নিঃশ্বাসে তুই পর্ব -১৪+১৫

#নিঃশ্বাসে_তুই |১৪|

ইদানীং অহমির বেশিরভাগ রাত কাটছে নির্ঘুম। তার ধ্যান- জ্ঞান, ভাবনা-চিন্তা সবকিছুর মূল কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠছে কেবল ধ্রুব। অহমির প্রতি করা ধ্রুব’র নিশ্চুপ কেয়ারগুলো
তার কিশোরী মনে না চাইতেও জাগিয়ে তুলছে তীব্র প্রেমের উদ্বেগ। অতর্কিতে মন হয় চঞ্চল, পুনরায় কিছু ভাবনা এসে মিয়িয়ে দেয় তাকে। নিজের সঙ্গে কীসব ঘটছে ভেবে ভেবে কুল-কিনারাহীণ হয়ে উঠছে সে। মনের দিক থেকে উত্তর হ্যাঁ হলেও মুখে প্রকাশ্যে নারাজ সে। সর্বদা নিজের কাছে তৎপর থেকে একটি কথাই ভাবতে চায়, ‘সে কোনো প্রেমে-টেমে পড়ে নি৷ অমন কাঠখোট্টা মানবের সঙ্গে প্রেম হয় নাকি?” কোচিং ক্লাসেও বন্ধুমহলে শুনতে হয় নানারকম রসিকতামাখা কথা। অহমিকে ঘিরে ধ্রুব যেসব পাগলামি করে থাকে তা সকলের দৃষ্টিতেই স্বাভাবিকের তুলনায় বৃহৎ। এমনকি পুষ্পও তাকে ছেড়ে কথা বলে না। সারাদিন খোঁচাতেই থাকে।

আজ দিনটি একটু ভিন্ন। কারণ আজ অহমি একা কলেজ যাবে। পুষ্প যেতে পারবে না প্রমি এসেছে তাই। অন্যদিন হলে অহমিও যেত না কিন্তু ইয়ার ফাইনাল এক্সামের আর মাত্র ছয়দিন বাকি। এ সময়টায় স্যার-ম্যাডামরা রোজই কিছু না কিছু জরুরি নোটিশ দিচ্ছেন। তাই সেসব একদমই মিস দেওয়া যাবে না। নিজে নোটিশ গুলো কালেক্ট করে পুষ্পকেও পাঠিয়ে দেবে। সে ভাবনা থেকেই একা বেড়িয়ে পড়ল অহমি। ধ্রুব’র পাঠানো গাড়ি করেই রোজকার মতো কলেজে চলে গেল সে।

.

“আপু আমি কিন্তু আজ কোনো এক্সকিউজ শুনছি না। জিজুকে আজ দেখাতেই হবে। সেই তিন বছর ধরে বলে বলে আজও দেখাতে পারলে না। তা শুনি কে সেই মহান ব্যক্তি যে আমার ভোলা ভালা আপুটাকে পটিয়ে নিল। কে সেই মহাপুরুষ? আজই তাকে স্বচক্ষে দেখতে চাই আমি।”

একনাগাড়ে কথা গুলো বলে থামল পুষ্প। প্রমি হা করে তাকিয়ে আছে বোনের মুখের দিকে। পুষ্প রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। অকস্মাৎ প্রমি তার কান টেনে ধরে। মাথা নেড়ে চেড়ে বলে,

“ওরে ফাজিল মেয়ে। খুব পেকেছিস তাই না। দ্বারা আমার আগেই তোকে বিদায় করতে বলব বাবাকে।”

“আরেহ আরেহ লাগছে তো আপু। ছাড়! ছাড় প্লিজ।”

প্রমি পুষ্পর কান থেকে হাত সরিয়ে নিল। কোলের ওপর বালিশ পেতে তার ওপর হাতের ভর ছেড়ে দিয়ে বসল। আনমনা কন্ঠে বলল,

“আমার কাছে সে সত্যিই মহাপুরুষ রে। তার মতো উদার মনের মানুষ আমি আর দুটো দেখিনি। তুই তো জানিস বরাবরই আমার সুন্দর মনের মানুষদের সঙ্গে ভাব হয়ে যায়। সেভাবেই আমি তাকে পেয়েছিলাম। তার মতো সুন্দর, পবিত্র মন আমি আর কারো দেখিনি। এই ক’ল’ঙ্কি’ত সমাজে সে এক জ’ল’জ্যা’ন্ত নক্ষত্র। জানিস এই মানুষটার মন এতটাই কোমল যে, ‘রাস্তায় কোনো পথচারী রাস্তা পাড় হতে না পারলেও তাকে এগিয়ে যেতে হবে। ফুল কাঁধে নিয়ে ঘুরে ঘুরে মালা বিক্রেতা মেয়েটি যখন বিষন্ন মনে শূন্য হাতে ঘরে ফেরার পথে তখনও সেখানে তার উপস্থিতি। সামর্থ্য অনুযায়ী ফুল কিনে নেওয়া। রাস্তায় মুমূর্ষু রোগীকে হসপিটাল অব্দি পৌঁছে দিতে তার জুড়ি মেলা ভার।’ এমন অনেক অনেক অনেক সুন্দর সুন্দর মুহুর্তের সাক্ষী আমি হয়েছি। সেই থেকেই ধীরে ধীরে আমি তাহাতে আবদ্ধ হয়ে গেছি। কখন, কীভাবে, কী হয়ে গেল জানা নেই দুজনের। শুধু এতটুকুই জানি সে আমার প্রাণ, আমি তার প্রাণভোমরা।”

পুষ্প হা করে প্রমির বদনে চেয়ে চেয়ে শুনলো তার অদ্ভুত সুখানুভূতির কথা। তার এই চুপচাপ, শান্তশিষ্ট স্বভাবের বোনটি যে কাউকে এতটা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে ভালবাসতে পারে এটা তার ধারণার বাহিরে ছিল। সত্যিই মানুষ চেনা বড়-ই শক্ত কাজ। কাউকে বাহির থেকে যাচাই করে তার ভেতরের খবর বের করা নেহাৎই বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। পুষ্প প্রমিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখল। প্রমি হুঁশে ফিরে পুষ্প’র মাথায় হাত রেখে মুচকি হাসল। শীতল কন্ঠে বলল,

“তোর জীবনেও খুব শীঘ্রই এমন কেউ আসুক। সে তোর প্রাণ হোক আর তুই হবি তার প্রাণভোমরা।”

পুষ্প মুচকি হেসে প্রমিকে আরও একটু শক্ত করে চেপে ধরল। মনে মনে বলল,

“এসেছে আপু! সে এসেছে। খুব শীঘ্রই কেন বহু বছর আগ থেকেই এসেছে। তার প্রাণভোমরা হতে পেরেছি কি না জানি না তবে সে আমার জান,প্রাণ,ধ্যান-জ্ঞান, ভাবনা-চিন্তা, সুখ-দুঃখ সব সব হতে পেরেছে। সে মিশে আছে আমার মুগ্ধতায়।”

.

টানা পাঁচ ঘন্টা ক্লাস করে বাড়ির পথে রওনা হয়েছে অহমি। ক্যাম্পাস পেড়িয়ে মেইন গেট অব্দি আসতেই বাঁধল এক বিপত্তি। কলেজের এক জুনিয়র তার সম্মুখে ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির। রীতিমতো বেশ গুছিয়ে প্রপোজ পদ্ধতি শুরু করে দিয়েছে সে। অহমি হতবাক। কলেজের বেশিরভাগ স্টুডেন্ট গোল হয়ে দাড়িয়ে পড়েছে ওদেরকে ঘিরে। এমন বিভ্রান্ত পরিস্থিতিতে পড়ে অহমি দিকশূন্য হয়ে পড়েছে। লোকলজ্জায় মাটির সঙ্গে পিষে ফেলছে তাকে। জুনিয়রের কাছ থেকে এভাবে প্রপোজ পাওয়া কোনো গর্বিত বিষয় নয় বরং তীব্র লজ্জার। অহমির কাছে এটাই মনে হয়। নিজেকে যথেষ্ট গুটিয়ে দাড়িয়ে আছে অহমি। সুযোগ পেলেই দৌড়ে পালানোর ধান্দায়। কিন্তু সে উপায় কী আর আছে? চতুর্দিক দিয়ে যে হারে সকলে ঘিরে ধরেছে তাতে করে ওভাবে পালাতে গেলে পরিস্থিতি উল্টো দিকে মোড় নিতে পারে। নানাবিধ চিন্তাধারা বিবেচনা করে সেভাবেই ঘাপটি মেরে দাড়িয়ে থাকল সে। এদিকে তার সম্মুখে তুষার নামক ছেলেটি হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে নানারকম ভাবে প্রেম উপস্থাপনে ব্যস্ত। অহমির কর্ণে তুষারের একটি বাক্যও ঢুকেছে কী না সন্দেহ। তুষার যখন শেষমেশ অহমিকে ‘ভালবাসি’ কথাটা বলেই দিল অকস্মাৎ চতুর্দিক থেকে সকলে হৈ হৈ শুরু করে দিল। সকলে একত্রিত হয়ে উচ্চস্বরে অহমিকে বলছে এক্সেপ্ট দ্যা প্রপোজাল। তীব্র অস্বস্তিতে দম বন্ধ হয়ে আসছে অহমির। তুষার অতি আগ্রহী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে অহমির পানে। তুষার ছেলেটি দেখতে মাশাল্লাহ। পড়াশোনায়ও বেশ। বাবার টাকা পয়সাও আছে। বয়সটা বাদে মোটামুটি সবদিক দিয়ে অহমির জন্য পারফেক্ট। হাজারটা অপশন নিকটে থাকলেও অহমির মনে হচ্ছে তার জন্য শুধু একটি অপশনই বেস্ট। আর তা হলো ধ্রুব। ধ্রুব ছাড়া অন্য কোনো পুরুষকে ইদানীং নিজের সঙ্গে কল্পনাতেও আনতে পারে না সে। অকূল দরিয়ায় ভাসছে যেন সে এখন। প্রবল সংকট জনক মুহুর্ত তার জন্য এটা।

নানা দোটানার মধ্য দিয়ে অহমি যখন মনস্থির করল তুষারের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার ঠিক তখনই সহসা তার কোমল, তুলতুলে হাতটি কেউ প্রবল শক্তি প্রয়োগে চেপে ধরল। কোনো প্রকার দিরুক্তি বিহীন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল তাকে। অহমি টালমাটাল পায়ে এক পল চাইল ব্যক্তিটির দিকে। ততক্ষণাৎ তার সকল জ্বালা যন্ত্রণা ফুরিয়ে এলো। মনের কোণে তীব্র শান্তি অনুভব হতে লাগল। মনে মনে হয়তো এই মুহুর্তটার অপেক্ষাতেই সে ছিল।

পুরো ক্যাম্পাসের সামনে ধ্রুব অহমিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তার চোখে মুখে উপচে পড়ছে তীব্র ক্রোধের আভাস। যার কিছুটা গিয়ে পড়ছে অহমির ওপর। তুষার রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাড়িয়ে আছে। ছেলেটা বেশ ত্যাড়া। আদরে বাঁদর প্রায়। সহজে হার মেনে নেবে না। এদিকে পুরো কলেজের স্টুডেন্টরা হা করে তাকিয়ে আছে এই দৃশ্যে। কারো চরম অপমান, কারো চরম ক্রোধ আর কারো বা চরম অস্বস্তি সবকিছু বেশ মজা নিয়ে উপভোগ করছে তারা। ধ্রুবকে নিয়ে রীতিমতো কথা উঠে গেছে সকলের মধ্যে। ধ্রুব চৌধুরীকে চেনে না এমন মানুষ খুলনা শহরে বিরল। কিন্তু সেই ধ্রুব’র সঙ্গে অহমির কী সম্পর্ক এটাই অজানা সকলের। সেই সঙ্গে আলোচনার বিষয়।
#নিঃশ্বাসে_তুই |১৫|

ধ্রুব’র ঘরের বিছানায় ঘাপটি মেরে বসে আছে অহমি। ধ্রুব তাকে এখানে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে। সারা রাস্তা অহমির সঙ্গে একটি কথাও সে বলেনি। অহমি বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করে গেছে কিন্তু ধ্রুব ইশারায় প্রতিবারই তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। আর এখন
কোথায় যে গেছে তার কোনো নামগন্ধ নেই। মনে মনে তীব্র আশঙ্কায় ভুগছে অহমি। কী যে চলছে ধ্রুব’র মনে কে জানে।

পেরিয়ে যায় বেশ কিছু সময়। অহমি বসে থাকতে থাকতে বোরিং হয়ে উঠছে। ব্যাগের মধ্যে ফোনটা রয়ে গেছে। সেই ব্যাগ আবার ধ্রুব’র গাড়িতে। গাড়ি থেকে বের হয়ে ধ্রুব ব্যাগটা আনার মতো সময় অব্দি তাকে দেয় নি। তার আগেই হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এসেছে। সেই দরুন এখন একা একা বসে থেকে বোর হতে হচ্ছে।

.

হালকা – পাতলা সেজেগুজে একদম পারফেক্ট লুকে তৈরি হয়ে নিল পুষ্প। শত হোক হবু জিজুর সঙ্গে আলাপ করতে যাচ্ছে বলে কথা। একটু তো সাজ দিতেই হয়। প্রমিও মোটামুটি তৈরি। প্রমি বেশ লজ্জা পাচ্ছে তা তার মুখশ্রীতে স্পষ্ট। পুষ্প সেদিকে লক্ষ্য রেখে বলল,

“এখনি এতো লজ্জা পেলে চলবে কনে বউ। সব লজ্জা ফুরিয়ে গেলে জিজুর সামনে কীভাবে লজ্জা পাবে শুনি?”

প্রমি যেন দ্বিগুণ লজ্জা পেল। আড়ষ্ট কন্ঠে রিনরিনিয়ে বলল,

“মা’র’ব এক ফা’জি’ল মেয়ে।”

পুষ্প শব্দ করে হেসে উঠল। প্রমি আর দাড়াল না এক প্রকার ছুটে বেড়িয়ে গেল। পুষ্প পার্সে মোবাইল ঢুকাতে ঢুকাতে সেও বেড়ল। দু বোনকে একত্রে বেড়তে দেখে মনে মনে ফুঁসে উঠলেন সাবিনা বেগম। ওদের রাস্তা রোধ করে কড়া গলায় বললেন,

“দুজনে কোথায় যাচ্ছ? পুষ্প তোমাকে না বলেছি বাড়ি থেকে বেশি বেড়তে না। তবু কেন বারেবার অমান্য কর আমার কথা?”

পুষ্পর মন খারাপ হয়ে গেল। নত মস্তকে জবাব দিল,

“সরি। আর হবে না।”

প্রমি বিরক্ত হলো। মায়ের এমন আচরণ তার বরাবরই অপছন্দ। তার ওপর তার মা কঠোর বলতে তা কেবল পুষ্পর ওপর। ওইটুকুনি একটা মেয়ে তার সঙ্গে এমন না করলেই কী নয়? প্রমি বিরক্তিমাখা শ্বাস ফেলল। মুখ দিয়ে ‘চ’ এর ন্যায় শব্দচারণ করে বলল,

“তুমি কবে শোধরাবে একটু বলবে প্লিজ। তোমার জন্য বছরের মাথায় বাড়িতে এসেও দু দন্ড শান্তি মেলে না। বাই দি ওয়ে, এমনি সময় যেমনই হোক আমি বাড়িতে থাকলে আমার বোন সর্বদা আমার সঙ্গেই থাকবে। তুমি বাঁধ সাধতে আসবে না একদম।”

“চলে আয় পুষ্প।”

প্রমি পুষ্পর হাত ধরে টেনে নিয়ে বেড়িয়ে যায়। পুষ্প ইতস্তত করছিল যা দেখে চরম ভাবে চোখ রাঙানি দেয় প্রমি৷ সাবিনা বেগম রীতিমতো ফুঁসছেন। ক্রোধে তার সর্ব মুখশ্রীতে ছড়িয়ে পড়েছে লাল আভা। ক্রোধের তাড়নায় হাতের কাছে থাকা কাঁচের গ্লাসটা স্ব জোরে আছড়ে ফেললেন ফ্লোরে। মুহুর্তেই ঝনঝন শব্দের সঙ্গে তা হয়ে গেল কয়েক টুকরো। দাঁতে দাঁত চেপে চিৎকার করে উঠে বললেন,

“ওই কা’ল’না’গি’নীর জন্য আমি আমার স্বামী, সন্তান থেকে দূরে। স’র্ব’না’শী আমার জীবনটা অ’ভি’শ’প্ত করে তুলেছে। তোকে তো আমি দেখে নিব। আমার মেয়েটা হয়েছে তেমন আপন পর চিনছে না। যখন ওই কা’ল’না’গি’নী পেছন থেকে ছো’ব’ল বসাবে তখন বুঝবি।”

সাবিনা বেগমের কোনো কথাই ওদের কানে যায় নি। ওরা তো তার আগেই বহুদূরে চলে গেছে।

.

স্বল্প সংখ্যক মানুষের সম্মুখে বধূ রুপে মাথায় ঘোমটা টেনে বসে আছে অহমি। চোখে মুখে তার উপচে পড়া আতঙ্ক। এমন বিভ্রান্ত মূলক পরিস্থিতিতে এসে চরম অস্বস্তি উপলব্ধি করছে সে। আজ দিনটাই যেন তার জন্য চরম অ’ভি’শ’প্ত। ক্ষণে ক্ষণে দমকা হাওয়ার বেগে বি’প’দ এসে জেঁকে ধরছে। এই তো একটু আগেই কয়েকজন পার্লার কর্মী এসে তাকে জোর জবরদস্তি বধূ রুপে সজ্জিত করে ড্রয়িং রুমে ধরে এনেছে। এখানে এসে সে পর্যবেক্ষণ করল তার ঠিক ডান সাইডের সোফায় বর বেশে বসে আছে ধ্রুব। ধ্রুবর সম্মুখে কাজী। ধ্রুবর আশেপাশ দিয়ে ঘিরে আছে তার বন্ধু মহল। অহমি এদের মধ্যে থেকে অনেককেই চিনল কারণ এরা প্রায়জন’ই অর্পারও ফ্রেন্ড। কী হচ্ছে না হচ্ছে কিছুটা আঁচ করতে পারছে অহমি। আর সেই সঙ্গে কমে আসছে তার শক্তিসামর্থ্য। ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে আসছে মস্তিষ্ক।

উপস্থিত সকলেই অহমির সঙ্গে কথা বলতে চাইছে কিছু ধ্রুব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে সব কথা পড়ে। অগত্যা সকলে মুখ ভার করে দাড়িয়ে রইল। এমন গম্ভীর লোকের বিয়েতে এমনটা তো হওয়ারই ছিল। এরই মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে সেখানে উপস্থিত হয় অর্পা। ধপ করে সোফায় বসে লম্বা শ্বাস টানে সে। তারপর ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“মাকে বুঝিয়ে আসতে একটু লেট হয়ে গেল সরি রে।”

অতঃপর সে উঠে চলে গেল অহমির কাছে। পরম স্নেহে বোনের চিবুকে হাত রাখল। আলতো করে উঁচু করে ধরে মন ভরে দেখল সেই মায়াবী বদনখানি। মৃদু কন্ঠে আওড়াল,মাশাল্লাহ। অতঃপর অহমিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদুরে গলায় বলল,

“ভ’য় পাস না একদম আপি আছি তো। যা হচ্ছে হতে দে। মনে রাখবি এতে তোর ভালো বৈ খারাপ হবে না।”

অহমি অর্পার বুকে লেপ্টে পড়ল। এতক্ষণের দমবন্ধ পরিস্থিতি পেছনে ফেলে বোনকে জড়িয়ে কেঁদে দিল। কেন কাঁদছে তার জানা নেই। শুধু এতটুকু জানে, তাকে এখন কাঁদতে হবেই। না কাঁদলে মন হালকা হবে না।

বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায় খুব সুষ্ঠু ভাবে। অর্পা বাড়িতে বলেছে অহমিকে নিয়ে সে আজ তার কোনো এক বন্ধুর বাড়িতে থাকবে। রাতে বাড়ি ফিরবে না। যেহুতু অর্পা বলেছে তাহমিনা বেগমও নিশ্চিন্তে তা মেনে নিয়েছে। অর্পার দ্বায়িত্ব বোধ প্রখর। জান থাকতে অহমির কিছু হতে দেবে না। কিন্তু সে এটা জানে না তার এই দ্বায়িত্ব পরায়ণ মেয়েটিই আজ তার জীবনের সবথেকে বড় দ্বায়িত্বটি পালন করেছে তারই অগোচরে।

.

রেস্টুরেন্টের দোতলায় মুখোমুখি বসে আছে তিনটি মুখ। একে অপরকে বেশ নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত। সকলের মধ্যেই নিরবতা। নিরবতা ভেঙে পুষ্পই প্রথমে মুখ খুলল। তার মনটা খচখচ করছে। খচখচানি কমাতে তাকে যে মুখ খুলতেই হতো।

“আরেহ বিভোর ভাই যে। আপনি এখানে? কোনো কাজে এসেছিলেন বুঝি? ”

পুষ্প লক্ষ্য করল তার গলা কাঁপছে। অজানা ভয় ধীরে ধীরে বশে নিয়ে নিচ্ছে তাকে। পুষ্পর এহেন প্রশ্নে বিভোর বিব্রতবোধ করল। সেই সঙ্গে উত্তর খুঁজতে লাগল। তখনই প্রমি বলে উঠল,

“আরেহ পুষ্প কী বলছিস? ওকে তো আমিই ডেকেছি।”

পুষ্প ভড়কাল। অবাকান্বিত নয়নে চেয়ে বলল,

“তুমি ডেকেছ মানে?”

প্রমি একটু লজ্জা পেল বোধহয়। তবে তেমন প্রশয় দিল না। সোজাসাপ্টা বলে দিল,”ও-ই তো তোর জিজু। আই মিন ফিউচার জিজু।”

পুষ্পর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। মুহূর্তে কেমন যেন অসাড় হয়ে পড়তে লাগল তার শরীর। কথা বলার শক্তি লোপ পেতে চাইল। তবুও দূর্বল কন্ঠে সে বলল,

“তুমি মজা করছ তাই না আপু।”

প্রমি আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বলল, “মজা কেন করব?”

পুষ্প তার দূর্বল চাহনিতে অসহায়ত্ব মিশিয়ে দৃষ্টি দিল বিভোরের দৃষ্টিতে। বিভোর এ পর্যায়ে অস্বস্তিবোধ করল। প্রমি তাকে বলে নি পুষ্প তার সঙ্গে আসবে। আগে জানালে কখনোই সে আসত না। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে যেচে পড়ে আসার কোনো মানেই হয় না।

.

ফুলে সজ্জিত ঘরটিতে স্বযত্নে বসিয়ে দিয়ে গেল অর্পা অহমিকে। বড় বোনের আগে ছোট বোনের বিয়ে হয়ে গেল। এমন পরিস্থিতিতে সকলের মনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হিং’সা জাগে। কিন্তু অর্পা পুরোটাই ভিন্ন। সে নিজে হাতে গুছিয়ে দিচ্ছে বোনের সংসার। মনে তার কোনো হিং’সা বরং আছে তীব্র শান্তি। ছোট্ট বোনটার ভবিষ্যৎ সুখী জীবনের কথা স্মরণ করে তীব্র প্রশান্তি।

অর্পা চলে যেতেই অহমি শক্ত হয়ে বসে রইল। পুষ্পকে এখন তার ভীষণ মনে পড়ছে। দু জন দুজনের বিয়েতে কত মজা করবে ঠিক করে রেখেছিল। অথচ হলো টা কী? তার এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পুষ্প তার থেকে দূরে। জানতে অব্দি পারল না তার প্রাণ-প্রিয় বান্ধবীটির জীবনের কথা। দু বান্ধবীর জীবনে ঘটে গেল অকস্মাৎ কিছু ঘটনা। এক বান্ধবী তার বোনের হাত ধরে পা ভেড়াল সুখের রাজ্যে আরেকজন অজান্তেই প্রিয় বোনটির দ্বারা হলো চরম আ’হ’ত। দু বান্ধবীর জীবনের মোড় কোথাও গিয়ে ঠেকে এবার সেটাই দেখার।

.
চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here