দ্বিতীয় বসন্ত ❤️ পর্ব -০৯+১০

#দ্বিতীয়_বসন্ত-(৯+১০)
Zannatul Eva

ছেলে গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, তোদের বোনও নিশ্চয়ই মাঝেমধ্যে লাল নীল ড্রেস পরে। আর তাকে দেখেও বাইরের কত গুলো বদমাশ ছেলেরা এরকম নোংরা নোংরা কথা বলে তাই না?

ছেলে গুলোর মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলো, ঐ…….আমার বোনের গায়ে ওর মত কলঙ্ক লাগে নাই। এই মাইয়া তো ধর্ষিতা।

একথা বলে ছেলে গুলো আবারও পৈশাচিক হাসিতে মেতে উঠলো। মাহির প্রচন্ড জোরালো গলায় বলল, হ্যাঁ ও ধর্ষিতা। আর ওর নামের আগে ধর্ষিতা তকমা লাগিয়েছে তোদেরই মতো কোনো এক ধর্ষক, নরপশু। আর তোদের বোন তো ধর্ষিতা না। কিন্তু কে বলতে পারে একটু পরেই হয়তো বোনের ধর্ষন হওয়ার খবর পেলি৷

ছেলে গুলো রাগান্বিত হয়ে বলল, কীহ! শালা তোর মুখ ভেঙ্গে এখনই গুড়িয়ে দেবো। শহর থেকে এসে দাদা গিরি!

মাহির প্রচন্ড জোরে হেসে বলল, কুল ম্যান কুল। জাস্ট এটুকু বললাম তাতেই এতো রাগ! নিজের বোনের বেলায় সব হিসেব বরাবর আর অন্যের বোনের অসয়তার মজা নেয়ার সুযোগ একদম হাত ছাড়া করা যাবে না৷ এরপর থেকে রুহিকে দেখলে চোখ নিচে নামিয়ে রাখবি। নয়তো…….

একথা বলেই মাহির চলে গেলো। ছেলে গুলো চেচিয়ে চেচিয়ে বলল, শহর থেকে এসে দাদা গিরি দেখাচ্ছে। পাই একবার সুযোগ মতো…….

রুহির ভাই রায়রান দৌড়ে মাহিরে সামনে এসে বলল, থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাইয়া।

মাহির অবাক হয়ে বলল, কেনো?

আপনি আমার আপুর জন্য প্রতিবাদ করলেন। শুধু এই ছেলে গুলোই না আপু যেখানেই যায় সেখানেই আপুকে এসব কথাবর্তার সম্মুখীন হতে হয়। সবাই ভাবে আমার আপু খারাপ। কিন্তু আমার আপু তো খুব ভালো। আমার কলেজের অনেকেই আপুকে নিয়ে কটু কথা বলে। হাসাহাসি করে। আমি কিছু বলতে পারি না৷ মাথা নিচু করে চলে আসি। কিন্তু আপনি উচিত জবাব দিয়েছেন।

মাহির বলল, শুনো কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করবে না। যারা মাথা নিচু করে থাকে তাদেরকে মানুষ দুর্বল মনে করে। আর দুর্বলদের সাথে সবসময় মানুষ জুলুম করে মজা পায়। সব সময় মাথা উঁচু করে বাঁচবে। কেউ কিছু বললে তাকে সাথে সাথে জবাব দেবে। দেখবে এরপর আর কেউ তোমাকে নিয়ে কিছু বলতে সাহস পাবে না। কথায় আছে, “মানুষ শক্তের ভক্ত, নরমের গরম।” মনে থাকবে?

রায়হান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।

মাহির বলল, জোর গলায় বলো।

রায়হান জোরে বলল, হ্যাঁ।
____________________________________________________

বিয়ে বাড়িতে কয়েকজন মহিলা বলাবলি করছিলো রুহিকে নিয়ে।
ময়নার বিয়ায় ঝামেলা হইতো না যদি না এই মাইয়া এইহানে না আইতো। এই মাইয়ার খারাপ ছায়া পরছে আমগো ময়নার উপরে। শুভ কাজে অশুভ মাইয়া মানুষের নজরে এমন একটা ঝামেলা ঘইটা গেলো।

হ ভাবি ঠিকই কইছেন৷ ভাগ্যিস পোলাটায় আছিলো। নাইলে তো মাইয়াডার বিয়া ভাইঙ্গাই যাইতো। অপয়া মাইয়া নিয়া আসার কী দরকার ছিল এইহানে!!

আরে ভাবি বড়লোকরা তো এইসব মানে না৷ ভালো খারাপের বালাই থাকলে কী এইহানে আইতো!!

রায়হান প্রচন্ড জোরালো গলায় বলল, চুপ করেন আপনারা। তখন থেকে কী সব বলে যাচ্ছেন আমার আপুকে নিয়ে। আপনার মেয়ের সাথে এরকম হলে তখনও কি ঠিক এইভাবে বলতে পারতেন?

একজন মহিলা ঝাঁজালো গলায় বলে উঠলো, এই পোলায় কয় কী! আমাগো মাইয়া এমন আকাম কুকাম কইরা বেরায় না শহরের মাইয়াগো মতো। ভালো মাইয়াগো সাথে তো এরম হয় না। এই মাইয়া উল্টাপাল্টা কিছু করছে বইলাই তো এই কাম ঘটছে। ছিঃ ছিঃ এইসব ভাবলেও তো গা ঘিনঘিন করে।

রায়হান এবার তেড়ে গেলো মহিলা গুলোর দিকে। মুখের সামনে আঙুল তুলে বলল, একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়েকে এসমস্ত কথা বলতে একটুও বাঁধছে না! কেমন মানুষ আপনারা?

রুহি রায়হানকে টানতে টানতে বলল, চলে আয় টমটম৷ এদের সাথে তর্ক করে কোনো লাভ নেই৷

রায়হান রুহির হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, এদের তো বুঝতে হবে ধর্ষিতা মানেই একটা মেয়ে খারাপ হয়ে যায় না৷ এদের জন্যই ঐ ধর্ষক গুলো পার পেয়ে যায়। দিনশেষে সমস্ত অপবাদ কেবল ঐ মেয়ে গুলোর জন্যই বরাদ্দ থাকে৷ অথচ ধর্ষকরা ঘুরে বেরায় ভালো মানুষদের ভীরে। তাদেরকে কেউ কিছুই বলে না। এখনও ছেলে মেয়ের মধ্যে এতো ভেদাভেদ। ওয়ার্ন করছি আর কোনোদিন যদি আপনাদের মুখে এসব কথা শুনি তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।

রুহি রায়হানকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে এলো৷
বাসায় ফেরার পর থেকে রুহি একটা কথাও বলেনি কারো সাথে। চুপচাপ রুমের মধ্যে বসে ছিল। সায়েদা বেগম আশরাফ খানকে ডেকে বললেন, এই জন্যই কইছিলাম ওরে এতো মাইনষের ভীরে নিছ না। দেখলি তো ঠিক মাইনষে পাঁচ কথা হুনায় দিলো। এইবার মাইয়ার বিয়ার ব্যবস্থা কর আশরাফ। নাইলে কথা হুনতে হুনতে কান পইচা যাইবো বেবাকতের। আমি রশিদ ঘটকরে খবর দিছি। দেহি হ্যায় কেমন পোলার সন্ধান দেয়।

রুহি বলে উঠলো, আমি বিয়ে করবো না দাদিজান৷ যেমন আছি তেমনই ভালো আছি। মানুষের কথা না ধরলেই তো হয়! বিয়ের দিয়ে ঘার থেকে বোঝা নামাতে চাইছো তাই না? আমি এখন তোমাদের ঘাড়ে অনেক বড় বোঝা হয়ে গেছি৷ বুঝি আমি সব।

আশরাফ খান বললেন, নারে মা। ছেলে-মেয়ে বড় হলে সব বাবা-মায়েরই চিন্তা হয়। আমারও তো বয়স হচ্ছে। একটা ভালো পাত্রের হাতে তোকে তুলে দিয়ে যেতে পারলে আমার শান্তি।

রুহি কোনো কথা না বলে চলে গেলো। আশরাফ খান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মমতা খানমের চোখ বেয়ে পানি পরছে৷ সায়েদা বেগম ভারী গলায় বললেন, ছোট বউ রশিদ ঘটকরে আবার একটা ফোন লাগাও তো।
___________________________________________________

রুহি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছে৷ প্লে লিস্টে বাজছে রুহির প্রিয় গান____

“আমি শুনেছি সেদিন তুমি
সাগরের ঢেউয়ে চেপে,
নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো।
আমি শুনেছি সেদিন তুমি
নোনবালি তীর ধরে,
বহুদুর বহুদুর হেঁটে এসেছো।
আমি কখনও যাই নি জলে,
কখনও ভাসিনি নীলে
কখনও রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাংচিলে।
আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে
আমাকেও সাথে নিও,
নেবে তো আমায় বল নেবে তো আমায়?”

রায়হান এসে রুহির পাশে দাঁড়ালো। কোনো কথা বলছে না।

রুহি ইয়ারফোন খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, তখন এতো পাকা পাকা কথা বললি এখন চুপ করে আছিস যে! এতো কথা কে শেখালো তোকে! নাকি আমার ভাই সত্যিই অনেক বড় হয়ে গেছে হুম?

মাহির ভাইয়া।

কী?

মাহির ভাইয়া শিখিয়েছে। কিভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়।

এর মধ্যে মাহির কখন এলো!

কয়েকটা ছেলে তোকে নিয়ে বাজে কথা বলছিলো। তখন মাহির ভাইয়া ওদের মুখের উপর জবাব দিয়েছে। সত্যিই তো আমরা চুপ করে থাকি বলেই সবাই আরও পেয়ে বসে।

তো কী করতাম! মাহিরের মতো গুন্ডামি করতাম?

গুন্ডামি নয় তবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত। মুখের উপর জবাব দেয়া উচিত। এটা আজ আমি মাহির ভাইয়ার কাছ থেকে শিখেছি। উনি আসলেই খুব ভালো মানুষ আপু। বিয়ে বাড়ির ঝামেলাটা কি সুন্দর করে হ্যান্ডেল করলো দেখলি!

রুহি পাত্তা না দিয়ে বলল, হয়েছে হয়েছে। এখন যা এখান থেকে। আমি একটু ঘুমোবো।

রায়হান চলে যাওয়ার পর রুহি মাহিরের কথা ভাবতে লাগলো।

আচ্ছা আমি কী সত্যিই মাহিরকে একটু বেশিই খারাপ ভেবে ফেলেছিলাম! ও তো আমাকে কখনও খারাপ কিছু বলেনি। হ্যাঁ একটু বেপরোয়া টাইপ কিন্তু অতোটাও খারাপ না। যাই হোক যেহেতু আমার হয়ে এতো গুলো কথা বলেছে সো একটা থ্যাংক্স দেয়াই যায়। দেখা হলে বলে দিবো।
____________________________________________________

মাহিরের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখবো ভাবছি। রেহনুমা আহমেদ বললেন।

তামজিদ আহমেদ কপাল কুঁচকে বললেন, মেয়ে তো আমাদের চোখের সামনেই আছে। ভীষণ ভালো মেয়ে।

রেহনুমা আহমেদ বললেন, কোন মেয়ের কথা বলছো?

পর্ব-১০

কেনো আমাদের আশরাফের মেয়ে।

রেহনুমা আহমেদ বললেন, কালকে বিয়ে বাড়িতে শুনতে পাও নি কিছু?

কী?

ঐ মেয়ে তো রেপ হয়েছিলো।

তামজিদ আহমেদ বললেন, হোয়াট? কী সব বলছো!

হ্যাঁ। আশেপাশের লোকজনদের কানাঘুষায় তো তেমনটাই শুনলাম। এমন মেয়েকে আমার ছেলের জন্য আনবো তোমার কী মাথা খারাপ নাকি! একমাত্র ছেলে আমার।

তামজিদ আহমেদ বললেন, এতো কিছু হয়ে গেলো আর আশরাফ আমাকে কিছু জানালো না! স্ট্রেঞ্জ!!

রেহনুমা আহমেদ বললেন, এসব কথা কেউ বলে! ওনারা তো ধামাচাপা দিতে চাইবেনই। নয়তো মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে! কিন্তু সত্য কী কখনো চাপা দিয়ে রাখা যায়!!

তামজিদ আহমেদ নিচু স্বরে বললেন, সো স্যাড। মেয়েটার জন্য বড্ড মায়া হচ্ছে। ভীষণ ভালো মেয়ে। ঐ দিন সকালে হাঁটতে বেরিয়ে যে বুকে ব্যথা উঠেছিলো। তখন ঐ মেয়েটাই আমাকে পানি খাইয়েছিলো। এতো সুন্দর একটা মেয়ের সাথে এমন দুর্ঘটনা ঘটলো! দুনিয়াটা আসলে খারাপ লোকে ভরে গেছে। মেয়েদের কোনো নিরাপত্তা নাই।

রেহনুমা আহমেদ বললেন, অন্য কিছুও তো হতে পারে! হয়তো মেয়েটারই কোনো দোষ ছিল। তারপর বাঁচার জন্য রেপ কেস বলে চালিয়ে দিয়েছে। আজকালকার মেয়েদের দিয়ে বিশ্বাস নেই।

আহা তুমি এসব কী বলছো! আশরাফ আমার ছোট বেলার বন্ধু। ওর মেয়ে এমন হবে! ইম্পসিবল। আশরাফ তার ছেলে-মেয়েকে যথেষ্ট ভদ্রতা শিখিয়েছে। মানুষ চিনতে আমার ভুল হতে পারে না। মেয়েটি ভীষণ ভালো।

রেহনুমা আহমেদ বললেন, ভালো খারাপ যাই হোক। একবার যখন ও মেয়ের গায়ে ধর্ষিতার দাগ লেগে গেছে আমার ছেলের জন্য ঐ মেয়ের কথা ভুলেও ভাববে না তুমি। দুনিয়ায় কী আর কোনো মেয়ে নেই!!

হোয়াট ইজ দিছ রেনু! তুমি তো একজন শিক্ষিতা মহিলা। তোমার মাথায় এসব পুরনো চিন্তা-ভাবনা শোভা পায় না। কারো জীবনে খারাপ কিছু ঘটেছে বলে কী সে নতুন করে বাঁচতে পারবে না! কেউ না কেউ তো ওকে বিয়ে করবেই৷ তাহলে আমাদের ছেলে করলে দোষ কোথায়? এটা তো আরও গর্বের ব্যাপার হবে যে আমার ছেলে সমাজের পুরনো নিয়ম, নোংরা চিন্তাভাবনার দেয়াল ভেঙ্গে দেবে।

তোমার এসব বিপ্লবী চিন্তা-ভাবনা তোমার ভেতরেই রেখে দাও। খবরদার আমার ছেলের কানে তুমি এসব কথা তুলবে না। খুব খারাপ হয়ে যাবে তাহলে।

একথা বলেই রেহনুমা আহমেদ গটমট করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলেন।
__________________________________________________

এই রুহি আপু ঐ দেখো মাহির!

কই? কই?

বাহ দেখার জন্য এতো উদগ্রীব হয়ে আছো! জানলে না হয় একটা খবর দিয়ে আনতাম তাকে।

রুহি রুম্পার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে বলল, চুল টেনে ছিড়ে ফেলবো একদম৷ আমি জাস্ট ওকে থ্যাংক ইউ বলতে চাই। বাস আর কিছু না। মিথ্যে কেনো বললি!!

রুম্পা মুখ টিপে হেসে বলল, না বললে তো জানতামই না তোমার উদগ্রীব হওয়ার কথা।

দাঁড়া এবার সত্যি সত্যিই তোর চুল ছিড়বো আমি।

রুহি আর রুম্পা দুষ্টুমি করতে করতে সারা বাড়ি দৌড়াচ্ছিলো এমন সময় সায়েদা বেগম বললেন, এই মাইয়া যা ঘরে যা। বিকালে তোরে পাত্রপক্ষ দেখতে আইবো। একদম শান্ত হইয়া থাকবি। আর রুম্পা তোরে যানি তখন আশেপাশে না দেহি৷ ঘরের মধ্যে চুপ কইরা বইয়া থাকবি কইলাম।

রুম্পা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
____________________________________________

বিকেলে পাত্রপক্ষ এলো রুহিকে দেখতে। মমতা খানম মেয়েকে সাজিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে এলো।

পাত্রের মা চোখমুখ বেকিয়ে বলল, আপনাদের মেয়ের নাকি…… আসলে আসার পথে অনেকের মুখেই শুনলাম এসমস্ত কথা। আগে জানলে সময় নষ্ট করে আসতাম না এতো দূর৷ আমাদের একটা সম্মান আছে। এরকম একটা মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে নিয়ে যাবো কীভাবে বলেন? নানা লোকে নানা রকম কথা বলবে। তবে আমরা শুনেছি আপনাদের বাড়িতে আরও একটা মেয়ে আছে। আমরা ঐ মেয়েকে একবার দেখতে চাই।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here