তোর মনপাড়ায় পর্ব ১৪

#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১৪

— “কোথায় গিয়েছিলে তুমি! গত দুদিন ধরে তোমার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তোমার ধারণা আছে, কি পরিমান টেনশনে ছিলাম আমরা। দেখতে হবে না কার মেয়ে, যেমন ইরেন্সপন্সিবল মা, তেমন তার মেয়ে। দুজনেই সমান। ”

চরণ দুটি থেমে গেল ঈর্ষার। এই কন্ঠ-টা তার অতি পরিচিত একজন মানুষের। সাহস নিয়ে পেছনে তাকালো সে। বুকের ভেতরের ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠলো সাথে সাথে।‌ পুরোনো সেই ক্ষতটা ভাজা হয়ে এলো। পূর্বে এই মানুষটি দেখলে একসময় পাগল হয়ে যেতো সে। দৌড়ে জাপটে ধরতো। আর আজ ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। মাথা চুলকে ঠোঁট কামড়ে বলল.

— “কে? কে আপনি? আমাদের বাড়িতে কি করছেন বলুন তো? তারচেয়ে বড় কথা আমার ব্যাপারে ইন্টার ফেয়ার করার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে?(শাহিনুজ্জামান কে উদ্দেশ্য করে) আর মামা তোমাকে বলছি; অপরিচিত লোকদের কেন বাড়িতে এনেছ তুমি!”

শাহিনুজ্জামান কিছু বলতে নিলেই হাত দিয়ে থামিয়ে দিল ঈর্ষা। ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল.

— “তুমি আমাকে আগে বলে দিতে; আমি এই বাড়ির আশে পাশেও আসতাম না। যতদিন এই মানুষগুলো এই বাড়িতে থাকতো?”

করতালির আওয়াজ শোনা গেল কিছুক্ষণ। অনিক আহসান একবার শাহিনুজ্জামান আরেকবার ঈর্ষার দিকে তাকাচ্ছে। বিদ্রুপ করে বলল.

— “আই সি! তুই আমার মেয়েকে এই শিক্ষা দিয়েছিস। এতো গুলো বছর পর বাবা এসেছে, বাবাকে সম্মান না করে, ভালো না বেসে। মেয়ে বলছে, বাবা যতদিন থাকবে ততদিন মেয়ে বাবার সাথে থাকবে না।”

“বাবা” বলে তাচ্ছিল্যের হাসলো ঈর্ষা। মুখের আকৃতি পরিবর্তন করে দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠলো সে.

— “বাবা মেয়ে! কে তোমার মেয়ে? আমি কারো মেয়ে নই। যদি মেয়ে হতাম তাহলে পরিচয় হীন হয়ে ঘুড়তে হতো না আমাকে। সকলের কাছে ছোট হতে হতো না আমাকে! তুমি স্যরি আপনি খুনি! (আঙুল তুলে) আপনি আমার মাকে খুন করেছেন? আমার শৈশবের খুশীগুলোকে খুন করছেন? একটা হাসিখুশি পরিবারকে ভেঙ্গে মাটির সাথে গুটিয়ে দিয়েছেন। আবার বাবা বলছেন? বাবা হওয়ার কোনো যোগ্যতা আপনার নেই। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আজও আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে,,
জানেন, আমি প্রতিদিন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আপনাদের ঝগড়া শুনতাম। প্রতিদিন রাতে কেঁদে বালিশ ভেজালাম। মাম্মা আপনার সাথে ঝগড়া করে নানু বাড়িতে চলে গেল আর আপনি আপনার পিএ কে বিয়ে করে নিয়ে এলেন। আর সেই শোকে আমার মা মরেছে। যেই আমি সামান্য অন্ধকার দেখলে ভয়ে কাঁদতাম, সেই আমি অন্ধকার রাত একা একা জেগে কাটিয়ে দিয়েছি। ভয় পেলে বালিশে মুখ গুজে মা বাবা বলে কেঁদে উঠতাম। তখন তো আপনি আসেন নি। আমাকে শান্তনা দেননি। তাহলে আজ কেন এসেছেন? বাবার আছে সেটা প্রমান করতে? বিদেশ থেকে দামী দামী গিফ্ট আর টাকা পাঠালে বিলাসবহুল জীবন কাটানো যায়। আনন্দে কিংবা সুখে থাকা যায় না।”

একদমে কথা গুলো বলে থামলো ঈর্ষা। সবার দৃষ্টি তখন নত। আগে এই দিনগুলোর কথায় ভাবলে কেঁদে ভাসিয়ে দিত সে। কিন্তু আজ তার মুখে হাসি। কারণ, ভালো ভাবে বাঁচার এবং ভালো থাকার সন্ধান সে পেয়ে গেছে। একবার তার পাশে থাকা মহিলার আর তেরো কি চৌদ্দ বছর বয়সের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো।

__________________
— “আসবো!”

ডাঃ অথৈ দরজার দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি দিল। সাদাফ এসেছে। মুচকি হেসে এঁটে বলল.

— “আমার চেম্বারে আসার জন্য কখনো পার্মিশন নেওয়ার দরকার নেই। এবার ভেতরে আয়.

সাদাফ চপল পায় ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। অথৈর মুখোমুখি বসে রিপোর্ট গুলো এগিয়ে দিল তার দিকে। অথৈ রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে কৌতূহলী চোখে সাদাফের দিকে তাকালো। রিপোর্ট গুলো ফিরিয়ে দিয়ে বলল.

— “এই রিপোর্টগুলো তোর কাছে কি করছে সাদাফ। এইগুলো তো ঈর্ষার রিপোর্ট।”

— “না এগুলো ঊষার রিপোর্ট। এবার বল এখানে এমন কি আছে, যাতে একটা মেয়ে গাবড়ে যেতে পারে। উচ্ছন্নে যেতে পারে!”

— “স্যরি সাদাফ। আ’ম ভেরি ভেরি স্যরি। রিপোর্ট-টা তোর নয়। আর আমি অন্য একজনের সমস্যা তোকে বলতে বাধ্য নয়।”

আয়েশ করে চেয়ারে বসলো সাদাফ। পায়ের উপর পা তুলে ঘাড় বাঁকিয়ে বলল.

— “তুই যদি বলতে না চাস। ইজ ফাইন। বাট আমিও জেনেই ছাড়ব। তুই আমার ফ্রেন্ড তাই তোর কাছে এসেছিলাম। এখন না হয় তোর চেয়ে বড় কারো কাছে যাবো।”

অথৈ ভালোভাবেই সাদাফকে চেনে। তাই আর কথা বাড়ালো না। ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন সবটা।
সবটা শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলো সে। দুহাতে মুখ ঢেকে বললো. — এর চিকিৎসা নেই।
হাসলো‌ অথৈ। চেয়ার ঘুড়িয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে বললেন.

— “আজ পর্যন্ত সব রোগেরই কম বেশী চিকিৎসা রয়েছে। এই রোগেও আছে, তবে বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। রোগীর বিশ্বাসের ভিত্তি এবং প্রতিক্রিয়া জানতে হবে। রোগীকে বিশেষ মাত্রায় অ্যান্টি সাইকোটিক ওষুধের পাশাপাশি ‘বিহেভিয়ার থেরাপি’ প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। রোগীর অন্য কোনো অসুখ আছে কিনা, তাও ভালোমতো দেখতে হবে। ‘ওথেলো সিনড্রোমে’র রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চান না। নিজেকে সব সময় সুস্থ মনে করেন। নিজের ধারণাটিকে প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন। ঈর্ষা তো তবুও মনবল সঞ্চয় করে এসেছিলেন।”

বিভিন্ন কারণে এই রোগ হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে— ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা, সিজোফ্রেনিয়া, মদে আসক্তি প্রভৃতি। এ ছাড়া কিছু শারীরিক অসুখের কারণেও ‘ওথেলো সিনড্রোম’ হতে পারে। যেমন, মস্তিষ্কে টিউমার, এন্ডোক্রাইন ও বিপাক ক্রিয়ার ত্রুটি প্রভৃতি।

মায়ের ডাকে ধ্যান ভাঙল সাদাফের। ঈর্ষাকে দিয়ে ফেরার সময় অথৈর থেকে সব জেনে এসেছে। সেই ঘটনাটি বারবার ভাবছে সে। সাবিহা সাদাফের পাশে বসে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন.

— “তুই তোর ভাইকে সামলা। এই ছেলের একটাই কথা ঊষাকে বিয়ে না করা পর্যন্ত পড়াশোনা করবে না। খাবেও না। কোথায় যাবো, কি বলতো আমি ।”

স্বল্প ফাঁক হয়ে গেল সাদাফের মুখ। তখনই সুট বুট পড়ে শব্দ করে হাঁটতে হাঁটতে আদাফ এসেছে।একহাত পকেটে গুজে অন্যহাতে চুল ঠিক করতে করতে বলল.

— “ভাইয়া ভাবীর জন্য যে ব্রেসলেটটা এনেছিস, সেটা দে তো‌। তোর ভাবীকে গ্ৰিফ্ট করে আসি।”

ভ্রু কুঁচকে আদাফের দিকে তাকিয়ে সাবিহা কে বলল.

— “মা তুমি একটু রুম থেকে যাও তো। আজ ব্রেসলেট ওর মুখে সেলাই করে দিবো।”

আদাফ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে এক চিৎকার করে রুমে থেকে ছুটে গেল। আদাফের পিছু পিছু ছুটল সাদাফ। দুভাই বোনের কান্ড দেখে শব্দ করে হেঁসে উঠল সাবিহা।

_________________
চারদিনের বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। সাদাফ আর ঈর্ষার মাঝে কোনো দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। দুজনে দুজনের কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে। তবে ঈর্ষার সাথে বেশ সন্ধি হয়েছে সামিরার। যতবার ছোট মেয়েটার দিকে তাকায় ততবারই নিজের শৈশবের কথা মনে। ছোট বাচ্চা মেয়েকে অবহেলা করলে সে আরো জোকে বসেছে। যে করেই হোক, সে ঈর্ষার রাগ ভাঙাবে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে। শাহিনুজ্জামানের গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে ঈর্ষা। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বের হয়েছে। কিছুক্ষণ ড্রাইভ করার পর গাড়ি থামিয়ে দিচ্ছে সে। পেছনে ডিকি থেকে রিংটোনের আওয়াজ ভেসে আসছে। গাড়ি থামানোর সাথে সাথে থেমে যাচ্ছে আবার শুরু করলে ভেজে উঠছে। সেদিকে তোয়াক্কা না করে ড্রাইভে মন দিল ঈর্ষা। উদ্দেশ্য শপিং মলের সামনে নেমে চেক করা। বেশ কিছুক্ষণ পর গাড়ি এসে পৌছালো কাঙ্খিত অবস্থানে। গাড়ি থেকে নেমে পড়লো ঈর্ষা। লক করে ডিকির দিকে এগিয়ে গেল। ডিকি খুলতেই সামিরা মেকি হাসি দিয়ে ঈর্ষার গলা পেঁচিয়ে ধরলো। বিরক্ত হলো সে। সারাদিন তো শান্তি দেইনি, এখন রাস্তায়ও শান্তি নেই। কোনোমতে ছাড়িয়ে ঈর্ষা। একটু পিছিয়ে বুকে হাত গুজে গম্ভির কন্ঠে বলল.

— “এখানে লুকিয়ে আছো কেন? এইসবের মানে কি সামিরা। আমি তোমাকে আগেও বলেছি আর এখনও বলছি; আমাকে ডিস্টার্ভ করো না।”

এক লাফে ডিকির ভেতর থেকে বেরিয়ে বন্ধ করে দিল। জামাকাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে বলল.

— তু”মি আমার আপু! আমি তোমার ছোট এবং একমাত্র বোন! সো তুমি যেখানে আমিও সেখানে। প্লীজ বোকো না, আমি কখনো দেশে আসিনি। ঘুড়েও দেখা হয়নি। আজ তোমার সাথে ঘুড়বো। প্লীজ আপু প্লীজ..
প্রথম কথাগুলো ভাব নিয়ে বললেও পরে করুন সুরে বলল। মনে মনে হাসলো ঈর্ষা। একটু গম্ভীর ভাবে “ঠিক আছে” বলে সামিরার হাত ধরলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here