ধ্রুব পর্ব ৫

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৫

বৌভাতের দিন মা আমাকে জোর করে সীমার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে গেলো। আমি যেতে চাইছিলাম না। কারন ওখানেই গেলেই ধ্রুবর সাথে দেখা হবে। হয়ত তরুও সাথে থাকবে। আমি সহ্য করতে পারবো না। ওদের দুজনকে একসাথে দেখলে আমার ভেতরটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত জ্বলে উঠে। ভীষণ কষ্ট হয় আমার! কিন্তু আমার কোন অযুহাতই মা শুনলো না। বাধ্য হয়ে আমাকে যেতে হলো।

আমাদের জন্য যেই গাড়ি ব্যবস্থা করা হয়েছে তাতে আমি, মা, আন্টি,তরু, সুমাইয়া আরো অনেকেই ছিলো। কিন্তু ধ্রুবকে কোথাও দেখলাম না। মনে মনে খুশি হলাম। কিন্তু কে জানতো এই খুশিটুকু কেবল নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই! সীমার শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে যখন ওকে দেখলাম না তখন ভেতরে ভেতরে আমার অস্থিরতা শুরু হয়ে গেলো। মনে প্রাণে চাইছিলাম ধ্রুব যেন আসে। একবার যেন ওর দেখা পাই। চারদিকে চোখ। বুলিয়ে শুধু ওকেই খুঁজছিলাম। ওর দেখা পেলাম খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষে।

আমি মায়ের সাথে ভেতরের একটা রুমে বসে রেস্ট নিচ্ছিলাম। আন্টি আর তরুও ছিলো। বসে থাকতে থাকতে বোর হচ্ছিলাম বিধায় সুমাইয়াকে বললাম,” চল, আশপাশটা ঘুরে আসি।” ও রাজি হয়ে গেলো। রুম থেকে বেরিয়ে কিছুদূর এগোতে দেখলাম ধ্রুব এদিকে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব তাড়ায় আছে। দশবারো বছরের একটা ছেলে রুমের কাছে ঘুরঘুর করছিলো। ধ্রুব ঐ ছেলেটার হাতে নিজের সেলফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বললো, “তরুকে বল ভাইয়ার ফোনের চার্জ শেষ। চার্জ দিতে হবে। ওর ব্যাগে ভাইয়ার চার্জার আছে।” ছেলেটা ফোন নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ধ্রুব জড়িত ঘটনাগুলো আমার জীবনে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ালো যে এই সামান্য ঘটনাটাও তখন আমার মনে ঈর্ষা জাগিয়ে দিলো। বিদ্রোহ ঘোষণা করলো তরুর প্রতি। ধ্রুব পাশে তরুর নামক কোন অস্তিত্ব আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিলো।

কিন্তু আফসোফের বিষয় এই যে আমি চাইলেও কিছুই করতে পারছিলাম না। নিতান্ত রাগে দুঃখে আমি মায়ের কাছে গিয়ে বললাম, আমি এখুনি বাসায় যেতে চাই। মা তখন গল্পের আসর জমিয়ে ফেলেছে তাই রাজী হলো না। সবার সাথে একসাথে ফিরবে বললো। আমার মেজাজ তখন এতটাই খারাপ পারলে একা বেরিয়ে আসি। হঠাৎ আন্টি বললেন তার শরীর খারাপ লাগছে তিনি বাসায় ফিরে যাবেন। ধ্রুবকে খবর দেওয়া হলো। ধ্রুব এলে আন্টি রেডি হয়ে নিলেন বাসায় যাওয়ার জন্য। যাওয়ার সময় তিনি আমাকে সাথে যাওয়ার জন্য বললেন। আমি না করে দিলাম। তিনি শুনলেন না। ধমক দিয়ে বললেন,”এই মেয়ে,তোর যখন এখানে খারাপ লাগছে বসে থেকে কি করবি? তারচেয়ে আমার সাথে চল, বাসায় গিয়ে রেস্ট নিবি। তোর মা যখন ইচ্ছে ফিরুক।” মা-ও আমাকে আন্টির সাথে যাওয়ার জন্য জোর করলেন। অতঃপর আমি আন্টির সাথে বাসায় চলে এলাম। ধ্রুব আর তরুও ছিলো। ওদের দেখে ।না পারছিলাম সইতে না পারছিলাম কিছু বলতে এতটাই খারাপ অবস্থা ছিলো আমার।

বাসায় আসার কিছুক্ষন পর ধ্রুবকে দেখলাম আবার বেরিয়ে যেতে। ফিরলো একেবারে রাত সাড়ে দশটার দিকে। আমি আন্টির রুমে বসে গল্প করছিলাম। ধ্রুব ফ্রেশ হলে আন্টি টেবিলে খাবার দিলেন। টেবিলে তরুও ছিলো। আন্টি আমাকে জোর করে ওদের সাথে বসিয়ে দিলেন। ওদের দুজনের সাথে এক টেবিলে বসতে আমার খুব অকওয়ার্ড লাগছিলো। কিন্তু কিছু করার ছিলো না।

খাওয়ার সময় আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওদের দুজনকে পর্যবেক্ষণ করলাম। কিন্তু বাড়াবাড়ি ধরনের কিছু চোখে পড়লো না। দুজনেই দুজনের মত খাচ্ছে। তরুর খাওয়া আগে শেষ হলে ও উঠে গেলো। টেবিলে তখন আমি আর ধ্রুব। শুরু হলো আমার হৃদযন্ত্রের বেসামাল ধুকপুকুনি। তীব্র থেকে তীব্রতর স্পন্দন! আমি আধখাওয়া প্লেট রেখে উঠে গেলাম। ধ্রুব খাওয়া শেষ করে ধীরেসুস্থে উঠলো।

খাওয়া শেষে তরু ড্রয়িংরুমে টিভি দেখতে বসলো। আমি একপাশে চুপচাপ বসে ছিলাম। আন্টি ভেতরের ঘরে শুয়ে ছিলেন।ধ্রুবর ঘরের বাতি নেভানো। একবার ভাবলাম উঁকি দেই। কিন্তু সাহস হলো না। উঠে আন্টির কাছে চলে গেলাম।

এগারোটার দিকে বাবা মা ফিরলেন। আমি তখন ভেতরের রুমে বসে ছিলাম। তরু বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলো। দরজা খুললো ধ্রুব। সে-ই আমাকে জানালো, মা দরজায় অপেক্ষা করছে। মা আসার খবর শুনে আমি আর আন্টি দুজনেই একসঙ্গে বেরিয়ে এলাম। ধ্রুব নিজের ঘরে চলে গেলো। আমিও আন্টির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে এলাম। কিন্তু তারপর থেকে সারাদিন সারারাত ধ্রবকে ভেবে পার করতে লাগলাম। আমার অলস দিনগুলোর একমাত্র আনন্দঘন মুহূর্ত হয়ে উঠলো ধ্রুবকে নিয়ে ভাবনার সময়টুকু! আমি বারবার করে চেয়েও নিজেকে ওর কথা ভাবা থেকে সরাতে পারি নি। আগে বুঝতে পারি নি ওকে অন্য কারো সাথে দেখলে আমার এত কষ্ট হবে! নতুবা আমি কখনোই ওকে ফিরিয়ে দিতাম না। কখনো না! কিন্তু এই কথাটা ওকে কি করে বোঝাবো! ও তো আমাকে ভুলেই গেছে।

পরেরদিন সকালে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছিলাম। তরুকে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরোচ্ছে। আন্টিকে জিজ্ঞেস করতেই বললো,”তরু হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছে।” জীবনে এত খুশি বোধহয় কোনদিন হই নি যতটা খুশি এই খবরটা শুনে হয়েছি।

রাতের বেলা মনের আনন্দে ছাদে উঠলাম হাওয়া খেতে। তরু নেই। ভাবতেই বুকটা কেমন হালকা লাগছিলো। হঠাৎ ছাদের পশ্চিম পাশে চোখ পড়তেই ধ্রুবকে দেখলাম হাঁটতে হাঁটতে ফোনে কথা বলছে। ও আমাকে দেখতে পায় নি। আমার মাথায় কোন ভূত চাপলো জানি না, আমি আড়ালে চলে গেলাম। আমি অন্ধকারে পানির টাংকির পাশে গা ঢাকা দিয়ে রইলাম।

এদিকে আমাদের নতুন কাজের মেয়েটা আমাকে খুঁজতে ছাদে চলে এলো। নিশ্চই মা পাঠিয়েছে। ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে জোরে জোরে ‘নিশাত আফা’, ‘নিশাত আফা’ করে ডাক দিলো। আমি নড়লাম না। চুপচাপ পানির টাংকির পেছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। ধ্রুব সুলতানার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে?”

সুলতানা ছাদে আসতে ভয় পাচ্ছিলো বোধহয়। ভয়ে ভয়ে বললো,” নিশাত আফারে আম্মা ডাকে। হ্যায় একলা কাউরে না জানায়া ছাদে উইঠ্যা আসছে। আফনে একটু দ্যাখবেন ভাইজান?” ”

ধ্রুব ফোনের টর্চ অন করে ছাদের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলো। বিপাকে পড়ে গেলাম! আবার ওর মুখোমুখি পড়তে হবে ভেবে বুকের ভেতর তীব্র মাত্রার ভাইব্রেশন চালু হয়ে গেলো। ও এদিকটায় আসার আগেই আমি নিজে থেকেই বেরিয়ে গেলাম। ও চমকে উঠে বলল,”তোমাকে সুলতানা কতবার করে ডাকছে শুনতে পাও নি?”

ভাগ্য ভালো আমার হাতে ফোন আর হেডফোন ছিলো। গান শুনবো বলে নিয়ে এসেছিলাম। আমি হেডফোন দেখিয়ে বললাম,”গান শুনছিলাম। তাই শুনতে পাই নি।”

ধ্রুব বিরক্ত বোধ করলো। বোধ করি আমার একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকাটা ও ভালোভাবে নেয় নি। বললো,”আন্টি তোমাকে ডাকছেন। তাড়াতাড়ি নিচে যাও।”

আমিও আর দাঁড়ালাম না। সুলতানার সাথে নিচে নেমে গেলাম। নিচে নামার পরের স্মৃতিও খুব একটা সুখকর নয়। একা একা ছাদে যাওয়ার অপরাধে মা খুব বকাবকি করলো। যদিও মায়ের এসব বকাবকি কিছুই আমার কানে ঢুকছিলো না। আমি শুধু ভাবছিলাম ধ্রুব নিশ্চই ফোনে তরুর সাথে কথা বলছিলো। এই কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছিলো। পাগল পাগল লাগছিলো। এতদিনের থম মেরে থাকা কান্নাটা ভারী বর্ষণের ন্যায় বেরিয়ে এলো। আমি বুঝতে পারলাম ধ্রুবকে আমি হারিয়েছি। ধ্রুব আমার চেয়েও অনেক বেশি জেদী। ও যদি একবার কিছু ঠিক করে নেয়, তার থেকে ওকে ফেরানো অসম্ভব!

কিন্তু আমার ব্যাকুল হৃদয় বারবার শুধু একটা কথাই বলছিলো ধ্রুবকে আমার চাই। যেভাবেই হোক চাই! আমি জানি না এটা ভালোবাসা নাকি ঈর্ষা, আমি শুধু জানি ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। কিছুতেই পারবো না। ওকে ফিরে পেলে আমি কি করে বাবা মায়ের সামনে মুখ দেখাবো,তাও আমি জানি না কিন্তু এইমুহূর্তে শুধু একটা কথাই আমি জানি, তা হলো ধ্রুবকে আমার চাই। নয়ত আমি মরে যাবো।
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here