নিশীথচিত্র পর্ব ৫

‘নিশীথচিত্র’ (৫)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে

_____________

ঝি ঝি পোকার ডাকে চারিপাশ মুখরিত। পাল্লা দিয়ে ডাকছে।তেমনি দিহানের মাথায়ও ঘুরপাক খাচ্ছে নানান চিন্তা। দিহানের কি হলো নিজেই বুঝতে পারছে না।তার মন আর মস্তিষ্ক একটা কথাই বার বার বলছে যে রিনির মুখ টা একবার দেখলেই সমস্ত অশান্তির অবসান হয়ে যাবে।একেবারে না হলেও অন্তত একটু শান্তি অনুভব করবে । তবুও এতো রাতে কোনো মেয়ের রুমে উঁকি দেয়া উচিত হবে না ভাবতে ভাবতেও ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো দিহান।অবচেতন মনের কথা অনুসারেই রিনির রুমের ব্যালকুনির পাশের কাঁঠাল গাছটা বেয়ে ব্যালকুনিতে পা রাখলো ।রিনির রুমের দরজা হয়তো দেয়া। অবশ্য ভিতরে যাওয়ার ইচ্ছাও ছিলো না দিহানের। জালনা টা হালকা খুললো ।

ড্রিমলাইটের আবছা আলোয় কি অপূর্ব রিনির মুখটা।এতো মায়াভরা মুখ আগে কখনও কাউকে দেখে মনে হয় নি।দিহান কি জন্য এই পর্যন্ত ছুটে এসেছে তা সে জানে না। আবার মনে হলো নাহ আসা একদমই উচিত হয় নি।তবুও বেশ কিছুক্ষণ রিনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো দিহান। পরক্ষণে চোখ পরলো রিনির ঘুমানোর ধরনের দিকে।দুই হাত দুইদিকে মেলে রেখেছে সাথে এক পা বাংলাদেশে এক পা ভারতে অবস্থান করছে।দিহানের আফসোস হলো মেয়ে মানুষ হয়েছে সুস্ত সুন্দরভাবে নিজেকে ঘুচিয়ে ঘুমাবে তা না। আবছা অন্ধকারের মধ্যে এতক্ষণে দিহানের মনে হলো রিনির পোশাকটাও তেমন সুবিধার না।তাই তাড়াতাড়ি গাছ বেয়ে নেমে গেলো।

_______________

রিনি পড়তে এলো ঠিক তার দুইদিন পরে।কারণ টা অবশ্য দিহানের জানা।রেহানা আন্টির কথা অনুসারে রিনির জ্বর ছিলো। এক থাপ্পড়ে জ্বর!!!! ভাবা যায়??
দিহান আবার ভাবলো যে তুলোর মতো মেয়ে হতেও পারে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।দেখলেই মনে হয় এই বুঝি তুলোর মতো কখন জানি উড়ে গেলো ।

স্যার স্যার কন্ঠে উপদেশ দিলো দিহান।
— “রিনি গণিত বের করো।আর হ্যা তুমি আমাকে ভাইয়াও ডাকতে পারো স্যারও ডাকতে পারো।”

গনিত শব্দটা শুনেই রিনির মেজাজ ভারী হলো,
— “আচ্ছাহ।কিন্তু প্রথমেই গণিত?”

— “হুম। তাহলে কি ইংলিশ পড়বে?”

রিনি ঠোট উল্টে বললো
— “দুইটাই তো বিপদ।”

— “কোনটা বেশি ভয় লাগে?”

রিনি আস্তে করে জবাব দেয়
— “গণিত। ”

দিহান মজা পেলো যেন।বললো
— “তাহলে গণিতই শুরু করবো।”

রিনি অনুনয়ের সুরে বললো
— “না প্লিজ। ”

— ” চুপ।একদম চুপ।”

রিনি চুপ হলো ঠিক কিন্তু পরক্ষণেই বললো
— “আচ্ছা তবে একটা প্রশ্ন করি?”

–” করো।”

— “আমাকে তুমি করে ডাকার কারণ? ”

দিহান হাসি হাসি মুখ করে বলে,
— “তুমি আমাকে প্রথমেই তুই করে না বললে প্রথম থেকেই তুমি করে বলতাম।কিন্তু তুমি তা করো নি রাগের বশে আমিও তাই।।আর এখন আশা করি তুমি আর সেই ভুল করবে না।তাই আমিও শুধরে নিলাম।আমার হঠাৎ করে একজন অপরিচিত কাউকে তুই করে বলতে খারাপ লাগে।অতি আপন কাউকে তুই করে বলা যায়।এটা আমার কাছে মনে হয় আর কি।”

এতক্ষণ দিহান বই থেকে অঙ্ক খুজছিল আর রিনিকে এই কথাগুলো বলছিলো।

দিহানের বুঝানো অতি স্পষ্ট আর একই জিনিস বার বার বুঝায় মগজে ঢুকানোর জন্য। কিন্তু বিষয়টা যে গণিত। রিনির মাথা তো গণিত বইয়ের কভার পেজ দেখলেই ভন ভন শুরু করে দেয় ।এই ভনভন ঝনঝন নিয়েই দিনের পর দিন কাটছে।রিনি মনে হচ্ছে সে শুধু দিহানকে দেখতেই পড়তে আসছে নয়তো বাবা মাকে কিছু একটা বলে নিশ্চয়ই এই পড়া ছাড়িয়ে নিতো।কিন্তু তার ছোট্ট মন তা পারছে না।আর এই অপারগতার কারণ হিসেবে ধরা পরেছে দিহানকে দেখার তৃষ্ণা, ভালোলাগা।দিন যাচ্ছে আর পড়াশুনা কেমন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে দিন দিন।দিহানের খাতা রোল করে মারা বারি গুলোও বেশ লাগে আজকাল। চোখ মুখ কুচকে হজম করে নেয় রিনি।রিনির বার বারই মনে হয় তার অনুভূতিগুলো জমা হতে হতে একটা নাম নিচ্ছে।এই অনুভূতি যে অনেক আগের তাও বেশ বুঝতে পারছে রিনি।আর এই অনুভূতিগুলোই জমা হতে হতেই আজ নিজের নাম দিতে অতি ব্যস্ত হয়ে পরছে রিনি। ভাবনার বাইরের ব্যাপার গুলো হজম হচ্ছে না কিছুতেই।

সেই দিনের থাপ্পড়ের পর থেকে রিনি দিহানকে অদ্ভুত ভাবেই ভয় পেতো।তার ধারণা মানুষটার অনেক রাগ। তেরিবেরি করলে তো লুচু ছেলেরা প্রাধান্য দেয় দিহান ভাই ভালো তাই ই সে সুযোগ কাজে লাগায় নি। সেদিনের পর বেশ কিছুদিন রিনি দিহানকে সম্মোধনই করতো না৷ যেমন”এটা কিভাবে হবে, ওটা কিভাবে হবে, এটা লাগতো, বুঝি নাই এইভাবেই বলতো।রাগ অভিমান কমে যাবার পর আপনি বলেই বেশির ভাগ সম্মোধন করতো।আসলে নিজের অনুভূতি তীব্র হচ্ছিলো বলেই রিনির এই পরিবর্তন। অন্যকারো কাছে হলে এই পরাজয় রিনি এক্কেবারেই মেনে নিতো না।দেখিয়ে দিতে রিনি কি জিনিস!!!!

রিনির হঠাৎ শান্ত হয়ে যাওয়া দিহানের কাছে অদ্ভুত লাগতো না তা নয়। পরক্ষণেই ভাবতো যা হয়েছে ভালো হয়েছে।মেয়ে মানুষ অতি অবুঝ আর অতি চঞ্চল হতে নেই।আর দিহানের মনের অনুভূতিগুলো বেশির ভাগ সময়ই দিহানের মনে প্রধান্য পায় নি। জোর করে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা যাকে বলে।এভাবেই থাকার ইচ্ছা তার।আর তাই নিজের কঠোর দিকটাই রিনির কাছে তুলে ধরে।

______________

ম্যাথ বুঝাতেই বুঝাতেই দিহান প্রশ্ন করলো,
–” বিষয় টা কি বুঝেছো?”

— “হ্যা দিহান ভাই।”

— “এক্সামের কয়দিন বাকি?”

— “বিশ দিন।”

— “না বুঝলে বলতে বলেছি। এক্সামে খারাপ করলে চলবে না কিন্তু।আংকেল আন্টির কাছে আমার নাম খারাপ করবে না একদম।”

— “আমি আপনার নাম খারাপ কেন করবো দিহান ভাই?”
দিহান হালকা হেসে বইয়ের পাতা থেকে চোখ উঠিয়ে বলে
— “তুমি তো করবে না তোমার রেজাল্ট খারাপ হলেই করবে । ”

দিহানের ঘাড়ে দোষ দেয়ার করার কথা রিনি ভুলেও ভাবতে পারে না।কিন্তু আজকাল যে তার মাথায় দিহান ছাড়া কিছুই ঘুরে না।তার কি হবে? রেজাল্ট যদি সত্যি খারাপ হয়?।চিন্তুত মুখে বললো
–” হ্যা দিহান ভাই চেষ্টা করবো। ”

— “তাহলে আজ একটা এক্সাম নি? ”

রিনি আঁতকে উঠল। এখন কি হবে?তুতলিয়ে বললো,
–” দিহান ভাই এক্সাম নিবেন আগে বলে দিতেন। মানে প্রিপারেশন ছাড়া কিভাবে এক্সাম দেব?”

— “যেভাবে পারো।এতো দিন বেশ বলেছো যে সব বুঝেছি সব বুঝেছি। এইরকম হঠাৎ পরীক্ষা নিলেই বুঝতে পারবো এতদিন কি বুঝেছো”

রিনি মহা ফ্যাছাদে পরলো।এতো দিন তো অঙ্ক বিজ্ঞান এক্সামের দিন ঠিক করা থাকতো আর তাই পরীক্ষার আগের রাতে শুরু হতো টানা মুখস্থ করা। বার বার বুঝানো জিনিসগুলো তো আর বলা যায় না যে বুঝি নি।আর যদি বলে তাহলে নিশ্চয়ই কারণ জানতে চাইবে?
রিনি ভাবলো কারণ জানতে চাইলে তখন কি বলতো? “দিহান ভাই আপনাকে দেখেই কূল পাই না অঙ্ক কখন দেখবো? আপনি তো অঙ্কের চেয়েও জটিল।আর এই জটলা ছাড়াতে আপনার রিনি এতোই ব্যস্ত যে গণিত কে সময় দেয়ার সুযোগই পাচ্ছে না” আল্লাহ এইটা বলবো? তওবা তওবা মেরে ফেলবে আমাকে।রিনির কথা গুলো মনেই থেকে গেলো।

— “দিহান ভাই এটলিস্ট কাল দি এক্সামটা।”

— “এই আমি তোমাকে প্রত্যেকটা বিষয় কি কম বুঝাইছি? এখনই দেবা এক্সাম দেখি গণিত বই টা দাও।খাতা খুলো।ফাস্ট”
দিহান তাড়া লাগায়। তার মানে আজ আর রক্ষা নেই।

— “বিজ্ঞান বা ইংরেজি এক্সাম নেন না দিহান ভাই। কাল নাহয় গণি…”

রিনি কথা শেষ করতে পারলো না দিহানের ধমকে।

— “এখন কি তুমি আমাকে ঠিক করে দিবা আমি কি করবো না করবো?”

রিনি আর কথা বলার সাহস দেখায় না।

দশটা অঙ্ক করতে দিয়েছে।ততক্ষণে রিনির গলা শুকিয়ে কাঠ।সব অঙ্ক বার বার দেখছে। পারে তো খাতার মধ্যেই ঢুকে যায়। কিন্তু মাথা বাবাজি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তার কিছুই মনে পড়ছে না।

দিহান নিজের বই পড়ছিলো। রিনিকে পড়ানোর ফাঁকে সে নিজেও পড়ে। রিনির দিকে তাকিয়ে দেখে সে অঙ্ক তুলছে, বার বার কাটছে, ঝিমুচ্ছে সব।

— “রিনি অঙ্ক গুলো বার বার করাইছি তোমাকে। তাড়াতাড়ি করো। মোরামুরি করতেছ কেন?দেখি কয় মিনিট আছে।আর মাত্র পনের মিনিট আছে।অনলি ফিনটিন মিনিটস।কুইক ফাস্ট ।।”

রিনি নিশ্বাস আটকে বললো
— “পারছি না।”

দিহান কথাটা নিতে পারছে না।আস্তে করে বললো
–“মানে কি রিনি আমি তোমাকে সবগুলো করাইছি।বার বার বুঝাইছি।আর তুমি কিনা এখন বলতেছ পারছি না। পাঁচ ছয়টা তো পারছো নাকি? কই দেখি খাতা দাও।”

রিনির খাতা দেখছে আর দিহানের মাথার রক্ত গরম হচ্ছে।এটা একদমই আশা করে নি সে।

— “রিনি মাত্র একটা অঙ্ক হইছে।কেমনে সম্ভব? ”

রিনি নিশ্চুপ রইলো

— “রিনি উত্তর দাও।”

রিনি উত্তর দিতে পারে না।

টেবিলে রাখা স্টিলের স্কেল দিহানের হাতে উঠতেই রিনির আত্মা উড়ে গেছে।শেষ রক্ষা হলো না দিহানের রাগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দুধে-আলতা গায়ের রং এ স্কেলের দাগ গুলো বেমানান ভাবে লাল হয়ে উঠছে। হাতের ডানা পিঠ সব জায়গায় মারছে।টানা পাঁচ সাত মিনিট মার খাওয়ার পর আর সহ্য করতে না পেরে রিনি “আর পারছি না” বলে কান্না করে দেয়। স্টিলের স্কেলটাকে হাতের মুঠোয় পিশে ফেলতে মন চাচ্ছিল দিহানের।পরক্ষনেই হাত দিয়ে ফেলে দেয়।রিনির কান্নার আওয়াজ তীব্র হচ্ছে। তবে রিনির কান্নার আওয়াজ ঘরের বাইরে যাওয়ার মতো না। । দিহান চেয়ার দিয়ে উঠে ওয়াসরুমে গেলো নাকমুখে মাথায় পানি দিয়ে গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আবার চেয়ারে বসে।

রিনির কান্না দেখে আজ আবার রিনিকে মায়াবতী ডাকতে মন চাইলো।

— “রিনি বাচ্চাদের মতো কাঁদে না।থামো।আর আমি সরি আমি রাগের মাথায় বেশিই হয়তো মেরেছি।কিন্তু তোমার ভুল বেশি।বুঝতে পারছো না আমায় কেন বলো নি?”

রিনির কান্না থামছে না।বেশ কিছুক্ষণ থামতে বলে লাভ হলো না।হাতের খালি অংশ টুকুর দিকে তাকিয়ে দেখলো অবস্থা খুব একটা ভালো না।আসলেই অনেক মেরেছে।দিহানের নিজেরই খারাপ লাগতে শুরু করলো।বাচ্চা মেয়ে ভুলে গেছে হয়তো কিন্তু অনেক বার বুঝিয়েছে তো সে তবুও পারলো না? দিহান আবার ভাবছে পারেনি হয়তো তার পড়ানোতে ঘাটতি আছে আসলেই এতো মারাও উচিত হয় নি।মায়াবতীর কান্না তার যন্ত্রণা হয়ে উঠছে।রিনির চেয়ার ওকে সুদ্ধই ঘুরিয়ে হাটু গেড়ে রিনির সামনে বসে পরলো।রিনির দিহানের চোখে চোখ পরেও সরিয়ে নিয়ে নিজের কান্নায় মন দেয়।দিহান রিনির দুই গালে আস্তে করে হাত দেয়।

গালে হাত পরতেই রিনি অবাক চোখে দিহানের দিকে তাকায়।দিহান তার গালে হাত দিয়েছে এটা ভাবতেই গায়ের ব্যাথা উধাও হয়ে গেলো। ব্যাথা যায় নি ঠিকই কিন্তু এই ছোঁয়া ওই মারের কাছে হেরে গেছে।রিনির চট করে মনে হলো কান্না থামালে গাল থেকে হাত সরিয়ে নিতে পারে তাই আবার সমানে কান্না জুড়ে দিলো।

–” বেশি ব্যাথা লেগেছে?”

রিনি অপলকে দিহানের দিকে তাকিয়ে আছে।

–“রিনি লিসেন আম সরি। দ্যাখো আমি তোমাকে প্রত্যেকটা বিষয় বার বার পড়াইছি।তবুও তুমি বুঝতেছ না সেটা হয়তো আমার ব্যর্থতা ছিলো। তবে তোমাকে মারা আমার একদম উচিত হয় নি।”

রিনি মনে মনে ভাবছে” ইশ আমার গাফিলতির কারনে আজ দিহান ভাই নিজেকে দোষ দিচ্ছে।রিনির খারাপ লাগলো।”
দিহান আবার বললো
–“তোমার বাবা আমার কাছে পড়তে দিয়েছে যাতে তোমার রেজাল্ট ভালো হয়।উল্টো যদি খারাপ হয় তাহলে আমি মুখ দেখাবো কিভাবে? ”

রিনির চোখ গড়িয়ে পানি পরছে।যতই হোক গায়ে ব্যাথা করছে।

–“কেদো না তুমি প্লিজ আমার খারাপ লাগছে।”

এই আল্লাদ রিনির সহ্য হলো না বিটলবনের মতো রিনির কষ্ট, সুখ, আনন্দ ব্যাথা সব মিশ্রিত হচ্ছিলো। আর এর মধ্যে এমন কথা শুনে আল্লাদে আরও জোরে কান্না পায়।
দিহান অনুশোচনার ভঙ্গিতে বলে
— “কেদো না রিনি।আমার গিল্টি ফিল হচ্ছে খুবই।প্লিজ।উহ প্লিজ রিনি।”

দিহান রিনির হাত ধরে বিছানায় বসায়।রিনির মাথা টেনে নিজের বুকের সাথে মিশায়।এসব কাজ হচ্ছিলো অজান্তেই।রিনির আত্মা তখন উড়ি উড়ি।সত্যিই সে দিহানের এতো কাছে।কান মুখ দিহানের বুকের সাথে লেপ্টে আছে। শরীরি দুরত্বে ঠিকই রেখেছে শুধু গলা জরিয়ে মাথা টা বুকের সাথে মিশিয়েছে দিহান।রিনির অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে।কি জানি! তার নাম কি।

দিহান কানের কাছে আস্তে আস্তে করে বলে –“মায়াবতীদের মায়া চোখের কান্না সুন্দর দেখালেও সহ্য করার মতো হয় না জানো তো।তুমি আর কেদো না রিনি।”

রিনি উত্তর দেয় না।নাম না জানা অনুভূতি শরীরের দুরত্বে মানতে পারছে না।দিহান কি বলছে এই মুহুর্তে তার কানেই যাচ্ছে না।রিনি আস্তে আস্তে করে দুরত্ব টা দূর করে দিলো। দিহানের অবাক লাগলেও হজম করে নেয়।সাথে সাথেই আস্তে করে রিনিকে ছাড়িয়ে একটু দূরে বসে।

— “দ্যাখো রিনি কাল থেকে আমি তোমাকে আরও সময় বাড়িয়ে পড়াবো।আমার বাসায় যেয়ে দুইটা ছেলে মেয়েকে পড়াতে হয় লাগলে তাও বাদ দিয়ে দেব।কিন্তু তোমার ভালো রেজাল্ট চাই ই চাই।যদি ভালো রেজাল্ট না হয় আমি ক্লাস টেনে আর তোমাকে পড়াবো না।আমাকে দিয়ে তো তোমার লাভই হচ্ছে না অযথা আমার কাছে পড়বে কেন?”

কথাটা রিনির মাথায় টনিকের মতো কাজ করে।যেকরেই হোক দিহান ভাইয়ের কাছে পড়তেই হবে।আর তার জন্য যেভাবে হোক ভালো রেজাল্টও করবেই রিনি।

–” যাও রিনি মুখে পানি দিয়ে পড়তে বসো পড়াবো।”

পড়ানো শেষে যাবার সময় দিহান রিনিকে ডাক দেয়।

— “বলেন দিহান ভাই।”

–” তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতাম । ”

— “বলেন আমি কিছু মনে করবো না।”

— “কাল থেকে মাথায় ওড়না পরো তোমাকে ভালো লাগবে।”

রিনি বুঝতে পারলো দিহান তাকে ইনডিরেক্টলি ওড়না পরতে বলছে।

রিনি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে এলো।

তারপর থেকে যোগ হলো জিন্স , থ্রি কোয়াটার প্যান্ট টি-শার্ট গেঞ্জির সাথে গলায় একটা ওড়না।তবে মাথায় দেয় না গলায়ই ঝুলায়।দিহান ভাবে এই ই অনেক। মেয়েটাকে বার বার নিজের মনের মতোই সাজাতে ইচ্ছে হয় কিন্তু সময়ের অপেক্ষা।

____________

–রিনি তুমি দুইদিন ধরে ফুল হাতার জামা পরছ যে?

রিনি মিনমিন করতে করতে বললো

— “গায়ে দাগ হয়েছে দিহান ভাই”

— “কই দেখি”

রিনি জামার হাতা কিছু উঠিয়ে কয় একটা দাগ দেখায়।দিহানের বেশ খারাপ লাগে।ছোট্ট করে সরি বলে।
রিনি চট করে বললো
— “দিহান ভাই আপনি কি আমার পিঠের দাগগুলো দেখবেন? সেগুলো আরও ভয়ংকর। ”

দিহান চমকে উঠল।পরক্ষণেই বললো

–” যদি কোনো দিন অধিকার মেলে তাহলে খুব করে মেরে ভয়ংকর এর থেকে আরও ভয়ংকর কিছু দেখে নিবো কেমন?এখন পড়।”

রিনির কাছে কথা গুলো স্পষ্ট না একদমই।দিহানের দিকে তাকিয়ে রইলো যার অর্থ সে বুঝে নি।

–“বুঝবে বুঝবে বুঝার বয়স তো হোক। শুধু তাকিয়ে থাকা বুঝলেই যে সব বুঝে গেছো এটা আমি বিশ্বাস করি না।”

রিনি চমকে তাকালো”এই রে দিহান ভাই কি আমার তাকিয়ে থাকা দেখে ফেলেছে?নাকি অন্য কিছু বোঝালো? দেখে ফেললে সর্বনাশ।”
‘নিশীথচিত্র’ (৫-এক্সট্রা)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে

_____________

রিনির কাছে কথা গুলো স্পষ্ট না একদমই।দিহানের দিকে তাকিয়ে রইলো যার অর্থ সে বুঝে নি।

–“বুঝবে বুঝবে বুঝার বয়স তো হোক। শুধু তাকিয়ে থাকা বুঝলেই যে সব বুঝে গেছো এটা আমি বিশ্বাস করি না।”

রিনি চমকে তাকালো”এই রে দিহান ভাই কি আমার তাকিয়ে থাকা দেখে ফেলেছে?নাকি অন্য কিছু বুঝাইছে? দেখে ফেললে সর্বনাশ।”

__________

এরপর থেকে দিহান রিনিকে দুই ঘন্টার জায়গায় তিন ঘন্টা পড়ায়।রাতে রিনির বাসায় এসে খাবার আগে একঘন্টা পড়ায়। তারপর একবারে খেয়ে দেয়ে চলে যায়।

পড়ানোর সময় রিনি জিজ্ঞেস করে

— “আপনার অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাই না দিহান ভাই?

দিহান হাসলো
–“মাত্র কয়টা দিন এতে আহামরি খুব কষ্ট হবে না আমার।”

— “তবুও দিহান ভাই।ভার্সিটি থেকে এসেই দুইটা টিউশনি করাতে যান।।তার একফাঁকে দুপুরের খাবারটা খান।বাসায় ফিরে রাতে আবার আমাকে পড়াতে আসেন খেয়ে গিয়ে সেদিনও দেখলাম চারটা বাজে আপনার রুমের লাইট অফ হইছে।আবার সকাল সাতটার আগে আমি পড়তে আসি।” রিনি এক নাগারে কথাগুলো বলে জিরোয়।

— “হুম তো?তুমি দেখলে কিভাবে আমি রাত চারটায় রুমের লাইট বন্ধ করি?”

এখন কি বলবে রিনি? দিহানের কষ্টে ভাগ বসাতে সে জালনার পাশে চেয়ার দিয়ে বসে রুমের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে?এটা বলা একেবারেই সম্ভব না।

–” ঘুম ভেঙে গেছিলো দিহান ভাই। বলি বাইরের প্রাইভেট দুইটা বাদ দিয়া দ্যান দিহান ভাই।”

দিহান ছোট্ট করে উত্তর দিল
— “বাসায় টাকা পাঠাতে হয়। ”
রিনিকে সব কিছু খুলে বলার ইচ্ছা দিহানের নেই।

— “আপনি ইনকাম না করলেও তো চলতো আপনার ফ্যামিলির তাই না?”

–” অবুঝের মতো কথা বলে না রিনি।আর যা জানো না তা নিয়ে তো না ই।”

— “সরিহ।”

দিহান প্রলম্বিত নিশ্বাস টেনে বলে।দিহানই নিজে নিজেই বলতে শুরু করলো
— “বাবার ব্যাবসাটা দিন দিন খারাপই হচ্ছে।আমাদের আধকরা বিল্ডিংটায়ও কাজ করাতে পারছি না।সেটার মধ্যেই থাকতে হচ্ছে।আধকরা বলতে ছাদ নেই এমন না।রং টং করা হয়নি প্লাস্টার দেয়া হয় নি। দেয়া হয়নি ।টাকার অভাবের জন্য মোটামুটি দামের দরজা জালনা লাগিয়ে তাতে থাকছি।ভালো ফার্নিচার নেই।তখন না হয় ছোট ছিলাম এখন তো বাবার কাজে আসতে পারি।আর দোকান দিয়ে যা আসছে তা আবার দোকানের পিছনেই ঢালতে বলেছি তাতে যদি ব্যাবসায় উন্নতি আসে।আর আমি যা টাকা পাঠাচ্ছি তা দিয়েই নিত্যদিনের বাজার আসবাব যা লাগে ।আমার তো এক্সট্রা কোনো খরছ নেই যাতায়াত ছাড়া। আসলে খরচ করলেই খরচ আর না করলে সেটাই সেভ।অপ্রয়োজনীয় খরচ করতে আমার এমনিই ভালো লাগে না।তার থেকে দোকান বড় করার চেষ্টা করাই ভালো। ইচ্ছা আছে কোনো কোচিং সেন্টারে মাস্টারি করবো।কথা বার্তা বলছি দেখি কি হয়।দুইটা প্রাইভেট একটা কোচিং। ” এসব বলে দিহান নিজে নিজেই হিসাব শুরু করলো তারপর বললো “এই ছাব্বিশ হাজারের মতো হয়ে যাবে।আর সেটা পেলে তোমাদের বাসা ভাড়া দিয়ে থাকা শুরু করবো। তোমার বয়সি একটা বোন আছে আমার “দিপ্তি”বোনের নাম।ওরে ইন্টারে এইখানের ভর্তি করানোর চিন্তা ভাবনা আছে।অনেক দায়িত্ব। অনেক।”দিহান একটা দীর্ঘশ্বাস টানলো।

রিনি দিহানের কথা শুনে ভাবছে একটা ছেলে কতো দায়িত্ব। টেবিলে রাখা ফোনটার দিকে তাকায় রিনি।একটা নরমাল বাটন ফোন। দিহানেরই ফোন । এই বয়সে ছেলেরা কত আমোদ ফুর্তি করছে আর দিহান ভাই কিনা!!!!! অবশ্য নিজেও করছে।রিনির বুকটা কষ্টে ছেয়ে গেল।রিনি তখনই ভাবলো দিহান যদি বাসা ভাড়া দেয় যদিও এই বাসা তার বাবা ভাড়া দিত না আগেও।কিন্তু দিহান ভাই অবশ্যই সেল্ফরেসপেক্ট থেকেই চাইছে তাহলে সেও তার বাবাকে প্রাইভেট ফি দিতে বলবে দিহান ভাইকে।যতই হোক দিহান ভাইয়ের প্রাপ্য এটা।লাভ লস হবে না হয়তো তবুও সম্মান বজায় থাকবে তার দিহানের।যদিও মুনির হোসেন টাকা দিতে চেয়েছে দিহানই না করেছে।সে হিসাবে তার দিহান মাগনা খায় নি একদমই। রিনির বেশ ভালো লাগলো যতই হোক দিহান ভাই এই বাড়ির জামাই হবে সম্মান আছে তো নাকি হ্যা।!!!!!এটা ভাবতেই আবার রিনি মিটিমিটি হাসলো।

দিহানের গলায় চমকে উঠল

— “এই রিনি তুমি হাসছো? এই জন্যই তোমাকে বলতে চাইনি।তুমি এসব কখনোই বুঝবে না।বড় হয়েছো তো মুখে সোনার চামচ দিয়ে তাই ই এমন।আর এমনিও মাথায় বড় হও নি বুঝলে।”

— “সরি দিহান ভাই আমি এইজন্য হাসছি না আমি হেসেছি অন্য কারণে। ”

— “আমার এতো কথার মাঝে তুমি অন্য কিছু ভাবার সময় পাচ্ছো? লাইক সিরিয়াসলি?এই জন্যই আরও তোমায় বলা উচিত হয় নি।তুমি কথার মর্ম বুঝো না।আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো। ”

রিনু অসহায় মুখ করে বললো
— “আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে।”

— “বাদ দাও। পরীক্ষার কয়দিন বাকি?”

— “পাঁচ দিন।”

— “এখনও কি মাথা দিয়ে সব বের হয়ে যাচ্ছে?”

— “না না ধরে বেধে রেখে দিয়েছি দিহান ভাই।”

— “গুড।চোখ যদি খাতার দিকে বেশি টাইম দেয় তাহলে আর ধরে বেধে রাখতে হবে না এমনিই থেকে যাবে।”

এরপর থেকে রিনি পুরো দমে চেষ্টা চালাচ্ছে।
কিন্তু পাগল চোখ কি কথা শুনে? সে তো চলেই যায়।তাকে বুঝানোর সাধ্যি রিনির নেই।হাল ছেড়ে দিলেও সব কূল যাবে।তাই রিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে নিজেকে সামলিয়ে পড়াশুনায় মন বসাতে।

— “রিনি।”

দিহানের ডাকে উত্তর করে রিনি।

দিহান একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলো রিনির দিকে
— “কি এটা?”

— “খুলো। ”

রিনি প্যাকেট টা খুলে দেখলো খয়েরী কালারের একটা লং গোল টপস।

রিনু খুশিতে পুলকিত হলো
— “জামা?”

— “হুম তোমার এক্সাম তাই দিলাম বুঝলে?আই গেস তুমি যেসব জামা পরো তার থেকে এই টাইপ জামায় ভালো লাগবে।”

রিনি মাথা দুলিয়ে বলে
— “আচ্ছা।”

রিনির বুঝতে অসুবিধা হলো না যে দিহান তার পোশাকগুলো পছন্দ করে না।আর দিহান ভাই যা পছন্দ করে না রিনি তা করবে? নেভার!!!! আর একদিন ও না।রিনি বাসায় গিয়ে সাথে সাথে দিহানের দেয়া জামাটা পরলো।বাবার কাছ দিয়ে টাকা নিয়ে সাথে সাথে সপিংয়ে চলে গেলো। দিহান যা পছন্দ করে সেই টাইপ বেশ কিছু জামাও কিনলো।সাথে দিহানের জন্যও একটা শার্ট কিনলো।

___________

এক্সামের মধ্যেও প্রত্যেক সাবজেক্ট কোন বিষয়গুলো ভালো ভাবে পড়তে হবে, এক্সাম কেমন কি হলো সব খবরই দিহান নেয়।এক্সাম ভালো হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলে রিনি এমন ভাবে উত্তর দেয় তাতে মনে হয় এবার বুঝি ফার্স্ট হয়ে গেলো। কিন্তু রিনির এই কথায় দিহান একদম বিশ্বাসি না।সে আছে রেজাল্টের অপেক্ষায়।

__________

রিনির রেজাল্ট দিবে এটা দিহান জানতো।দুপুরে খেতে আসতেই দিহানের সামনে মিষ্টি দিলেন রেহানা। রেহানার চোখ মুখে খুশির ঝলক।রিনিও পাশে এসে বসলো।

মুনির হোসেন বলে ওঠে
— “নাও দিহান খাও। রিনি অঙ্কে ৬১ পেয়েছে।ভাবতে পারছো?অল ক্রেডিট গোস টু ইউ দিহান।থ্যাঙ্কিউ ”

— “আল্লাহ আংকেল কি বলছেন?তবে আমি ভেবেছিলাম আরও বেশি পারবে।আমি প্রশ্ন দেখেছি।প্রায় অনেকটাই কমন পরেছে।সেই হিসাবে কমই পেয়েছে।”

রিনির খারাপ লাগলো দিহান ভাই কি তাহলে খুশি হয় নি?

— “আরে বাদ দাও এই ই অনেক। আমি এতেই খুশি।” মুনির বেশ আমেজেই বললেন।

— “রিনি মার্কশিটটা নিয়ে আসো।”

— “সাথে নিয়েই এসেছি।”

— “দাও।”

— “খুব ভালোও না খুব খারাপও না।আর এই মধ্য পরিস্থিতির মানুষদের বিপদ বেশি জানো তো?আরও ভালো চাই বুঝলে?”

রিনি বুঝতে পারল দিহান ততটাও খুশি হয় নি।

— “তবে আরও ভালো পারবে। মন খারাপ করবে না কেমন?”

এবার রিনির মন আবার ভালো হয়ে গেলো ।

মুনির আবার বললো
— “আমার মেয়েটা আগের থেকে কতো লক্ষ্মী হয়ে গেছে দেখেছো দিহান।এখন ও যা করছে পেরেছে এতেই আমি খুশি।”

রিনি মনে মনে ভাবলো দিহান ভাই তুমি না এলে বাবার মুখের কথাটা শুনাই হতো না কোনোদিন থ্যাঙ্কিউ দিয়ে ছোট করবো না।

___________

রাত ১২ টা বাজতে দেরি নেই।কিছুক্ষণ পরই দিহানের জন্মদিন। রিনি নিজেকে খুব সাজালো উদ্দেশ্য দিহানকে চমকে দাওয়া। রেজাল্ট ভালো হওয়ার খুশিতে বাবা ফোন কিনে দিয়েছিলো তাকে।ইউটিউব দেখে শাড়ি পরার তীব্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রিনি।আর মনে মনে ভাবছে কিভাবে চমকে দেয়।
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here