দ্বিতীয় বাসর(গল্প) পর্ব ১
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
মিতুর আজ বিয়ে।চারিদিকে সাজ সাজ হৈচৈ ব্যাপার স্যাপার।কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না মিতু।নিজেকে সেই ছোটবেলার বিয়ের পুতুল মনে হচ্ছে।বৌপুতুল সাজবার আগে তো মেয়েদের চোখে কত স্বপ্ন থাকে?কিন্তু মিতুর চোখে কোন স্বপ্ন নেই।
সেই ছেলেবেলায় মিতুর গায়ের রঙ ছিল ফকফকা দুধে আলতা বরণ।মিতুর দাদী তাই ওকে ডাকত হীরা।গোসলের পর মিতুর গোলগোল গালগুলো যেন হীরার মতোই চকচক করতো।সেই হীরার গায়ের রঙ এখন ফিঁকে বর্ন হয়ে গেছে সংসার আর কাজের চাপে।মা মরা হতভাগী মেয়ে বাবার সংসারে তাই দিব্যি বসে বসে খাওয়া কপালে জোটে নি।মিতু যখন মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ে তখনি তাদের মা চলে যান না ফেরার দেশে।ছোট ভাইয়ের বয়স তখন এক বছর কি দেড়।মিতু ও তার বোন মায়ের মতোই কোলে পিঠে বড় করে তুলেছে একমাত্র ভাইটিকে।মিতু মেঝো,বড় বোন সেতারার বিয়ে হয়ে যাবার পর মিতু একলা সংসারের হাল ধরেছে।ইন্টার পড়ুয়া ছোট ভাই মুহিনের পড়াশোনার খরচ সে চালায়।বাবা ফজলুল রহমান সরকারী কলেজের শিক্ষক ছিলেন।রিটায়ার্মেন্ট এর পর কিছু টিউশন করান।তবে আগের মতো ছাত্র পড়াতে পারেন না।প্রায়ই অসুস্থ থাকেন।এ্যাজমা বা হাঁপানীর সমস্যায় ভুগছেন দীর্ঘদিন যাবৎ।বাবার পেনশনের টাকাটা মিতুদের তিনতলা বাড়ীর কাজে ব্যায় হয়েছে,মোহাম্মাদপুরে।
“কত বড় কপাল নিয়ে জন্মেছিলিস মিতু? না হলে কোন ছেলে আজকাল এত কমের উপর ছাড়ে?তাও আবার আর্মি অফিসার জামাই।যে কিনা বিয়ের আগেই মেয়ের বাবাকে বলেছে বিয়ের কোন খরচ লাগবে না,শুধু মেয়েকে দিলেই হবে।ভাইজানের তো কোন দুশ্চিন্তাই নেই!’
মিতুর ছোটমামী মুখভর্তি রসের পান চিঁবোতে চিঁবোতে বলছে এ কথাগুলি।
“মামীর সবকিছুতেই বাহুল্যতা।’এসব কোন কথাই তার হবু স্বামী বলেনি।বলেছে পাত্রের নানী।
“কি অদ্ভুত মানুষের আচরন? মামী নিজে কোটিপতির বউ তার হঠাৎ আমার বিয়ে নিয়ে এত আদিক্ষ্যেতা কেন?অথচ তার কারনেই মামা আর আগের মতো নেই।মামাকে আমাদের থেকে পর করে দিয়ে এখন স্বান্তনার শ্লেষ গাইছে।’
পুরো নাম মিতালী রহমান মিতু।পাত্রের নাম বন্ধন আহমেদ বাবু।লাল রঙা সুন্দর ডিজাইনের কার্ডে গোটা গোটা হরফে লেখা।বাবা, মা নাম ঠিকানা, মুঠোফোন যেটা দরকার ইত্যাদি লেখা।মিতুর কাজিনরা বেশ মজা করছে পাত্রের নাম নিয়ে।
“মিতু আপা,দুলাভাইয়ের নাম বাবু কিন্তু চেহারার সাথে যায় না?যে ভাব তোমার জামাই এর?’
পারুলের(মামাতো বোন) টিপন্নী শোনে মিতুর গায়ের হলুদের দিন।কিছু বলে না মিতু।
মিতুর বড় বোন সেতারা ভারী রেগে যায় শুনে,
“চেহারার সাথে যায় না মানে?পাত্রের চেহারা কি খারাপ?ফরসা,লম্বা,আর্মি অফিসার।শুধু বয়স খানিকটা বেশী।কি বলিস তোরা মিতুর মনটা খারাপ করাবিনা এখন।’
পারুল ও আর সবাই জুঁই,শান্তা,সজীব, শাওন(সব খালাতো,চাচাতো,ফুপাতো ভাইবোন)সবাই বেশ মজা করছে। আর্মি অফিসার দুলাভাই নিয়ে তাদের কৌতুহলের যেন শেষ নেই।
“না না আমরা কি তাই বলেছি নাকি?ভাইয়া তো দেখতে নায়ক শাকিব খানের মতো?’সজীব (খালাতো ভাই)এর জবাব।
ওমনি পারুল প্রতিবাদ করে, “হুম তবে আমাদের বোনও কম না আমাদের বোন ঐরকম সাজলে বাংলা সিনেমার নায়িকাদের এক হাত দেখিয়ে দিত।’মুহিনও(মিতুর ছোট ভাই) সায় দেয়।
মিতু এবার অনেকক্ষন পর হেসে ওঠে।কদিন ধরে ওর মনে হচ্ছিল ও হাসতে পারছে না।দুচোখটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসে কেবলই।ওকে কেউ বিয়ের জন্য জোর তো করেনি?
“তবে কেন এত চাপা বেদনা?’নিজের মনেই ভাবে মিতু।
“পারুল তো ঠিকই বলেছে এমন হোমড়া চোমড়া কাঁচাপাকা দাঁড়িওয়ালা মানুষের নাম বাবু হয় কিভাবে?এটা তো উনার নানীর দেয়া নাম।নামটা কার্ডে না দিলেই কি হতো না?সব জ্বালাচ্ছে এখন কার্ডের এই নামটা দেখে।’
বন্ধন আহমেদ,ছিপছিপে গড়ন।সামান্য ভুঁড়ি আছে।সজীব ও শাওনের(চাচাতো ভাই) পর্যবেক্ষণ। চোখে চশমা প্রায় বেয়াল্লিশ বছরের কাছাকাছি লোকটার ব্যক্তিত্বকে আরো ভারী তুলেছে।আর্মি অফিসার ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার যাকে বলা হয় এয়ারমার্শাল ।
“মিতুর তো রাজকপাল।পুরুষ মানুষের বয়সে কি যায় আসে? এমন দক্ষ আর সম্মানী লোকের অফিসারের বউ হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।’বিয়ে বাড়ীর মহলে মিতুর বাবার বাড়ীর সবারই একই চর্চা মুখে মুখে।
মিতুর পরিবারে এখন সবার ভিতরেই যেন কত স্বস্তি।
পূর্বে বিয়ে হয়েছিল বন্ধন রহমানের।স্ত্রী কেয়া দুরারোগ্য ব্যাধিতে মারা যায় তাও বছর তিনেক আগে।সেই ঘরে এক ছেলে আছে।ছেলের নাম বাবাই।বাবার চেহারা পেয়েছে, বাবার মতোই চশমা চোখে।বাবাইকেই পড়াতে যেত মিতালী।মিতুর স্কুলে পড়ে বাবাই,যে স্কুলে সে শিক্ষকতা করে।মিতুকে পছন্দ করে বাবাই এর বড় মা অর্থাৎ বন্ধন সাহেবের নানু।বন্ধন সাহেবের বাবা মা কেউ বেঁচে নেই।আশির ঊর্ধ্ব বন্ধন সাহেবের নানু এখনো বেশ শক্ত পোক্ত।এছাড়া বাবু সাহেবের আরো দুজন ভাই তারাও দেশের বাইরে থাকে।তাই নানু ও বাবাই সব। মিতুর পরিবারে এখন বাবা ও ছোট ভাই।সেতারা তার স্বামীর সাথে মালয়শিয়া থাকে।সেতারা ও তার স্বামী দুজনেই পি এইচ ডি হল্ডার।মালয়শিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তার স্বামী।
মিতুরও পূর্বে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার মামাতো ভাই ইঞ্জিনিয়ার হীমেলের সাথে।কিন্তু সম্পত্তি সংক্রান্ত পারিবারিক কোন্দলে এ বিয়ে ভেঙে যায়।তবে ভালবেসেছিল মিতু হীমেলকে।এক পর্যায়ে জীবনে আর কখনো বিয়ে করবে না এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।কিন্তু মিতুকে নিয়ে তার বাবার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিলনা।মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারন মেয়ে তাই তার গন্ডি ছাড়িয়ে কখনো জাঁকজমক স্বপ্নে বিভোর থাকতো না মিতু।সেই মিতুর এখন বিয়ে বন্ধন আহমেদের মতো ধনী আর্মি অফিসারের সাথে।মিতুর ফুপি,খালা,বাড়ীর সবাই,সব ভাইবোন রা তো মহাখুশী।মিতু মহারানীর মতো থাকবে।
“অনেক সয়েছিস বোন,এবার তোর সুখের পালা।’বোনের কপালে আলতো চুমু খেয়ে কথাটা বলে মায়ের মতো বড় বোন সেতারা।
“হুম সুখ……’মিতু পাশ ফিরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
(চলবে)