‘নিশীথচিত্র'(২৪)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে
______________
আবছা নীলচে আলোয় বুক তোলপাড় করা মুহূর্ত বারেবারেই বিমোহিত করে দিহানকে।অন্তর্দেশ দাপিয়ে বেড়ায় ভালোবাসা।বুকের ভেতর হরতাল চলে।থামাথামির নামই নেয় না, এ যেনো চব্বিশ ঘন্টার ধরাবাধা হরতাল।তখনকার মুহুর্ত ছিলো আরও ভয়ংকর। অবাঞ্চিত অভিলাষ তখন প্রবল ভাবে টানছিলো দিহানকে।রিনির অধর ছেড়ে গ্রীবায় দীর্ঘ সময়জুড়ে আনাগোনা করছিলো।রিনির প্রবল বেগে আছড়ে পরা তপ্ত নিশ্বাস সারা মুখ জুরে অত্যুক্তি করছিলো।।হুট করে ছেড়ে দেয় দিহান। অপরদিকে ফিরে প্রলম্বিত নিস্বাস ত্যাগ করে।একবার নয় দুই তিন বার।হয়তো নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টায়।রিনি মাথা বাসের সিটের সাথে হেলিয়ে দিয়ে দিহানের দিকেই ফিরে ছিলো।দিহানও ফেরে রিনির দিকে।দুজনের তপ্ত নিশ্বাস দুজনকে ছেয়ে যায়। এরপর শুরু হয় দুজনের গল্পবিলাশ।কেটে যায় মোহনীয় তমাসা যামিনী। দিহানের কাছে এখন মুহুর্তটা লোমহর্ষক। কম্বলের মধ্যেই আবার শরীরের লোম দাড়িয়ে গেলো দিহানের।দিহান চোখ বুজেই নিদ্রার চেষ্টা করে।
_______________
— “বাবু ও বাবু দ্যাখ মেয়ে দুটো উঠবে না? কখন ঘুমাইছে কে জানে!ওঠার নামই নিচ্ছে না।তিন তিন বার ডেকে আসছি”।হাফসা খানিক দম নিয়ে বলে “তুই কি পণ করেছিস বাথরুম দিয়ে বের হবি না ?”
দিহান মুখ মুছতে মুছতে বের হয়।
–“আমি দেখছি মা তুমি যাও।”
— “আমি একটু ছাদে যাই।কম্বলগুলো শুকাতে দিয়ে আসি। তুই যা তাড়াতাড়ি ”
দিহান দীপ্তির রুমের দিকে আগাচ্ছে আর বিরবির করে বলছে” মেয়েটার পরীক্ষা শেষ হবার পর বাজে অভ্যাস বাধিয়েছে।বারোটা বেজে গেলো এখনও ঘুমাচ্ছে”
বড়সড় একটা ধমক দিয়ে ঘুম ভাঙাবে সে এমন মনোবাসনা করতে করতেই রুমে ঢুকে। মায়ামুখ খানা দেখে সব বিস্মৃত হয়ে যায় কর্পূরের মতো। পাশেই দীপ্তি ভুসভুস করে ঘুমাচ্ছে। বিছানার কানায় রিনির মুখটা। দিহান হাটু গেড়ে বসে।রিনির মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক ঘষে। প্রশান্তিতে বুক টইটুম্বুর!! ঠোঁটে ছোট্ট করে আদর মাখা চুমু খায়। ঘুমন্ত অধর যেনো অন্য আর এক ভালোবাসা।এই মেয়ের থেকে কিভাবে দূরে সরে থাকবে? আস্তে আস্তে কাছেই টানছে।দিহান বিছানার পাশে বসে । ঘুম ভাঙাতে মন সায় দেয় না।তবুও ডাকে।খেতে হবে অনেক বেলা হয়েছে।দীপ্তির মাথায় দুইটা মারতেই উঠে বসে।বিরবির করতে করতে ওয়াসরুম চলে যায়।রিনিকে ডাকার আগেই উঠে বসে চোখ কচলে বলে
–“চুমু কেন খেলেন?আমি খেলে তো দোষ হয়ে যেত”।
দিহান খানিক অপ্রতিভ হয়ে পরে।চালাকটা ঘুমে ছিলো না ভান ধরে ছিলো তাহলে!!দিহান কাশতে কাশতে রুম ছাড়ে।
_______________
রিনি খাবার খাওয়া শেষ করে দিহানের রুমে উঁকি দেয়।বেশ কিছুক্ষণ ধরে মেইলি আওয়াজ পাচ্ছিল সে।খাবার ছেড়ে ওঠা এক ধরনের অভদ্রতা বিধায় চুপচাপ খাচ্ছিলো। হাসির শব্দে কান ঝালাপালা করছিলো রিনির।
–“রিনি ভেতরে আসো।”
দিহান ডাকে রিনিকে। রিনি ভেতরে যায়।হুট করে কারো রুমে ঢোকা যায় না সেই সংশয়েই বাইরে থেকে উঁকিঝুকি দিচ্ছিলো।আহ্বান পেয়ে রুমে ঢোকে।
দিহান হাত দিয়ে বসার বিছানায় বসার জায়গা দেখিয়ে দেয়।রিনি বসতেই হুট করে এসে দীপ্তিও বিছানায় জায়গা দখল করে নেয়।
দিহান মিরার দিকে তাকিয়ে বলে
–” ও মিরা। সেম ব্যাচ আমরা।এখানকার স্থানীয় কলেজে অনার্স করছে এখন।”
রিনি আগ বাড়িয়েই কথা বললো দুই একটা।ভেতরে কোনো একটা অস্থিরতা কাজ করছে।এমনটা আগে হয় নি।মিরা যে তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে এটাও একটা অস্বস্তির কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে।
মিরা ভেতরের বিস্তর জগৎ টা কাউকে বুঝতে দিতে চায় না সহজেই। জ্বলে পুরে যাচ্ছে তার ভেতর শুধু মেয়েটাকে দেখেই। এটা তার স্বভাব বলা চলে।একমাত্র দিহানের সাথে কোনো মেয়েকে দেখলেই প্রতিহিংসা তার বুকে বিধে।তবে তার মনের অবস্থা যত গর্জে তত বর্ষে না টাইপের।ভালোবাসার মানুষটাকে ক্লাসের মেয়ের সাথেও কথা বলতে দিতে মন চাইতো না আগে।অধিকার থাকলে তো দিতোই না।প্রয়োজনে কারো সাথে কথা বললেও তার কাছে অসস্তি হয়ে দাড়াতো আর সেখানে নাকি এই মেয়েকে নিয়ে এসেছে রাতের বেলায়।দিহান এই মেয়েকে কেন এনেছে? কে এই মেয়ে?মিরার ধারণা মতে দিহান ঢাকায় যে বাড়িতে থাকে সেই বাড়িরই মেয়ে হয়তো।খালার কাছ থেকে, দীপ্তির কাছ থেকে দিহানের বিষয় নানান খবর নেয় মিরা।সে বাড়ির দুটো মেয়ে মিরা তাও জানে।কিন্তু দিহানের সাথে গ্রামে কেন এলো?
রিনি মুখে যথেষ্ট হাসি ধরে রেখেই বললো
— আপু আমি রিনি।
মিরা তার ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসে।মিরা কিঞ্চিৎ হাসলো।
রিনি নিজে থেকেই বললো
— আপু আমি দীপ্তির ক্লাসমেট ।
মিরা আগ্রহ দেখায় না।স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে
— রেজাল্ট কেমন হবে?
— হবে। মোটামুটি হবে।বাকী আল্লাহর ইচ্ছা।
দিহানই বললো
— মিরা আমি যে বাসায় ভাড়া থাকি তার মেয়ে রিনি।
দিহান নড়েচড়ে বসে। ছোট বেলার বন্ধু মিরা।সম্পর্কে হাফসার খালাতো বোনের মেয়ে মানে তার খালাতো বোন। পাশাপাশি বাড়ি হবার সুবাদে একসাথে বড় হয়ে ওঠা।ছোট বেলা থেকে খুটি নাটি কথা গুলো সমবয়সী হওয়ায় দুজন দুজনকে শেয়ার করতো।একসাথে পড়াশুনাও করতো তারা।ক্লাস নাইনে বিভাগ পাল্টে যাওয়ায় একসাথে পড়া বন্ধ হয়েছে।তবুও বন্ধুত্ব কমে নি।মিরার ব্যবহার দশম শ্রেণি থেকে অদ্ভুত লাগতো দিহানের কাছে।একাদশ শ্রেণির শেষ দিকে কারণটাও জেনে ছিলো দিহান।মিরাকে দিহান বুঝায় তাদেএ সম্পর্ক বোন, বন্ধুর থেকে বেশি না।সে ভাবতে পারবে না এর থেকে বেশি।তবুও মিরা ঠিক হচ্ছিলো না বিধায় দিহান কথা বলা বন্ধ করে দেয়।সেই ভয়েই মিরা পাগলামি বন্ধ করে নিজেকে সাভাবিক করে।তবে নিজের মনকে সাভাবিক করতে পেরেছে কিনা তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে দিহান।রিনিকে ভালোবাসার কথাটা কি বলবে মিরাকে।না বলেও শান্তি পাচ্ছে না যেন।তাছাড়া রিনিকে যদি উল্টা পাল্টা কিছু বলে?দুবছর কেটে গেছে এখন হয়তো সেরকম কিছু নেই মিরার মনে ওমনটা ভেবে দিহান মিরার কানের কাছে গিয়ে বলে
— ওটা ভালোবাসা আমার। দ্যাখ পছন্দ হয়েছে কিনা!!বলে দিস না আবার বলি নি আমি এখনও ওকে।
দিহান নিজের জায়গায় আবার বসে।রিনি চোখ কুচকে তাকিয়ে আছে।দিহান স্মিত হাসে।হাসির ভাষা বোঝে না রিনি।কি এমম কথা যে কানে কানে বলতে হবে?
মিরার দৃষ্টি কঠোর হয়ে গেলো। বিপন্ন মুখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিনির দিকে। সবার অগোচরে ওড়না চেপে ধরলো খুব শক্ত করে।মর্মদেশে চিকন ব্যাথা হচ্ছে।দিহান ভালোবাসবে না সে জানতো তবুও অপেক্ষা করতো।না চাইতেও অপেক্ষা করতো।আর নিজস্ব একটা ইচ্ছা ছিলো তার।দিহান যদি কাউকে ভালোবাসে তার মুখ দেখবে না সে।তবুও আজ মুখটা ভাগ্যক্রমে তার দিকে।অপছন্দ হওয়ার যুক্তি নেই মোটেই।অত্যন্ত সুন্দর মেয়েটা।হয়তো এমন কিছু আছে মেয়েটার যেটা ভালোবাসার মতো।দিহান শুধু চেহারা দেখে ভালোবাসবে তা মনে হয় না মিরার।হ্যা সুন্দর খুব সুন্দর। চিৎকার করতে মন চাইছে মিরার।শরীর প্রচুর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে হুট করে গায়ের সোয়েটারে কোনো লাভ হচ্ছে না।অকারণে রিনির দোষ খুজতে মন চাইছে।দিহানের মন থেকে রিনির নামটা মুছে দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তা সে করবে না।ভেতর থেকে নানান নেতিবাচক ভাবনা এলেও সে করবে না।দিহানের নাম খারাপ হবে ক্ষতি হবে এমন কাজ মিরার দাড়া অসম্ভব। রিনির দিকে তাকিয়ে মন থেকে একটা কথা বের হলো ” আজ দিহানের ক্ষতি করতে পারবো না বিধায় তোমার ক্ষতি হলো না”।চোখ মুখ ঝলসে যাচ্ছে মিরার।দিহানের দিকে তাকিয়ে রাশভারী কন্ঠে বললো “সুন্দর।খুব সুন্দর”
মিরা চকিতে উঠে চলে গেলো। এখানে থাকার ইচ্ছা নেই তার।দিহান কি বললো তাও শোনার ইচ্ছে হচ্ছে না।
দীপ্তি দিহান কিছুটা আন্দাজ করেছে।নিরবতা কাটাতে দীপ্তি বললো
— ভাইয়া চল পেছনে যাই।
দীপ্তিদের বাড়ির পেছনের পরিবেশটা অত্যন্ত সুন্দর। পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে পেছনের পুকুর।ঘাটবাধানো পুকুরের চারপাশে গাছগাছালিতে ভরপুর। পুকুরের পাশের চিকন রাস্তা দিয়েই খালপাড়ে যেতে হয়। বাড়ির শেষ সীমানেই বিশাল খাল।পুকুরের শেষ হবার পর খাল পর্যন্ত ছোট বড় অনেক গাছ।ফলমূলের গাছও রয়েছে বেশ।খালের পরে বিস্তর কৃষিমাঠ।দৃষ্টি যতদূর যায় ততোদূর বিস্তর মাঠ আর মাঠ।হালকা মৃদু পবন ছুয়ে দিচ্ছে ওদের। রিনি চাদরটা আরও একটু ভালোভাবে গায়ে জড়ায়।দিহান মোটা সেরেজ গাছটার গায়ে হেলে দাড়ায়।রিনির চোখ বিস্তর মাঠের দিকে নিবিষ্ট। দিহান পেছন থেকে রিনির খোপা খুলে দেয়।রিনি পুলকিত হয়।হালকা লজ্জায় আবিষ্ট হয় রিনি।দীপ্তি খালের ঠিক পাশের গাছটার শিকরে বসে।দিহানের কাজে খিল খিল করে হেসে দেয়। রিনি লজ্জা পায় ভারী।
দিহান ভ্রু উচিয়ে বলে
— “হাসছিস কেন তুই?”
দীপ্তি কৌতুকের সুরে বললো
–“হাসি পেল তাই হাসছি।”
দিহান ধমকের ন্যায় বলে,
–” পেছনের দিকে একদম ফিরবি না।একদম না।”
দীপ্তি হেসে বললো
–” যথাআজ্ঞা ব্রাদার”
বড্ড প্রেম প্রেম পাচ্ছে দিহানের।কিন্তু সে তো কঠোর হতে চেয়েছিলো।মস্তিষ্ক আর মনের একটা কথা বলতে ইচ্ছে হলো”কঠোরতার খ্যাতাপুড়ি”।
উড়ন্ত চুলের ঘ্রাণে অদ্ভুত মাদকতা দিহানের নাসারন্ধ্রে লাগছে ।সেই মাদকে দিহানের আসক্ত হতে ইচ্ছা করছে।রিনির চুলগুলো হালকা উড়ছে এটাও দিহানের বড্ড ভালো লাগছে।দিহান সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে রেখেছে।চুলের ছোয়া তার হাতেই লাগছে।অদ্ভুত মুগ্ধতায় জুড়িয়ে যাচ্ছে মন প্রাণ।প্রেয়সীর চুলেও এতো ভালোবাসা কেন?
দিহানের অদ্ভুত অভিলাষ হলো। রিনির চুলে বেণি গাথবে সে।রিনির সোজাসুজি দাড়ালো।রিনির মধ্যে অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে।আজ তার নিশ্চুপ থাকতেই ভালো লাগছে মাঝে মাঝে দুই একবার হাসছে ।
দিহান রিনির চুল তিনভাগ করলো। রিনি বিস্ময়ে নির্বাক হলো যেনো।বিষ্ময় কাটিয়ে বললো
— “করছেন কি?”
দিহানের মনযোগী চোখ মুখ মোটেও পাল্টালো না তাতে।সাভাবিক ভাবেই বললো
— “বেণি।”
রিনির মুখ বৃহৎ আকারে হা হয়ে যায়।দীপ্তি পেছনে তাকায়।নিষিদ্ধ জিনিসে মানুষের আগ্রহ বেশি দীপ্তিও তার বাইরে না।বেণি গাথবে শুনে আরও বেশি উৎসাহ পায়।পেছনে না তাকিয়ে পারে না আর।
–“আবার তাকিয়েছিস?”
দীপ্তির মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
–“তোরা কি বাসর ঘরে যে তাকানো যাবে না?”বলেই আবার জিভ কাটে দীপ্তি।
এমন কথায় নির্বাক হয়ে যায় দিহান। রিনি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে।এরপর পিনপতন নিরবতা।
শুধু দিহানের হাত চলছে।কিন্তু বেণির ব ও তার দাড়া হয়ে উঠছে না পেচিয়ে জট পাকিয়ে যাচ্ছে।হিশহিশ করে দীপ্তিকে ডাকলো দিহান।
দীপ্তি অভিমান ভরা গলায় বললো
–“তাকাবো না আমি। যাহ।”
— “আয় না দীপ্তু। বেণির ব ও হচ্ছে না আমার দাড়া।মানসম্মান বাচাতে অন্তত আয়।”
দিহানের এরুপ অনুনয় মাখা গলা শুনে রিনি নীরবতা ভেঙে খিল খিল করে হেসে উঠলো।হেসে উঠলো দীপ্তিও।দিহানের মুখে লজ্জার রেশ।
দীপ্তি জামা ঝারতে ঝারতে উঠে বললো
–” তুই লজ্জাও পাও ভাইয়া? টমেটো টমেটো লাগছে তোকে।”
বলেই রিনি দীপ্তির আর এক চোট হাসির রোল পরে গেলো। দিহান লজ্জায় মিয়িয়ে যাচ্ছে যেনো দীপ্তি না থাকলে এই লজ্জা টজ্জা পেতো না সে।অতি কষ্টে ধমক দিয়ে বললো
–” তুই হেল্প করবি?হেল্প করলে কর নয়তো ভাগ।”
দীপ্তি এগিয়ে এলো। রিনির পেছনে দাঁড়িয়ে শিক্ষকের মতো বললো
–” মনযোগ দিয়ে দ্যাখ।”
দিহান মনযোগী মুখ নিয়ে তাকায়।
–“শোন প্রথমে তিন ভাগ করবি বুঝলি।তারপর ডান পাশের ভাগ মধ্যভাগ আর বাম পাশের ভাগের মধ্যে নিবি।এরপর বামপাশের ভাগটা বাকি দুইটার মধ্যে নিবি।এরপর মধ্যের ভাগ যেটা ছিলো সেটা বাকি দুটোর মধ্যে নিবি।”
দীপ্তি বেণি করছে আর বলে যাচ্ছে গড়গড় করে।দিহানের মেজাজ তখন চৌঠা আসমানে। দীপ্তি কি বলছে বোঝার মতো করে মোটেই বলছে না। মুখ বন্ধ করে শুধু হাতের দিকে খেয়াল করলেও হয়তো কিছু বোঝা যেতো।মুখের বুলিতেই দীপ্তি দিহানের সব গরবর করে দিচ্ছে। কিন্তু এভাবে..
দিহান মাথায় চাটি মারলো।অতিষ্ঠ গলায় বললো
–” কোন ঘোড়ার ডিম বলতেছিস, আবাল একটা ।”
দীপ্তি হাসতে হাসতে বললো
–” একটু ভুল বললি আমার আবাল হবার চান্স নাই।”
–“মেজাজ খারাপ করিস না।মুখ বন্ধ করে বেণি কর।মুখ খুললে কাদা খাওয়াই দেবো একদম।”
–” পারোই ধমকাইতে। নাও আবার দেখো।মাথায় তো গোবর কেমনে পারবা।”
দীপ্তি আবার শুরু করলো বেণি করা।পাঁচ বার দেখিয়ে দেবার পর দিহান পারলো ঠিক ভাবে।হাফ ছেড়ে বাচলো যেনো।প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বললো
–” ম্যাথ সলভ করতেও আমার এতো কষ্ট হয় না।”
পাশের গাছ থেকে দুটো রক্তিম জবা ফুল ছিরে রিনির বেণিকে সজ্জিত করে দেয়।রিনি অবাক চোখে তাকায়।মুখে কোনো কথা নেই।মাঝে মাঝে ভালোবাসা নিশ্চুপ ভাবে অনুভব করতেই বেশি ভালো লাগে।রিনি আজ সেই ভালোবাসা অনুভব করছে।আবার মাঝে মধ্যে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছে বুকের মধ্যখানটায়।মিরাটা কে?তার দিহান ভাইয়ের দিকে ওমন চোখে কেন তাকায়?এমন অনেক মেয়েই কি দিহান ভাইয়ের দিকে এভাবে তাকায়? তাকে সে একদম সহ্য করবে না।এমন টা কখনও মাথায় আসে নি রিনির। এমন প্রশ্ন বার বারই তাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করে তুলছে অব।
চলবে,
‘নিশীথচিত্র'(২৫)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে
______________
অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।দূর থেকে দুই একটা কৃষক দেখা যাচ্ছে গরু নিয়ে ঘরে ফিরছে।রিনি অপলকে সেদিকে তাকিয়ে আছে।রিনির এতো নিরবতায় দিহান অবাক না হয়ে পারে না।কি হলো মেয়েটার?
–“আমি গেলাম।তোমরা আসো”
দীপ্তির সাথে রিনিও হাটা শুরু করে।
দিহান চকিতে বললো
–“রিনি দাড়াও। পরে যাও মানে আমার সাথে যেও।”
রিনি বিনা বাক্যে দাঁড়িয়ে পরে দিহানের ডাকে।রিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডান হাতে বাম হাত ঘষছে অনবরত।
–“ভালো লাগে নি তোমার?”
–“কি বলেন তো?”
দিহান অবাক না হয়ে পারে না।রিনি এভাবে কখনোই কথা বলে না। এখন অব্দি অন্তত বলে নি এভাবে।দিহান চিন্তাগ্রস্থ মুখ নিয়ে বলে
–“তুমি এভাবে কেন বলছো রিনি?”
এই প্রশ্নের জবাব দেয় না রিনি।বেশ মোহনীয় স্বরে বলে
–“তুমি কি বলবেন?একবার মাত্র একবার?”
দিহান দ্বিধান্বিত মুখ নিয়ে বলে
–“কি?”
রিনি অকপটে উত্তর দেয়
–“ভালোবাসি ”
দিহান যেনো স্তব্ধ হয়ে যায়।তৎক্ষণাৎ মাথায় আসে ভালোবাসি না বলেও দুদিন ধরে ভালোবাসার অধিকার খাটাচ্ছে সে?সত্যিই তো।অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনে ভালোবাসি কথা বলা মূর্খতা তার নিকট। আশা দিয়ে আশা ভঙ্গ করা আরও অপরাধ মনে হয় দিহানের কাছে।নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেই ভালোবাসি কথাটা বলবে এমনই দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে নিজের কাছে।এই ডিসিশনে তার থেকেও রিনির জন্য বেশি ভালো হবে।তবে আজ রিনির কাছ থেকে এড়িয়ে যাওয়াও যেনো কঠিন থেকে কঠিনতর।
দিহানের ভাবনার সুতো কেটে রিনি বললো
–“আমি আপনাকে তুমি আপনি মিলিয়ে কেন বলি বলেন তো?”
রিনি প্রসঙ্গ পাল্টালো।দিহান ভালোবাসি বলবে না জেনেই প্রসঙ্গ পাল্টেছে সে।
দিহান হাফ ছেড়ে বাঁচে।আজ কেন যেনো ফিরিয়ে দেয়া বড্ড দুরূহ হতো।আটকে থাকা নিশ্বাসটুকু সজোরে ছেড়ে দিহান বলে
–“জানতে চাইনি তো।হয়তো তোমার ভালো লাগে তাই মাঝে মাঝে বলো”
— “উহু তা নয়।আপনি ডাকার জন্য এতো থাপ্পড় খেয়েছি যে আপনি ডাকটা ছাড়তে মন চায় না আমার এটা অভ্যাস আর মায়া দুটোরই আয়তায় চলে গেছে বুঝলেন।এদিকে ভালোবাসার মানুষটাকে তুমি ডাকার তীব্র ভয়াবহ তেষ্টা পায় আমার।তাই সম্মান ভালোবাসা দুটো একসাথে মিলিয়ে প্রাদুর্ভাব ঘটাই যখন আমার খুব আল্লাদ হয় তখন।আজও হচ্ছে খুব আল্লাদ হচ্ছে।তবে আমার মনে হয় আজকের আল্লাদটা নিশ্চুপ আল্লাদ।কেন যেনো অপ্রকাশেই বেশি আনন্দ লাগছে।”
দিহানের মোহনীয় স্বরে বলতে মন চাইলো
–“আমার যে চঞ্চল রিনিকে খুব বেশি ভালো লাগে।তারল্য, চপলতা, অস্থিরতা আর মনের দিন দিয়ে বড্ড সাদা রিনিকে বড্ড বেশি ভালো লাগে।আমি বিমুগ্ধ,আমি মোহিত সেই রিনিতে।”
কিন্তু দিহান বললো না।বাস্তবতা মাথা জুরে ভর করছে তার।মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে তার উপর রিনির বাবা এক কথায় আশ্রয় দিয়েছিলো তাকে।ব্যক্তিত্বে আঘাত হানছিলো বিধায় কঠোর পরিশ্রম করে নিজের ভার নিজে নিয়েছিলো ।কিন্তু রিনির বাবার ঋণ তার দিহানের কাছে অমেয়,অপরিমিত ।আর সেই মানুষটার মেয়ের দিকে হাত বাড়ানো?তাহলে তার চরিত্রকে ঠিক কি উপাধি দেবে তারা?লোভী?অর্থগৃধ্নু?বামুন?অকৃতজ্ঞ?ব্যক্তিত্বহীন ও কি ভাববে?ভাবতেই পারে।কারো নিজস্ব চিন্তা ভাবনায় হস্তক্ষেপ তো আর করা যাবে না নিজস্ব চিন্তা ভাবনার স্বাধীনতা রয়েছে।রিনির বাবা শিক্ষিত মানুষ। সে উচ্চপর্যায়ে গেলে অবশ্যই মেনে নিবে। রেজাল্ট নিয়ে দিহানের চিন্তা হচ্ছে না।হচ্ছে সময় নিয়ে।লেখা পড়া করে সিজিপিএ ধরে রাখতে পারবে সেটুকু ভরসা আছে নিজের উপর। রিনির হাতে সময় কতটুকু কে জানে?আশা দিয়ে নিরাশা করাটা অনুচিত। ভালোবাসি বললেই শত শত স্বপ্ন বোনা শুরু হয়ে যাবে রিনির মনে।ছোট বয়সের অসীম আবেগে নানা স্বপ্ন দেখবে।অধিকার নেই ভেবে যেসব কাজ আজ করছে না ভালোবাসি নামক শব্দ টাই হাজারো স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া পাওয়া, কমিটমেন্ট জুড়ে দিবে তখন,তখন রিনি আরও মুক্ত হয়ে যাবে।আর এসব যখন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
পূরণ হবার আগেই উপাখ্যান শেষ হয়ে যাবে তখনকার মর্মদেশের ব্যাথা কল্পনায়ও ভাবতে পারে না দিহান।দিহান চায় না রিনি প্রণয়লীলার সুখে পূর্ণতা না পাক।পেলে পুরো পাবে নয়তো প্রারম্ভই হবে না কখনও অর্থাৎ ভালোবাসা তো কারো ধরা ছোয়ার বাইরে কিন্তু প্রেমে তো সবার হাত আছে চাইলেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। দিহান চায় রিনির বিষয়ে সম্পুর্ন নিশ্চিত হয়ে আগাতে আর যতদিনে নিশ্চিত না হয় ততোদিন যেমন চলছে তেমনই চলবে। । প্রণয়ে পূর্ণতার পরে বিচ্ছেদ এসব দিহান ভাবতে পারে না।সে নিজেকে গুটিয়ে নিবে।রিনি পাগলামি করুক কিন্তু সে অনড় থাকবে আবারও একবার প্রতীজ্ঞাবদ্ধ হলো দিহান।দিহানের মনের ক্ষুদ্র কুটিরে বিস্তীর্ণ ভালোবাসা একটা কথাই উচ্চারিত হয় “প্রণয়ের পরিণয় যেনো হয়”
রিনি খপ করে হাতের মধ্যে হাত শক্ত করে চেপে ধরে।গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে
–“আমাকে কিভাবে আবার এড়িয়ে যাবেন তা নিয়ে এতো ভাবতে হবে না।আপনি কাল আর আজকের মতো বার বার করবেন না আমি জানি।আমিও এমন নিশ্চুপ থাকবো না তা আপনি জানেন না?” রিনি দিহানের হাত শক্ত করে ধরেই হাটতে হাটতে বলে”আমার প্রেম হবে উড়াউড়ি মার্কা উথাল-পাতাল প্রেম।উথাল-পাথাল প্রেমের ঢেউয়ে জলমগ্ন হবে শত শত লঞ্চ,স্টিমার,জাহাজ,নৌকা,ডিঙি নৌকা।”বিজ্ঞ সুরে আবারও বললো “টাইটেনিক ও ডুবতে পারে বুঝলেন।আমার আবার ইট্টু সিট্টু ভালোবাসা না। আমার বিশাল ভালোবাসা”
দিহান ফিক করে না হেসে পারে না।রিনিকে থামিয়ে দেয়।না থামালে আরও কতো কি ডুবায় কে জানে?
— ” থামো রিনি।তোমার বিশাল লম্বা ভালোবাসায় আমিই ডুবলাম না তারপর তো টাইটেনিক”
রিনি রহস্যময় হাসলো।
_____________
রাতের খাবার সবাই একসাথে খাচ্ছে।রিনি ভদ্র মুখ করে টুক টুক করে খাচ্ছে।দিহান আড় চোখে বার বার চোখ গরম দিয়ে তাকাচ্ছে।তার অবশ্য যথেষ্ট কারণ রয়েছে।ডান পাশের চেয়ারেই রিনি বসা। সে তার দুই পা দিয়ে দিহানের ডান পা আটকে ধরে আছে।অকাজ করার সময় অতি ভদ্রতা ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি রকমের বেড়ে যায় রিনির।মুখ টা তখন অতি দুধে ধোয়া তুলশি পাতা হওয়া চাই কারণ অকর্মের সময় ধরা খাওয়ার ভয় মানুষের প্রকট হয় তাই ই অতি সাধুবাদ ।রিনিও তেমন ভেজা বিড়াল হয়ে আছে।দিহান চোখ গরম করে বার বার বলছে “রিনি দ্রুত খাও, এটা নাও, ওটা নাও। ” হাফসার আর বলতে হচ্ছে না ছেলেই বলে দিচ্ছে ।কেউ বুঝতে না পারে সেভাবে বার কয়েক পা টানাটুনি করেছিলো দিহান কিন্তু লাভ হয় নি কোনো।
খেতে খেতে হাফসা বললো
–” শুনছিস মিরা তো বিয়ের জন্য লাফাচ্ছে।আজ নাকি ওর মাকে ধরছে তিন দিনের মধ্যে বিয়ে দিতে হবে।”হাফসা আবারও অতি বিস্ময় নিয়ে বললো”আর জানিস এই মেয়েকেই কাল দেখতে আসার কথা ছিলো কতো তালবাহানা করে নাকচ করে দেছে প্রস্তাবটা। আর এখন নিজেই,,,”
হতাশ কণ্ঠে হাফসা আবার বললো” কি যে হইলো কে জানে!!আজকাল বাচ্চাদের মাথায়ও যে কি ঘোরে বোঝার মতো বোধ বুদ্ধি আমাদের নাই বাবা।”
দিহান দীপ্তি মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো।দীপ্তি ইশারায় কিছু একটা জিজ্ঞেস করতেই দিহান হ্যা সূচক মাথা নাড়লো।দীপ্তি হাত মুখের যুগ্ম ভঙ্গিতে প্রকাশ করে বললো”কামের কাম সাড়া”
–“কথা কি কানে যায় তোদের?যাই হোক মিরারে দেখতে আসবে।আগের মানে কালকের প্রস্তাবটাই। প্রস্তাবটা অনেক ভালো।তিন দিনের মধ্যেই বিয়া হইয়া যাইতে পারে বুঝলি”
দীপ্তি খুশিতে গদগদ।যাকগে যা হয় ভালোর জন্য হয় ।এদিকে রিনি মনযোগ দিয়ে অনেক গুলো কাজই একসাথে করছে।দু পা দিয়ে দিহানের পায়ের আঙুল টানা,মনযোগ দিয়ে খাওয়া আর এতক্ষণের কথা মনযোগ দিয়ে শোনা।মিরার এভাবে বিয়ের জন্য পাগলামি তার কাছে অদ্ভুত লেগেছে বেশ।তবে দিহানকে তার কাছে গম্ভীর লাগলো।
ফিরোজ হাত ধুতে ধুতে বললো
–“মিরা কি খালি একটা বিয়া আটকাইছে? ওর বিয়া তো আরও এক দেড় বছর আগেই হইতো।ওর ঘাড়ত্যাড়ামির জন্যই তো”
ফিরোজ আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলো হাফসা থামিয়ে দিলো
–“অতো কথা বাদ দিয়ে কাজের কথা বলো।হাফসারে বিয়ায় কি দেয়া যায়?সোনা গয়না তো দেয়া লাগেই নাকি?”
চলবে