নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব-১

দমকা হাওয়ায় ইনায়ার চুলগুলো উড়ছে। আকাশটা ক্রমশ কালো হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে পরিবেশটা উপভোগ করছে ইনায়া। সেই মুহূর্তে নিজ খেয়ালে এতটাই হারিয়ে গেছে বাইরে বাজতে থাকা কলিং বেলের আওয়াজটা ওর কান অব্দি পৌঁছায়নি। কিছুক্ষণ পর টনক নড়লে দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল ইনায়া।

দরজা খুলতেই ইনায়াকে পাশ কাটিয়ে হনহন করে ঘরে ঢুকে পড়ল রেহান। ঘেমে একাকার হয়ে এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল ও। এমনিও অফিসে একটা ঝামেলা হওয়ায় মেজাজটা ভিষণ গরম হয়ে আছে। তার মধ্যে ঘরে এসেই তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভিত মুখটা দেখে রাগটা আরও তড়তড় করে বেড়ে যাচ্ছে!
-“এতক্ষণ লাগলো কেন দরজা খুলতে?”

রেহানের কর্কশ কন্ঠ শুনে ইনায়া কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
-“স..সরি, আসলে আমি শুনতে পাইনি।”

রেহান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকালো ইনায়ার চোখের দিকে।
-“আমি কি বাঘ না ভাল্লুক! এভাবে তাকানোর কী আছে?
রেহানের কথা শুনে কিছুটা অবাক চোখে তাকায় ইনায়া রেহানের দিকে। এই প্রথম হয়তো এত ভালোভাবে রেহানের চোখে চোখ রেখেছে ইনায়া। তবে তা বেশিক্ষণ স্হায়ী হয়নি। সাথে সাথে চোখটা সরিয়ে ফেলে ও। রেহানও আর কিছু না বলে রুমে চলে গেল।

রেহান আর ইনায়ার বিয়ের আজ প্রায় দুই মাস। কিন্তু ওদের সম্পর্কটা কোন স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতো না।
রেহান প্রথম থেকেই ইনায়াকে ইগনোর করে আসছে। বিয়ের প্রথম রাতে রেহান ইনায়ার সাথে কোন কথা না বলেই বালিশ নিয়ে ফ্লোরে ঘুমিয়েছে। ইনায়া সেদিন রেহানকে কিছু বলতে যেয়েও পারেনি। জড়তা কাজ করছিল মনে। ও কি এতোটাই ঘৃণার যোগ্য! যা হয়েছিল তাতে তো ওর কোন দোষ নেই। বলতে গেলে সেই রাতটা নির্ঘুম অবস্থায় কেটেছে ইনায়ার।
তারপর থেকে ইনায়াও রেহানের থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখে। ওর শ্বাশুড় বাড়ির সবাই যে কয়েকদিন ছিল রেহান ফ্লোরেই ঘুমিয়েছে। ইনায়ার সাথে একটা কথাও বলেনি। সবাই চলে যেতেই রেহান অন্য ঘরে ঘুমানো শুরু করে। বিয়ের পর সেদিনই হয়তো প্রথম রেহান কথা বলে ওর সাথে।
-“কখনো আমার রুমে আসবে না!”
সেদিন রেহানের নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলা কথাটা ইনায়ার কানে গেলেও মুখ ফুটে কিছু বলেনি। খুব ইচ্ছে করছিল একবার জিজ্ঞেস করতে এতটা অপছন্দ করলে বিয়ে কেন করলো ওকে। চাচী তো বলেছিল ও সব জেনেই বিয়েতে রাজি হয়েছে। তাহলে!
_______________

সকালের দিকে কড়া রোদ ছিল আর এখন বাইরে থেকে মেঘ গর্জনের আওয়াজ ভেসে আসছে। রেহানের রুমের বাইরে একরাশ আতঙ্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইনায়া। বেশ অনেকক্ষণ নিজের মনের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে দরজায় নক করে ইনায়া। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে যায়।

গুটি গুটি পায়ে রেহানের রুমে ঢুকলো ইনায়া। রেহানকে না দেখতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে একবার রুমটায় চোখ বুলালো। আজ প্রথম এ ঘরে আসলো ও। এমনিও এই বড় এপার্টমেন্টাতে সারাদিন একাই থাকে ইনায়া। রেহান আসতে আসতে প্রায়ই রাত হয়। এসেই নিজের রুমে চলে যায়। খাওয়া দাওয়াও বাইরে করে।
রুমটা বেশ পরিপাটি মনে হচ্ছে। হঠাৎ চোখটা রুমের একপাশে দেয়ালের সাথে লাগানো ছোটখাটো একটা বুকশেলফের দিকে গেল। ইনায়া মুচকি হেসে সেদিকে এগিয়ে গেল। প্রায় বেশিরভাগ বইগুলোই এডবেঞ্চার বিষয়ক। কিছুটা অবাক হলো ইনায়া। ওর শাশুড়ী বলেছিল রেহান তেমন একটা ঘুরাফেরা করে না। বইগুলো দেখতে দেখতে আশেপাশের কোন খেয়ালই নেই ইনায়ার।
ঘাড়ে কারও গরম নিশ্বাস পড়তেই স্তব্ধ হয়ে যায় ইনায়া। একটা লম্বা শ্বাস ফেলে পিছনে ফিরতেই রেহানের মুখোমুখি হয় ও। মানা করা সত্বেও রেহানের রুমে আসায় রেহান রেগে আছে না কি ইনায়া বুঝতে পারছে না। রেহানের চেহারায় রাগের কোন চিহ্নই নেই। সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইনায়ার দিকে রেহান। রেহানের মুখে আজ পর্যন্ত হয় রাগ না হয় বিরক্তিই বেশি দেখেছে ইনায়া। কিন্তু আজকেই এই চাহনি বেশ অন্যরকম মনে হচ্ছে ইনায়ার কাছে। দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। প্রচন্ড ঘামছে ও। রেহান যতই ওর দিকে আগাচ্ছে ততই ঐ রাতের সব ভয়ংকর স্মৃতি ওর মাথায় হানা দিচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে ইনায়া।চারপাশটা ক্রমশ ঘোলাটে হতে শুরু করলো। রেহানের চেহারাও ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ইনায়ার এমন ব্যবহারে খানিকটা ঘাবড়ে যায় রেহান। ইনায়ার কাঁধে হাত রাখতেই ইনায়া ছিটকে দূরে সরে যায়।
বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে ইনায়া আর হঠাৎই ফ্লোরে লুটিয়ে পড়তে নিলে কেউ ওকে জড়িয়ে ধরে।

__________________

পিটপিট করে চোখ খুলে নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করে ইনায়া। মাথাটা বেশ ভার হয়ে আছে। নিজে নিজেই উঠে বসে ইনায়া।রেহান ডাক্তারের সাথে কথা বলছিল।
কিছুক্ষণ পর বাসার দিকে রওনা দিল ওরা। পুরো রাস্তা রেহান ইনায়ার সাথে একটা কথাও বলেনি। যদিও এমনিও রেহান তেমন কথা বলে না। কিন্তু এই মুহুর্তে ওদের মাঝে বিরাজ করা নিস্তব্ধতা অসহ্য লাগছে ইনায়ার কাছে। যতই স্বাভাবিক ব্যবহার করার চেষ্টা করুক না কেন, পারে না!ওতো আগে এমন ছিল না। যথেষ্ট সাহসী ছিল। এখন কেন নিজেকে সামলাতে পারছে না! আড়চোখে রেহানের দিকে তাকালো ইনায়া। বেশ শান্ত ভাবেই গাড়ি চালাচ্ছে রেহান।
বাসায় এসেই রেহান বেশ শান্ত গলায় ইনায়াকে প্রশ্ন করলো,
-“আমার ঘরে কী করছিলে তুমি?”
ইনায়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই রেহান আরও জোর গলায় বললো,
-“মানা করেছিলাম তোমাকে আমার রুমে আসতে, আমাকে এত ভয় পেলে আমার রুমে কী করছিলে তুমি?”
রেহান হঠাৎ এভাবে চিৎকার করে কথাগুলি বলায় খানিকটা কেঁপে ওঠে ইনায়া। ইনায়াকে চুপ থাকতে দেখে রেহানের রাগটা যেন আরও বেড়ে গেল।

-“আনসার মি!”

চলবে…

#নিস্তব্ধ_বিচরণ
#তানজিলা
#পর্ব-১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here