নিভৃতে প্রিয়া পর্ব -০৪ ও শেষ

#নিভৃতে_প্রিয়া
#অন্তিম_পর্ব
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা
_______
নিষুপ্ত রজনী।কুজ্ঝটিকার তীব্রতায় অম্বরের পূর্ণ চন্দ্রিমা মনুষ্যকুলকে নিজের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে।কুয়াশার স্তর ভেদ করে ক্ষীণ রুপালি চকচকে আলো দুনিয়ার বুকে ঠিকরে পড়লেও হিম শীতল আবহাওয়ায় উষ্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন লেপ অধিক আকর্ষণীয়।লেপের উষ্ণ পরশেও ঘুমের রাজত্বে আধিপত্য বিস্তারে অক্ষম হচ্ছে অধরা।চিন্তার রেখায় ঘুম পালিয়েছে চিরতরে।তার সাথে চলমান ধাঁধার উত্তর না মিললে হয়তো প্রশান্তির দেখা মিলবেও না।কিছু সময় এপাশ ওপাশ করে অগত্যা হাতে মুঠোফোন তুলে নেয় অধরা।কালো তালিকা থেকে মুগ্ধর নাম্বারটা সড়িয়ে ডায়াল করে তাকে।বার দুয়েক রিং হওয়ার মাথায় রিসিভ করে মুগ্ধ।ঘুম জড়িয়ে আসা কন্ঠে আওয়াজ তোলে,

“কি এমন মহা প্রয়োজন যে রাত্রি শেষ প্রহরেও কল দিতে হল তাও আবার আমাকে?”

“কেন এমন করলে তুমি?”

দীর্ঘদিন পর অধরার কন্ঠে ঘনিষ্ঠ সম্বোধন তুমি ডাক শুনে কম্পিত হয় মুগ্ধ।শিরায় শিরায় আন্দোলন তোলে অতি প্রিয় এ তুমি ডাক।কিন্তু নিজের ভালোলাগার অনুভুতিকে আড়াল করে ভিন্ন প্রশ্ন তোলে,

“তুমি বলার সম্পর্ক কি এখনো বিদ্যমান আমাদের মাঝে?”

“আপনি তো তুমিই ডাকেন!”

“আমার তুমি ডাকা আর তোমার তুমি ডাকা কি এক হল?আমি তোমার সিনিয়র।উপরন্তু এককালীন শিক্ষক হই তোমার।”

“কেন এমন করছো বল?কি দোষ আমার?”

“তোমার কোন দোষ নেই অধো।সব দোষ আমার।আমিই আর তোমাকে চাই না।”

“তোমার কথার মাঝে ইদানীং আমি সত্যি মিথ্যার তফাৎ খুঁজে পাই না।একবার তুমিই ব্যাক করতে চাও আবার তুমিই ছুঁড়ে ফেলে দেও।হোয়াই মুগ্ধ?কেন এমন গেম খেলছো আমার সাথে?তুমি এঙ্গেজড না হয়েও মিথ্যা নাটক কেন করছো বল?”

আহত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে অধরা।প্রতিউত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মুগ্ধ।নিজের ভিতরের বয়ে যাওয়া মিশ্র অনুভূতির বেড়াজালে আটকা পড়তে চায় খুব করে।কিন্তু তা প্রকাশ্য করলে চলবে না।নিজেকে ধাতস্থ করে নেয় দ্রুত।কন্ঠে ঐকান্তিক ভাব ফুটিয়ে বলে,

“দেখো অধো সেদিন নেশার ঘোরে কি না কি উল্টাপাল্টা বলেছি তার জন্য আমি দুঃখিত।এই কথাটা জানাতে তোমাকে বার বার কল দিলেও রেসপন্স করোনি তুমি।এখন সেই কথার জের ধরেই যদি ফিরতে চাও আমার কাছে আমার কিছুই করার নেই।আমাদের মাঝের সম্পর্ক কোনভাবেই একত্র করা সম্ভব নয়।হ্যাঁ আমি এঙ্গেজড না হয়েও নাটক করেছি।তার একমাত্র কারন তোমাকে আমার জীবন থেকে চিরতরে সড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম।তাই প্ল্যান করে আহিয়ার সাথে ওভাবে পিকচার তুলে তোমাকে দিতে বলি।”

“আমাকে তো তুমিই প্রেমের জালে ফাসিয়েছিলে।শুরুতে রাজি ছিলাম না আমি।এতো কাঠ খড় পুড়িয়ে এক বছরে আশার আলো জালিয়ে ধুপ করে কেন নিভিয়ে দিচ্ছো এখন?”

“সব কিছু জানতে নেই অধরা।কিছু জিনিস অজানা থাকাই ভালো।”

“কারণটা না বললে তোমার কথা কিভাবে বিশ্বাস করি বল।নেশা করলে সত্যি বলা তোমার অভ্যেস এটা আমার চেয়ে কেই বা ভালো জানে মুগ্ধ!কি লুকাচ্ছো আমার কাছে?”

“দেখো অধো তখনের প্রেম আমার জন্য আবেগ ছিলে।বাস্তবতার করালগ্রাসে পড়ে গিয়েছি আমি।এখন আর কোন আবেগ আকৃষ্ট করে না আমাকে।সময়ের সাথে আমার পজিশন বা আমার ডিমান্ড আকাশ ছুঁই হয়ে যাচ্ছে।মানছি তুমি অনেক ব্রিলিয়ান্ট।ভার্সিটির গন্ডিতে তুমিও পা রাখবে।কিন্তু আমার চাহিদা মতো সুন্দর তুমি কখনোই হতে পারবে না।আয়নার সামনে দাঁড়ালে প্রত্যেকটা মানুষই নিজেকে সুন্দর দেখে।তবে প্রকৃত যাচাই করে দেখতে পারো কতটা উজ্জ্বললাবিহীন তুমি।উপরন্তু আব্বু আম্মুরও অপছন্দনীয় তুমি।হুটহাট রাগের পাহাড় জমানো মেয়েকে বিয়ে করে আমার জীবনটা নরক বানাতে চাই না।তাই এখনই আলাদা হয়ে গেলাম।দয়া করে আর বিরক্ত করো না।”

কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই কাশি ওঠে মুগ্ধর।কথপকথন অসম্পূর্ন রেখেই লাইন কেটে দেয় সে।মুগ্ধর গাম্ভীর্যপূর্ন কথাগুলো তীরের মতে লাগে অধরার বুকে।রোদের সাথে আলাপনের পর এক বুক আশা বেধেছিল সে।পুরোনো প্রেম আবার নতুন উপাখ্যানে জেগে উঠেছিলো তার মাঝে।আশাটা ক্ষীন হলেও কষ্টটা তীব্র অনুভুত হচ্ছে তার।মুগ্ধর কাছে শান্ত ব্রেনে এমন প্রত্যাখানে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় সে।সে নিজেও জানে সে হুটহাট রেগে যায়।আর রাগ উঠলে নিজেকে সংযত করতে পারে না।তাই বলে অগ্রহণযোগ্য সে?এই বাহ্যিক রাগ দেখলেও তার ভিতরের সুন্দর মনটা দেখলো না মুগ্ধ?প্রথম দিনে আহিয়ার পাশে মুগ্ধকে দেখেও এতোটা কষ্ট পায় নি সে।যতটা কষ্ট মুগ্ধর মুখে নিজের অপূর্ণতাগুলোর নিখুঁত বর্ননা শুনে পেল সে।আচ্ছা নিজের চেহারার উপর কি কারো হাত থাকে?যদি নিজের চেহারার উপর কারো হাত থাকত তবে নিজেকে সেরা সুন্দরী বানাতে ব্যস্ত হত সবাই।মুগ্ধর কথাগুলোর প্রতিউত্তর নিজে নিজেই করল সে।এতে কষ্টে ভাটা পড়ল কি না জানা নেই।তবে নির্ঘুম কেটে গেলো সারা রাত্রি।
_________
“আমাকে বিয়ে করবেন বর্ন ভাইয়া?”

অধরার মুখে হটাৎ এমন আবদার শুনে ভ্যবলাকান্ত বনে যায় বর্ন।অধরা ও তার মাঝের পবিত্র বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্কে কখনো এমন প্রস্তাব পাবে জানা ছিলো না তার।বিষ্মিত হয়ে ফোনের তারিখটা চেক করে বর্ন।জানুয়ারির বিশ তারিখ জ্বলজ্বল করছে।তটস্থ কন্ঠে উত্তরে বলে সে,

“আজ তো পহেলা এপ্রিল ও নয়।তবে এমন মজা করছো কেন?নিশ্চয়ই কারো সাথে ডেয়ার ধরেছো।কিন্তু তুমি তো জানো আমি মহাপুরুষ হওয়ার পথে।বিয়ে শাদীর ব্যাপারে নিশ্চিত প্রত্যাখান করব।ভুল ডেয়ার ধরে ফেলেছো।”

কথাটা বলে একটা প্রাপ্তির নিশ্বাস ফেলে বর্ন।অধরা তাকে ঠকাতে চেয়েছে কিন্তু নিজের বুদ্ধির জোরে ঠকলো না সে ব্যাপারটা প্রাপ্তিরই বটে।কিন্তু অধরার পরবর্তী কথাগুলো শুনে থমকে যায় সে।

“আমি সিরিয়াস বর্ন ভাইয়া।কোন মহা পুরুষ হয়ে না।অতি সাধারণ একজন পুরুষ হয়ে বিয়ে করবেন আমাকে?বিশ্বাস করেন আমার রাগ জেদ সব ধুলোয় মিশিয়ে দেব।একজন লক্ষি ঘরোনি হয়ে আপনার সংসার সামলাবো।আপনাকে সুখে করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আমি।নিজেকে একদম বদলে ফেলব।শুধু নিজের শ্যামবর্ন চামড়াটা বদলাতে পারব না।নিজের কুৎসিত চেহারা বদলে অপরুপা হতে পারব না।এই খুঁতটা মেনে নিতে পারবেন না আপনি?..”

কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বিলাপ করতে থাকে অধরা।মুগ্ধর প্রত্যাখান বেশ জ্বালিয়েছে তাকে।অসহায় বোধ হচ্ছিল তার।নিজের কাছের জায়গা হিসেবে বর্নের মুখটাই মাথায় ভাসে।আশ্রয়স্থল হবে সেবে বিভ্রান্ত হয়ে তাকেই চেয়ে বসে করুন সুরে।খারাপ সময় থেকে নিজেকে উতরে নেয়ার কান্ডারি প্রিয় ব্যক্তিটির সাথে চিরকাল কাটানোর লোভনীয় প্রস্তাব কোন পুরুষই বা ফেলতে পারে?ধাতস্থ কন্ঠে প্রতিউত্তরে বলে,

“যদি তুমি মন থেকেই চাও তবে তোমাকে প্রত্যাখানের দুঃসাহস এ অধমের নেই।”

“আমি চাই আজই বিয়ে হোক।”

“তবে তাই হবে।”

বর্ন ও অধরার পরিবারের এ বিয়েতে আগে থেকেই পূর্ণ সম্মতি ছিলো।কিন্তু বর্ন ও অধরার অসম্মতির জন্য বিলম্ব হচ্ছিল বিয়েতে।হটাৎ তাদের সম্মতি পাওয়ায় বিষ্মিত হয় শহিদুল ইসলাম।তার বয়সটা বেড়ে চলেছে।অধরাকে এমনিতেই বিয়ে দিতে ইচ্ছুক তিনি।তার উপর মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতেও নারাজ তিনি।তার অনুরোধে বর্নের পরিবারও আজই বিয়ে পড়াতে রাজি হয়ে যায়।হটাৎ বিয়ে হওয়ায় ধুমধাম আয়োজন করতে পারেন না কেউ।ঘরোয়া পদ্ধতিতেই বিয়ের কার্যাদি সমাপ্ত করে অধরা পা রাখে বর্নের বাড়ির চৌকাঠে।এখনো স্বপ্নের মতো লাগছে তার কাছে।তার এক কথায় যে বর্ন সত্যি সত্যি বিয়ে করবে তাকে ভাবে নি সে।মুগ্ধর দেওয়া কষ্টের ভীরেও একটা সুভ্র অনুভুতি খেলে যায় হৃদয়জুড়ে।কষ্টের অথৈ সাগর পাড়ি দিয়ে প্রাক্তনের স্মৃতি বাদে সব চিহ্ন মুছে দেয় নতুন প্রিয়জনকে কাছে টেনে নিয়ে।উভয়ের সুস্থ মস্তিষ্কের পূর্ন সম্মতিতে বিয়ে হলেও সম্পর্কের পূর্ণতা প্রাপ্তিতে ফেলে আসা মুগ্ধের স্মৃতি ভেসে ওঠে আবার।অধরার পাগল মন ভাবে মানুষটা মুগ্ধ ও হতে পারত।কিন্তু যা হবার নয় তা না ভেবে সময়টা উপভোগ করে সে।
_________
সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে প্রশান্তির দেখা খুজতে অনলাইনে আসে মুগ্ধ।সাথে সাথেই ছোট করে বেজে ওঠে তার নোটিফিকেশন সাউন্ড।অধরার আইডিকে ট্যাগ দিয়ে ম্যারেড স্ট্যাটাস দিয়েছে বর্ন।সাথে লাল টুকটুকে অধরার বধু বেশে তার পাশে বসা একটা ছবি এড করা।বুকের মাঝে ধক করে ওঠে মুগ্ধর।কত অপরুপ লাগছে অধরাকে।মেয়েটার গায়ের রঙ চাপা হলেও তার সৌন্দর্যে ওই রঙ ভাটা পড়তে দেয় নি।কত নিখুত মায়া মেয়েটির মুখশ্রীতে।নিস্কম্প নয়নে সে মায়া দেখে মুগ্ধ।এই মায়ায়ই তো আটকে গিয়েছিলো সে।অথচ এই মায়াময় মুখশ্রীকেই অসুন্দর বলতে বাধ্য হয়েছে সে।দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল।এই সুখময় সময়ে অধরার সাথে সেও চাইলে সাক্ষী হয়ে থাকতে পারত।অধরাকে নিয়ে কত স্বপ্ন সাজিয়েছিলো সে।কিন্তু বিধাতা হয়তো তা চাননি।এ কারনেই সম্পর্কের এক বছর পূর্তির আগেই তার শরীরে ক্যান্সারের বীজ পুতে দেয়।দীর্ঘ দিন ধরে অতিরক্ত স্মোক করার অভ্যেস মুগ্ধর।প্রায়শই ড্রিংকস ও করে সে।অধরা হাজার বার নিষেধ করার পরও এসব বাজে নেশা ছাড়তে পারে নি সে।ফলস্বরুপ ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় সে।এ কারণেই হয়তো এতো অল্প সময়ের ব্যবধানেই অতি সুপ্রিয় নেশা অধরাকে ত্যাগ করতে হল তাকে।তার এই অনিশ্চিত জীবনে অধরাকে আর ঠায় দিতে সাহস করে না সে।এ কারণেই তো তার বেষ্ট ফ্রেন্ড আহিয়ার সাথে পরিকল্পনা করে ছবি পাঠায় অধরাকে।সে জানত ওটা দেখে অধরা কষ্ট পাবে।কিন্তু নিরুপায় সে।এই ঠুনকো কষ্ট অঅরা এক সময় ভুলতে সক।ষম হলেও তার অসুস্থতার শোক কখনো কাটিয়ে উঠতে পারবে না।উপরন্তু পাগলামি করে তার সাথেই নিজের জীবনকে জড়িয়ে সারাজীবন পার করে দিতে চাইবে।যা একজন সুভ্র হৃদয়ের প্রেমিকের পক্ষে মেনে নেয়া অসম্ভব।অভিনয় করে হলেও নিভৃতে সে তার প্রিয়াকে সুখময় স্থানে পৌঁছে দিয়েছে।অধরা সময়ের সাথে তাকে ভুলে গিয়ে সুন্দর গোছানো জীবন পাবে।বর্ন মানুষ হিসেবে অতটা খারাপও নয়।সাধারন সিগারেট খাওয়াও তার স্বভাবে নেই।ভালোই থাকবে তার প্রিয়া।নোনাজল মিশ্রিত চোখে ম্লান হাসে মুগ্ধ।মনে প্রানে তার প্রেয়সীর সুখ কামনা করে প্রার্থনা চালায় সে।হয়তো সুখীও হবে তার প্রিয়া তবে নিভৃতেই ঢাকা পড়ে যাবে তার এই আত্মত্যাগের গল্পটি।একারণেই গল্পটির নাম নিভৃতে প্রিয়া।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here