#চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা – ১৪(শেষ পর্ব)
আমরা টিলার পেছনের দিকটাতে বসলাম। এদিক দিয়েও নামার পথ আছে। কম ব্যবহার হওয়ায় সিঁড়ির ধাপে ঘাস উঠেছে, একটু জঙ্গুলে। কাছাকাছি টিলাও বেশ দূরে। তবে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওই টিলায় একটা টেম্পাংশালা।
এখানে বালক শ্রমণরা, পূর্ণাঙ্গ ভিক্ষু হওয়ার ধর্মিয় আচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতি শিক্ষা করে। মূল টেম্পাংশালার গেইট আটকে গেছে। বুদ্ধের বোধিসত্ত্ব মূর্তির সামনে আলো জ্বলছে। বসার জায়গা না পেয়ে সিঁড়ির উপর বসলাম। এখান থেকে নদীও দেখা যাচ্ছে। বাতাসে হিম বয়ে আনলেও প্রাচীন স্থাপত্যের টেম্পাংশালা, গৌতম বুদ্ধের নিমীলিত চোখের সৌম্যতা, নিরিবিলি নিস্তব্ধতা মিলে চারপাশ একেবারে শান্ত আর শান্তিময়। তার উপর আকাশে মেঘ জমেছে, আঁধার আরও গুমোট বেঁধেছে। পাহাড়ের ফাঁকফোঁকর দিয়ে সদর রাস্তা দেখা যাচ্ছে, দুএকটা চাঁদের গাড়ি শোঁ করে চলে যাচ্ছে।
আমি সোয়েটার পরেছি, তারউপর শাল জড়িয়েছি তবুও মাঘের কনকনে হাওয়া বাধ মানছে না। হাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কুয়াশাও পড়ছে। মিতাভাই আমার হাত নিজের হাতের ভেতর ধরে রেখেছে। আমার কেমন অদ্ভুত লাগছে, হাত টেনেও নিতে পারছি না, আবার সংকোচও হচ্ছে। যতই অভিমান হোক না কেন এই মানুষটাকে আমি ভয়াবহ রকম পছন্দও তো করি। তার আহবান এড়ানো আমার জন্য অতি কষ্টকর। আর আমি কথাও দিয়েছি আজ চুপচাপ তার সব কথা শুনব। কোনোরকম অস্থিরতা, চঞ্চলতা দেখাব না।
‘আচ্ছা, তো আমরা স্টেপ বাই স্টেপ শুরু করি। একদম প্রথম থেকে?’
আমি ঠোঁট উল্টালাম ‘আমরা কি অংক কষছি নাকি? সরল অংক? বদমাস রুল, প্রথম বন্ধনি না মিললে শেষ অংক মিলবে না?’
‘আমি যে অংক ছাড়া কিছু বুঝি না। তাই এভাবেই চেষ্টা করি?’
‘হুম।’
‘একদম শুরুতে ধর, হাসপাতালে আমি একটা অস্বাভাবিক রকম পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিলাম। মানে রাতে ঘুমিয়েছি, সকালে উঠে দেখলাম আমি হাসপাতালে। আমাকে জড়িয়ে কান্নাকাটির রোল পড়ে গেছে। কী? আমি সুইসাইড করতে চেয়েছি। মা কাঁদছে, বাবা চিৎকার করছে, সবাই ধরেই নিয়েছে প্রেমঘটিত ব্যাপার, মেয়ের নাম জানতে চাইছে। আমি হতবুদ্ধি, খুব বিব্রত আর একইসাথে নাকাল। আবার জানা গেলো কফসিরাপ খেয়ে সুইসাইড এটেম্পট করেছি। তখন ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে গেলো। লজ্জায় আমি মরে যাচ্ছিলাম। তখন তুই শুরু করলি আমাকে জড়িয়ে কনকের ভবিষ্যৎ বিপদবাণী। আমি এবারে বিহবল হয়ে গেলাম, ভয় পেয়ে গেলাম। আমার জন্য কেউ অকারণ কষ্ট পাবে, এটা আমি মানতেই পারছিলাম না। তোর মাথার দুটো তার ছেঁড়া ছিলো, না মানে এইকথা মিজবাউল বলে।’ আমার দিকে তাকিয়ে ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে আবার শুরু করল ‘তোর দুটো তার ছেঁড়া ছিলো আমার চারটে ছিঁড়ে দিলি। সেই সময়ে ভালোমতো কিছু ভাবার অবকাশ পেলাম না। বাবার হুংকারে কিছু বলার সাহস হলো না। সবাই একরকম ধরেবেঁধে বিয়ে দিয়ে দিলো আমাদের। বল ঠিক কীনা?’
আমি কী বলব, সেদিনের মিতাভাইর মুখ মনে পড়ে হেসে ফেললাম। আমার হাসি দেখে মিতাভাই চোখ কটমট করে উঠল।
‘হাসি থামা? আর তারপরে আমি আরও হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। একে তুই আমার থেকে দশ বছরের ছোট হবি। তায় বাচ্চা মেয়ে আর এরকম অদ্ভুত বিয়ে। আমি তোকে নিয়ে কী করব, কী ভাবব, কিছু ভেবে না পেয়ে তোর দিকটা, তোকে ভাবা একেবারে বন্ধ করে দিলাম। এমনভাব করে থাকতে লাগলাম যেন তোকে আমি দেখছিই না। কারণ আমি সমাধান পাচ্ছি না! তোকে বিয়ে করেছি, তুই বউ আমার – এইকথা আমার মস্তিষ্ক নিচ্ছে না তখন, আমি মানতেই পারছি না। অংক ভুল, সুত্র ভুল।’
আমার চোখ ছলছল করে উঠল। মিতাভাই আমার হাতের তালুতে নিজের আঙ্গুল দিয়ে সার্কেল আঁকতে আঁকতে বললেন ‘এখন রাগ না করে একটু ভাব, আমার জায়গা থেকে ভাব, আমি কী করতে পারতাম তখন? তোকে খুব অবোধ্য মনে হতে থাকে আমার। তোর আচরণ অস্বাভাবিক মনে হয়। হুট করে আমার ঘরে থাকা শুরু করলি তুই। আমার চারপাশে থাকিস। আমার চারিদিকে যেন তোর বলয় তৈরি হয়ে গেলো। আমার মনে হলো তুই আমার মতোই জটিল জালে আটকে গেছিস। জোর করে হওয়া সম্পর্কটাকে আগাতে চাইছিস। আমি তখন আমার মতো করে ভাবছি। আমাকে বাবা প্রতিদিন হুমকি ধামকি দিচ্ছে, তোর প্রতি দায়িত্ব পালন করছি কীনা। আমার মনে হতে থাকল, একইরকম চাপ তোর উপরও, আমার খেয়াল রাখার জন্য তোর উপর প্রেশার দেওয়া হচ্ছে। আমি তোকে বলতাম, ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে, যেন তুই মুক্তি পাস। তুই গান করতি। আমি বকতাম। আমার মনে হত যেকোনোভাবেই আমার মন পাওয়ার এই চেষ্টা তোকে কেউ শিখিয়ে দিয়েছে। অচেনা কনককে সম্ভাব্য অন্যায়ের হাত থেকে উদ্ধার করতে তোর উপর কতবড় অন্যায় করলাম আমি ; তাই ভেবে আমি তখন মরমে মরে যাচ্ছি। কোনোভাবেই প্রতিকার খুঁজে পাই না। আমি তাই পালাতে থাকি। নিজের থেকে, তোর থেকে। নিজের সামনে দাঁড়াতেও সাহস পেতাম না আমি, নিজেকে ছোটো, নীচ মনে হতো। নিজে ভালোমানুষ থাকতে গিয়ে তোকে প্রতারিত করেছি বলে মনে হতো সারাক্ষণ। একবার মনে হলো, যেহেতু জানাজানি হয়নি, আমি ডিভোর্স দিয়ে তোকে মুক্ত করে দেই। কিন্তু সেটাও আমি বলতে পারছিলাম না। তোর মনের উপর কিভাবে প্রভাব ফেলবে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন পড়াশোনায়ও তুই খুব সিরিয়াস। রেজাল্ট ভালো হচ্ছে। আমি একটু সময় নিলাম। ভাবলাম, তুই আরেকটু বড় হয়ে যা, আরেকটু ম্যাচিউরড হয়ে যা। তখন, যা আমার বুদ্ধিতে আসছে না তোর সাথে মিলে একটা ডিসিশন নেওয়া যাবে।’
মিতাভাই থামল একটু। আসলেই অনেক কথা বলে ফেলেছে। অল্প কথার মানুষেরা একবার বলতে শুরু করলে থামেই না সহজে। এদিকে আমার বিস্ময়বোধ কাটছে না। একটাই ঘটনা, অথচ দুজনের পারসেপশন কতটা আলাদা!
মিতাভাই আবার বলতে লাগল ‘এর ভেতর পিউ’র বিয়ের তোরজোড় শুরু হলো। তোর আচরণ আমার কাছে আরও অস্বাভাবিক লাগতে লাগল। মনে হচ্ছিল, তুই আমার সাথে ফিজিক্যালি ইনভলবড হতে চেষ্টা করছিস। আর এক রাতে তুই বাড়াবাড়ি করলি। আমি ক্ষিপ্ত হলাম। কেন বলি? সেইদিনই বাবা এসে ইশারা ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করছিল, আমরা যেন বাচ্চা নেই। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান। এই একই বুদ্ধি তোকেও কেউ দিয়েছে মনে হলো আমার। আমার খুব রাগ হয়েছিল তোর উপর, সবার উপর। শুধুমাত্র বিয়ে হয়ে গেছে বলে সম্পর্কের চাপ কেন মাথায় বয়ে বেড়াতে হবে? কেন এই বিয়েটাকেই এতোটা গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে ফেলতে হবে? তুই কত ভালো রেজাল্ট করেছিস তখন। লম্বা পথ সামনে। বাচ্চাকাচ্চার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে সবাই তোকে আটকে দেবে আর তুইও সেটা মেনে নিবি?’
আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে মিতাভাই বলল ‘হ্যাঁ আমারও ভুল হচ্ছিলো। তোকে সবকিছু পরিস্কার করে, পুরো পরিস্থিতি তোকে বুঝিয়ে বলা উচিত ছিলো। কিন্তু ওই যে বললাম, আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। সমাধান আছে আমি জানি তখন কিন্তু কিভাবে শুরু করব তাই বুঝে উঠছি না। ত্রিকোণমিতির অংকের মতো। অনেকরকমভাবে সমাধানের চেষ্টা করা যায়, সবগুলোই শুদ্ধ, কিন্তু সমাধান পাওয়া যাবে শুধুমাত্র একটা সুত্র দিয়ে এগোলে, অন্য সুত্র দিয়ে নিয়ম মেনে অংক কষলেও সমীকরণ মিলবে না, সঠিক উত্তর আসবে না। সেই সঠিক নিয়ম, নির্ভুল সুত্রটাই আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি তোকে ভালোবাসতে পারছি না, স্ত্রী হিসেবে জায়গাটা দিতে পারছি না আবার তোকে ছেড়ে দিয়ে জীবনের কোনো কঠিন পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতেও পারছি না। সে এক ভীষণ অবস্থা!’
মিতাভাই’র কন্ঠে অপারগতার অসহায়তা আর অপরাধবোধ দেখে আমি বলতে চাইলাম ‘না, এরকম ছিলো না সবটা।’ কিন্তু মিতাভাই বলতে দিলো না। আমার ঠোঁটে নিজের আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিয়ে বলল ‘কিছু না বলে আমি সবকিছু জটিল করে ফেলেছি আরও। আজ শুধু আমি বলব, তুই শুধু শুনবি।’
আমি চোখের পানিতে ভেসে মাথাটা নাড়লাম শুধু।
‘এরপরে তুই হঠাৎ করে হাওয়া হয়ে গেলি। আমি বুঝলাম খুব খারাপ করে ফেলেছি আমি। রাগটা তোর উপর দিয়ে গেছে। কিন্তু অপরাধী তো আমি। তুই ছোটোমানুষ, আমি চুড়ান্ত ক্রেডিবল আচরণ করে তোর বোকা কথায় ভুলেছি, তোর কথা না ভেবেই স্বার্থপরের মতো তোকে বিয়েতে রাজি করিয়েছি। তোকে বিয়ে করে আমি তোকে মেনে নিতে পারিনি, তোর প্রাপ্য কিছুই তোকে দিইনি, আবার তোকে ধরেও রেখেছি, বন্ধনমুক্ত করতে আগ্রহ দেখাইনি। সবখানেই দোষি আমি। কিন্তু বকলাম তোকে। নির্লজ্জ আর বেহায়া বানালাম তোকে। আর কী হলো, তুই আমাকে ত্যাগ করলি। আমি কিন্তু তখনও বুঝিনি যে তুই আমাকে ছেড়ে আমার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছিস। তোর কষ্ট হয়েছে আমি সেটা তখনো পরিমাপ করতে পারিনি। তুই পিউ’র পুরো বিয়েতে আমার ধারেকাছে আসলি না। তখনও আমি কিন্তু কিছু টের পাচ্ছি না। ভাবছি, বিয়ের আনন্দ হুল্লোড়ে ব্যস্ত থাকছিস। অনুষ্ঠান শেষ হলেই ফিরে আসবি আর আমি তোর সাথে সামনাসামনি বসে কথা বলব। কিন্তু এখানেও দেরি করে ফেললাম। পিউ চলে গেল শশুরবাড়ি কিন্তু তুই ফিরলি না। নিচে তো নামলিই না, আমার সামনেও পড়লি না। এলোমেলো বৃত্ত এঁকে খাতা ভরা আমার মুদ্রাদোষ, আমি ফ্রিহ্যান্ড নিঁখুত বৃত্ত আঁকতে পারি, প্রথমবারের মতো বৃত্তগুলো চ্যাপ্টা, তেরছা হয়ে যাচ্ছিলো। ইন্টিগ্রেশন, ডিফারেন্সিয়েশন প্যাঁচ লাগিয়ে ফেললাম। খুব মিস করতে শুরু করলাম তোকে। আমার ঘরের মতো খাতার পাতাও খালি থাকতে লাগল। ভয়ও হচ্ছিলো, খারাপ কিছু না করে ফেলিস। আমি তাহলে মরে যাব একদম। রিপেন্ট করতে লাগলাম ওভাবে রাগ না করে সুন্দর করে তোকে বুঝিয়ে বলতে পারতাম। কিন্তু আমি যে কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না! তোকে কী বোঝাবো, নিজেই তো বুঝি না! না পেরে বইয়ের অজুহাতে তোকে ফোন দিলাম, ভাবলাম বই খুঁজে দিতে নেমে আসবি আর আমি তোর রাগ ভাঙাব। কিভাবে রাগ ভাঙাব সেটা ভাবিনি, শুধু ফোন দেওয়াটা দরকার সেটাই মাথায় এসেছিল। আমি কিন্তু খুব সহজেই উপরে গিয়ে তোর সাথে কথা বলতে পারতাম। কিন্তু সংকোচ হচ্ছিলো, চাইছিলাম তুই নিজে থেকে আসবি, সব সহজ হয়ে যাবে। আমি অপেক্ষা করে বসে রইলাম কিন্তু তুই তো আসলি না! পরেরদিনই আমি উপরে গেলাম তোকে ডাকতে। ছোটোচাচি যখন বলল তুই একেবারে দেশ ছেড়ে চলে গেছিস তখন আমি খুব অবাক হলাম আর রেগেও গেলাম। যে আমি একঘরে থেকেও তোর কোনো খেয়াল করিনি, কেন আমাকে না বলে চলে গেলি সেই অপরাধে তোকে প্রতিনিয়ত শাস্তি দিতে থাকলাম। কখনো কানে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখি তো কখনো বিছানায় শুতে দেই না! প্রতিদিন তোর নাম্বারে গুণে গুণে একশোটা কল দেই। রোবোটিক নারীকন্ঠ আউট অফ রিচ বলে, আমি সেইটুকু কান পেতে শুনি, আর কল দিয়ে যাই। আমি অস্থির হতে থাকি আর তখনই আমার সুত্রটা মিলে যায়।
পুরো সম্পর্কটা আমার কাছে দ্বিঘাত সমীকরণের মতো ছিলো যার ডানপক্ষ ছিলো আমাদের বিয়ে আর বামপক্ষে তোর আর আমার সাথে অজানা রাশি এক্স আর ওয়াই। ওই সময়ে নিজের সাথে থাকা এক্স এর মান আমি পেয়ে গেলাম। তোকে আমি ভালোবাসি সেটা টের পেলাম। আর সাথে সাথে এটাও জানলাম, তোর মনের খবর আমি জানিনা, এই সম্পর্কে তোর মনের ওয়াই এর মান আমি জানিনা।’
আমি মিতাভাই’র হাত চেপে ধরলাম এবার। সে মুখ তুলে একটু প্রশ্রয়ের চোখে তাকালো শুধু। আমার যতটুকু শোনার দরকার তা আমি শুনে ফেলেছি আর কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে না, তবুও চার বছরের হিসেব পেতে মন আগ্রহী হয়ে উঠল। মিতাভাই বলছে ‘তুই একেবারে আমাকে ত্যাগ করল। আমি প্রতিদিন একবার করে উপরে যেতাম, মিলাকে জিজ্ঞেস করতাম তুই ফিরবি কবে? কোনো উত্তর পেতাম না। একদিন ছোটচাচি বলল তুই দেশেও ফিরেছিস আর বাড়ি ছেড়ে হলেও উঠে গেছিস। আমার জন্য খুব কষ্টকর হলো কথাটা বিশ্বাস করা। তুই পুরোপুরি সম্পর্কটা ত্যাগ করেছিস, আমাকে ছেড়ে গিয়েছিস আমি পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম। আর ততই তোকে বেশি করে পাওয়ার ইচ্ছে আমাকে অস্থির করে দিচ্ছিলো। তোর অসমাপ্ত চুমু আমাকে উন্মাদ করে রাখছিল। সারারাত আমি ঘুমাতে পারলাম না, সব হারানোর যন্ত্রনায়, তোকে হারানোর ভয়ে। সকালেই ভার্সিটিতে গিয়ে তোর সাথে কথা বলব ভাবলাম।
ভোরের আলো ফুটতেই তোর হলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার পা ব্যথা করছিলো জানিস? অনেকক্ষণ পরে তুই বেরোলি। সেদিন কোনো একটা অনুষ্ঠান ছিলো তোদের ডিপার্টমেন্টে। তুই শাড়ি পরেছিলি। অনেকদিনের পরে তোকে দেখলাম, অনেক বড় হয়ে গেছিস মনে হলো। তোকে ডাকলাম সংকোচ ছেড়ে। তুই সামান্য পরিচিতর মতো কথা বলে এড়িয়ে গেলি আমাকে পুরোপুরি। নিজের শিক্ষক ইমেজ ছেড়ে আমি মরিয়া হয়ে পেছন থেকে তোকে ডাকলাম, তুই ফিরলি না। জারুল ফুলের মতো রঙ শাড়ির। প্রতিপায়ে শাড়ির কুঁচিগুলোর সাথে আমাকে, আমাদের বিয়েটাকেও যেন ছিটকে যেতে দেখছিলাম। মাথা একেবারেই খারাপ ছিলো তখন। আরও বিগড়ে গেলো। অপ্রকৃতস্থ আচরণ করতে লাগলাম। তখন মিজবাউল সামলালো আমাকে।’
‘কে? মিজাভাই?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী বলল সে?’
‘ও আমাকে সময় নিতে বলল। তোকে সময় দিতে বলল। তোর পড়াশুনা, ক্যারিয়ার। এদিকে আমি তোকে সত্যি ভালোবাসি কিনা নাকি অভ্যস্ততার টান সেটাও নাকি স্পষ্ট হবে, কয়েক বছরের সময়ে।’
আমি এইটুকু শুনে পুরো হতভম্ব হয়ে গেলাম। মিজাভাইকে রাবারের মতো টেনে নুডলস বানিয়ে, ফোর্কের আগায় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কোৎ করে গিলে ফেলতে ইচ্ছে করছে। বহু আকাঙ্ক্ষার সেই প্রেম কবে এসেছিল জীবনে, ওই খাইস্টা মিজাভাইর জন্য এতোটাদিন কাঁদলাম আমি! ‘মিজাভাইর বাচ্চা’ বলে গালি দিতে গিয়ে মত পালটে মনে মনে বললাম ‘বড়চাচির বাচ্চা, তোমারে আমি খাইছি।’
‘আর আপনি মিজাভাইর কথা শুনে সেইমতন চললেন? আমার কাছে এলেন না?’ ঠোঁট ফোলালাম আমি।
‘ওর কথায় লজিক ছিলো। আর আমিতো লজিকের বাইরে চলতে পারিনা। তবে প্রেমও ছিলো আর মন লজিকে বেঁধে থাকছিলো না তাই প্রায়ই তোকে খুঁজে নিতাম। তোকে দেখতাম। কোনো কোনোদিন মন একেবারে বাঁধা না মানলে তোর সামনে যেতাম। ডাকতাম দুটো কথা বলার জন্য কিন্তু অবহেলায় তুই আমাকে শুনেও শুনতি না। আমি কষ্ট পেতাম। ভেঙেচুরে যেতাম। তোর সাথে জাবিরকে দেখতাম, তৌকিরকে দেখতাম, আরমানকে দেখতাম। কী সহজে মিশিস তুই ওদের সাথে, লাইব্রেরিতে যাস, বেড়াতে যাস, কত কথা বলিস! ইর্ষায় আমার চোখ জ্বলত। বিভিন্ন ছুটিতে তোর দেখা পাওয়ার আশায়, একটু সান্নিধ্যের আশায় বাড়ির গেইটে চাতক পাখির মতো চোখ লাগিয়ে বসে থাকতাম, বাড়ি তো আসবিই। তুই সেবার চন্দ্রনাথ পাহাড়ে গেলি, একবার গেলি রামুর রাবার বাগান দেখতে, একবার গেলি সেইন্ট মার্টিনে। আরও একবার গেলি শান্তিনিকেতন।
অসহ্য হতে লাগল সব। ভাবলাম তোকে জোর করিয়ে ফিরিয়ে আনি। বাবা বললে তুই না ফিরে পারবি না। আবার নিজেকে সামলালাম। তোর পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইলাম। মনে মনে প্রবোধ দিতে থাকলাম, তোর দিক থেকে হয়তো ওয়াই এর মান শূন্য হয়ে গেছে, তাহলে পুরো ইকুয়েশনে আমি ছাড়া তো কিছু নেই। আমি অপেক্ষা করলাম। অনেক অসহ্য অপেক্ষা। চারপাতা অংক কষে শেষটা না মেলার মতো যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষা। শুধু মনে হতে থাকে কেন তোকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম? তোর জায়গায় ফিরে নিজে নির্লজ্জ হতে ইচ্ছে করে। মিলার বিয়েতে তুই আসবি জানতাম, এলি ও। কত কথা বলার কথা আমার। কিছু বলতে পারলাম না। একবার তোকে কাছে পেতে নিজের স্বভাব ছাড়লাম, তোকে বারবার ডাকলাম। আমি তখন পুরোপুরি বুঝে গিয়েছি, তোকে আমি হারিয়েছি। ফাঁকিবাজির বিয়েটার ফাঁকিটাই শুধু রয়েছে আমার। আমার কিছু বলা হলো না তোকে। আসলে আমিতো জানিই না কিভাবে মনের কথা বলতে হয়!’
‘এইযে, এখন যেভাবে বলছেন সেভাবেই কেন বললেন না কোনোদিন। কানে ধরে কেন বললেন না,আপনার সব কথা আমাকে শুনতেই হবে?’ আমি কেঁদে ফেললাম এবার।
‘এভাবেই আমিই সবটা জটিল করেছি। একটা ধাক্কার দরকার ছিলো আমার। নইলে কোনোদিন বলতেই পারতাম না। তুই রাঙামাটি আসার আগে মাকে বলে এসেছিস, এই বিয়েটা তুই ভেঙে দিচ্ছিস। আমি হয়রান হয়ে গেলাম। আমি জানতাম সব ভেঙে গেছে। সত্যি বলতে কোনোদিন তৈরিই হয়নি। তবুও আমার মাথা খালি হয়ে সব অংক, সুত্র বেরিয়ে যাওয়ার মতো যন্ত্রণা হলো। আমি নিজেকে স্থির করলাম। তোকে হারিয়েছি, সব প্রমাণ তাই বলছে, কিন্তু আমার কথাগুলো তো তোকে জানাতেই হবে। এই ধাক্কাটা তুই না দিলে হয়তো এভাবে কোনোদিন মনের কথাগুলো তোকে বলতেই পারতাম না। কখনো বলা হতো না ‘ঐন্দ্রিলা, তোকে খুব ভালোবাসি।’
আমি ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। যে কোনোদিন কিছু বলেনি, সে ঠিকই বলে দিলো তার ভালোবাসার কথা, আমার ধ্যানজ্ঞান ছিলো শুধু তাকেই ভালোবাসা, অথচ কোনোদিন বলতেই পারলাম না। ‘ভালোবাসি’ কথাটাই মুখ থেকে বেরোলো না। মিতাভাই এতো অনুতাপ করছে, অথচ এই জটিলতায় আমার দায় কি একটুও কম?
মিতাভাইর সব বলা হয়ে গেছে। চুপ করে বসে রইলাম আমরা কতটা সময় সেই আঁধারে। টিপটিপ করে বর্ষা নামতে শুরু করেছে। আমার মনেও। মাঘের কনকনে ঠান্ডা বৃষ্টির মতো সুশীতল বারিধারায় মন ভিজে যাচ্ছে, আমি ভিজে যাচ্ছি। অন্দর-বাহির সবখানে আমি আর্দ্র হয়ে যাচ্ছি।
আমি বললাম ‘মিতাভাই ওঠেন, বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি।’
‘ভিজিই না।’
‘না, ঠান্ডা লেগে যাবে।’
‘তুই কিছু বলবি না?’
আমি দুবার ঠোঁট নাড়লাম কিছু বলার জন্য, এতো এতো কথা জমে আছে আমার। কিন্তু সারাশরীরে অবসাদ নেমেছে, সব পাওয়ার অবসাদ। মুখে কথা ফুটল না। কিছু না বলেই আমি উঠতে গেলাম। মিতাভাই টেনে নিলেন আমাকে। নিজের সাথে একদম মিশিয়ে নিলেন। গাঢ় আলিঙ্গনে বাঁধলেন। আমি মনে হলো, আনন্দে মরেই যাবো। দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললাম। তার তপ্ত নিঃশ্বাস আমার গালে পড়ছে, উষ্ণতায় আমি গলে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি যেন অনুভূতির প্রগাঢ়তায়। আহ, পৃথিবী কি ঠান্ডা হয়ে গেছে? সব কি থেমে গেছে? আহ্নিক গতিতে ধ্বস নেমেছে?
‘একটা মজার কথা বলি? এখানে এসেছিলাম আমি তোকে হারিয়েছি জেনেই। পাগলামিও করেছি অনেক, যেগুলো ব্যাক্তি আমার সাথে যায়না। জাবিরকে অসহ্য লাগছিলো।’
আমি চোখ বুজে থেকেই ফিসফিস করে বললাম ‘তারপর?’
‘মিজবাউল লম্বা এক থ্রেড মেইল করেছে।’
আমি হাসলাম। ‘কী বলেছে মিজাভাই?’
সে আমার কানে ছোটো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো। আমাকে আরও আরও অনেকখানি মেরে ফেলে বললো ‘সেখানে লেখা আছে, ইট ওয়াজ অল ইউ! ইউ ডিড অল অফ দিস এন্ড ইটস অল ইয়োরস।’
ইশ, মিজাভাই সব বলে দিয়েছে? লজ্জায় আমি কেঁপে কেঁপে উঠলাম তার বাহুনন্ধনীতে! আমার একপক্ষীয় চুমু পূর্ণতা পেলো দুর্গম এই লালপাহাড়ের
উপর, একমাথা বর্ষায় ভিজে। আর আমি জানলাম, চুমু কখনো একপেশে হয়না। দুজন ভালোবাসলেই ঠোঁটে ঠোঁটে ছুঁয়ে গেলে স্বর্গ নেমে আসে পৃথিবীতে।
মিতাভাই ফিসফিস করে বললো ‘আজ ঢুকতে দিবি তো ঘরে?’
‘কখখোনো না! আমাকে কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অনেকদিন আগে? আমিও তো এভাবেই চেয়েছিলাম?’
‘আমাকে নিবিড় করে পেতে চাওয়াটা যদি তোর ভুল মনে হতো? তোর সেদিনের দিতে চাওয়াটা আমি যদি দুহাত ভরে নিতাম, তো এমনও হতে পারত আজ তুই অনুতাপের জায়গা পেতি না। আমি সেদিন ঠিক ছিলাম। তুই ইমম্যাচিউর ছিলি। সেদিনের ছুটিকে আমি আজও সর্বান্তকরণে গ্রহন করতে পারতাম না। সংকোচ থেকে যেতো, অপরাধবোধে ভুগতাম। আজকের ঐন্দ্রিলা কি সেদিনের ছুটির অভিমানে আমায় ফিরিয়ে দেবে?’
‘হুহ! আপনি শুধু ভালো করে অংক করে যান। আমাকে যতদিন ভুগিয়েছেন তার একবিন্দু ছাড় দেবো না আমি। সবটুকু শোধবোধ হবে আগে?’
‘আয় শোধবোধ করে দিই। এক আনা ফাঁকি দেব না, কথা দিচ্ছি!’ আমাকে একহাতে কাছে টেনে নিলো সে। আমি ভেঙে যাওয়া গলায় মিনমিন করে বললাম ‘প্লিজ মিতাভাই.. ‘
‘কী মিতাভাই, মিতাভাই করিস?’
‘আপনি তো জাতীয় মিতাভাই। আমি ঠিক করেছি, আমার বাচ্চাকাচ্চাও আপনাকে মিতাভাই বলে ডাকবে…’
‘তা আর কোথায় হলো?’ কপট উদাসীনতা মিতাভাইর গলায়।
‘কী হলো না?’
‘ওইযে বললি বাচ্চাকাচ্চা! কোথা থেকে আসবে? এখনো ঠিক করে বউই পেলাম না। এখন আবার চললি এতো বছরের জমানো শাস্তি দিতে..’
আমি তার বুকে মুখ লুকালাম। ষোড়শী ছুটির লজ্জা ছিলো না। আজ দুনিয়ার লজ্জা আমাকে ভর করেছে। আমি বিড়বিড় করলাম ‘যা বৃষ্টি ধরে যা!’
চৈত্রের খরার পরে মাটিতে নেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটার শব্দের সাথে সাথে সোঁদা গন্ধটাও পেতে পেতে হারিয়ে গেলাম আমি এই ভরা মাঘমাসে। মনের ভিতর বাজতে থাকল পাহাড়ি বর্ষার ছন্দময় দুলুনি…
আজ তুমুল বর্ষা নামুক না, একূল ওকূল সব ছাপিয়ে!
সমাপ্ত