের চেয়ে ওর ক্যারিয়ার বেশি প্রিয় ছিলো…… সন্তান ছিলো ওর কাছে বোঝা………….. একদম কোলের বাচ্চা ছিলো তখন নীলময়ী……… আর,,,, আমি!!! আমি নিজেও ঘৃণা করতে শুরু করলাম……… আমি ধরেই নিলাম এই সন্তানের জন্য আমার ভালোবাসার মানুষটা আজ আমায় ফেলে চলে গেলো…….. অবহেলা করতে লাগলাম……. আমার নিজের সন্তানকে……… অবহেলার মাত্রা একসময় এমন পর্যায়ে পৌছালো,,,,,, যে আমি ওর অস্তিত্বই ভুলে যেতে লাগলাম……. আমার যে কোনো মেয়ে ছিলো তাই ভুলে গেলাম……. কাজের বুয়া আর কেয়ারটেকারদের কাছে বড় হতে লাগল আমার মেয়ে…….
একটু থামলেন মাহমুদ সাহেব.…..….. বড় করে একটা দম নিলেন……..বর্ন খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে ওনার দিকে। উনি আবার শুরু করলেন……..
-নীলময়ীর জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমস্যা,,,,, ওর প্রয়োজন…… কোন কিছুই আমার চোখে পড়ল না…………… কিন্তু হঠাৎ একদিন…………. ওর বয়স তখন ১৬ কি ১৭ হবে হয়ত…. সেদিনের মতই হসপিটাল থেকে আমার কাছে ফোন এসেছিলো…….. আমি……. আমি…….. যখন গেলাম……….
মাহমুদ সাহেব জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। বর্ন পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন উনাকে……. একচুমুকে পানিটুকু শেষ করে উনি আবার শুরু করলেন,
-ডক্টর বললেন…. ও নাকি সুইসাইডের চেষ্টা করেছিলো…… আর ওইটাই নাকি প্রথম ছিলো না…… এর আগেও ও বেশকয়েকবার সুইসাইড অথবা নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিলো……সাইকোলোজিস্ট জানালেন……. নীলময়ী ডিপ্রেশনে ভুগছে……. এবং ও দিন দিন এতোটাই ডিপ্রেসড হয়ে পড়ছিলো যে…… ও নাকি সুইসাইডালে পরিণত হয়ে যাচ্ছিলো……….. আমি…… আমি……… শুধু হা করেই উনাদের শুনে গেলাম….. কিই বা বলতে পারতাম আমি……. আমাকে যখন আমার নিজের মেয়ের ডিপ্রেশনে ভোগার কারন জিজ্ঞেস করা হল,,,,,আমি ঠায় দাঁড়িয়ে……. তুমিই বলো,,,,, কি বলতাম আমি!!! যেই মেয়ের কোন অস্তিত্বই আমি স্বীকার করতাম না……. তার এই কন্ডিশনের কি কারন!!! তার জবাব আমি কিভাবে দিতাম!!!! বলো……..
মাহমুদ সাহেব ব্লেজারের হাতে চোখ মুছলেন……
-নিজের ভালোবাসার মানুষকে হারানোর শোকে আমি এতোটাই আহত হয়েছিলাম যে……..আমার ভালোবাসার অস্তিত্বটাকেই আমি ভুলে যেতে লাগলাম…… কতটা কতটা…….. নিষ্ঠুর বাবা না হলে আমি আমার সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলাম…….. কতটা……. কতটা……..
মাহমুদ সাহেব দুই হাতে চোখ মুছতে লাগলেন…..
বর্ন এখনো নির্বাক……..
-আমি জানি……. এইকথাগুলো একসময় নীলময়ীই তোমাকে জানাতো……. কিন্তু আমি আমার মেয়ের জন্য কোন রিস্ক নিতে চাইছিলাম না……. যদি আমার মেয়েটা আবার অবহেলিত হয়!!!! যদি আবার ওর মন ভাঙে…….. রিস্ক নিতে চাইছিলাম না……. আমি….বুঝতেই পারছো…….
মাহমুদ সাহেব উত্তরের অপেক্ষায় বর্নর দিকে তাকালেন…..
-আংকেল…… আপনি কি জানেন……. আমার জীবনে নীলময়ী আমার প্রথম বন্ধু……. সি ইজ এ প্রিসিয়াস গিফট টু মি….…. আমি নীলময়ী কে প্রমিস করেছি….. জানেন…… আমি সবসময়……. ওর সামনে ঢাল হয়ে থাকবো আমি…… আমি ওর সুপারম্যান তো……
বলেই বর্ন খুব সুন্দর করে হাসলো……
মাহমুদ সাহেব চোখ মুছেই যাচ্ছেন……. তিনি মনে মনে বললেন “হে পরমকরুনাময় পাক গাফফুর রাহিম….…. এই ছেলেটার জীবনে যেনো কখনো কোনো কষ্ট না আসে”

👇👇👇
তামান্না অফিস থেকে বের হয়ে সিড়ির কাছে দাড়ালো…… আবার বৃষ্টি!!!!! এই কি ঝামেলা…….. তামান্না ভ্রু কুচকে ব্যাগ থেকে ছাতা বের করতে লাগল……
-মিস তামান্না……
তামান্না এরকম হঠাৎ ডাকে…. ভয় পেয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেলো…… পাশে তাকিয়ে দেখে বর্ন দাঁড়িয়ে…… দুই হাত প্যান্টের দুই পকেটে ভরে একটা পিলারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে…….. তামান্না একটু অবাক হল,,,,,,,,, আজ সারাদিন তো উনাকে অফিসে দেখা গেলো না!!!!! তাহলে এখন কোথা থেকে উদয় হলো………. তামান্না হালকা করে হাসল……
-জ্বী স্যার বলুন……
-আসলে হয়েছে…… কি….. বৃষ্টি এমন হঠাৎ করে নামবে বুঝতে পারি নি……..…. ইয়ে মানে….. আমার গাড়িটা একটু সামনেই পার্ক করা…….. আপনি কি আমায় একটু লিফট দিবেন……..!?……
হেসে দিলো তামান্না…….. একদম প্রথম দিনের কথা মনে করে…….. এবং তামান্না ঠিক বুঝতে পারছে বর্নও সেই প্রথন দিনের কথা মনে করেই আজ আবার এভাবে বলছে……. তামান্না ব্যাগ থেকে ছাতা বের করল। আজও ওই ফুটো ছাতা!!!
তামান্না আর বর্ন পাশাপাশি হেটে চলছে……. বৃষ্টি অত জোরে না পড়লেও বর্ন অনেকটা ছাতার ভিতর সড়ে দাড়িয়েছে…… দু’জনের হাতে হাত ঘেষছে…..গাড়ির কাছাকাছি এসে বর্ন ঘুরে দাড়ালো……শুধু দাড়িয়েই রইল,,,,,,কিছু বলল না…… প্রথমে তামান্নাই শুরু করল
-জানেন….. কাল রাতে আমি একটা খুব সুন্দর স্বপ্ন দেখেছি…….
বর্ন চুপ করে রইল…… স্বপ্নের কথা শুনতে কি আজ ও এসেছে!!!! এতক্ষন যাবৎ দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করেছে কি এভাবেই চলে যাওয়ার জন্য!!!! আজও কি এই মেয়েটা কিছুই বলবে না!!!!!
-………………….. কি স্বপ্ন…..!?
-উমমমম…… সেটা নাহয় আজ নাই জানলেন……
-স্বপ্নটা কি অনেক সুন্দর ছিলো!?
-হুম…. ছিলো……. খুব সুন্দর ছিলো…….
-তাহলে আমি শুনতে চাই…………
-নাহ………. আজ না……. একদিন…… অনেকক্ষন সময় নিয়ে,,,,শুনাবো আপনাকে আমি স্বপ্ন……. আপনি যেমন সময় নিয়ে শুনান আপনার বইয়ের গল্প,,,, তেমনি…….
-একদিন?!!!!
-হুম………….
-ওহ………………… মিস তামান্না……. আসি আমি……… তাহলে……..
-জ্বি,,,,,, আসি স্যার……..
বলে তামান্না হালকা হেসে ঘুরে হেটে যেতে লাগল। বর্ন দাঁড়িয়ে রইল……. ঠিক যতক্ষন তামান্নাকে দেখা যায় ঠিক ততক্ষন দাঁড়িয়ে রইল।

(আসছে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here