নীলাম্বরীর প্রেমে পর্ব ৭

#নীলাম্বরীর_প্রেমে
#Tuhina pakira
পর্ব : ৭

খেতে বসে সকলে আয়ু আর স্পর্শের বাবার ছোটো বেলার কাহিনী শুনতে শুনতে হেসে মরে যাচ্ছে।

-” শোন তবে একবার কি হয়েছে। জয় আর আমি তখন ওই ধর পনেরো কী ষোলো বছরের । তখন তো আমাদের এখানে তেমন ইলেকট্রিসিটি ছিল না। তো সন্ধ্যে হলেই সবাই যে যার বাড়িতে ঢুকে পড়তো। বিশেষ করে শীতের সন্ধ্যেতে। আর আমাদের সমবয়সী কিংবা বড়ো দাদা দের নিয়ে একটা দল ছিল নাটকের। আমরা একসঙ্গে নাটক করতাম। একদিন এইরকম নাটক করে বাড়ি ফিরছি। শীতকাল রাস্তায় কেউ নেই আবার মাঠের পাশ দিয়ে বাড়ি আসছি। তো মাঠে তখন আলু হয়েছে। তখন এক বড়ো দাদা বুদ্ধি দিল এই মাঠ থেকে আলু তুলে আলুরদম করা হবে। তো সবাই মিলে আলু তুলতে লেগে গেলাম। একে অন্ধকার কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। হঠাৎ করে আমি কিছু একটার উপরে পা দিয়ে দিয়েছি। তো ওটা ছিল একটা কুকুর ওর লেজেই দিয়েছি পা। সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটা আমাদের দিকে তেড়ে এলো। আর আমরাও দিলাম ছুট।”

সকলে হাহা করে হেসে উঠলো।

-” তো এবার শিশিরের বাড়ির পিছনের বাগানে চলে গেলাম। যেহেতু আমাদের দুজনের বাড়ি সামনে তাই দুজনে চুপিচুপি বাড়ি গিয়ে রান্নার সব কিছু নিতে এলাম। হঠাৎই শিশির আমাকে বললো, ওই জয় চল আমরা বরং পাশের বাড়ি থেকে একটা মুরগি নিয়ে আসি। তারপর জমিয়ে মুরগির মাংস খাওয়া যাবে। আর দাদারাও আমাদের উপর খুব খুশি হবে। তো দুজনে চুপিচুপি চলে গেলাম পাশের বাড়ি মানে তোদের তিশাদের বাড়ি। তখন তো ওর বাবা শুভ জন্মায়নি। আর শুভর বাবা নির্মল কাকু আমাদের থেকে দু – তিন বছরের বড়ো; বেশ শান্ত , ভদ্র লোক।তবে সে আমাদের মত ছিল না। তো গিয়ে দেখি নির্মল কাকুর বাবা বাইরে বেড়িয়েছে। কী করবো কিছুক্ষণ লুকিয়ে থেকে চুপি চুপি মুরগির খাঁচাটা খুলে একটা মুরগি বার করে যেই দরজাটা দিতে যাবো পিছনে কিছু আওয়াজ হতেই শিশির তো ভূত বলে চেঁচিয়ে উঠলো। আর আমি ওর মুখ বন্ধ করতে যেতেই এদিকে খাঁচা থেকে সব মুরগি বেরিয়ে পড়লো। তখন আমি একবার ভাবছি পালাবো তো পরক্ষণে ভাবছি মুরগি গুলো ধরবো। আর এইদিকে শিশির ভূত ভূত করে চিৎকার করেই চলেছে। অপর দিকে নির্মল দার বাবা চোর – ডাকাত করে চিৎকার করছে। এতো চেঁচামেচি শুনে নির্মল দা আলো নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। অপর দিকে চোর এসেছে চিৎকারে আমাদের বাবা কাকারাও বেরিয়ে আসে। কিন্তু এই চোরেরা যে তাদের গুণধর পুত্ররা তারা তো বোঝেই নি। বাবারা আমাদের সেইদিন বেধরোপ পিটিয়েছিল। আর শাস্তি ছিল এক মাস ওই মুরগির খাঁচা আমাদের পরিষ্কার করতে হবে। অপরদিকে যাদের সামনে নিজেরা ভালো হতে গিয়েছিলাম তারা চিৎকার শুনে অন্য জায়গায় পালিয়ে যায়। আর সেই আলুগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে আলু পোড়া খেয়ে যে যার মতো বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুম দিয়েছিল। ”

আরেক দফা হাসির রোল পড়ে গেলো। দিহান হেসে উঠলো,
-” শেষ কালে মুরগি চুরি করতে না পারা চোর। হাহাহা। ”

-” সে তোরা বলতেই পারিস। তবে সেই সব দিনগুলো আমাদের কাছে স্বর্গ ছিল তাই না জয়?”

– ” যা বলেছিস শিশির। তবে তোরা এখনকার ছেলে মেয়েরা তা বুঝবি না। তোদের হাতে এখন দামি দামি স্মার্ট ফোন, বাইক , বন্ধুদের সঙ্গে আউটিং কিংবা ওই একটা গেম আছে না কি যেনো নাম?”

আয়ু হেসে বলল ,
– “পাবজি, ফ্রী ফায়ার। ”

-” হ্যাঁ ওটাই। তোরা এখন ওই সবে মত্ত। আগে বৃষ্টির দিনে চলে যেতাম খেলার মাঠে। বৃষ্টি মুখর দিনে ফুটবল, শীতের দিনে খড় দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তাপ নেওয়া। আহা কী দিন ছিল। ”

দিহান নিজের ফোন দেখিয়ে বললো ,
-” আর আমাদের স্মার্ট ফোন। আহা কী যুগ। আই লাভ এই যুগ।”

দিহানের হাতে স্মার্ট ফোন দেখে স্পর্শের বাবা ধমক দিয়ে বলল ,
-” দিহান তুই ফোন কোথায় পেলি? নিশ্চয় মা কে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছিস?”

-” না তো এটা তো মা গিফট করেছে জন্মদিনে। ”

-” যাবার সময় ফোনটা রেখে যাবি আমার কাছে। মাধ্যমিক এক্সাম শেষে এসে নিয়ে যাবি। ”

দিহান ঢোক গিলে বললো ,
-” কষ্ট করে ফোন হাতে পেলাম আর তুমি কিনা নিয়ে নেবে। এ হবে না। ”

স্পর্শের বাবা শান্ত গলায় বলল,
-” পড়িস এই সবে ক্লাস নাইনে। এখন থেকে ফোন কীসের? তোর মায়ের সাথে আমি পড়ে কথা বলছি। এইটুকু ছেলেকে ও কী করে ফোন হাতে দেয়। ”

স্পর্শের মা দিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-” আহ্ তুমি থামো তো। আর দিহান মামার কথা শোন। তোর ভালোর জন্যই বলছে। এই যে দেখ দ্রুতি ওউ তো তোর সাথেই পড়ে । ওউ তো বায়না করে ফোন নিতে পারতো তাইনা। আর আয়ু ওর কাছেও তো ফোন নেই তাইনা। আমার সোনা বাবা তুই আমার কথাও শুনবি না?”

দিহান মুখ ভার করে বললো ,
” ঠিক আছে রেখে যাবো। ”

সকলের থেকে শেষে বসে থাকা আয়ু বিড়বিড় করে বললো ,
– ” সাধে কি আমার কাছে ফোন নেই মিমি। আমি ফোনের নাম উচ্চারণ করলে আমার গাল চড়িয়ে লাল করে দেবে তোমার গুণধর পুত্র। তাও আবার নিজের উদ্যোগে। আর আমার মা তাতেই সায় দেবে। উল্টে মা ও দু ঘা দেবে। ”

-” এতো কিছু বুঝে চলিস বলেই না তোকে এতো ভালোবাসি।”

আয়ু চমকে পাশে তাকিয়ে দেখে স্পর্শ কথাটা ওকেই বলেছে তবে কানে কানে।

-” আয়ু তুই চিকেন খাচ্ছিস না কেনো?”

আয়ু মৃদু স্বরে বলল,
-” আরে চামচে করে আমার দাঁড়া চিকেন খাওয়া পসিবল না। তাই জন্যে।”

স্পর্শ কিছু বললো না। আয়ুর দিকে কিছুক্ষন কড়া চোখে তাকিয়ে ওর প্লেটের চিকেনের পিস ছোটো ছোটো করে ছাড়িয়ে দিতে লাগলো।

-” আয়ু দেখ তো রান্নাঘরে কী বেড়াল ওটা?”

স্পর্শের ফিসফিস করে বলা কথায় রান্নাঘরের দিকে তাকাতেই স্পর্শ আয়ুর প্লেটে হাত দিতে গিয়েও পারলো না। আয়ু কিছু দেখতে না পেয়ে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ” কোথায়? আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”

-” ভালো করে আরেকবার দেখ। ”

আয়ু আবার যেই অপর দিকে দেখলো স্পর্শ আয়ুর পাত থেকে বিরিয়ানির আলুটা তুলে নিয়ে আয়ুর দিকে তাকাতেই স্পর্শ দেখলো আয়ু ওর দিকে গোলগোল চোখে তাকিয়ে রয়েছে।

-” এটা ঠিক না স্পর্শ দা। ”

-” কী ঠিক না। সব ঠিক আছে। তোর আলু খাওয়া উচিত না পরে মটু হয়ে যাবি।”

কথাটা বলে স্পর্শ পুনরায় ওর বাবাদের গল্পে মন দিল। পড়ে প্লেটে তাকিয়ে দেখলো বিরিয়ানির আলু হাওয়া। আয়ুর প্লেটে তাকিয়ে দেখলো ওখানেও নেই। আয়ু কে এই বিষয়ে কিছু বলতে যেতেই দেখলো আয়ুর গাল দুটো ফুলে রয়েছে। স্পর্শ বেচারা ওকে দেখে হাসতে হাসতে হিচকি উঠে গেছে।

আয়ুর মা ওকে এক গ্লাস জল এগিয়ে বললো ,
-” সাবধানে খা স্পর্শ। আর খাওয়ার সময় আর কোনো কথা না। চুপচাপ খাও সবাই।”

স্পর্শের মা আয়ু কে আরেকবার বিরিয়ানি দিতে গেলে আয়ু মুখে থাকা খাবারটা কোনো মতে শেষ করে বললো ,
-” আমি আর খাবো না মিমি।”

-” সে কি কেনো? তুই তো ঠিক মতো খেলিই না।”

-” না আমি আর নেবো না। স্পর্শ দা বলেছে আমি নাকি মোটু। আমি নাকি স্পর্শ দার টাকায় বেশি বেশি খাচ্ছি। যাতে স্পর্শ দা ফকির হয়ে যায়। ”

-” ওই আমি কখন বললাম? মা বিশ্বাস করো আমি বলি নি।”

স্পর্শের মা চোখ রাঙিয়ে বললো,
-” তুই বলিসনি তো ও কী মিথ্যে বলছে?”

-” হ্যাঁ মা মিথ্যে বলছে। আমি খালি বলেছি মোটু হয়ে যাবি পড়ে।”

আয়ু অতীব ভদ্রের সহিত বললো,
-” দেখলে মিমি কী বললো।”

-” ওকে আমি পরে দেখছি। তুই খা তো মা। ওই শয়তান ছেলের কথা ধরিস কেনো। ও তো লেজ বিহীন একটা বাঁদর। ”

স্পর্শ রাগী গলায় বলল ,
-” মা এটা ঠিক না। ”

– ” তুই আবার বকিস। চুপচাপ খেয়ে ওঠ।”

স্পর্শ আর কিছু বললো না। চুপচাপ খেতে লাগলো। মাঝে আড়চোখে আয়ুর দিকে তাকিয়ে দেখেছে ও মিটমিট করে হাসছে। খাওয়া শেষে স্পর্শ উঠে দাঁড়িয়ে আয়ুর লম্বা বিনুনি করা চুলটা চুপচাপ চেয়ারে হালকা করে বেঁধে দিয়ে উপরে চলে গেলো।


রাত্রি 11 টা।

জল টান ধরায় বিছানার পাশ থেকে জলের বোতল নিতে গিয়ে আয়ু দেখলো আবারও ওর ঘরে
লেসার লাইট এর লাল আলো ঘরে এসে পড়ছে। আয়ু কী মনে করে বারান্দার দরজা খুলে বাইরে গেলো। যা ভেবেছে তাই। আবারও স্পর্শ।

-” কী হলো তোমার কি ঘুম পায়নি স্পর্শ দা?”

– ” আসলে আমি শুয়ে পরেছিলাম। কিন্তু ঘুম আসছিলো না। মাথায় একটা কথা ঘুরছিল। তা জানতেই তোকে ডিস্টার্ব করলাম।”

আয়ু হাই তুলে বললো ,
– ” কী কথা?”

-” এই যে তোর মাথায় কী ব্যথা আছে?”

কথাটা বলেই স্পর্শ হেসে দিল। আয়ু গাল ফুলিয়ে বললো,
-” তোমার কিন্তু ওটা করা একদম উচিত হয়নি। তুমি জানো আমি যেই উঠলাম সঙ্গে সঙ্গে চুলে টান পড়তেই কী লাগলো মাথায়।”

– ” আর তুই যে আমার নামে মিথ্যে বললি। তিলকে যে তাল করলি তার বেলা।”

-” আসলে আমাদের ‘সাহিত্যের ইতিহাস’ বইয়ে প্রবাদ প্রবচন আছে। ওখানে লেখা ছিল তিলকে তাল করার প্রসঙ্গ। আমি কেবল প্র্যাক্টিক্যাল এর মাধ্যমে ব্যাপার টা বুঝলাম। ”

আয়ুর কথায় স্পর্শ ফিক করে হেসে উঠলো।
– ” দিন দিন তুই ভারী দুষ্টু হচ্ছিস। ”

– ” তা হচ্ছি বটে। আচ্ছা আসছি ঘুম পাচ্ছে। ”

আয়ু যেতে গেলে স্পর্শ ওকে থামিয়ে বললো ,
– ” আরে শোন আরও কথা আছে।”

-” কী কথা বলো।”

– ” দাঁড়া ভেবে বলছি।”

শুভ গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎই কাঁধে কারো স্পর্শে পিছন ফিরে বললো ,
-” তুমি ঘুমাও নি?”

-” ঘুমিয়েই তো ছিলাম। হঠাৎই ঘুম ভেংগে যেতে দেখি তুমি পাশে নেই। কিছু হয়েছে তোমার?”

-” আমার আবার কী হবে; কিছুই হয়নি। আসলে পুরোনো কথা মনে পড়ছিল। ১০ বছর বয়সে বাবাকে হারাতে মা আর আমি প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। মা কষ্ট করে আইসিডিএস পরীক্ষা দিয়ে অঙ্গনওয়ারী স্কুলের কাজটা পেলো। জানো মা যখন স্কুলে যেতো বাড়িতে একা একা থাকতাম । কিছু ভালো লাগতো না। আস্তে আস্তে ওই ভাবে বড়ো হতে লাগলাম। কয়েক বছর পর স্পর্শ হলো। সারাদিন ওর সঙ্গেই আমার কেটে যেতো। আমি ওর কাকা কেউ বলতো না। সবাই বলতো দুই ভাই। পড়ে আয়ু কে নিয়ে আমাদের দিন আরও মজার কাটতে লাগলো। স্পর্শ ওকে কাঁদাতো আর বেচারি আমার কাছে বিচার দিত। সময় বয়ে গেলো। পড়াশোনা শেষে চাকরি , তোমাকে বিয়ে, আর তার পর তিশা; আমাদের পুচকি মেয়েটা। কী সুন্দর জীবন। আর কী চাই বলোতো, আর কী চাই? মা ছেলের দুজনের পরিবারে আজ সদস্য বেড়েছে। তার সঙ্গে বেড়েছে আনন্দ, ভালোবাসা। ”

-” আচ্ছা চলো ঘুমাবে। কাল তো অফিস আছে।”

নিশিতা ঘরে চলে যাচ্ছিল শুভর কথায় থেমে গেলো,
– ” আমাকে খুব ভালো বাসো না?”

-” তোমার কী মনে হয়?”

শুভ , নিশিতা কে নিজের কাছে এনে বললো ,

– “খুব ভালোবাসি তোমায়।”

-” আমিও।”

নিশিতা লজ্জা পেয়ে শুভর বুকে মুখ লুকালো। শুভ ওকে সযত্নে নিজের সঙ্গে আগলে বললো ,
-” পাগলি।”

হঠাৎই নিশিতার নজর গেলো স্পর্শ আর আয়ুর দিকে।

-” এই শুভ ওরা কি করছে? এখন কি গল্পের সময়?”

শুভ হেসে বলল ,
” বুঝলে বউ ওখানে , নতুন কোনো প্রেমময় ভালোবাসার সূচনা হচ্ছে।”

(চলবে )
{ বিঃ : ত্রুটি ক্ষমা করবেন । ভালো কিংবা খারাপ কেমন হয়েছে জানাবেন । হ্যাপি রিডিং }

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here