দ্বিতীয় বসন্ত ❤️ পর্ব -০২

#দ্বিতীয়_বসন্ত-২
Zannatul Eva

নভেম্বরের শেষ সময়টায় শীতটা বেশ ভালোই পড়ছে। বেলকনি দিয়ে ফুরফুর করে শীতল হাওয়া আসছে। বিভিন্ন ফুলের ঘ্রানে বেলকনিটা ম-ম করছে। পৃথিবী কত সুন্দর! চাইলে কত রকম ভাবে আমরা পৃথিবীটাকে উপভোগ করতে পারি। কিন্তু এতো সুন্দর পৃথিবীতে আমার মতো মেয়ের গায়ে কলঙ্ক নিয়ে বাঁচার কী কোনো অধিকার আছে! কারো ভালোবাসার প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ার অপরাধে আমাকে হতে হয়েছিলো ধর্ষনের শিকার। যার জন্য পরিবারের সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ। মরে গেলে তো সবটাই মিটে যায়।

রুহি হাতের মুঠোয় অনেক গুলো ঘুমের ঔষুুধ নিয়েও সেগুলো বেলকনির গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ফেলে দিলো। চোখ মুখ মুছে দরজা খুললো।

কি রে দরজা বন্ধ করেছিস কেনো?

এমনি।

তোকে না পইপই করে বারন করেছি দরজা বন্ধ করতে না। কি এমন দরকার পড়লো যে দরজা জানালা বন্ধ করতে হয়েছে!

আর করবো না। ঘুমাতে যাও মা।

মমতা খানম মেয়ের উপর ভরসা করতে না পারলেও নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পরোক্ষনেই সে আবার পেছন ঘুরে তাকিয়ে বলল, আজ আমি তোর সাথে শুবো।

রুহি হেসে বলল, আমাকে পাহারা দেয়ার জন্য আমার সাথে শুতে হবে না। তুমি নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। আমি দরজা খুলেই ঘুমাবো। এতো চিন্তা করার কিছু হয় নি। এতো সহজে মরছি না।

মমতা খানম মেয়ের দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো।

রুহি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। রাত চারটা বেজে পাঁচ মিনিট। মমতা খানম ঘুম থেকে জেগে মেয়ের রুমে উকি মারলেন। মেয়েটা ঘুমোচ্ছে। এতোক্ষনে তার কলিজায় পানি এলো। আল্লাহ মেয়েটাকে রক্ষা করুক। নিজেকে সামলানোর ধৈর্য্য দিক।

রুহি তার মায়ের উপস্থিতি বুঝতে পারে। সে জানে ঐ ঘটনার পর থেকে ঘরের কারোরই ঠিক মতো ঘুম হয় না। রুহিরও ঘুমোতে ভয় করে। প্রায়ই মাঝরাতে সে সেই কুৎসিত স্বপ্নটা দেখে। তার গলা শুকিয়ে যায়। পাশ টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়েও যেনে গলা ভেজে না। এই অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকা কি কষ্টের তা কেবল সেই সব মেয়ে গুলোই জানে, যাদের সাথে এমন অঘটন ঘটেছে। আচ্ছা তারা সবাই কি মরে যায়? জীবনটা এতো ছোট মরে গিয়ে সব শেষ করে ফেললেই কি আগের জীবন ফিরে পাওয়া যায়! যে মরে যায় সে তো চিরতরেই হারিয়ে যায়। কে মনে রাখে তাকে? পরিবারের মানুষ ছাড়া কেউই মনে রাখে না। পাড়াপ্রতিবেশিরা তো কেবল খোঁটা দেয়ার জন্যই মনে রাখে। একবার বেঁচে থেকে তাদের দেখিয়ে দেয়া উচিত নয় কি যে ধর্ষিতা মেয়েরা খারাপ নয়। কেউ কি ইচ্ছে করে ধর্ষিত হয়!! একবার বাঁচার মতো বেঁচে যেতে খুব ইচ্ছে করছে রুহির। প্রান ভরে বাঁচতে চায় সে। বাবা-মায়ের দুঃখ, কষ্ট গুলো ঘুচিয়ে দিতে চায়৷ এসব ভাবতে ভাবতেই শেষ রাতে রুহির ঘুমে চোখ লেগে গেলো।

সকাল সকাল রুহি ড্রেসিং টেবিলের সামলে বসলো। বহুদিন পর আজ একটু সাজবে সে। কতদিন হয়েছে আয়নায় ভালো করে মুখটাও দেখে না। আজ নিজেকে দেখবে। মায়ের আলমারি থেকে বেছে বেছে একখানা শাড়ি বের করা হয়েছে। রুহির নিজের কোনো শাড়ি নেই। বরাবরই সে তার মায়ের শাড়ি পরে। আজও পরবে।

ছোটভাই টমটম বড় বোনের কান্ড দেখে খুশিতে নাচতে শুরু করলো। রান্নাঘর থেকে মা কে টেনে নিয়ে আসলো দেখানোর জন্য। মমতা খানম মেয়েকে এমন প্রানবন্ত রূপে দেখে কেঁদে ফেললেন।

মা কাঁদবে না তো। অনেক হয়েছে এবার আপু আগের মতো হয়ে গেছে। এখন আর কেঁদো না। আপু দেখলে ভীষণ রেগে যাবে।

মমতা খানম ভয়ে আতকে উঠে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুখ মুছে নিলো। দূর থেকেই মেয়ের সাজগোছ দেখলো। কাছে যাওয়ার সাহস পেলো না। যদি আবার রেগে যায়! ঐ ঘটনার পর থেকে মেয়েটা খিটখিটে হয়ে গেছে।

মমতা খানম ময়নাকে দিয়ে রুহির জন্য ব্রেকফাস্ট পাঠালো।

রুহি ময়নার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বলল, কি রে তুই সাজিস নি কেনো? তুই না সেজেগুজে থাকতে পছন্দ করিস!

ময়না মাথা নিচু করে বলল, গ্রামের বাড়ি থেইকা ফিরাই আম্মার কাছে ওইসব হুনলাম। তারপর কি আর সাজগোজের মন থাকে আফা? বাড়ির কারো মন ভালা নাই আমি এর মধ্যে সাজগোছ কইরা ঘুরতাম!! চাচাজানে দেখলে আমারে খেদায়াই দিতো।

রুহি ময়নার কথা শুনো হাসলো।

ময়না রুহিকে স্বাভাবিক দেখে একটু অবাক হলো। বলল, আফা আপনারে সাজলে কত সুন্দর লাগে। আপনের কাছে তো সাদা ধবধবা মাইয়ারা কিছুই না। হেগোরে সাজলেও এতো সুন্দর দেখায় না যতোডা আপনেরে না সাজলেও সুন্দর দেখায়।

রুহি এবার খিলখিল করে হেসে দিলো। মমতা খানম রান্না ঘর থেকে মেয়ের হাসির শব্দ শুনে প্রচন্ড খুশি হয়ে গেলো।

রুহি বলল, আয় তো ময়না তোকে সাজিয়ে দেই। বস এখানে।

ময়না বলল, না না আফা। চাচাজানে যদি একবার দেহে আমি সাজগোছ কইরা ঘুইরা বেরাইতাছি আমারে আস্ত রাখবো না।

রুহি বলল, ও মা! যার জন্য শোক পালন করবি সে নিজেই তো সেজেগুজে বসে আছে। বোকা মেয়ে কোথাকার। বাবা কিছু বলবে না। আয় তো।

আফা একখান কতা কইতাম।

কী কথা বলনা!

আমার বিয়া ঠিক হইছে।

কিহ!! খুশির খবর দিতে তোর এতোক্ষন সময় লাগলো?

আপনের মন ভালা নাই ভাবছিলাম। এহন তো আপনে সাজগোছ করছেন। মনডা ফুরফুরা তাই ভাবলাম কইয়া ফালাই।

কবে ঠিক হলো বিয়ে?

গ্রামে গেলাম যে তহন। মায় এই জন্যই খবর দিয়া নিছিলো আমারে।

তা তোর বর কি করে? দেখেছিস তুই?

হুনছি কাঠের মিস্তিরি। আমারে দেখবার আইছিলো। তয় আমি হের দিকে তাকাই নাই। মুরব্বিরা সামনে আছিলো কেমনে তাকাই কন আফা। শরমে তো আমার জান যায় অবস্থা।

ময়নার কথা শুনে রুহি হুহু করে হেসে দিলো। হাসি থামিয়ে বলল, তা জেনে নিয়েছিস ছেলের চরিত্র কেমন? ছেলের ফ্যামিলি কেমন ইত্যাদি।

আমার মামায় জানে। হেই তো এই সম্বোন্ধ আনছে। আমি আর কী জানুম! হেরা কী আর আমার খারাপ চাইবো কন?

তারপরও তোর সবটা জানা দরকার। বিয়ে তো তুই করবি।

বাপ নাই। মায় মাইনষের বাড়িতে কাম করে। আমারে চাচাজানে নিজের লগে নিয়া আইলো গ্রাম থেইকা। কত ভালা মানুষ চাচাজানে। মায় কইছে চাচাজানের কাছে বিয়ার কথা কইতে। টাকা-পয়সা লাগবো। চাচাজান হুনলে এমনেই দিবো কিন্তু আমি ক্যামনে কই এই কথা কন আফা! আমার শরম করে।

মা কে বলিস। আচ্ছা তোকে বলতে হবে না। আমি কথা বলবো।

আপনে ভীষণ ভালা আফামনি।

হয়েছে আর পাম মারতে হবে না। বিয়েতে দাওয়াত দিলেই হবে। বলেই রুহি জোরে হাসলো।

দাওয়াত! কি যে কন আফামনি। আপনারা হইলেন ইসপেশাল গেস্টো। সবার আগে তো আমি আপনারেই কইলাম। বেবাকতের যাইতে হইবো আমার বিয়ায়।

রুহি হেসে বলল, ওটা ইসপেশাল গেস্টো না বোকা স্পেশাল গেস্ট হবে। তবে ভালোই হলো তোর বিয়ের জন্য গ্রাম থেকে ঘুরে আসা হবে। চল তোর সাজ কমপ্লিট।

আফা কই যান?

ভার্সিটি যাবো একটু।

নাস্তা খাইয়া যান।

না এখন সময় নেই। মা কে বলিস ফিরতে দেরি হতে পারে।

আইচ্ছা।

রুহি ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আইনি বিভাগে পড়ছে। বহুদিন পর সবাই রুহিকে ভার্সিটিতে দেখে চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে আছে। যেনো সবাই ভূত দেখছে। ক্লাসে গিয়েই শর্মীর চুল ধরে টেনে দিলো রুহি। শর্মী পেছনে ঘুরে রুহিকে দেখে অবাক হয়ে গেলো।

তুই! দুম করে ভার্সিটি চলে এলি আমাকে একবার জানালিও না!! বড্ড শয়তান তুই। এতোদিন যখন ফোন করে করে ভার্সিটি আসার জন্য বলতাম তখন তো ফোন কেটে দিতি। আজ একেবারে একা একাই চলে এলি!

আমি যে এসেছি এটাই কী বেশি নয়? যদি আর কখনও না আসতাম!!

শর্মী মলিন স্বরে বলল, তুই ঠিক আছিস? আঙ্কেল, আন্টির কী খবর! কেমন আছেন সবাই?

ভালো আছে। এখন থেকে সবাই ভালো থাকবে।

শয়তানটার কথা ভাবলেই আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। বাপের ক্ষমতায় যা খুশি তাই করে বেরায়। একবারও ভাবলো না এসব করলে তার পরিনাম কি হতে পারে! তবে আমার মনে হচ্ছে বাবার ক্ষমতার জোরে ও খুব শীঘ্রই জেল থেকে বেরিয়ে আসবে। এসে না জানি আবার কোন তান্ডব চালায়।

আগে বেরিয়ে তো আসুক। কলেজ থেকে তো রাস্টিকেট হয়ে গেছে। লাইফ বরবাদ। ছাড়তো আর ভালো লাগছে না এসব ভাবতে।

কাল আসবি তো ভার্সিটি?

না রে। ময়নার বিয়ে। গ্রামে যাবো সবাই মিলে।

বাহ এখন আমি এখানে একা একা বসে মুড়ি চাবাই। তুমি মামা মাস্তি করে যাচ্ছো।

এক সপ্তাহ জাস্ট। তারপর আমি তোর মেরি জানেমান।

চল ক্যান্টিনে বসে কিছু খেয়ে আসি।

হ্যাঁ যাওয়া যায়। তবে খেয়েই কিন্তু বেরিয়ে পরতে হবে।

এতো তারাতারি!

ময়নার বিয়ের জন্য শপিং করবো। চাইলে তুই ও আসতে পারিস। বিকেলে চারটের সময়। সবাই মিলে শপিং করবো।

ক্যান্টিনে গিয়ে বসতেই আগমন হলো ভার্সিটির সবার হার্ট থ্রব মাহিরের। এই ছেলে প্রথম দিন থেকেই রুহির পেছনে লেগে আছে।

মাহির রুহিদের টেবিলে এসে বসলো। সিনিয়র ভাই বলে কথা। শর্মী মাহিরকে দেখেই বলল, আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো রুহি।

জ্বি ভালো।

তোমার সাথে যেটা হয়েছে একদম ঠিক হয় নি। রোহন শালাকে একদম টাইড দিয়ে দিয়েছি। ভার্সিটিতে তো আর পা রাখতে পারবে না। জীবনে কখনও সামনে পড়লে ঠ্যাং ভেঙ্গে গুরো করে দেবো।

আপনাকে বলেছি এসব করতে?

না।

তাহলে আগ বাড়িয়ে এতো কথা বলছেন কেনো?

এই হলো তোমার সমস্যা। এতো রেগে কথা বললে তো যে কোনো ছেলেরই মাথা গরম হয়ে যাবে। নেহাত আমি শান্তশিষ্ট ছেলে। আর তোমাকে পছন্দ করি বলে কিছু বলি না।

শর্মী আমাদের উঠতে হবে। বলেই রুহি শর্মীকে নিয়ে উঠে চলে গেলো।

যেতে যেতে শর্মী বলল, এতো সুন্দর একটা ছেলেকে তোর ভালো লাগে না? কী ভালো লাগে তোর?

বয়ফ্রেন্ড ছেড়ে দিলে বুঝতি কেনো ভালো লাগে না। আর কোনো ছেলেকে বিশ্বাস ও করবো না কখনও। এখন আমার জীবনের লক্ষ্য একা বাঁচতে শেখা।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here