#দ্বিতীয়_বসন্ত-২১
লেখা:Zannatul Eva
মুনিরা মুন্নীকে দেখে কাঁদতে শুরু করলো। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, কী হয়েছে তোর? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
মুন্নী কোন কথা বলছে না। শুধু ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চুল গুলো উস্কখুস্ক হয়ে আছে। গায়ের ওরনাটাও ছেড়া।
মুনিরা আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলল, সব কি শেষ? আমার মেয়ের জীবনটা কি একেবারেই শেষ হয়ে গেল?
রুহি বলল, আগে ওকে বসতে দিন। আস্তে ধীরে প্রশ্ন করুন। এভাবে প্রশ্ন কারলে তো ও ঘাবড়ে যাবে।
রুহি এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে মুন্নিকে দিয়ে বলল, এই নাও পানি খাও।
মুন্নী রুহির হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিল।
সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে মুন্নীর কাছ থেকে সকল প্রশ্নের উত্তর শুনবে বলে। কিন্তু সবাইকে নিরাশ করে দিয়ে মুন্নী বলল, আমি এখন ঘরে যাব। প্লিজ তোমরা কেউ আমাকে বিরক্ত করবে না। আমি একটু একা থাকতে চাই।
মুনিরা আবারো কেঁদে উঠার আগেই তালেব আহমেদ ইশারা করে বললেন মুন্নীকে ভেতরে যেতে দিতে।
এরই মধ্যে নির্ঝা এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে। মুন্নীকে ওরা…… ওরা মুন্নীকে……
একথা বলেই নির্ঝা
অজ্ঞান হয়ে গেল।
মুনিরা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো, আমার মেয়ের সর্বনাশ হয়ে গেল। হায়রে আমার মেয়ের সর্বনাশ হয়ে গেল। আমার মেয়েটার জীবন শেষ হয়ে গেল। এখন আমার কী উপায় হবে হায় আল্লাহ! এই মেয়েকে আমি কী করে বিয়ে দেবো? আল্লাহ তুমি বলে দাও আমার কী হবে?
রুহি মাহিরকে বলল,এরকম একটা পরিস্থিতিতে আমার এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। আপনি প্লিজ আমাকে ও বাড়িতে দিয়ে আসেন।
মাহির বলল, এই সময়ে তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে? বাড়ির কারো মনের অবস্থা ভালো না রহি।
রুহি বলল, উনারা কেউই আমাকে সহ্য করতে পারেন না। এমনিতেই তো আমি কলঙ্ক গায়ে নিয়ে এ বাড়িতে এসেছি। দেখুন না এখানে এসেও শান্তি নেই। আরেকটা অঘটন ঘটে গেল। হয়তো আমার জন্যই এমনটা হয়েছে। আমার এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। আমি সত্যিই চলে যেতে চাই।
তালেব আহমেদ বললেন, এক্ষুনি থানায় রিপোর্ট করতে হবে। যারা আমার নাতনির সাথে এরকম অন্যায় করেছে তাদের কে আমি ছাড়বো না। এর একটা হেস্তনেস্ত আমি করেই ছাড়বো। এত বড় অন্যায় আমি কিছুতেই মেনে নেবো না।
মাহির বলল, আগে মুন্নীর সাথে কথা বলো। সবটা জেনে তারপর যা করার করতে হবে। ও তো কাউকে কিছুই বলছে না। আমি বরং রুহিকে ওদের বাড়িতে দিয়ে আসি। ততোক্ষনে তোমরা মুন্নীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করো। আমি এসে এদিকটা দেখে নেবো।
রুহি বলল, আমি একবার যাব মুন্নীর কাছে?
মুনিরা রাগি গলায় বলল, খবরদার বলছি তুমি আমার মেয়েদের ছায়াও মারাবে না।
রুহি বলল, দাদাভাই আমি আসছি। একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলো।
কিন্তু কেউই রুহির সাথে কোনো কথা বলল না।
মাহির এবং রুহি দুজনেই চলে গেল।
তালেব আহমেদ বললেন, তামজিদ, মাহির এলে তুমি ওকে নিয়ে থানায় যাবে।
মুন্নী এসে বলল, কাউকে কোথাও যেতে হবে না।
সবাই প্রচন্ড রকমের একটা ধাক্কা খেলো। অবাক দৃষ্টিতে মুন্নীর দিকে তাকিয়ে রইলো।
মুনিরা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ওরা তোর সাথে অন্যায় করেছে। ওদেরকে শাস্তি দিতে হবে। আর তুই বলছিস তোর কিচ্ছু হয়নি! ভয় পাস না মা। তোর কোনো ভয় নেই। তুই শুধু বল ওরা কারা? কোথায় নিয়ে গিয়েছিলো তোকে?পুলিশ ওদেরকে শাস্তি দেবে। আমরা সবকিছু করবো। তোর কোনো ভয় নেই। কিছু চিন্তা করিস না তুই। সব ঠিক হয়ে যাবে।
মুন্নী ভারী গলায় বলল, কিচ্ছু ঠিক হবে না মা। এরপর সবাই আঙুল তুলবে। চারদিকে ঢি ঢি পরে যাবে।সবাই বলবে, ঐ দেখ ধর্ষিতা যাচ্ছে। অলক্ষী, অপয়া, ওর নিশ্বাসে বিষ আছে বলে সবাই দূরে ঠেলে দেবে। কিচ্ছু ঠিক হবে না মা। কিচ্ছু ঠিক হয় না।
বাড়ির সবাই একদম স্তব্ধ হয়ে গেল মুন্নীর কথা গুলো শুনে।
মুনিরা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
মুন্নী বলল, কেঁদো না মা। তোমার মেয়ের কিছুই হয় নি। হয়েছে তো নতুন ভাবির। যার জন্য নতুন ভাবিকে তোমরা সবাই মিলে প্রতিনিয়ত কথা শুনিয়ে যাচ্ছো। আজ তবে কেনো কাঁদছো? ধর্ষিতা মেয়েরা তো খারাপ। সব দোষ তো ওদেরই হয়। তাহলে আজ নিজের মেয়ের জন্য কেনো চোখের জল ফেলছো?
মুনিরা বলল, তুই আমার মেয়ে মুন্নী। তোকে নিয়ে চিন্তা করবো না আমরা!!
নতুন ভাবিও তো কারো মেয়ে। তার বাবা-মায়েরও তো কষ্ট হয়৷ কিন্তু তাও তোমরা, সমাজের লোকজন মিলে তাদেরকে কথা শোনাতে একবারও ভাবো নি। এমনকি নতুন ভাবিকে দূরদূর করে তাড়িয়েও দিলে সবাই মিলে।
আগে নতুন ভাবিকে ফিরিয়ে আনো। তারপর না হয় নিজের মেয়ের কথা ভেবো। আর আমার কিছুই হয় নি। আমি একদমই ঠিক আছি। বাড়ি থেকে বেরোনোর উদ্দেশ্যই ছিল তোমাদেরকে শিক্ষা দেয়া। আমি, নির্ঝা আর ছোট কাকি মিলেই এই প্ল্যানটা করেছিলাম। কারন মানুষ ততোক্ষন পর্যন্ত অন্যের কষ্ট বুঝতে পারে না, যতোক্ষন পর্যন্ত সেও ঐ একই কষ্টের মধ্যে দিয়ে না যায়। এখন বুঝতে পারছো তো নতুন ভাবির কোনো দোষ ছিল না। সেও তোমার মেয়েরই মতো খোলা আকাশে ডানা মেলে বাঁচতে চেয়েছিলো। কিন্তু সমাজের কিছু নরকিট আর তোমাদের মতো সমালোচকদের জন্য নতুন ভাবি প্রানভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।
মুন্নী রেহনুমার কাছে গিয়ে বলল, আমি চাই তোমরা ভাবিকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। নতুন ভাবি অনেক ভালো বড় কাকি। তুমি ভাবিকে বউ হিসেবে মেনে নাও।
মুনিরা এবং রেহনুমাও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। রুহিকে ফোন করে সমস্তটা বলে ক্ষমাও চেয়েছে। কিন্তু রুহি এ বাড়িতে ফিরতে রাজি হয় নি। রুহি চায় না মাহিরের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক। মাহির ভীষণ ভালো ছেলে। সে কেনো রুহির মতো একটা খুঁত ওয়ালা মেয়েকে নিয়ে জীবন কাঁটাবে? তাই সে মনস্থির করলো আর কখনও ও বাড়িতে ফিরবে না।
_____________________
রাতে মাহির রুহিকে ফোন করে বলল, ও মাই গড রুহি! তুমি ভাবতে পারছো আমার বোনেরা আমার জন্য কী করেছে!! গোটা বাড়িটাকেই একদম পাল্টে দিয়েছে ওরা। তোমাকেও মা মেনে নিয়েছে। প্লিজ তুমি চলে এসো। আমি কালই আসবো তোমাকে নিতে। ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে রেখো।
রুহি বলল, আমি আর ফিরবো না। কিন্তু আপনাকে একটা দায়িত্ব দেবো। যদি সেটা ঠিকঠাক মতো পালন করতে পারেন তবে ভেবে দেখতে পারি।
মাহির প্রচন্ড খুশি হয়ে বলল, কী সেই দায়িত্ব?
চলবে…….