দ্বিতীয় বসন্ত ❤️ পর্ব -১৮

#দ্বিতীয়_বসন্ত-১৮
Zannatul Eva

বিয়ে কেনো ভেঙ্গে গিয়েছিল তা আমাদের সবার অজানা। আমরা তখন অনেক ছোট ছিলাম। আর বড় হওয়ার পর এসব বিষয় নিয়ে কেউ কখনও কোনো আলাপ আলোচনা করেনি। তারপর চাচাজান আর কখনও বিয়ে করেন নি।আমাদের দাদাজান হয়তো এ ব্যাপারে সবটা জানতেন। কিন্তু দাদাজান ও মারা গেছেন বহু বছর হয়ে গেছে।

তমজিদ আহমেদ কথা গুলো বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রুহি বলল, স্ট্রেঞ্জ! দাদিজানও তো বিয়ে করেন নি।আমার মনে হয় ওনারা এখনও দুজন দুজনকে ঠিক আগের মতোই ভালোবাসেন৷সেটা না হলে দুজনেই নতুন করে বিয়ে করে সুখে সংসার করে জীবন কাটিয়ে দিতেন।

পয়েন্ট টু বি নোটেট। রুহি একদম ঠিক কথা বলেছে। আচ্ছা বাবা বড় দাদাভাইকে যদি এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করি……!

তামজিদ মাহিরকে বলল, ভুলেও সে কাজ করতে যাস না। আমাদের কারোই সেই সৌভাগ্য হয় নি আজ পর্যন্ত। উল্টো চাচাজান ভীষণ রেগে যাবেন। আমার মনে হয়েছে তোদেরকে ধোঁয়াশায় রাখা ঠিক হবে না।তাই যেটুকু জানি সেটুকু বললাম।

এ কথা বলেই তামজিদ আহমেদ চলে গেলেন।মাহির আবারও একটা সিগারেট ধরালো। রুহি রাগি স্বরে বলল, আবার!! এক্ষুনি ফেলুন ওটাকে।

কেনো ফেলবো!! তোমার জন্য কেনো ফেলবো? তুমি আসার আগে সিগারেট আমার জীবনে এসেছে। আর তাছাড়া তুমি তো আমাকে তোমার স্বামী হিসেবে মেনেই নাও নি। মানে আমাদের বিয়েটা লোক দেখানো। তাহলে কেনো আমি তোমার কথা শুনতে যাব? হোয়াই?

রুহি মুখ বেকিয়ে বলল, অধিকার দেখিয়ে বলিনি। সমাজের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মানুষকে সিগারেট খেতে বারন করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পরে। ভুলে যাবেন না আমি কিন্তু আইনি বিভাগের ছাত্রী।

পড়াশোনা তো সব লাটে উঠেছে।

সেটাও আপনার জন্যই। এসেছিলাম ময়নার বিয়ে খেতে আর এখন নিজেই বিয়ে করে বসে আছি।ইচ্ছে করছে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাই।

তুমি বরং সেটাই করে।

রুহি এবং মাহির ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো, তালেব আহমেদ দাঁড়িয়ে আছেন।

আসসালামু আলাইকুম দাদাভাই। আসুন না।বসুন প্লিজ। রুহি বলল।

তালেব আহমেদ হাত উঠিয়ে বললেন, বসতে আসিনি। বলতে এসেছি।

বলুন না দাদাভাই কী বলবেন?

তালেব আহমেদ হালকা কেশে বললেন, খান পরিবারের সাথে আমাদের ওঠাবসা নেই প্রায় অনেক বছর।সেই বাড়ির মেয়ের সাথে আমার একমাত্র নাতির বিয়ে হবে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। এরপর যখন তোমাকে তোমার বাপের বাড়ি থেকে নিতে আসবে তখন তুমি তাদের সাথে চলে যাবে। এবং আমি চাই তুমি যেনো আর কখনও এ বাড়িতে পা না রাখো।

রুহি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।

মাহির বলল, বড় দাদাভাই আমার কথা শুনো………..

তালেব আহমেদ তৎক্ষনাৎ চলে গেলেন।

মাহির রুহির দিকে রাগি স্বরে তাকিয়ে বলল, তুমি তখন বড় দাদাভাই এর কথায় মাথা নাড়ালে কেনো?

তো কী করতাম! কেনো থাকবো বলুন তো আমি এ বাড়িতে! আমার মতো একটা মেয়েকে কেনোই বা আপনার পরিবারের লোকজন মেনে নেবে? কেনো?

বাবা, ছোট চাচা-চাচি তারা তো মেনে নিয়েছে।

কিন্তু আপনার মা? এখন তো মনে হচ্ছে এসবের চেয়ে তখনই যদি সবাইকে বলে দিতাম আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না। তাহলেই বোধহয় খুব ভালো হতো। এ বাড়িতে আসার পর এতো সমস্যা তৈরি হবে আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি। আমি শুধু তখন আমার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন আমি চাই নি আমার এই কলঙ্ক মাখানো জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে। আচ্ছা আপনি কেনো আমাকে বিয়ে করতে চাইলেন? আপনি তো সবটা জানতেন। তাও কেনো একটা ধর্ষিতা মেয়েকে পছন্দ করেন আপনি?

মাহির শুধু হাসলো। কোনো কথা বলল না। একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

রুহি অদ্ভুত দৃষ্টিতে মাহিরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
_____________________

হুনলাম তামজিদের পোলা নাকি একটা ধর্ষিতা মেয়েরে বিয়ে করছে? হ্যাঁ গো ভাবি কথা কী সত্যিই?

কয়েকজন প্রতিবেশী এসেছে নতুন বউ দেখতে। আসলে বউ দেখতে এসেছে বললে ভুল হবে। এরা এসেছে নিন্দে করতে। নতুন বউয়ের দোষ গুন বিচার করতে। এরকম একদল প্রতিবেশী বোধহয় দুনিয়ার সব জায়গাতেই বিদ্যমান।

মাহিরের মেজো চাচি মুনিরা বলল, তা আর বলতে!! এমন মেয়ে বিয়ে করে এনেছে কী আর বলবো। মেয়ের তো চরিত্রের ঠিক নেই। কী জানি ঢাকায় কী করে বেরাইছে। ভালো মেয়েদের সাথে এসব হয় নাকি? বড় ভাবি তো বিয়ে মেনে নেয় নাই।

ঠিকই বলছেল ভাবি আপনে। কেমনেই বা মাইনা নিবো! একটা মাত্র পোলা৷ তাও যদি পছন্দ কইরা বিয়া খান হইতো। হইছে তো ধরা খাইয়া। তা মাহির কী সত্যিই…….

মুনিরা বলল, আরে না না কী বলেন ভাবি! আমাদের ছেলের কোনো দোষ নাই। ও মেয়েই মাহিরকে একা পেয়ে ফাঁসিয়ে কায়দা করে বিয়ে করে এ বাড়িতে এসে জুটেছে। ধর্ষিতা মেয়ে এই জীবনে তো বিয়ে শাদি হতো না। হলেও আমাদের মাহিরের মতো ছেলে পাইতো? হুহ তাই তো এসব করে ঘাড়ে চাপছে।

নীলিমা বলল, ছিঃ ছিঃ ভাবি এসব তুমি কী বলছো? একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সম্পর্কে না জেনে এতো খারাপ কথা বলছো! পৃথিবীতে যে সব মেয়েরা ধর্ষনের শিকার হয় তারা সবাই কী খারাপ? এখানে তাদের কী দোষ? একটা মেয়ের সম্পর্কে এভাবে বলো না। তোমারও মেয়ে আছে। আল্লাহ কখন কাকে কোন পরিস্থিতিতে ফেলে কেউ বলতে পারে না।

মুনিরা রেগেমেগে বলল, একদম মুখে মুখে কথা বলবি না ছোট। খবরদার বলছি। আমার মেয়েদের আমি এমন শিক্ষা দিয়ে বড় করিনি। ওরা যথেষ্ট ভালো।

নীলিমা বলল, তুমি কী করে জানলে রুহি খারাপ মেয়ে? তুমি কী করে আরেক জনের মেয়েকে খারাপ বলতে পারো?

রেহনুমা এসে উত্তর দিলো, মেজো তো একদম ঠিকই বলেছে। যেই মেয়ে এভাবে আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করতে পারে সেই মেয়ে যে কেমন হবে তা আমার ভালোই জানা আছে। তুই আর ওর হয়ে সাফাই গাস না।

তুমি আমার হয়ে কিছু বলোনা ছোট চাচি। সত্যিই তো আমি একটা ধর্ষিতা মেয়ে। আমার কোনো দোষ না থাকলেও সমাজ আমাকে অন্য চোখে দেখে। সবাই ভাবে আমিই দোষী।

ও মা গো এই মেয়ে তো ভালোই চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলতে পারে৷ দুদিন হয়নি বিয়ে করে এসেছে আর এখনি মুখে মুখে কথার উত্তর দিচ্ছে।

প্রতিবেশীরাও মুনিরার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলালো।

রুহি মৃদু গলায় বলল, ছোট চাচি আমাকে বলো কী রান্না করতে হবে। আমি আজকে সবার জন্য রান্না করবো।

রেহনুমা বলল, মেজো-ছোট ওকে বলে দে, ওর হাতের রান্না করা খাবার আমি মুখেও তুলবো না।

রুহি বলল, আচ্ছা তাহলে আমি হাতে হাতে সাহায্য করে দেই?

তোমার হাতের স্পর্শ করা কোনো কিছু আমি মুখে তুলবো না৷ দরকার হলে আমি না খেয়ে থাকবো। তবুও তোমার হাতের রান্না খাবো না।

রুহির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে।

নীলিমা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বলল, এ মা তুমি তো নতুন বউ। তুমি কেনো রান্না করবে? তোমাকে এখন কিচ্ছু করতে হবে না। তুমি নিজের ঘরে যাও। ক’দিন যাক তারপর থেকে না হয় সংসারের কাজে হাত লাগাবে।

রুহি নিচু স্বরে বলল, জ্বী আচ্ছা।
____________________

আচ্ছা ফুপুজান রুহির দাদা শ্বশুর বলল, আপনার নাকি ও বাড়িতে যাওয়ার মতো মুখ নাই। এমন কথা কেনো বলল সে? এর কারন কী?

সায়েদা বেগম শাড়ির আঁচলে চাবির গোছা বাঁধতে বাঁধতে বললেন, হুহহহ কে কারে মুখ দেখাইতে পারবো না তা আমার খুব ভালো কইরাই জানা আছে। তা সে কী জানে যে তার মতো মানুষের মুখদর্শনও আমি করতে চাই না বইলাই ঐ বাড়িতে যাই নাই। আমি তো ভাবতেই পারতেছি না যে আমার নাতনির বিয়া ঐ বাড়িতে হইছে। ঐ বাড়ির লোকজনের কাছে তো বিয়া একটা পুতুল খেলা। কিন্তু আমার নাতনির জীবন নিয়া আমি ওদের পুতুল খেলতে দিম না। আমার নাতনি কেমন আছে আশরাফ?

আশরাফ খান ভারী নিশ্বাস ফেলে বললেন, আর কেমন! সেই ঘটনার পর থেইকা আমার মাইয়ার জীবনটা বড়ই জটিল হইয়া গেছে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন যে ওর অতীতের ঘটনা সহজ ভাবে মাইনা নিবো না তা আমি খানিকটা আন্দাজ করছিলাম।

সায়েদা বেগম বললেন, তাইলে বিয়া ক্যান দিলি ঐ বাড়িতে? আমার নাতনিরে আমি এমন জায়গায় বিয়া দিতাম যেইহানে সবাই ওরে মাথায় তুইলা রাখতো। এতো জায়গা জমিন পইরা আছে আমাগো। অন্য সব পাত্রের নামে কত খানি জমিন লেইখা দিলেই আমার নাতনিরে খুশি মনে বউ কইরা নিয়া যাইতো।

সম্পত্তির লোভে যে আমার মেয়েরে বিয়ে করতো সে তো আরও বেশি কিছু পাইলে আমার মেয়েরে ছাইড়াও দিতে পারতো। এমন বিয়া হইয়াই বা কী লাভ ফুপুজান!

মাইয়াগে জীবন বড়ই অদ্ভুত রে আশরাফ। কত কিছু যে সহ্য করতে হয়। কিন্তু ঐ বাড়ির লোকজন তো এহন ইচ্ছা কইরা আমার নাতনিরে জ্বালাইবো। কারন অয় আমার নাতনি। এইটা তো সে মাইনা নিতে পারবো না। আমি ভালোই বুঝতাছি।

সবাই প্রচন্ড অবাক হয়ে বলল, কেনো? আপনার সাথে তার কিসের শত্রুতা?

সায়েদা বেগম কোনো উত্তর দিলেন না।
_____________________

একটা কিচ্ছু খুঁজে পাই না। ব্লু শার্টটা কোথায় রাখলাম! মা আমার ব্লু শার্টটা কোথায়?

মাহির শার্টের জন্য চিৎকার চেচামেচি করছিলো। রুহি বলল, সব এলোমেলো করে রাখলে খুঁজে পাবেন কী করে! শার্টটা ভাঁজ করে
আলমারিতে গুছিয়ে রেখেছি। দ্বিতীয় সারিতে দেখুন।

আমার ওয়ালেট কোথায়?

ড্রয়েরের ভেতরে।

মাহির ভারী গলায় বলল, এরপর থেকে আর কখনও আমার জিনিসে হাত দেবে না।

রুহি অবাক হয়ে বলল, কেনো?

মাহির থমকে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি চলে গেলে যখন কিছু খুঁজে পাবো না তখন আরও বড্ড বেশি এলোমেলো লাগবে। চলেই তো যাবে। তাহলে শুধু শুধু অভ্যেসটা নষ্ট করে কী লাভ!!

মাহিরের কথা শুনে রুহি একদম চুপ হয়ে গেল। সে মাহিরকে পছন্দ করতো না ঠিক কিন্তু ধীরে ধীরে একটা ভালো লাগা তৈরি হতে শুরু করছে সেটা সে ফিল করছে।

মাহির রাগি, বদমেজাজি কিন্তু তাও কেনো জানিনা আমার ওর প্রতি একটা শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি হয়েছে। সেটা কী ও আমার অতীত জানা স্বত্তেও আমাকে বিয়ে করেছে সেই জন্য? আমি চাই না মাহির আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে পরুক। মাহিরের মা আমাকে একদমই পছন্দ করে না। তাছাড়াও দাদাভাইয়ের সাথে দাদিজানের এক তিক্ত পুরনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে। হয়তো দাদিজানের সাথে অন্যায় হয়েছিলো বলেই দাদিজান তাকে সহ্য করতে পারেন না। সেকালে মেয়েদের বিয়ে ভেঙ্গে গেলে সমাজের কাছ থেকে কত অপমান অবহেলা সহ্য করতে হতো। এতো বছর পরে এখনও সমাজ মেয়েদেরকে আলাদা নজরে দেখে। একটু দোষ পেলেই সারাক্ষণ হাজারটা কটু কথা শোনাতে একবারো ভাবে না। তাহলে সেই সময় হয়তো দাদিজানকে অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিলো। তবে তার আগে জানা দরকার ঠিক কী কারনে তাদের দুজনের বিয়েটা ভেঙ্গে গিয়েছিলো।

এসব ভাবতে ভাবতেই রুহি চুপিচুপি তালেব আহমেদের রুমের দিকে গেল।

মনে মনে ভাবলো, যদি দাদাভাইর মেজাজ ঠান্ডা থাকে তাহলে তার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইবো।

এরমধ্যেই নির্ঝা এসে বলল, নতুন ভাবি কোথায় যাচ্ছো?

রুহি চমকে উঠলো। বলল, দাদাভাইর ঘরে।

কেনো? দাদাভাই জানলে কিন্তু রেগে যাবেন।

দাদাভাই ঘরে নেই?

না বাইরে গেছে। কিন্তু তুমি ভুলেও দাদাভাইর ঘরের ভেতর যেও না।

নীলিমা নির্ঝাকে ডাকতেই সে চলে গেল।

রুহি পা টিপে টিপে আস্তে আস্তে তালেব আহমেদের রুমের ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে বিশাল বড় একটা আলমারির দিকে তার নজর পরলো। পুরনো দিনের আলমারি। তাতে অনেক অনেক বই সাজিয়ে রাখা আছে। রুহি গ্লাস সরিয়ে বই গুলো ছুঁয়ে দেখছিলো। হুট করে উপর থেকে একটা পুরনো ডায়রি পরলো রুহির পায়ের কাছে। রুহি ভাবলো এটা বোধহয় দাদাভাইয়ের ডায়রি। হয়তো এই ডায়রিতেই সে তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে। রুহি কৌতুহল নিয়ে ডায়রিটা খুলল।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here