নিভৃতে প্রিয়া পর্ব -০৩

#নিভৃতে_প্রিয়া
#পর্ব_৩
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা
_______
“তোমাকে আমার এক ফ্রেন্ড পছন্দ করে অধরা।”

ধাতস্থ কন্ঠে বিড়বিড় করে কথাটি বলে মুগ্ধ।মুগ্ধের এহেন বক্তব্যে হাসির ঝংকার তোলে অধরা।যেন কোন মজার কৌতুক শুনেছে।তার মতো এমন উগ্রতা সম্পন্ন মেয়েকে কেই বা পছন্দ করবে।এটা তো মজার কথাই।কোনমতো হাসি চেপে মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করে,

“কে সেই আল্লাহর বান্দা?”

অধরার এমন প্রতিক্রিয়ায় ভড়কে যায় মুগ্ধ।তটস্থ কন্ঠে বলে,

“তুমি চিনবে না।”

“নাম না বললে ভালো হবে না।আমাকে আপনি ভালো করেই চিনেন।”

কপট রাগ দেখায় অধরা।অধরার রাগ সম্পর্কে মুগ্ধও অবগত।মেয়েটা প্রচুর জেদী স্বভাবের হওয়ায় নিজে টিচার হয়েও কিঞ্চিৎ পরিমান ভয় পায় অধরারকে।ভয়ে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা জমে তার কপালজুড়ে।প্রতিউত্তরে ইতস্তত করে বলে,

“কাল জানতে পারবে।কথা দিচ্ছি।এখন পড়।”

অধরাও মুগ্ধের অভ্যন্তরীন অবস্থা বুঝতে পেরে আর বাড়ায় না বিষয়টা।তবে ঠিক তার পরেরদিনই তাকে পছন্দকরা ব্যক্তিটির নাম জানতে পারে।প্রখর বৃষ্টির মাঝে রোদ ও অধরা কাকভেজা হয়ে পুরো এলাকা মাতিয়ে যখন বাসায় ফিরতে উদ্যত হচ্ছিল।ঠিক তখন রোদ পলিথিনে মোড়ানো একটা চিরকুট গুজে দেয় তার হাতে।রোদ অধরার বেষ্ট ফ্রেন্ড।আবার মুগ্ধর ভাতিজি হয় সম্পর্কে।রোদ চিরকুটটা হাতে দিয়ে স্মিত হেসে বলে,

“মুগ্ধ কাক্কু দিয়েছে তোকে।”

বিষ্মিত হয় অধরা।

“কি লেখা আছে এতে?”

“এ অধম বান্দি জানবে কেমন?অনুমতি দে পড়ে দেখি কি লেখা আছে।”

কথাটি বলে ভিলেন মার্কা এক হাসি দেয় রোদ।অধরার আগ্রহ দ্বিগুণ গতিতে বৃদ্ধি পায়।বৃষ্টির মাঝেই মেলে ধরে চিরকুটটি।গোটা গোটা হরফে স্পষ্ট লেখা-

প্রিয় তুমি,

জানবেও না কখনো আমার ঠিক কতটা অপ্রিয় ছিলে তুমি।পড়াতে গিয়ে ঘন্টা খানেক বসে থাকার পর যখন ঘুম জড়ানো ঢুলু ঢুলু পায়ে পড়তে আসতে চড়ম বিরক্ত হতাম আমি।কিন্তু তোমার আড়মোড়া ভাবটাই যে কবে প্রিয় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বুঝতে পারিনি।প্রিয় অভ্যাস প্রিয় আসক্তিতে পরিণত হয়ে ফাঁসিয়ে দিয়েছে আমাকে।যেই ধাঁধায় পড়ে শিক্ষক হয়ে ছাত্রীকে প্রেম প্রস্তাবের মতো অন্যায় করছি।এই অন্যায়ের প্রশ্রয় দেবে কি?

তোমার আমি

লেখাটা মুগ্ধর বুঝতে কষ্ট হয় না অধরার।অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে বিরক্তিতে বিষিয়ে ওঠে সে।মুগ্ধ তার হোম টিউটর।বাড়ি ফিরে শহিদুল ইসলামকে স্পষ্ট করে জানায় সে আর পড়বে না।এভাবেই নিরব প্রত্যাখানে ভূলুণ্ঠিত করে মুগ্ধকে।

উপরক্ত ঘটনাটি কয়েক বছর পূর্বের।অধরাকে প্রথম প্রস্তাব দেয়ার গল্প ছিলো এটা।তাদের প্রনয়টা এর দুই বছর পরে হয়।প্রস্থম প্রস্তাবেই অধরার সচতুর প্রত্যাখানে তখন ভীষণ কষ্ট পায় মুগ্ধ।কয়েকবছর আগে পাওয়া সেই সমতুল্য কষ্টটিই আজকেও পাচ্ছে সে।প্রথম বার পাওয়া কষ্টে নিজেকে গুছিয়ে নিলেও আজ ঢকঢক করে মদ্যপান করে মুগ্ধ।চোখমুখ লাল হয়ে আছে তার।অধরার উপর রাগ জমে গেছে।নিজেকে সংযত করতে না পেরে কানে তুলে নেয় নিজের মুঠোফোন।অধরার নাম্বারটিতে বার দুয়েক রিং হওয়ার পরই রেসপন্স পায় সে।অধরা কল রিসিভ করে কিছু বলার আগেই তিক্ত কন্ঠে মুগ্ধ বলে,

“ফাইনালি বর্নর মতো একটা মাথামোটা ছেলের সাথে প্রেমে জড়ালি তুই।আমি ভাবতেও পারছি না এতোটা লো ক্লাসের কখনো হবি তুই।”

মুগ্ধর কন্ঠ শুনে গা রি রি করে অধরার।আরও মেজাজ বিগড়ে যায় মুগ্ধর উচ্চারিত বুলি শুনে।প্রতিবাদ করে সে,

“সবাইকে নিজের মতো ছ্যাচড়া চরিত্রের ভাববেন না।যে ক্ষনে ক্ষনে বিভিন্ন ব্যক্তির প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে প্রেম করে বেড়াবো।আর বর্ন ভাইয়াকে লো ক্লাসের বলছেন আপনি?আপনার চেয়ে টেন টাইম বেটার সে।”

তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় মুগ্ধ।

“আমি আর বর্ন প্রাইমারিতে একই ব্যাচ এর ছিলাম।আমি এখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স ফাইনাল ইয়ার এ পড়ছি।অথচ বর্ন ফেল করে করে সবে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল।কোন দিক দিয়ে সে আমার চেয়ে বেটার?”

“মন মানসিকতার দিক দিয়ে।সে আপনার মতো ব্রিলিয়ান্ট না হলেও শুভ্র মনের অধিকারী।যে কিনা কোন মেয়ের কাছে প্রতারিত হয়েও তাকে এক আকাশ ভালোবাসতে পারে।আর আপনি এতোই নিচু মনের যে তার সাথে আমাকে জুড়ে দিয়ে বাজে মন্তব্য করে বসলেন?”

অধরার উত্তরে কিছুটা স্বস্তি মেলে মুগ্ধর।সে নিশ্চিত হয় বর্ন আর অধরাকে নিয়ে শুরু হওয়া গুঞ্জন মিথ্যা।নিজের ভুল স্বীকার করে নরম স্বরে বলে,

“আ’ম সরি অধো।আমাকে ক্ষমা কর প্লিজ।আসলে তোমার পাশে ওকে আমি মেনে নিতে পারি নি।তাই এমন বলেছি।আমি এখনো তোমাকে চাই।চলো নতুন করে আবার সব শুরু করি!”

“কেন আহিয়া আপুর প্রতি ইন্টারেস্ট নষ্ট হয়ে গেছে?নাকি আপনার বাবা মার তাকেও অপছন্দনীয় লাগছে এখন?”

“আহিয়ার প্রতি কোন কালেই আমার ইন্টারেস্ট ছিলো না।নষ্ট হবে কি?”

“তাহলে এতোদিন শুধু শুধু প্রেম করলেন?”

“তুমি ছাড়া আমি কারো সাথে প্রনয় গড়িনি।তাই এসব ফালতু কথা বলবে না।”

“ফালতু কথা আমি না আপনি বলছেন স্যার।ইন্টারেস্ট না থাকলে এঙ্গেজমেন্ট হত না আপনাদের।”

“এঙ্গেজমেন্ট আসল কোথা থেকে!আর দয়া করে স্যার,আপনি এসব সম্বোধন বন্ধ কর।তোমার সাথে আমার যে সম্পর্ক তাতে ওসব শব্দ যায় না।”

“আপনার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। কিসব আবোল তাবোল বলছেন।নেশা করছেন নাকি?”

“হ্যাঁ করেছি।তুমি আমার কাছে ফিরে না আসলে আমি আরও নেশা করব।”

“আপনার যা ইচ্ছা করেন।”

কথা শেষ হওয়ার আগেই খট করে লাইন কেটে দেয় অধরা।একটা মাতাল মানুষের উল্টাপাল্টা কথা শোনার চেয়ে নিসঃঙ্গ থাকা ভালো।আহত হয় মুগ্ধ।অনেক আশা নিয়ে অধরাকে কল দিয়েছিল সে।কিন্তু তাতে কোন লাভই হল না।তবে হাল ছাড়ার পাত্র মুগ্ধও নয়।ফোনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে সে আপন মনে বলে,

“তোমাকে আমার কাছে ফিরতেই হবে অধো।আমি তোমাকে অন্য কারো হতে দিব না।তোমাকে হারানোর যন্ত্রনা আমি সহ্য করতে পারছি না।যেভাবেই হোক তুমি আমারই হবে।এটা মুগ্ধর প্রতিজ্ঞা মনে রেখো।”

__________
কেটে গেছে কয়েকমাস।অধরার এইচ এস সি পরীক্ষা পূর্ণ রুপে শেষ হয়েছে গতকাল।এখন বেশ ফুরফুরে মুডে আছে।এডমিশন প্যারা শুরু করার আগে দুই তিন দিন একটু মাস্তি করে কাটাতে চায়।বর্ন ও অধরার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা আরও গভীর হয়েছে ধীরে ধীরে।অধরার প্রতি আপনি সম্বোধনটা এখন তুমিতে রুপান্তরিত হয়েছে।একে অপরের মানসিকতায় প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে তাদের।যে কারনে আলাপচারিতা জমেও উঠছে সবসময়।মুগ্ধর শূন্যতাটা বর্ন পুষিয়ে দিয়েছে অধরার ক্ষেত্রে।আবার বর্নও অধরার সান্নিধ্যে তার প্রাক্তনের শূন্যতা অনুভব করে না।অধরার হাত ধরে এই কয়েক মাসে প্রচুর বই পড়ার অভ্যেস হয়েছে বর্নের।অধরার প্রিয় হুমায়ুন আহমেদ এর হিমু সমগ্র বইটা গিফট করেছে বর্নকে।সেটা পড়ে হিমু চরিত্রে প্রচুর মুগ্ধ হয়েছে বর্ন।সে এখন হিমুর ন্যায় মহাপুরুষ হতে চায়।জীবনে প্রেম নামক একটা অধ্যায় থাকায় আফসোস করে সে।প্রায় প্রতিদিনই অধরার সাথে আলোচনার সময় অনুশোচনা প্রকাশ করে।আজও কথার ফাঁকে একবার বলে,

“জানো অধরা হিমু সমগ্র বইটা আগে পড়লে তানজিলার সাথে কখনোই সম্পর্কে জড়াতাম না।এসব প্রেমের মাঝে কিছু নেই।শুধু শুধু কষ্ট পেয়েছি তখন।এরচেয়ে হিমুর মতো মহাপুরুষ হতে পারলে কতই না ভালো হত বল!ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারতাম।”

বর্নের এমন পাগলামি পূর্ণ কথা শুনে হাসে অধরা।রসিকতা করে বলে,

“তো সমস্যা কি!এখন হিমুর মতো জীবন গড়েন।ভবিষ্যৎ বানী দেয়া শুরু করেন।”

“এখন কি তাই হবে বল।হিমুর জীবনে প্রেমের ছোয়া ছিলো না।কিন্তু আমার জীবনে তো প্রেমের ছোঁয়া এসেছে।আমি ভবিষ্যৎ বানী দিলে তা সত্যি হবে না এখন।উপরন্তু পাবলিকের কাছে মাইর খেতে হবে।”

কথা শেষ করে স্বজোরে হেসে ওঠে বর্ন।তাল মেলায় অধরাও।অতপর ধাতস্থ হয়ে বলে,

“শুরু করেন ভবিষ্যৎ বানী।সত্যি হতেও তো পারে।না হয় শুরুতে আমার সাথে প্র্যাক্টিস করেন।যখন অভ্যস্ত হয়ে যাবেন তখন পাবলিকের সামনে বলবেন।মানুষ চাইলে পারে না এমন কিছুই নেই।চাইলে আপনিও হিমু ন্যায় হতে পারবেন।এখন আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলেন একটা কথা দেখি মেলে কি না।”

অধরার কথাগুলো শুনে ঐকান্তিক হয় বর্ন।কিছু সময় ভেবে বলে,

“আজ তোমার পুরাতন কোন বান্ধবী কল দিবে।”

কথাটা গাম্ভীর্য ভরে বললেও পরক্ষণেই হেসে ফেলে বর্ন।অধরাও হাসে।তারা দুজনেই নিশ্চিত এমন কিছুই হবে না।কথার ঝুড়ি আরও লম্বা করে তারা।আধা ঘন্টা পরেই আকষ্মিকভাবে অধরার ফোনে রিং আসে।তার পুরাতন বেষ্ট ফ্রেন্ড রোদ কল দিয়েছে।ইন্টারে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছে সে।আর অধরা স্থানীয় এক কলেজে।যার দরুন আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমে যায় তাদের।শেষ কবে কথা হয়েছে অধরার মনে নেই।অবাক হয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বর্নকে বলে,

“আপনি হয়তো সত্যি হিমু হয়ে যাচ্ছেন বর্ন ভাই!”

“কেন?কেউ কল দিয়েছে?”

“হুম রোদ কল দিয়েছে।”

“আচ্ছা কথা বল।”

লাইন কেটে দেয় বর্ন।রোদের কল একবার বেজে বন্ধ হয়ে গিয়ে আবার কল এসেছে।এবার আর বিলম্ব না করে রিসিভ করে অধরা।

“কি রে চাচি।চাচার সাথে শেষ পরীক্ষা উদযাপন এতো লম্বা সময় ধরে চলছে!ইশ আমারও এমন কেউ যদি থাকত!”

রসিকতা করে অধরাকে খোঁচায় রোদ।তার কথায় বোঝার উপায় নেই দীর্ঘদিন যোগাযোগ বন্ধ ছিলো তাদের।এজন্যই তো রোদ অধরার বেস্ট ফ্রেন্ড এর তালিকায় জায়গা পেয়েছে।

“চাচি ডাকার সম্পর্ক তো অন্য কারো সাথে গড়েছিস।আমাকে চাচি ডকছিস কেন?”

নিরানন্দ কন্ঠে প্রতিউত্তর করে অধরা।বিষ্মিত হয় রোদ।

“মানে কি!কার সাথে আবার সম্পর্ক গড়লাম!”

“বাদ দে।যা হওয়ার হয়ে গেছে।তোর অবস্থা বল।”

ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলে অধরা।তার আচরণে অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায় রোদ।

“কি হয়েছে বল তো।ঝগড়া হয়েছে তোদের?”

“যেখানে সম্পর্কই নেই সেখানে ঝগড়া হওয়া বিলাসিতা মাত্র।আর তোর চাচার এঙ্গেজমেন্টের পরেও সম্পর্ক থাকবে ভাবলি কি করে।”

“মুগ্ধ কাক্কুর তো এঙ্গেজমেন্ট হয় নি।এসব ভুয়া খবর কে দিলো তোকে?”

আশ্চর্য হয়ে যায় রোদ।অধরাও অবাক হয়।মুগ্ধর এঙ্গেজমেন্ট হলে রোদ তো অবশ্যই জানবে।তবে মুগ্ধর সেদিনের বলা কথা সত্যি ছিল!তার পরে কতবার মুগ্ধ তার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছে।কিন্তু পাত্তা দেয়নি অধরা।যদি রোদের কথা সত্যি হয় তবে আহিয়া তাকে মিথ্যা বলল কেন?আর মুগ্ধই বা আগে অভিনয় করল কেন?কিছুই মাথায় ঢুকছে না অধরার।এসবের মানে কি তাকে বপর করতেই হবে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here