#দ্বিতীয়_বসন্ত-১৭
Zannatul Eva
সকাল সকাল রুহি ঘুম থেকে উঠে জানালার পর্দাটা টেনে দিলো। সূর্যের আলোটা একদম মাহিরের মুখ বরাবর এসে পরেছে। রুহি এক দৃষ্টিতে মাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলো। সব সময় রাগি, বদমেজাজি মাহিরকে ঘুমন্ত অবস্থায় একদম নিষ্পাপ লাগছে। ঘুমন্ত অবস্থায় সব মানুষকেই একদম নিষ্পাপ, শুদ্ধ মনে হয়। রুহি মনে মনে বলল, আমি চাই না আমার মত একটা মেয়ে আপনার জীবনের সাথে জড়িয়ে পরুক৷ ভালোবাসার উপর থেকে আমার সমস্ত ভরসা উঠে গেছে। আর কখনও কাউকে ভালোবাসতে পারব না। আপনি আমার কাছ থেকে কিছুই পাবেন না। না ভালোবাসা না…..
এমন সময়ই মাহিরের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। রুহি তারাতারি চোখ সরিয়ে নিলো।
মাহির কপাল কুঁচকে মনে মনে বলল, ও কি আমায় দেখছিলো? নাকি আমার মনের ভুল!! শাড়িতে রুহিকে অসম্ভব সুন্দর দেখায়। কাল রাতে খেয়াল করে দেখিনি। এই প্রথম রুহিকে শাড়ি পরা দেখলাম। যাকে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম নিয়তির খেলায় সেই রুহিই এখন আমার স্ত্রী। ভবিষ্যৎ কী অদ্ভুত!!
মুন্নী দরজায় নক করে বলল, ভাইয়া ভাবি বড় চাচ্চু তোমাদেরকে খাবার টেবিলে আসতে বলেছেন। জলদি এসো।
রুহি নিচু স্বরে বলল, তুমি যাও আমরা আসছি।
মাহির একটা সিগারেট ধরালো। রহি একটান দিয়ে মাহিরের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে গেল।
সকাল সকাল কেউ এসব খায়? ইশশশ ছিঃ কী বাজে গন্ধ! কী করে খান বলুন তো এসব ছাইপাঁশ!! আমার তো গন্ধতেই মাথা ধরে যায়। আপনার জন্য এখন আমার সারাদিন মাথা ধরে থাকবে। সারাজীবন আমাকে এসব সহ্য করতে হবে!!
মাহির মৃদু হেসে বলল, তুমিও চাইলে ট্রাই করতে পারো। মুভিতে দেখো নি?
রুহি বলল, কী?
হিরো হিরোইন একসাথে সিগারেট খায়। ব্যাপারটা কিন্তু দারুন রোমান্টিক।
ইশশশ ছিঃ এটাকে আপনার রোমান্টিক ব্যাপার মনে হলো!! এর থেকে তো না খেয়ে থাকা অনেক ভালো। আমি জীবনেও এসব খাবো না। আর আপনিও খাবেন না। বাইরেও না আর আমার সামনে তো একদমই না।
বলেই রুহি গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
মাহির সিগারেটের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে বলল, হাহ! বউয়ের জন্য এখন প্রথম প্রেমিকাকে ইগনোর করতে হবে! সরি মাই র্ফাস্ট লাভ। তুমি বরং এখন থেকে আমার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যেস তৈরি করো। তোমার সতিন কিন্তু তোমাকে একমদই সহ্য করতে পারে না৷
________________________
খাবার টেবিলে সবাই মিলে নাস্তা করছিলো এমন সময় তালেব আহমেদ রুহিকে বললেন, তোমার বাড়ির লোকজন যেনো ভুলেও এ বাড়ি না আসে। এ বাড়িতে থাকতে হলে তুমি ওদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবে না। যদি রাখো তাহলে তোমাকে সারা জীবনের মতো ও বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে। বোঝা গেছে?
সবাই প্রচন্ড অবাক হয়ে গেল। মাহির বলল, কেনো বড় দাদাভাই? কী জন্য এমনটা বলছো? রুহির পরিবার কী দোষ করেছে?
এ নিয়ে আর একটা কথাও বলতে ইচ্ছুক নই আমি।
রুহি কিছু বলতে যাবে এমন সময়ই বাড়িতে অতিথিদের আগমন হলো।
রুহির বাবা-মা, ছোট চাচা-চাচি আর রুম্পা এসেছে।দেখা মাত্রই এক দৌড়ে সবার কাছে ছুটে গেল রুহি।
মমতা খানম মেয়েকে দেখেই কেঁদে ফেললেন। রুহিও সবাইকে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে গেল। নাছিমা চোখ মুখ পাকিয়ে বলল, বাহ রুহি ভালো পরিবারটাকে একদম হাতিয়ে নিয়েছিস।
আজমল খান চোখ রাঙিয়ে নাছিমাকে শান্ত করালেন।
মাহিরের মা এসে যা নয় তাই বলে সবাইকে অপমান করতে শুরু করলো।
আপনারা আপনাদের ধর্ষিতা মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছেন না বলে আমার ছেলেটার ঘাড়ে গছিয়ে দিলেন? এতো লোভ আপনাদের!!
মমতা খানম বলল, এসব কী বলছেন ভাবি? আমরা কেউই কিছু জানতাম না। রুহির বাবা রাতে বাড়ি ফিরে আমাদেরকে সমস্তটা খুলে বলার পর জেনেছি। তাছাড়া আমার মেয়ে কেনো আপনার ছেলের ঘাড়ে চাপবে? ও পড়াশোনা জানা মেয়ে। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি বাকরি করবে। কারো ঘাড়ে বোঝা কেনো হবে আমার মেয়ে!!
তাহলে সেটাই করাতেন মেয়েকে দিয়ে। তাহলে অন্তত আমার ছেলেটা বেঁচে যেতো। আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। আমার এক মাত্র ছেলে কী এমন এটা মেয়েকে ডিজার্ব করে! যেই মেয়ে কিনা একটা ধর্ষিতা।
মাহির বলল, মা এসব কী বলছো তুমি!! রুহির অতীত নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তাহলে তোমাদের সমস্যা হচ্ছে কেনো? সংসার তো তোমরা করবে না। আমি করবো। আর রুহি মোটেও খারাপ মেয়ে নয়৷ আই ট্রাস্ট হার।
এক রাতেই আমার ছেলের মাথাটা চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছে। অলুক্ষনে মেয়ে কোথাকার৷
রুহি একদম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ মুখ বুজে সবটা সহ্য করে যাচ্ছে।
আশরাফ খান বললেন, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন যদি আপনারা আমার মেয়েকে মেনে না নেন তাহলে আমার মেয়ের কী হবে? আমি তো তোর ভরসাতেই আমার মেয়েকে তোর ছেলের হাতে তুলো দিয়েছিলাম তামজিদ। এখানে এসে এসব কী শুনছি!! আমার মেয়েটা কী করে থাকবে এখানে?
নীলিমা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বলল, আপনারা বসুন না। বসে আমাদের সাথে নাস্তা করুন। এসব আলোচনা না হয় পরে করা যাবে।
ভয়ে ভয়ে নীলিমা চাচাজানের দিকে তাকালো।
তামজিদ বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ নীলিমা ঠিকই বলেছে। সবাই বসে নাস্তা করতে করতে ঠান্ডা মাথায় কথা বলা যাবে। বউ মা তোমার বাবা-মা সবাইকে বসতে দাও।
সবাই বসার পর রুহি জিজ্ঞেস করলো, দাদিজান এলো না যে!
আশরাফ খান বললেন, ফুপু আসতে পারেনি।
তালেব আহমেদ বললেন, আসবেন কী করে! আসার মতো মুখ আছে তার?
একথা বলেই তালেব আহমেদ উঠে চলে গেলেন।
আশরাফ খান ভীষণ চমকে গেলেন। কী ব্যাপার! ফুপুজানও গতকাল এ বাড়ির কথা শুনে রেগে গেলেন আবার এই বাড়িতে আসার পরেও সেই একই ঘটনা। কিছু তো একটা ব্যাপার আছে। আমার মনে হয় তামজিদ সবটা জানে।
আশরাফ তামজিদকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই সে এড়িয়ে যায়। যতক্ষন রুহির বাপের বাড়ির লোকজন ছিল ততোক্ষন রেহনুমা নিজের ঘর থেকে আর বেরোয় নি।
এরপর সবাই চলে যাওয়ার পর রুহি মাহিরকে প্রশ্ন করলো, দাদাভাই তখন এরকম কথা কেনো বললেন? আপনি কী জানেন?
আমি জানলে তো কোনো সমস্যাই থাকতো না। আমি বুঝতে পারছি না দাদাভাই কেনো তোমাদের পরিবারের কথা শুনলে রেগে যান।
তখন রুম্পাও আমাকে বলছিলো, দাদিজানও নাকি আপনাদের কথা শোনার পর প্রচন্ড রেগে গেছেন। এর পেছনে অবশ্যই কোনো কারন আছে। আমার মনে হয় বাবা সবটা জানেন।
তাহলে ফোন করে জিজ্ঞেস করো বাবাকে।
আরে আমার বাবা না। আপনার বাবা। মানে আমার শ্বশুর মশাই। বাবা কাল অনেক বার দাদাভাইকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আপনি খেয়াল করেন নি?
উনিই আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। যদিও আমার এসব জানার কোনো ইন্টারেস্ট নেই৷ আমাকে যদি এখান থেকে পাঠিয়ে দেয় আমি চলে যাব। আপনার ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকতে চাই না আমি।
মাহির ভারী গলায় বলল, চলে যাবে মানে!!
আসতে পারি? তামজিদ আহমেদ দরজায় নক করলেন।
রুহি মাথায় ঘোমটা টেনে বলল, আসুন না বাবা। বসুন।
আমি জানি তোমাদের মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছে গতকাল এবং আজকের ঘটনা নিয়ে। আমার মনে হয় আমার তোমাদেরকে সেসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া দরকার।
মাহির কোতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলো, কী হয়েছিলো দুই পরিবারের মধ্যে?
তামজিদ আহমেদ ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার দাদাভাই আর রুহির দাদিজানের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল। শুনেছি তাদের বিয়েও ঠিক হয়েছিল। কিন্তু কোনো কারনে বিয়েটা ভেঙ্গে যায়। তারপর থেকে কখনও দুজন দুজনের মুখোদর্শনও করেনি। ছোট বেলায় একসাথে লেখাপড়া করার সুবাদে আশরাফের সাথে আমার বন্ধুত্ব তৈরি হয় ঠিকই কিন্তু বড় হওয়ার পর চাচাজানের আদেশে আমি আশরাফের সাথে বহু বছর কোনো যোগাযোগ রাখিনি। গ্রামে এসে ওদের বাড়িতে গেলাম তা চাচাজানকে না জানিয়ে। জানলে হয়তো আর রক্ষে থাকতো না। আমার মনে হয়েছিল তোমাদের দুজনের বিয়েটা দুই পরিবারকে মেলাতে পারবে। কিন্তু ওনারা তো এখনও সেসব পুরনো স্মৃতি, রাগ, অভিমান জমিয়ে রেখেছেন। আমি কী তবে তোদের বিয়েটা দিয়ে ভুল করে ফেললাম!! সামনে হয়তো আরও অনেক বড় ঝামেলা আসতে চলেছে। জানিনা সেসব কীভাবে সামাল দেবো। দুই পারিবারকে কীভাবে এক করবো!!
রুহি এবং মাহির দুজনেই অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো, কিন্তু ওনাদের বিয়েটা কেনো ভেঙ্গে গিয়েছিল?
চলবে……..