নিভৃতে প্রিয়া পর্ব -০২

#নিভৃতে_প্রিয়া
#পর্ব_২
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা

কোলাহলে পূর্ণ ঘরে ওদের বলা অস্ফুটস্বরের বুলি কর্ণগোচর হয় না কারো।ওরাও নিজেদের সামাল দিয়ে নেয় দ্রুত।কিছু টুকটাক কথাবার্তার পরে পাত্রের বাবা আলতাব মাহমুদ বলেন,

“আমাদের পছন্দের চেয়েও ছেলে মেয়ের নিজেদের পছন্দটা অধিক জরুরী।সংসার জীবনে ওরাই পদার্পণ করতে চলেছে।তাই আমার মতে ওদের আলাদা কথা বলে নেওয়া দরকার।একে অপরের মতামত জানাটা ভীষণ জরুরী।”

স্বায় মেলায় শহিদুল ইসলামও।সবার পূর্ণ সম্মতিতে অধরার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় বর্নকে।পাত্র হিসেবে উপস্থিত ব্যক্তিটির নাম বর্ন মাহমুদ।মুগ্ধর ক্লোজ ফ্রেন্ড সে।মুগ্ধর সাথে অধরার প্রণয়ের সুত্র ধরেই পরিচয় ওদের।মুগ্ধ ও অধরার সম্পর্কে কোন কিছু নিয়ে মনোমালিন্য হলেই এগিয়ে আসতো বর্ন।তখন ওদের সম্পর্কের ঝামেলা মিটমাট করাই যেন তার মূখ্য কাজ হয়ে উঠত।মুগ্ধ যে বড্ড পাগলামি করতো বর্নের কাছে।কাছের বন্ধুর মন ভালো করতে এতোটুকু করাই যেত।কিন্তু দীর্ঘকালীন সময়ে ওদের মাঝে কোন ঝামেলা হয় নি।বর্নেরও প্রয়োজন পড়েনি।এখন এই বিচ্ছেদের সময়ে বর্নকে নিজের বিয়ের পাত্র রুপে দেখে অবাক হওয়াই যায়।
ঘরের মাঝে অতি পরিচিত দুটি প্রান নিরবতার পাহাড় জমিয়েছে।হটাৎ এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে বিব্রত তারা।বন্ধুর প্রেমিকাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ায় লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসছে বর্নের।সে কি জানত পাত্রী হিসেবে যাকে দেখতে যাচ্ছে সে তার বোনের নজরে দেখা কাছের বন্ধুটির প্রেয়সী?আড়ষ্ট হয়ে নিরবতা ভেঙে বর্নই আগে ওষ্ঠ ফাঁকা করে।

“আমি দূঃখিত অধরা।আমি বুঝতে পারিনি আপনার সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে।পাত্রী আপনি জানা থাকলে এ অধম এ বাড়ি পা রাখতো না।”

বর্নের বক্তব্যে নিজের ঘোর কাটার চেয়ে আরও বৃদ্ধি পায় কয়েকগুন।বর্নের শিক্ষাজীবনই অতিক্রম হয়নি এখনো।বেকার ছেলেকে এ সমাজে কোন পিতাই বা বিয়ে করাতে চায়।উপরন্তু অধরার জানা মতে একটা মেয়ের সাথে প্রনয়ের সম্পর্ক ছিলো তার।তাকে রেখে পাত্রী দেখা হচ্ছে কেন?তবে সেও কি মুগ্ধর সদৃশ্য?দুই ক্লোজ ফ্রেন্ড একরকম হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।মনে ঘৃনা জমে অধরার।তিক্ত কন্ঠ বের করে অধর গলিয়ে।

“তবে কি আপনাদের প্রেম ও প্রকৃত ছিলো না?”

নিজের বক্তব্যের পৃষ্ঠে ভিন্নতম এক প্রশ্ন শুনে আরও বিব্রত হয় বর্ন।নিচু করা মাথাটা তুলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অধরার দিকে।এমন প্রশ্নে দু চোখ ঘোলা হয়ে আসে তার।তার নিখুঁত প্রেম নিয়েও প্রশ্ন তোলাটা তীরের মতো ক্ষতবিক্ষত করে তাকে।তটস্থ কন্ঠে জবাব দেয়,

“উহু।আমাদের প্রেম প্রকৃত নয়।তবে ওর প্রতি আমার ভালোবাসাটা প্রকৃত ছিলো।”

তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় অধরা।এখন পুরো দুনিয়াটা অবিশ্বাস্য লাগে তার নিকট।একটু ত্যাড়া উত্তরে নিজের অবিশ্বাস্য ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলে সে,

“তো প্রকৃত ভালোবাসা ছেড়ে অন্য কাওকে বিয়ে করতে চলেছেন কেন?”

অধরার তাচ্ছিল্যের সুর অপমানের জোয়ার তোলে বর্নের হৃদয়ে।সবকিছু মেনে নিতে পারলেও এ প্রেম সংক্রান্ত উপহাস সে কখনোই মেনে নিতে পারে না।আজও ব্যতিক্রম হলো না।রাগ জমে গেলো অধরার উপর।নিজের ভুল স্বীকার করার পরেও তার পবিত্র অনুভূতি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় পাল্টা প্রশ্ন করে বর্ন।

“আপনিই বা মুগ্ধকে ছেড়ে বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কেন?”

বর্নের প্রশ্নে ভ্যাবলাকান্ত বনে যায় অধরা।সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় বর্নের পানে।অভিজ্ঞ দৃষ্টি বলে দেয় কোন রকম কপটতা নেই বর্নের মাঝে।তবে কি সে কিছুই জানে না?নিজের সন্দেহের সত্যতা যাচাই করতে প্রতিউত্তরে উদাস হয়ে বলে,

“যেখানে আমার বিন্দুমাত্র মূল্য নেই সেখানে আর কীসের অপেক্ষায় বসে রইব?”

আশ্চর্য হয়ে যায় বর্ন।প্রতিউত্তরে বিষ্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“এসব কি বলছেন আপনি?আপনাদের মাঝে আবারও ঝামেলা হয়েছে?”

“ঝামেলা নয় বিচ্ছেদ হয়েছে।”

আনমনে বলে অধরা।বিচলিত হয়ে ওঠে বর্ন।

“বলেন কি এসব।ইশ দীর্ঘদিন সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখায় এতো কিছু হয়ে গেছে জানতেও পারিনি।কি নিয়ে এমনটা হয়েছে বলুন আমাকে।আমি মুগ্ধকে মেনেজ করে দিব।”

বর্নের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট হয় সে সত্যি কিছু জানে না।সাথে সাথে অমত প্রকাশ করে বলে,

“তার আর দরকার নেই।মুগ্ধ এখন এঙ্গেজড।জব পেলে বিয়েটাও করে ফেলবে।”

এমন কিছু শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না বর্ন।বিষ্ময়ের চড়ম পর্যায়ে পৌঁছে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রয় সে।মুগ্ধর এহেন কান্ডে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে বর্ন।বিষ্মিত হয় অধরা।তার প্রেমিক তাকে ঠকিয়েও বিন্দুমাত্র সংকোচ করেনি।অথচ তার বন্ধু হয়েও লজ্জা পাচ্ছে এতে।সম্মানবোধ জাগ্রত হয় বর্নের প্রতি।তার বলা কথাটা মাথার ভিতরে চক্কর মারে অধরার।তাকে স্বাভাবিক করতে করে,

“মুগ্ধ তো ওর পরিবারের চাপে এঙ্গেজমেন্ট করেছে।এতে ওর দোষ নেই।আমিও মেনে নিয়েছি।পরিবারের উপরে তো কিছু করার নেই তাই না?তবে আপনার প্রেমিকাকে তো আপনার পরিবার মেনেই নিয়েছিলো।তবে এখন অন্যত্র বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?আর দীর্ঘদিন সববার সাথে বিচ্ছিন্নই বা রয়েছেন কেন?”

অধরার প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল বর্ন।প্রতিউত্তরে ম্লান হেসে বলে,

“সব তো গোছানোই ছিলো।আমার পরিবার,আমার মন,আমার সংসার সাজানোর স্বপ্ন।কিন্তু যাকে নিয়ে স্বপ্নের পাহাড় জমিয়েছিলাম সেই ব্যক্তিটি সঠিক ছিলো না।”

“মানে!”

“প্রতারণার স্বীকার হয়েছি আমি।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রনয় গড়ে ওঠায় ওর প্রকৃত জীবন জানা সম্ভবপর ছিলো না আমার পক্ষে।ও বিবাহিত মেয়ে।হাসবেন্ডের ব্যস্ততায় সময় কাটাতে আমাকে মিথ্যা ভালোবাসার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো মাত্র।পরে সবটা স্বীকার করে ওর সংসার নষ্ট না করার অনুরোধ করে।আমার ভালোবাসা তো মিথ্যা ছিলো না।তাই ওর সুখটা নষ্ট করতে পারিনি।এদিকে জীবনটা নষ্ট হয়ে যায় আমার।পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি ছয় মাস হবে।আমার ভবঘুরে আচরনে অতিষ্ঠ হয়ে বিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত নেয় আব্বু।হয়তো তাতেও যদি এ কষ্ট থেকে একটু নিস্তার মেলে।কিন্তু আদোও কি এ কষ্ট ভোলা সম্ভব!শুধু শুধু অন্য আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট হবে।কিন্তু আব্বু আম্মুকে মানানো দ্বায়।তাই একের পর এক পাত্রী দেখছি আর একটা না একটা বাহানা দিয়ে রিজেক্ট করছি।”

ম্লান হাসে বর্ন।অধরাও সে হাসিতে তাল মেলায়।তার আর বর্নের জীবনের পাতা একত্র হয়ে গিয়েছে।একইভাবে অধরাও এ যাবত চারটা বিয়ে ভেঙেছে।কিন্তু ক্ষান্ত হচ্ছেন না শহিদুল ইসলাম।দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে সংসার তার।বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগে।ছেলেটা ক্লাস নাইনে পড়ে।ছোট মেয়ে অধরার কষ্ট তাকে কিছুতেই স্থির হতে দিচ্ছে না।দুজনের সমস্যাই যখন একই তখন সমাধানটাও তাদের নিকটেই রয়েছে।তারা সিদ্ধান্ত নেয় একে অপরকে পছন্দ হয়েছে কিন্তু সঠিভাবে বুঝতে কিছুটা সময় প্রয়োজন এটা বাড়িতে জানানোর।সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এটাই জানানো হয়।এতো গুলো বিয়ে ভেঙে একজনের কাছে স্থির হওয়ায় উভয়পক্ষের অভিভাবকও মেনে নেয় সিদ্ধান্তটা।তাদের তিন মাস সময় দেওয়া হয় একে অপরের মন মানসিকতা বুঝতে।এই তিনটা মাস অন্তত শান্তিতে কাটবে ভেবে বিস্তর হাসে দুজন।

বাড়ি ফিরে দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা নিজের স্মার্টফোনটা চালু করে বর্ন।প্রেমের বিচ্ছেদে সবার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রাখতে এই ফোনটিও বন্ধ রেখেছিলো সে।প্রায় ছয় মাস পর নিজস্ব ফেসবুক একাউন্টও একটিভেট করে।হাজারো নোটিফিকেশনে ভরে যায় তার ফেসবুক ওয়াল।এতো এতো নোটিফিকেশনের ভিরে মুগ্ধর এঙ্গেজমেন্টের স্ট্যাটাসটা চোখ এড়ায় না।ফোন দেয় সে মুগ্ধকে।অধরা আর তাদের সম্পর্কে শেষ বারের জন্য একত্র করার ব্যর্থ প্রয়াস চালায়।পরিবারকে মানানো খুব কঠিন কিছু নয়।আর শুধু এঙ্গেজমেন্টই হয়েছে বিয়ে তো আর হয় নি।কিন্তু মুগ্ধর মাঝে অধরাকে নিয়ে কোন অনুভুতি খুঁজে পায় না বর্ন।মেজাজ বিগড়ে যায় তার।যদি একটা মেয়েকে নিয়ে সিরিয়াস নাই হবি তবে মিথ্যা আশ্বাস দিস কেন?এমন কথার প্রেক্ষিত দীর্ঘদিন পরের কথোপকথনে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়ে যায়।এক পর্যায়ে একে অপরের প্রতি বিতৃষ্ণায় লাইন কেটে দে।অধরার জনয় আফসোস করে বর্ন।মেয়েটা এখনো কত ভালোবাসে মুগ্ধকে।অথচ মুগ্ধ কি না তাকে নিয়ে একটুও ভাবে না।ভার্সিটির গন্ডিতে পা দিয়ে মুগ্ধ ও এখন নিজের লেভেল যাচাই করে।এমন মানুষ কি না তার কাছের বন্ধু ভেবে অনুশোচনা হয় বর্নের।
_________
ধীরে ধীরে সময় গড়াতে থাকে।অধরা ও বর্ন উভয়ের মনের অবস্থা একই থাকায় সখ্যতা গড়ে ওঠে খুব দ্রুত।একে অপরের সান্নিধ্য তাদের মনের মেঘ ধীরে ধীরে কনিয়ে ফেলেছে।এই খারাপ সময়টায় মন মতো একটা বন্ধু যে ম্যাজিকের মত ক্ষত সাড়ায় তা উপলব্ধি করে দুজনেই।জেন্ডার,বয়সের বয়বধান বন্ধুত্বের বাঁধা হতে পারে না এটাও বুঝে যায়।এইযে দুই বছর ব্যবধানের বিপরীত লিঙ্গের দুটি মানুষ কত সহজেই বন্ধুত্বের অটুট বন্ধনে পা দিয়েছে।অধরাও এই বন্ধুত্বের বলে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে।বর্নের অবস্থাটাও একই।ইন্টার কমপ্লিট করে পলিটেকনিক এ ভর্তি হয়েছিলো বর্ন।কিন্তু প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে প্রথম বছরেই পড়ার ইতি টানে।এই বছর সহজ একটা বিষয় নিয়ে ন্যাশনালে ভর্তি হয় বর্ন।পড়াশোনায় আগে থেকেই অতোটা মনোযোগী নয় সে।বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় তারাও চাপ দেয় না এসবে।অপরদিকে সামনে এইচ এস সি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মশগুল অধরা।এর মাঝেও নিয়ম করে বর্নের সাথে আলাপচারিতা চলে তার।সময় পেলেই একটু ঘোরাঘুরিও করে দুজনে।উড়ন্ত বিহঙ্গের মতো অনাবিল আনন্দে ভাসে আবারও।বর্নের ফুরফুরে জীবন বন্ধু মহলে গুঞ্জন তোলে অধরার সাথে নয়া প্রেমে জড়িয়েছে সে।যা মুগ্ধের কান অবধি পৌঁছে যায়।হটাৎ অপ্রত্যাশিত এমন খবরে দ্বিকবিদিক শূন্য হয় মুগ্ধ।কেন যেন প্রথম বার অধরার প্রত্যাখানের মতো অনুভুতি জেঁকে ধরে তাকে।নিজেকে অনেক চেষ্টা করেও নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে না।আহিয়ার সাথে ঝামেলা শুরু হয়ে যায় অকারণে।তবে কি সে মনের কোন কোঠায় অধরাকেই চেয়েছিলো?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here