ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি,পর্ব:৫

#ধাঁধার_থেকেও_জটিল_তুমি
( পঞ্চম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৮>

এইদিনের পর মেঘনার মনে একটা নতুন ভালো লাগা শুরু হয়েছিল , উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের এই সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর একটা ছেলের জন্য | আন্তরিককে আর ঠিক দূরের কেউ বলে মনে হয় না মেঘনার | উল্টে ওর সঙ্গে অকারণে কথা চলেই আসে ওর মাঝে মাঝে | এর মধ্যে সেদিন কফিশপে দেখা হওয়ার পর হঠাৎ রাতে হোয়াটস এপ এ একটা ছবিও এসেছিলো মেঘনার কাছে আন্তরিকের নাম্বার থেকে | রংবেরঙের ফুলে ঘেরা একটা মার্কেটের ছবি | মেঘনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল , ———– ” স্ট্যান্ড রোডে না ? তুমি গেছিলে ?”

আন্তরিক তার উত্তরে লিখেছিলো , ——— ” হ্যাঁ , কদিন আগে কলেজ থেকে ফেরার সময় গেছিলাম |”

মেঘনা এর উত্তরে টাইপ করেছিল , ———– ” ভীষণ সুন্দর হয়েছে | একচুয়ালি ..”

ব্যাস , সেদিনের পর থেকে হোয়াটস এপ এ দুজনের টুকটাক কথা হতেই থাকে আজকাল | কখনো কোনো ভালো সিনেমা নিয়ে | তো কখনো কোনো বেড়াতে যাওয়ার জায়গা নিয়ে | মেঘনা তো সব সময়ই ঘুরতে যেতে ভীষণ ভালোবাসে | তবে ও জানতো না যে আন্তরিকেরও এই নেশাটা আছে ! আন্তরিক তো না কি কনফারেন্সের থ্রু দিয়ে কাজের সঙ্গে নতুন নতুন জায়গা ঘুরে নেয় | কত রকমের খাবার ট্রাই করেছে ও সেইসব জায়গার ! লখনৌয়ের সিক কাবাব থেকে শুরু করে দিল্লীর পরাঠা গলির পরাঠা , তো আবার ইতালিতে কনফারেন্স এ গিয়ে ওখানকার ফেমাস হোয়াইট সস পাস্তা ! সব রকমের কুইজিন পছন্দ করে আন্তরিক | আর কি সব অফ বিট জায়গার নাম বলে ঘোরার জন্য | যেখানে অনেক লোক যায় না , ছোট বড়ো ট্রেকিং রুট ! তবে আন্তরিক যে কনফারেন্সের কাজে বাইরে গিয়ে মাঝে মাঝে ট্রেক করে আসে এদিক সেদিক , এটা সমরজেঠু জানে না না কি ! এই যেমন আগের বছর দার্জিলিং গেছিলো একটা স্পেশ্যাল ক্লাস নেয়ার জন্য | তারপর সান্দাকফু ট্রেক করে এসেছে নিজে | কিন্তু সমরজেঠু চিন্তা করবে বলে বলেনি কিছু | এইসব এলোমেলো কথা আন্তরিক নির্দ্বিধায় আজকাল বলে দেয় মেঘনার কাছে | মেঘনা জেনে অবাকও হয় ! আবার একটা প্রশ্নও আসে মনে ! কেন আন্তরিক ওর সাথে এতো ফ্রেন্ডলি হচ্ছে ! কেন ছেলেটা নিজে থেকে এতো কাছে চলে আসছে ওর ! এতো হিসাবি ছেলে এইভাবে বেহিসাবি কথা কেন বলে রোজ ওর কাছে ! মেঘনা উত্তরগুলো যেন বুঝেও ঠিক বুঝতে চায় না | আসলে মনে ভয় হয় শুধু | যদি প্রেমটা একতরফা হয় ! যদি আন্তরিক শুধু বন্ধু ভেবে এইসব শেয়ার করে ! যদি ভালো লাগাটা শুধু ওর নিজের হয় ! তাহলে মন ভাঙবে ওর | খারাপ লাগবে ভীষণ | সেই জন্য নিজের মনকেও লাগাম টানে মাঝে মাঝে | আন্তরিককে খুব মনে পড়লেও মন থেকে ভোলার চেষ্টা করে রোজ | প্রত্যেকদিন পণ করে , আজ যদি আন্তরিক না ম্যাসেজ করে , মেঘনাও ওকে নিজে থেকে ম্যাসেজ করবে না | কথা বলবে না | কিন্তু ওই , নিজের মনকে নিজের কাছে আটকে রাখাটা যে খুব শক্ত ! সে তো ফেরারি হতেই চায় ! তাই ফেসবুকে সুন্দর কোনো জায়গার ছবি দেখলে , বা ইউটিউবে কোনো ভালো সিনেমার ট্রেলার দেখলে ,মেঘনা ঠিক তার লিংক সেন্ড করে নিজে থেকে কথা শুরুই করে ফেলে প্রত্যেকদিন আন্তরিকের সঙ্গে | ওর এলোমেলো ভাবনাগুলো শেয়ার করেই ফেলে ছেলেটাকে |

সেদিন এইসবই ভাবতে ভাবতে যাচ্ছিলো ট্যাক্সি করে | একটা পাবলিকেশনের সঙ্গে কথা চলছে | নতুন একটা পুজোর বই বেড়োনোর কথা আছে ওর | গল্প গুলো লেখা চলছে | তারই কিছু সফ্টকপি দিতে যাবে প্রুফ রিডিং এর জন্য | এইসব কাজের চিন্তার মধ্যেই চলন্ত রাস্তার দিকে আনমনে তাকিয়েছিলো মেঘনা | কিন্তু একটা সিগন্যালে গাড়িটা থামতেই মেঘনার চোখটা হঠাৎ স্থির হয়ে গেলো একটা দৃশ্য দেখে | দুটো গাড়ি পার করে ওদের পাশের রো টায় আন্তরিকের গাড়ি দাঁড়িয়ে | আজ আন্তরিকের পাশের সিটে আরাত্রিকা বসে | ওর কোলে ল্যাপটপটা খোলা | কিসব যেন বোঝাচ্ছে আন্তরিককে মেয়েটা হাত নেড়ে নেড়ে | দৃশ্যটা দেখেই মেঘনার ভেতরটা থমকে গেলো যেন কয়েক সেকেন্ড | না চাইতেও খারাপ লাগলো ভীষণ | একটা অদ্ভুত রাগ আর কষ্ট হলো হঠাৎ | যদিও ও ট্যাক্সি থেকে বুঝতে পারছে যে আরাত্রিকার সঙ্গে আন্তরিক কাজের কথাই বলছে এখন হয়তো | কিন্তু তাও মন ঠিক মানতে চাইলো না ব্যাপারটা | আরাত্রিকা আজ নীল রঙের একটা শাড়ি পড়েছে | দূরে ট্যাক্সি থেকে দেখেও মেঘনা বুঝতে পারলো ভীষণ সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে দেখতে | আর ওরা যেভাবে দুজনে কাজ নিয়ে হারিয়ে ছিল যেন , তাতে মনে হচ্ছে আরেকবার ‘পারফেক্ট ম্যাচ’ | যেরকম সেই প্রথমদিন লেগেছিলো মেঘনার আরাত্রিকাকে ফ্ল্যাটে দেখে | আর সত্যিই তো | পারফেক্ট ম্যাচ তো বটেই | দুজনেই প্রফেসর | দুজনেই কেরিয়ারিস্টিক | দুজনেই সমান | ওদেরই তো একসাথে থাকার কথা | মেঘনার তো না ! মেঘনা তো পুরো অন্য জগতের একটা মানুষ | যে যুগের উল্টো দিকে হাঁটছে | ইউটিউব , নেটফ্লিক্সের যুগে গল্পের বই লিখছে ! শব্দ দিয়ে কল্পনাকে আঁকছে | কি দাম আছে ওর ! ওর কাজের ! কটা টাকা এতে রোজগার করতে পারবে ও ! আন্তরিকের মতন একজন পারফেক্ট , স্টুডিয়াস , এত ভালো চাকরি করা ছেলের কাছে সত্যি ওর কি দাম ! কথাগুলো না চাইতেও মনে হলো এই মুহূর্তে | আর গাড়িটা চলতে শুরু করলো এখন | লাল সিগন্যালকে সবুজ হয়ে গেছে এর মধ্যে | উল্টোদিকে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে আকাশে মেঘ করেছে কালো | আজ মাসের পঁচিশ তারিখ | আর ঠিক এক মাস বাদে পুজো | তাই শরতের মেঘ কখনো মুখ কালো করে , তো কখনো হেসে ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরের এদিক ওদিক | কিন্তু মেঘনার আজ এই কালো মেঘের আড়ালে নিজের চারিদিকটাও অন্ধকার লাগছে কিরকম | মনে হচ্ছে কেউ হঠাৎ করে খুব কাছে এসেছিলো ওর ! কিন্তু সে হঠাৎ আবার দূরে চলে যাচ্ছে যেন ! কিছু না বলেই | একটা গল্প ছিল , যেটা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে , মেঘনার মনে |
এইসবের পরে মেঘনা রীতিমতো নিজেকে শাসন করেই আন্তরিককে আর কোনো মেসেজ করেনি হোয়াটস এপ এ | কিরকম যেন দূরের মনে হচ্ছে ছেলেটাকে ওর | যার সঙ্গে দূরত্বটাই হয়তো নিয়তি | সেই জন্য ইচ্ছে করেই আর কোনো রকম কথা বাড়ানোর চেষ্টা করেনি মেঘনা | আর কি অদ্ভুত , এই শেষ দু তিন দিনে আন্তরিকও আর নিজে থেকে কোনো মেসেজ করেনি মেঘনাকে | কোনোভাবে কথা শুরু করেনি নিজে থেকে ! ব্যাপারটা মেঘনা আনমনে খেয়াল করেছিল | তাহলে কি ও সেদিন ট্যাক্সিতে বসে যেই দৃশ্যটা দেখেছিলো সেটাই সত্যি ! আন্তরিক আর আরাত্রিকার মধ্যে কিছু শুরু হয়েছে ! আর সেই জন্যই আন্তরিক ওকে হঠাৎ আর চিনছে না ! বার বার না চাইতেও এই কথাটাই মনে হচ্ছিলো মেঘনার | তবে যুক্তি দিয়ে ভাবলে মনে হচ্ছিলো মাত্র দু তিন দিনের আড়ালে এতো বড়ো একটা গল্প ভাবা কি ঠিক হচ্ছে ! এটাও তো হতে পারে যে আন্তরিক হয়তো খুব ব্যস্ত ! নতুন কোনো কলেজের কাজ অথবা রিসার্চের কোনো কাজ চলে এসেছে ! তাই আর আন্তরিক সময় করে উঠতে পারছে না মেঘনাকে মেসেজ করার , কথা বলার ! সেদিন এইসব ভাবনার মধ্যেই ও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল রাত্রে একা একা | তখনই ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো | স্ক্রিনে নয়নের নাম্বার | আসলে ওই আন্তরিক আর আরাত্রিকাকে সেদিন একই গাড়িতে বসে থাকতে দেখার পর থেকে মেঘনা আর কারোর সাথেই বিশেষ যোগাযোগ করেনি , কথা বলেনি | ওর চারিদিকে কিরকম মন খারাপের দেয়াল তৈরী হয়ে গিয়েছিলো একটা | সেটা ভেঙে কাউকেই আর ঠিক নিজের কাছে আসতে দিতে ইচ্ছে করছিলো না যেন | তবে আজ ফোনটা আর না ধরলেই নয় ! নয়ন এবার হয়তো মাঝরাতে বাড়ি এসেই হাজির হবে চিন্তায় ! কথাটা ভেবেই ও ‘হ্যালো’ বললো | কিন্তু ওপার থেকে বেশ উত্তেজিত একটা গলা কানে এলো ওর | নয়ন বেশ রাগ দেখিয়েই বললো ,

————– ” কি রে ? তোর কি হয়েছে বল তো ? ফোন করলে ফোন ধরিস না ! মেসেজ করলে সিন্ করে রেখে দিস ! প্রব্লেমটা কি ?”

মেঘনা এর শান্ত গলায় উত্তর দিলো , ———— ” কিছু হয়নি | এমনি , ইচ্ছে করছিলো কথা বলতে | লেখার কাজ ছিল | তুই কেমন আছিস ?”

নয়ন কথাটা শুনে এবার একটু উত্তেজনা কমিয়ে বললো , ————- ” আমি ঠিকই আছি ! কিন্তু ভালো লাগছে না কেন তোর হঠাৎ ? এক সেকেন্ড ! প্রেমে পড়লি না কি ? আমার দাদা তরঙ্গ লাস্টে কি তোর মন জয় করে ফেললো না কি ?”

কথাগুলো শুনে মেঘনা এই মুহূর্তে বিরক্ত হয়েই বললো , ————— ” থামেনি তুই ! প্রেম ছাড়া আর কিছু মাথায় আসে না তোর ?”

কথাটার উত্তরে নয়ন বেশ মজা নিয়েই বললো , ————- ” কি করে মনে হবে বল ! আমার দাদা তো এখন সকালে সন্ধ্যে রাত্রে শুধু তোরই কথা বলে ! তোর পার্সোনালিটি , তোর হাসি , তোর চোখ সব দেখেই সে একেবারে মুগ্ধ | তবে একটা কথা বলবো , আমার দাদা কিন্তু সত্যি পাত্র হিসেবে খারাপ না ! অনেক মেয়ে ওর জন্য পাগল ! ওর একটু এটেনশন পাওয়ার জন্য কত কি যে করে ! আর সে তোর প্রেমে একদম উল্টে পড়েছে | আর সঙ্গে সেলিব্রিটি স্ট্যাটাসটাও আছে ! তুই কিন্তু সত্যি একবার ভেবে দেখতে পারিস | দাদা একচুয়ালি তোকে নিয়ে সিরিয়াস |”

কথাগুলো কিরকম এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো নয়ন | তবে শেষ লাইনটা যে ও একটু জোর দিয়েই মেঘনাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো , এটা মেঘনা নিজেও স্পষ্টভাবে বুঝলো | তবে এর আর কোনো উত্তর ঠিক ভেবে পেলো না ও এই মুহূর্তে | তাই কথা ঘোরানোর জন্য ইচ্ছে করেই বললো , ———— ” নয়ন , তোর সাথে আমি কাল কথা বলি ! আমার ফোন এ আসলে একদম চার্জ নেই রে | তোকে কাল ফোন করবো |”

এই কথাটা যে ও বানিয়ে বলছে সেটা নয়ন বুঝলো কি না জানে না ! তবে নয়নও আর কথা না বাড়িয়ে এই মুহূর্তে রেখে দিলো ফোনটা | মেঘনার এরপর যেন বুকটা একটু হালকা হলো ! সত্যি , তরঙ্গ যে ওকে নিয়ে এতো কিছু ভেবে ফেলেছে মাত্র কটা দিনে , এটা মেঘনা একদম বুঝতে পারেনি ! সেই জন্যই ছেলেটা রোজ সকাল সন্ধ্যে মেসেজ করে ওকে | গানের লিংক পাঠায় | সেদিন তো একদম বাড়িতেই ফাংশনের ইনভিটেশন কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছিলো নিজে থেকে ! কিন্তু এইসবের কি উত্তর দেবে মেঘনা ! তরঙ্গ সত্যি ওর গল্পে লেখা নায়কদের মতন অনেকটা ! গান করে এতো সুন্দর ! সবার মধ্যে মিশে যায় খুব সহজে , এক্সট্রোভার্ট | কিন্তু এতো কিছুর পরেও মেঘনার গল্পের মতন ওর জীবনে কেন ছেলেটা নিজের জায়গা করে নিতে পারলো না কে জানে ! এটা সত্যি নিজের কাছেও রহস্য লাগে ভীষণ | তাহলে কি আমরা যা চাই , যা ভাবি , যাকে খুঁজি সেটা সত্যি না ! আসলে মনের গভীরে অন্য একজনের ছবি রাখা থাকে সবার অন্তরালে ! যাকে হয়তো আমরা নিজেরাও চিনি না ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই উল্টোদিকের রাস্তায় চোখ চলে গেলো | ওখানে এখন একটা কালো রঙের গাড়ি এসে থেমেছে | তবে এর পরের দৃশ্যটা দেখে মেঘনার চোখটা থমকে গেলো আরেকবার | গাড়ির ভেতর থেকে আন্তরিক আর আরাত্রিকা নামলো বেশ হাসতে হাসতে | গাড়ির সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দুজনে কথাও বললো বেশ কিছুক্ষণ | কত কিছু যেন বোঝাচ্ছিলো দুজন দুজনকে | সেটা দরকারি না অদরকারি সেটা মেঘনা বুঝলো না ! তবে এটুকু বুঝলো যে ওর মনে অদ্ভুত একটা নাম না জানা কষ্ট শুরু হয়েছে এখন ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই দেখলো এবার আন্তরিক আরাত্রিকার দিকে হাত নেড়ে বাই বলে এগিয়ে গেলো ফ্ল্যাটের দিকে | কিন্তু আরাত্রিকা কিরকম নিঃস্পলকভাবে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত সেই যাওয়াটার দিকে | মেঘনার এরপর সব কিছু বোঝা হয়ে গেলো খুব স্পষ্টভাবে | ওই থমকে থাকা দৃষ্টি , কাউকে যেতে না দেয়ার ইচ্ছা , এই সবই যে কেউ কাউকে আলাদা ভাবে মনে জায়গা দিলেই করে , এটা মেঘনা জানে | তাহলে ওর ভাবা গল্পটাই সত্যি সেদিনের | আন্তরিক আর আরাত্রিকা দুজনের মধ্যে একটা গল্প আছে | এটা নতুন না পুরোনো সেটা মেঘনা জানে না | কিন্তু গল্পটা যে আছে , এটাই বাস্তব | কথাটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ খেয়াল করলো ওর চোখে কয়েক ফোঁটা জল জমেছে হঠাৎ | একটা না পাওয়ার যন্ত্রনা এসে জমেছে মনে | মনে হচ্ছে এই একলা বারান্দাটাই ওর জীবন | যেই রূপকথাগুলো ও নিজের গল্পে লিখতো , সেটা শুধু শব্দেই সীমাবদ্ধ | জীবনে নয় | বাস্তবে আসলে যে যাকে চায় , সে তাকে পায় না | বাস্তবে সত্যি প্রেমে পড়া বারণ | কথাটা মনে হতেই আরেকটা ব্যাপারও হঠাৎ বুঝতে পারলো ও , যে মেঘনা একটা একতরফা ভালো লাগার মধ্যে জরিয়ে গেছে নিজে | এমন একটা গল্পে জরিয়ে গেছে , যেখানে ও একজন বাইরের লোক | আর খুব সহজে এই যন্ত্রনাটা শেষ হবে না মনে | বরং এটা আস্তে আস্তে বাড়বে ! চারিদিকটা আরও বেশি নিঃস্তব্ধ আর অন্ধকার হবে | কিছু দীর্ঘ্যশ্বাস এসে জমা হবে জীবনে |

সেদিনের পরেরদিন তবে আর একটা ধাক্কা লেগেছিলো মেঘনার ! আজ লাইব্রেরি যাওয়ার দিন | এক মাস হয়ে গেছে নহন্যতে বইটা সমরজেঠুকে পড়তে দিয়েছিলো ও | সেটা আজকে ফেরত নিতে হবে | যদিও সকাল থেকে কিছু করারই আর মন নেই ওর | তবে কাজ যখন আছে , করতে তো হবেই ! এদিকে একবার প্রকাশকের অফিসেও যেতে হবে | কভার ডিজাইন হয়ে গেছে ওর পুজোর বইয়ের | সেটা দেখতে আসতে বলেছে ফোন করে | যদি কিছু চেঞ্জ করতে হয় ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ও ওই সকাল সাড়ে এগারোটার পর গিয়েছিলো সমরজেঠুর ফ্ল্যাটে | ইচ্ছে করেই একটু দেরি করে গেছিলো আজ | আন্তরিক যাতে কলেজে বেড়িয়ে যায় | কারণ মেঘনা আর মুখোমুখি হতে চায় না ছেলেটার | এমনিতেই মন ভাঙার গল্পের সঙ্গে জরিয়ে ফেলেছে নিজেকে | তারপরে ওকে দেখলে আরো বেশি কষ্ট হবে | কথাগুলো ভেবেই আন্তরিকদের ফ্ল্যাটের দরজায় কলিংবেলটা বাজিয়েছিল | কয়েক মিনিটের ভিড়ে সমরজেঠু নিজে এসে দরজা খুলেছিলো এরপর | তবে আজ ড্রইং রুমে এসে মেঘনা দেখলো একজন ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা বসে আছেন সোফায় | সামনের টেবিলে দুটো মিষ্টির প্লেট সাজানো | মেঘনা ঠিক বুঝতে পারলো না ব্যাপারটা | তখন সমরজেঠু হঠাৎ মেঘনাকে বলে উঠলো , ———- ” যা না মা , রান্নাঘর থেকে দু কাপ চা করে নিয়ে আয় একটু | ” কথাটা বলে আবার ওই ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললো ,

————— ” ওহ , আলাপটাই তো করানো হয়নি ! ও মেঘনা | আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে | একদম আমার মেয়ের মতন |”

কথাটা শুনে ওনারা দুজনেই হাসলো এবার মেঘনাকে দেখে | মেঘনাও হাসিটা ফেরত দিলো কিছু না বুঝে | তারপর আর কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে চলে এলো চা বানাতে | তবে মনে প্রশ্নটা ঘুরপাক করতেই থাকলো | কারা এরা ! সমরজেঠুর কোনো বন্ধু কি ! না কি আত্মীয় ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই চা করে দুটো কাপে সাজিয়ে নিয়ে এলো ও ড্রইং রুমে | তখন সমরজেঠু ওদের সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত | মেঘনা এবার টেবিলে চা রেখে বলে উঠলো , ———– ” প্লিজ ,খেয়ে নিন |”

সেদিন এরপর ওরা আর দশ মিনিট বসেছিল | সমরজেঠুর বাড়িতে কে কে আছে , আন্তরিকের কোন স্কুল , কোন কলেজ , এইসব সাধারণ ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছিলো ওদের | তারপর ওঠার আগে ওই মহিলা বলে উঠলো , ————- ” আজকে আসি | এরপর তো আসা যাওয়া লেগেই থাকবে আমাদের | আর আই হোপ আন্তরিকও এই রিলেশনের জন্য হ্যাঁ ই বলবে | সত্যি , আপনার ছেলেকে একবার দেখেই এতো ভদ্র আর ভালো লেগেছে আমাদের ! একদম আমাদের আরাত্রিকার জন্য পারফেক্ট |”

শেষ দুটো কথা যেন কানে এসে বিঁধলো মেঘনার এই মুহূর্তে | আর বাকি কোনো কথাই ঠিক কানে ঢুকলো না ওর ! হাত দুটো কেমন মুঠো হয়ে গেলো অদ্ভুত একটা যন্ত্রনায় ! এর মাঝে যাওয়ার সময় ওই ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা মেঘনার দিকে তাকিয়ে আর একবার হাসলো | কিন্তু মেঘনা কিছুতেই ঠিক জোর করে আর হাসিটা ফিরিয়ে দিতে পারলো না ওদের | সমরজেঠু এরপর দরজা দিয়ে বেশ খুশি খুশি হয়েই ওর কাছে এসে বললো , ————- ” যাক , এতদিনে আমার মনে শান্তি ! এই ছেলেটার বিয়ে নিয়ে তো আমি অনেকদিন ধরেই চিন্তায় ছিলাম ! যা ইন্ট্রোভার্ট আর সিরিয়াস ! মনে তো হচ্ছিলো সারাজীবন ব্রহ্মচর্যই পালন করবে | ভাগ্গিস আরাত্রিকা ছিল ! শুনতাম মেয়েটার কথা মাঝে মাঝে আন্তরিকের মুখে | ওদেরই কলেজে আছে | খুব এফিশিয়েন্ট না কি ! তারপর আন্তরিক কি সব কলেজের কাজে ওকে ভীষণ হেল্প করেছিল কদিন আগে ! একটা প্রেসেন্টেশন রেডি করে দিয়েছিলো | সেই থেকেই মনে হয় বন্ধুত্বটা গ্রো করেছে | কাল তাই নিজের জন্মদিনে নেমন্তন্ন করেছিল মেয়েটা ওকে | আর আজ একেবারে আরাত্রিকার মা বাবা সম্বন্ধ নিয়ে হাজির | আন্তরিককে দেখে না কি ওদের ভীষণ ভালো লেগেছে !”

কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো সমরজেঠু , আর মেঘনা কিরকম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ওনার সামনে | ঠিক এই মুহূর্তে কি বলবে , কি সাজানো উত্তর দেবে , ভেবে পাচ্ছিলো না ! তখনই সমরজেঠু ওর থমকে থাকা মুখটা খেয়াল করলো হঠাৎ | তারপর ওর হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে বললো , ———- ” কি রে , কি হলো তোর ?”

মেঘনার এই প্রশ্নে যেন সম্ভিত ফিরলো এখন | ও নিজেকে সামলে একটু ভেবে বললো , ———— ” নহন্যতে , বইটা আজ লাইব্রেরিতে ফেরত দিতে হবে | সেই জন্য !”

কথাটা আর শেষ হতে দিলো না সমরজেঠু | ‘ওহ আচ্ছা আচ্ছা ‘ বলে পাশের ঘরে চলে গেলো বইটা আনতে | তারপর দু মিনিটের মধ্যেই বইটা নিয়ে ওর হাতে দিয়ে বলে উঠলো ,

———– ” এতো সুন্দর লেখা ! সত্যি ! মন ছুঁয়ে গেলো বইটা |”

মেঘনা এর উত্তরে এক কথায় একটু মলিন হেসে বললো , ———– ” হ্যাঁ , মন ভাঙার গল্প | মনে তো দাগ কাটবেই | আসছি জেঠু |”

কথাটা বলেই ও আর দাঁড়ালো না | বেড়িয়ে এলো আন্তরিকদের ফ্ল্যাট থেকে | চোখে এই সময় কিছুতেই আর জল আটকালো না মেঘনার ! ভিজে এলো হঠাৎ একদম এলোমেলোভাবে | ভেতর থেকে মনে হলো কিছু একটা শেষ হয়ে যাচ্ছে ওর | আসলে প্রথম ভালোবাসা , প্রথম প্রেম না কি কখনোই পূর্ণতা পায় না ! মেঘনারও তাই হলো | ওর এই পঁচিশ বছরের জীবনে এই প্রথমবার , কাউকে মন থেকে ভালো লাগাটা পূর্ণতা পেলো না ! কথাটা আনমনে মনে হলো ওর | আর চারিদিকটা কিরকম নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেলো হঠাৎ | মনে হলো কারোর কাছে যেন হেরে গেছে ও ! এখন শুধু নিঃস্তব্ধতাটাই সঙ্গী |

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here