ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি,পর্ব:৪

#ধাঁধার_থেকেও_জটিল_তুমি
( চতুর্থ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৭>

মেঘনার জন্মদিনের পর বেশ কটা দিন কেটে গেছে । আজ পনেরোই সেপ্টম্বর। আন্তরিক দের কলেজে ফাউন্ডেশন ডে । বেশ তোড়জোড় সকাল থেকে সেই নিয়ে । যদিও ও কালচারাল কমিটিতে নেই , তাও থাকতেই হবে আজ অনুষ্ঠানে অনিচ্ছা সত্ত্বেও। আসলে যেদিন থেকে শুনেছে এই অনুষ্ঠানে গান গাইবে তরঙ্গ , তাও আবার ও ই না কি মেন এট্রাক শন , বড়ো বড়ো প্ল্যাকার্ড টাঙ্গানো হয়েছে ওই ছেলেটার ছবি দিয়ে , তখন থেকেই অনুষ্ঠানের প্রতি, ফাউন্ডেশন ডে এর প্রতি সমস্ত রকম ইন্টারেস্ট চলে গেছে আন্তরিক এর । জানে না কেনো মনটা একেবারে উঠে গেছে ওর সব কিছু থেকে । তবে যেহেতু আন্তরিক প্রিন্সিপাল এর খুব পছন্দের লোক, তাই এই ফাংশনে না আসার ডিসিশনটাও নিতে পারেনি ! যাইহোক , এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিরেই বসেছিল অডিটোরি়ামে । তখনই খেয়াল করলো ওর পাশের দুটো রো পরে সেই উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের মেয়েটা বসে । মেঘনা ! এখানে কি করছে ! কথাটা বেশ অবাক হয়েই ভেবেছিল আন্তরিক ! কিন্তু উঠে ওকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আরাত্রিকা এসে হাজির । কাল একটা জেনারেল মিটিং আছে কলেজের স্টাফদের নিয়ে । সেখানে কিছু টপিকস এর ওপর আন্তরিক কে বলতে হবে । সেটা নিয়েই ডিসকাস করার জন্য আরাত্রিকা ওকে ডাকতে এসেছে ! এই মুহূর্তে আরত্রিকা কে কিছু আর বলার ঠিক সুযোগ পেলো না আন্তরিক । কালকের মিটিংটা খুব ইম্পর্টেন্ট । তাই ওর কোনোভাবেই আর মেঘনার কাছে যাওয়া হলো না এখন ।

যাইহোক , সমস্ত আলোচনা কমপ্লিট করে প্রায় এক ঘন্টা পর ও ভিড়ের মাঝে অডিটোরি়ামে এলো আরেকবার । কিন্তু এই সময়ে মেঘনা কে দূর থেকে দেখেই পা টা আটকে গেল ওর । উল্টোদিকের স্টেজ এ তরঙ্গ গান গাইতে উঠেছে । মেঘনা সেই গানের মধ্যে যেন হারিয়ে গেছে কেমন । নিস্পলক দৃষ্টিতে ও স্টেজের দিকে তাকিয়ে । মাঝে মাঝেই আনমনে আবার হাততালি দিয়ে উঠছে নিজে থেকে । দৃশ্যটা দেখে আন্তরিক এর না চাইতেও মনের মধ্যে একটা হালকা রাগ এসে ভিড় করলো হঠাৎ ! মেঘনা একজন আউটসাইডার হয়ে কি করে এই ফাংশনটা দেখতে এলো ! তাহলে কি এই তরঙ্গই ওকে ইনভাইট করেছে ! নইলে তো পাশ পাওয়ার কথা না ! আর মেঘনা যদি কলেজে এসেও থাকে অন্য কারোর ইনভাইটেশন এ , তাহলেও ,ওর সঙ্গে একবার দেখা করলো না কেন ! মেঘনা তো জানেই আন্তরিক এই কলেজে পড়ায় । তাহলে একবার কি ওর জায়গায় এসে ওর খোঁজ করা যেত না ! একটা কদিনের চেনা ছেলের গানের মধ্যেই হারিয়ে থাকতে হবে ! কথাগুলো কিরকম বেহিসাবী ভাবেই ভেবে ফেললো আন্তরিক । তারপর ওয়েট করতে থাকলো ফাংশনটা শেষ হওয়ার । এই ভিড়ে চিৎকার চেঁচামেচি র মধ্যে আন্তরিক বিশেষ কথা বলেও উঠতে পারবে না! তার থেকে এই তরঙ্গ স্টেজ থেকে নামুক , তারপর আন্তরিক দেখা দেবে নিজের ।

এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়ে ই অবশেষে তরঙ্গর গান শেষ হলো । অডিটোরি়ামটা হাততালি আর তরঙ্গ নামের চিৎকারে ভরে গেল তারপর । এইসব এর পনের মিনিট বাদে মেঘনা যখন কলেজ ক্যাম্পাস দিয়ে আনমনে হেঁটে যাচ্ছিল বাইরে বেরোনোর জন্য , তখনই ওর কানে এলো সেই চেনা গলার আওয়াজটা । আন্তরিক পেছন থেকে এসে বলে উঠলো হঠাৎ ,

————- ” হাই .. আমাদের কলেজে হঠাৎ ফাংশন দেখতে এলে যে ! আর দেখা না করেই চলে যাচ্ছো।”

কথাগুলো কিরকম কঠিন গলায় বললো ও । মেঘনা কথাটা শুনে একটু অবাক চোখে পেছনে তাকিয়ে যেন কয়েক সেকেন্ড থমকে গেল । তারপর একটু কথা সাজিয়ে বললো,

———— ” ওই তরঙ্গ খুব রিকোয়েস্ট করলো ওর শো শুনতে আসার জন্য ! বাড়িতে পাশ অব্দি পাঠিয়ে দিল সকাল সকাল নিজে লোক পাঠিয়ে । তাই আসতেই হলো । আর তোমার সাথে দেখা করিনি কারণ ভাবলাম তুমি হয়ত বিজি থাকবে ! আমি গেলে ডিস্টার্বড হবে , তাই !”

কথাটা শুনে আন্তরিক একটু গম্ভীরভাবে ই উত্তর দিল,———– ” না , ডিস্টার্বড হতাম না । অতোটা ও আনসোশ্যাল নই । বরং চেনা কাউকে দেখলে ভালোই লাগতো । ”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেল কেমন আন্তরিক । মেঘনা একটু অবাকই হলো এবার ! এই ছেলেটা সত্যি ধীরে ধীরে চেনা ছবিটা ছেড়ে কেমন অন্য হয়ে যাচ্ছে! কথাটা আনমনে ভাবতেই দুর থেকে তরঙ্গ হাসি মুখে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে দেখতে পেল । কয়েক সেকেন্ডের ভিড়ে তরঙ্গ এরপর আন্তরিক আর মেঘনার একদম কাছে এসে আন্তরিক কে এভয়েড করে সরাসরি মেঘনা কে জিজ্ঞেস করলো খুব একসাইটেড হয়ে ,———– ” হাই ,কেমন লাগলো শো ? গান ভালো লেগেছে ?”

মেঘনা এর উত্তরে অল্প হেসে কিছু কথা সাজিয়ে বললো , ———– ” হ্যাঁ , ভীষণ ভালো লেগেছে তোমার গান । স্পেশালি কলঙ্কিনী রাধা গানটা । খুব ভালো হয়েছে শো । থ্যাঙ্কস আমাকে ইনভাইট করার জন্য । তুমি অতটা জোর করলে বলেই এলাম । এখন মনে হচ্ছে না এলে সত্যি মিস করতাম ভালো কিছু গান !”
কথাটা শুনে তরঙ্গর মুখে চওড়া হাসি এলেও আন্তরিক কিরকম যেন বিরক্ত হলো একটু ! কি এমন গেয়েছে যে এতো প্রশংসা করতে হবে ! আর গান কম স্টেজের ওপর বেশি লাফিয়ে ছেলেটা ! মাইক নিয়ে এতো ঘাড় দুলিয়েছে যে মাঝে মনে হচ্ছিলো মাথাটা খুলে না নিচে পরে যায় ! এর জন্য এতো সুনাম ! কথাগুলো তবে মনে মনেই বলেছিলো ও সেদিন | মুখে নিঃস্তব্ধ গাম্ভীর্যটা ছিলই | তখন আচমকা তরঙ্গ যেন ওকে আবিষ্কার করার মতন দেখে বলে উঠলো , ———- ” আরে ! আপনি এখানে ? সরি মেঘনা সামনে ছিল তো , তাই আর আপনাকে আলাদা করে খেয়াল করিনি |”

কথাটা যে তরঙ্গ আন্তরিককে শুনিয়ে বললো এটা ও স্পষ্ট বুঝলো | তবে আজ আর আগেরদিনের মতন চুপ করে থাকতে পারলো না | একটু গম্ভীর হয়েই উত্তর দিলো ,

————– ” আমার কলেজে আমি থাকবো এটাই তো স্বাভাবিক | মাইক্রো বায়োলজি ডিপার্টমেন্ট , এসিস্টেন্ট প্রফেসর | এই ফেস্ট যেখানে গান গেয়েছো , তার অর্গানাইজিং কমিটির আমিও একজন মেম্বার |”

কথাগুলো আজ আন্তরিক এতটা সিরিয়াসভাবে বললো যে তরঙ্গও এরপর আর ওকে কোনো উত্তর করতে পারলো না | একটু যেন ঘাবড়েই গেলো কয়েক সেকেন্ড | তারপর কথা ঘোরানোর জন্য বললো , ———– ” ওহ আচ্ছা , নাইস | এনওয়েজ মেঘনা , তুমি গ্রিন রুমে চলো না আমার সঙ্গে ! আমার সব ব্যান্ড মেম্বার্সদের সাথে তোমার আলাপ করিয়ে দেব তাহলে |”

আন্তরিক খেয়াল করলো মেঘনা এর উত্তরে যেন একটু ইতঃস্তত ভাবেই বললো , ————– ” আজ না , অন্য একদিন | আজ আসি |”

কথাটা শুনে তরঙ্গ বেশ বিমর্ষ হয়েই বললো , ——— ” আসবে ! ঠিক আছে ! এস তাহলে | পরে দেখা হবে |”

মেঘনা এর উত্তরে কিছু না বলে অল্প হাসলো শুধু , তারপর আন্তরিকের দিকে তাকিয়ে বললো , ————— ” আসলাম | আর এরপরে যদি কখনো তোমাদের কলেজে আসি , তাহলে কোনো রকম এপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই দেখা করবো | আজকের মতন আর হবে না কখনো | ”

কথাটা বলে আর অপেক্ষা না করে এবার ও কলেজের গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করলো | তরঙ্গও আর এই সময় দাঁড়ালো না | গ্রিন রুমের দিকে এগিয়ে গেলো | কিন্তু আন্তরিক সেই মুহূর্তে কয়েক সেকেন্ড যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল | শেষ বিকেলের সোনালী রোদ এসে পড়েছে ক্যাম্পাসটায় | কলেজের বড়ো গেটটার সামনে একটা পাতাঝরা গাছ বেশ জোরে হাওয়া দিচ্ছে এখন | আর সেই সবের মাঝে মেঘনা ধীর পা এ এগিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পাসটা পার করে | আন্তরিক জানে না ঠিক কিসের জন্য , কিন্তু আজ এই সময়ে অদ্ভুত একটা খারাপ লাগছে ওর | মুড্ অফ হয়ে আসছে | ওর মতন প্র্যাকটিকাল একটা ছেলের যে কি করে একজনের চলে যাওয়া দেখে খারাপ লাগতে পারে , এটাই মাথায় আসছে না ঠিক ! মনে হচ্ছে এইভাবে মেঘনাকে আজ যেতে দেয়া যাবে না | বরং ওর সঙ্গে যেতে হবে | যা কিছু কলেজে পেন্ডিং কাজ আছে , সব ফেলে , সব ভুলে , এই মেয়েটার সঙ্গে যেতে হবে | কথাগুলো মনে আসতেই ও আর দেরি না করে মেঘনার দিকে পা বাড়ালো , সেই মুহূর্তেই হঠাৎ আরাত্রিকা পেছন থেকে ওকে ডেকে উঠলো | ও যেন একটু তাড়াহুড়ো করেই ওর দিকে এগিয়ে এলো | তারপর অল্প একটু হাঁফাতে হাঁফাতে বললো ,

———— ” আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম এতক্ষণ | তোমাদের ডিপার্টমেন্টের ল্যাব এর জন্য কিছু ইনস্ট্রুমেন্ট কিনতে হয়েছে না ! তার লিস্ট আর টোটাল ব্যালেন্স চার্টটা লাগবে কাল মিটিং এ | প্রিন্সিপাল স্যার আমার হাত দিয়ে চেয়ে পাঠিয়েছেন , সব ডিপার্টমেন্ট গুলো থেকেই | তুমি যদি ওটা একটু দিয়ে দিতে এখন আমাকে !”

কথাগুলো শুনে আন্তরিক দু সেকেন্ড ভাবলো | তারপর এই প্রথম হিসাবের বাইরে গিয়ে ও বলে উঠলো , ————- ” আজ আমাকে যেতে হবে | কাল দিয়ে দেব | আসলাম |”

কথাটা বলেই আরাত্রিকার আর কোনো বারণের অপেক্ষা না করে ও বেশ জোরে পা চালিয়ে কলেজের গেটের দিকে এগিয়ে গেলো | এই মুহূর্তে আরাত্রিকাও কিরকম থমকে গেলো হঠাৎ ! কি হলো এই ছেলেটার আজ ! এইভাবে কাজের ব্যাপারে তো কোনোদিন না বলে না আন্তরিক | আজ কি এমন তাড়া এলো ওর ! প্রশ্নগুলো যেন নিজের মনেই করে উঠলো ও |

যাইহোক , সেদিন এরপর আন্তরিক তাড়াতাড়ি পার্কিং থেকে নিজের গাড়িটা বার করে কলেজের উল্টোদিকের অটোস্ট্যান্ডটার দিকে এসেছিলো | ও জানতো মেঘনা নিশ্চই এখানেই দাঁড়িয়ে | আর মিলেও গেলো ভাবনাটা | লাল রঙের সালোয়ার পরে মেঘনা নিজের মনে দাঁড়িয়েই ছিল অটোর অপেক্ষায় | আন্তরিক আজ ওর সামনে গিয়ে গাড়িটা দাঁড় করলো আচমকা | মেঘনা তো একটু থতমত হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ | ও আন্তরিকের গাড়িটা চেনে | কিন্তু সেটা ওর সামনে এখন কি করছে এটা বুঝতে পারছিলো না | তখন আন্তরিকই গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বললো ,

————— ” বাড়ি যাচ্ছ তো ? আমিও যাচ্ছি | চলো | একসাথে ফিরবো |”

কথাগুলো ও এতটা অর্ডার করার মতন করে বললো যে মেঘনাও ঠিক উত্তর দিতে পারলো না ! আর এমনিতে জানে , আজ ও আন্তরিকদের কলেজে এসে একবারও ছেলেটার সঙ্গে দেখা করেনি , এতে ওর খারাপ লেগেছে ! তাও গাড়ি করে বাড়ি ছেড়ে দেবে , এই ভদ্রতাটা সত্যি ও এক্সপেক্ট করেনি আজ | তা ও একটু কথা সাজিয়ে বললো ,

—————– ” তোমার কলেজ ! কাজ শেষ ?”

আন্তরিক কথাটার এক কথায়ই উত্তর দিলো , ———— ” হ্যাঁ শেষ | আজ তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে এসেছি | এস |”

না , এরপর আর কোনো প্রশ্ন করলো না মেঘনা | উঠে বসলো গাড়িতে | তবে একটা জিনিস এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে হঠাৎ | এই ছেলেটা অল্প কথার লোক বলেই হয়তো ওর মুখের ওপর না করা যায় না | আন্তরিক একটু ডেস্ক্রিপশনের বাইরে কেউ | আগে তো দেখে মনে হতো কোনো ডেপ্থই নেই ওর | শুধু কাজ ছাড়া কিছু বোঝেই না এ | কিন্তু ধীরে ধীরে যত আন্তরিককে দেখছে , অল্প অল্প করে ওর কাজের বাইরের ‘আমি’-টা কে জানতে পারছে মেঘনা | মনে হচ্ছে একে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখাই যায় | খুব বোরিং হবে না ! কেউ যেমন আজই , ও দেখা করেনি বলে আন্তরিক যেভাবে মাইন্ড করলো ! এটাও তো ওর একটা নতুন দিক ! যেই ছেলেটা এতো বছর পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থেকে চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত , সে আজ কারোর দেখা না পাওয়ায় খারাপ ফিল করছে ! তারপর আবার তাকেই লিফ্ট দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে ! এটাও কিরকম হিসাবের বাইরেই লাগছে মেঘনার | মানে ওর এতো বছরের চেনা আন্তরিকের বাইরে অন্য একজন আন্তরিক | এইসবই ভাবছিলো সেদিন চলন্ত রাস্তাগুলো দেখতে দেখতে | তখনই আন্তরিক জিজ্ঞেস করে উঠলো , ———– ” কেমন লাগলো ফাংশন ? এখনো মনে হয় ওই জোনেই আছো ?”

কথাটা শুনে মেঘনা আলতো হেসে বললো , ———– ” একচুয়ালি খুব ভালো লেগেছে ফাংশন | তরঙ্গ সত্যি ভীষণ ভালো গায় | আর ওর কিছু গানের সিলেকশন তো আমার খুব ফ্যাভারিট | আমার প্লে লিস্ট এ ও আছে | ”

কথাটা শুনে মেঘনা খেয়াল করলো আন্তরিক যেন একটু সিরিয়াস হয়ে গেলো | তারপর একদম অন্য একটা কথা জিজ্ঞেস করে উঠলো হঠাৎ ,

————- ” তুমি কফি খাবে ? এখানে খুব ভালো একটা কফি শপ আছে | আমার খুব পছন্দের | ”

ওর এতগুলো কথায় মেঘনা এক সেকেন্ড থমকে গেলো | তারপর একটু ভেবে বললো , ———– ” কফি ! মানে তোমার দেরি হয়ে যাবে না ?”

আন্তরিক এর উত্তরে অল্প হেসে বললো , ———— ” আমি চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত থাকি না | ”

কথাটা বলেই আর কোনো প্রশ্ন উত্তরের অপেক্ষা না করে আন্তরিক গাড়িটা ঘোরালো উল্টো রাস্তায় | তারপর দশ মিনিট ড্রাইভ করে পৌঁছে গেলো ওর পছন্দের কফি শপের সামনে | মেঘনা এবার সত্যি সারপ্রাইজড হয়ে গেলো ! লিফ্ট এ করে বিল্ডিংটার ওপরে ওঠার সময়ও বুঝতে পারছিলো না কোথায় যাচ্ছে ওরা ! তবে বিল্ডিং এর টপ ফ্লোরে এসে মেঘনা হঠাৎ থমকে গেলো রুফটপ কফিশপটাকে দেখে | পুরো ছাদটা জুড়ে ছোট ছোট টেবিল চেয়ার রাখা | কাঁচের রেলিং দিয়ে ঘেরা ছাদের চারিদিক থেকে পুরো শহরের অদ্ভুত সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যাচ্ছে এখানে | দূরে গঙ্গা আর হাওড়া ব্রিজটাও দেখা যাচ্ছে কফিশপটা থেকে | আর তার মাঝে মিষ্টি একটা হাওয়া হাওয়া দিচ্ছে চারিদিকে | খোলা আকাশের নিচে এই রকম একটা জায়গা আছে শহর কলকাতায় , সত্যি মেঘনা এতদিন এখানে থেকেও ঠিক জানতো না ! ও তাই আন্তরিকের দিকে নতুনভাবেই তাকিয়েছিলো আজ | এই ছেলেটা কিভাবে খোঁজ পেলো এরকম খোলা আকাশের নিচে থাকা এতো সুন্দর একটা ঠিকানার ! আন্তরিক ওর মুখটা দেখে হয়তো মনের কথাটা বুঝে গিয়েছিলো | তাই উল্টো দিকের টেবিলে বসে বলেছিলো ,

———— ” আমার ফটোগ্রাফির শখ আছে | তাই এরকম চেনা শহরের অচেনা কিছু লোকেশন আমাকে জানতেই হয় |”

কথাটা শুনে মেঘনা এবার আরেকটা ধাক্কা খেলো ! ও চোখ দুটো বড়ো বড়ো করেই বললো ,

————- ” তুমি ফটোগ্রাফার ! মানে এটা তোমার হবি ! কিন্তু তুমি তো সারাক্ষণ তোমার রিসার্চের কাজ , কলেজের কাজ , এইসব করো | আর সমরজেঠুও তো কিছু বলেনি এই নিয়ে কখনো !”

কথাগুলো কিরকম চোখের পলকে বলে গেলো মেঘনা | আন্তরিক এর উত্তরে একটু সময় নিয়ে বললো , ———– ” কিছু জিনিস খুব নিজের হয় | সবাইকে দেখানোর জন্য না | শুধু নিজের ভালো লাগার জন্য | তাই বাবা জানলেও আমি কাউকে কিছু বলতে বারণ করেছি | ”

কথাটা শুনে মেঘনা এবার না ভেবেই বলে উঠলো , ———– ” মঙ্গোল গ্রহ জানো ! তুমি মনে হয় ওখানকারই | পৃথিবীতে ভুল করে চলে এসেছো ! এতো অদ্ভুত ! মানে কোনোভাবে ডেসক্রাইব করা

যাবে না ! তোমাকে এতো বছর ধরে দেখছি , কিন্তু তুমি না বললে বুঝতেও পারতাম না যে তুমি কাজ ছাড়াও কিছু বোঝো !”

কথাটা শুনে আন্তরিক এবার জোরেই হেসে ফেললো নিজে | ততক্ষণে ওয়েটার একটা ক্যাপাচিনো , আর একটা কোল্ড কফি নিয়েও হাজির | আন্তরিক এবার কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললো ,

———— ” তুমি আমার তোলা ছবি দেখবে ?”

মেঘনা এই কথাটায় বেশ একসাইটেড হয়েই উত্তর দিলো , ———– ” হ্যাঁ ! তুমি দেখাবে ? সত্যি ?”

আন্তরিক এর কোনো উত্তর না দিয়ে আলতো হেসে নিজের ব্যাগ থেকে আইপ্যাডটা বার করলো | তারপর ফটোগ্রাফির ফোল্ডারটা খুলে মেঘনার হাতে আইপ্যাডটা ধরিয়ে দিলো | মেঘনা এরপর কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে গেলো যেন | একের পর এক চেনা কলকাতার অচেনা কিছু ছবি দেখে | কখনো গঙ্গার ধারের সূর্যাস্ত , তো কখনো হাওড়া ব্রিজে হেঁটে চলা অসংখ্য মানুষের ভিড় , তো কখনো কলেজস্ট্রিটের বই পাড়ার একজন খুব পুরোনো বয়স্ক মুখে ভাঁজ পরা বই বিক্রেতা , তো আবার কখনো রাস্তার সিগন্যালে দাঁড়ানো ফুল হাতে একটা ছোট্ট মেয়ে , যার শরীরে অভাবের ছাপ থাকলেও মুখটা ভীষণ নিষ্পাপ ! অদ্ভুত সুন্দর শহর আর তার মানুষের ছবি দেখে | ও তারপর অন্যদিনের থেকে একটু আলাদাভাবেই আন্তরিকের দিকে তাকালো আজ | বিকেল গড়িয়ে এই সময় সন্ধ্যে নামছে শহরে | সূর্যের একটা ম্লান আলো এই মুহূর্তে এসে পড়ছে উল্টো দিকে বসে থাকা ছেলেটার মুখে | মেঘনার এই সময়ে হঠাৎ মনে হচ্ছে , এতদিনের চেনাটা কোনো চেনাই ছিল না ! যে সামনে বসে আছে , সে একজন নতুন কেউ | যাকে মেঘনার ভালো লাগতে শুরু করেছে , কোনো কারণ ছাড়াই ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন ও কিরকম নিজের মনেই আন্তরিককে

বলে উঠেছিল , ————– ” তুমি এতো ভালো ছবি তোলো ! এতো সুন্দর চোখ তোমার ! মানুষকে দেখার ! সত্যি বুঝিনি |”

কথাটার উত্তরে আন্তরিক যেন একটু ইতঃস্তত হয়েই বললো , ———— ” থাক ! হয়েছে | এরকম অনেকেই ছবি তোলে | এমন কিছু না |”

এর উত্তরে মেঘনা এবার একটু অন্য কথা বলে উঠলো | ও কয়েক সেকেন্ড আন্তরিকের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে অল্প হেসে বললো ,

———-” কেউ তোমার সুনাম করলে তুমি খুব ওকোয়ার্ড হয়ে যাও তাই না ! বুঝতে পারছি |”

আন্তরিক এর উত্তরে একটু ইতঃস্তত হয়ে বললো , ———— ” না মানে হ্যাঁ ! কিন্তু তুমি কি করে বুঝলে ?”

এর উত্তরে মেঘনা কিছুটা কনফিডেন্স নিয়েই বললো , ————– ” কারণ আমি একজন রাইটার | লোকজনের ক্যারেক্টার এনালিসিস করা আমার কাজ , তাই |”

কথাটা শুনে আন্তরিক এবার একটু আগ্রহ দেখিয়েই বললো , ————— ” আচ্ছা ! তাই ! তো কি বুঝলে তুমি আমাকে দেখে ? কি এনালিসিস করলে ?”

মেঘনা এর উত্তরে সেই আগের মতন কনফিডেন্স নিয়েই বললো , ————- ” বুঝলাম যে তোমার ক্যারাক্টারটা হচ্ছে ‘ক্রমশ প্রকাশ্য’ ক্যারেক্টার | অনেকগুলো লেয়ার্স আছে যেটাতে | তবে কেউই তোমাকে পুরোপুরি চিনতে পারবে না কখনো, প্রেডিক্ট করতে পারবে না ঠিক , যতক্ষণ না তুমি চাও |লোকজন তোমাকে বাইরে থেকে দেখলে ভাববে এক , আর আসলে তুমি আর এক |”

কথাগুলো মেঘনা আন্তরিকের চোখে চোখ রেখেই বললো | আন্তরিকও এই সময়ে বেশ অবাক হয়ে গেলো | আজ পর্যন্ত ওর ভেতরের আসল ‘আমি’-টা কে কেউ এইভাবে বোঝেনি | আর ও নিজেও কাউকে এইভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেনি যদিও ! তবে এই প্রথম নিজেকে কারোর সামনে এক্সপ্লেন করে ভালো লাগলো ! একটা অন্য রকম ফিলিংস এসে জড়ো হলো মনে | মনে হলো হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই মেঘনাকে নিয়ে এই কফিশপে আসার প্ল্যানটা খারাপ ছিল না ! বরং দশ বছর সামনাসামনি থেকেও এই রাইটারকে না চিনে থাকাটা ভুলই হয়েছে !

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here