নীল হতে নীলান্তে পর্ব ১৪ ও শেষ পর্ব

#নীল হতে নীলান্তে
#লেখিকাঃ তামান্না
অন্তিম পর্ব

অপরপাশে- তাহলে তো আরও ভালো!
আমি তৈরী শিকার করার জন‍্য! নজর রাখো তার উপর!
আমি তাকে চাই! বিশ্রীভাবে হেসে উঠলো ব‍্যাক্তিটি!

মেরিন্ডার মুখেও মুচকি মুচকি হাসি।
আড়াল থেকে মেরিন্ডা আর তার সেই বসের সব কথাই
একজন রেকর্ড করে ফেললো তাদের অজান্তেই!
বস আর মেরিন্ডার কথায় এই বিষয়টা ক্লিয়ার যে বন্দিমেয়ে গুলোকে পাচারের সময় চলে হয়ে এসেছে।
তবে অন‍্য আরেকজনের কথা বলায় বুঝতে পারছেনা আড়ালে থাকা ব‍্যাক্তিটি! কে সেই মেয়ে! যাকে চোখে চোখে রাখতে বলা হয়েছে?
ভাবতে ভাবতেই চমকে উঠলো সে! এতো সর্বনাশ করেছে কার উপর তারা নজর দিয়েছে এখন?
ওদের হয়ে এখন অর্নিতা আর নতুন মেয়েগুলো ও আছে। কোনভাবে যদি অর্নিতার কোন ক্ষতি করে ওরা?
অর্নিতার পরিচয় জানলে তো ওরা ওকে কোনভাবেই ছাড়বে না! ভাবতেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে তার।
অর্নিতার সামনে অনেক বিপদ!
যে করেই হোক ওকে এগুলো থেকে আগলে রাখতে হবে।
____________________________

অন্ধকার একটি রুম! পিটপিট করে চোখ খুলেই নিজেকে হাত বাধা অবস্থায় পেয়ে যায় অর্নিতা!
চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে তার।বন্ধ হয়ে আসছে চোখদুটো তার। চোখদুটির সাথে যেন তীব্র যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাকে।
অনেক কষ্ট করে চোখ দুটো খুলে আশেপাশে ভালো করে চেয়ে দেখে বুঝার চেষ্টা করলো কোথায় এখন সে।
উঠতে চেষ্টা করেও ব‍্যার্থ হয়ে পরেগেল সে।
মুখ থুবড়ে ফ্লোরে পরেগেল। হাত দুটো পিছন থেকে বেধে দেওয়া! নড়া চড়া করেও যেন সে ব‍্যার্থ!
পা দুটো নাড়িয়ে এপাশ থেকে ওপাশ করতেই চমকে গেল সে! নরম কি যেন ঠেকলো তার পায়ে।
অর্নিতা পা টিকে আবার নাড়িয়ে তুললো। এবার ও মনে হলো নরম কিছু আছে তবে ওটা একটা হাত!
জুতো খুলো অবস্থায় তাই পায়ে স্পর্শ করে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে সে।
অর্নিতা বুঝতে পারছে না কি করে কি হয়েগেল এসব!
সে তো ক্লাবে গিয়েছিল। ওখানে তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়েছিল সে। এর মাঝে কিছুই তার খাওয়া হয়নি তবে কি কোল্ড ড্রিঙ্কসে কিছু মিশিয়ে খাইয়েছে?
আর কিছুই ভাবতে পারছে না মাথাটা ঘুরে উঠছে।
চোখগুলো ঝাপসা হয়ে এসেছে।
অর্নিতা বুঝতে পারলো এগুলো এনেস্থেসিয়ার প্রভাব।
বন্দিদের মুক্ত করতে এসে অর্নিতা নিজেই বন্দিদের কাতারে পরেগেল!
ভাবতে ভাবতেই অর্নিতা শুনতে পেলো কিছু পায়ের শব্দ! শব্দ গুলো এগিয়ে আসছে ক্রমশ তার কাছে।
খট করেই শব্দ হলো দরজায়। প্রবেশ করল কিছু পুরুষ!
অর্নিতা তাদের ভিতরে আসা দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। হালকা চোখ খুলে দেখে বুঝতে পারছে তার পায়ের কাছে পরে থাকা মেয়েগুলোকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
একটি মেয়ে মুখবাধা অবস্থায় ব‍‍্যার্থ ভাবে আর্তনাদ করে উঠলো মুখ দিয়ে তার বোবা শব্দ ছাড়া স্পষ্ট কিছুই বের হলো না!
তীব্র বাচার আকুতি! সবগুলো মেয়েকে একে একে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অর্নিতা চোখগুলোকে কুচকে বন্ধ করে রেখেছে । উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া মেয়েদের মধ‍্যে অনেকেই অজ্ঞান অবস্থায়। অর্নিতাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যারা তাকে নিয়ে যাচ্ছে তারা তাদের নিজেদের মধ‍্যে কথা বলায় ব‍্যাস্ত। অর্নিতাকে একটি গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোথাও।

এইদিকে দিহান অর্নিতার কাছে ফোন করছে বারবার
অর্নিতার সামনে বিপদ অনেক সে থিংচিনফু থেকে শুনেছে মেরিন্ডা নাকি তাদের বসকে অর্নিতার সম্পর্কে বলেছে। অথচ তারা দিহানকে এই বিষয়ে একবার ও জানালো না কিছুই!
দিহান তাদের সঙ্গে কথা বলে যা শুনলো তা বুঝলো তারা অর্নিতাকে সেই বসের কাছে তুলে দিবে।
দিহান দিশেহারা হয়েগেছে কিভাবে অর্নিতাকে ওদের কাছ থেকে মুক্ত করবে?

অর্নিতাকে একটি বিরাট বড় প‍্যালেসে নিয়ে আসা হয়েছে। প‍্যালেসের একটি বেডরুমে নিয়ে তাকে রাখা হয়েছে। অর্নিতাকে রেখে লোকগুলো বাহিরে চলেগেল।
ভিতরে প্রবেশ করল একজন মধ‍্য বয়স্ক পুরুষ! সঙ্গে আরো কিছু লোক!
অর্নিতার সামনে এসে দাড়িয়েছে সে।

লোকটি- বাহ! এতদিন সিনেমায় দেখতাম প্রতিশোধ নিতে কেউ আসে তার শত্রুর কাছে! আজ তা নিজের চোখেই দেখলাম! তবে আমার শত্রু যে একজন চব্বিশ বছরের যুবতি তা আমি বুঝতে পারিনি। এমন সুন্দরীকে কি করি বলতে পারো? মারতে ইচ্ছে করছে না! এক কাজ করি সারাজীবনের মত তোমাকে আমি আমার করে ফেলি কি বলো?
লোকটি অর্নিতার গায়ে হাত দিলো এবং লোকগুলো ও সাথে সাথে অর্নিতার কাছে যেয়ে তার হাত পা বেধে ফেললো……..

ঠিক তখনই ঘরে প্রবেশ করলো কিছু লোক গলায় আইডি কার্ড! আর হাতে বন্দুক! তাদের শরীরে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর পোশাক!
সেই লোকগুলোর মধ‍্য থেকে বেরিয়ে এলো অরুপ!
অর্নিতা উঠে গিয়েছে সাথে সাথে।

পাচার কারীদের সেই বস মানি জানে আলম যেন অবাকের উপর অবাক হচ্ছে!
অর্নিতার সঙ্গে দাড়ানো লোকগুলো একে একে নিজেদের ছদ্মবেশের সবকিছু খুলে ফেলল!
জানে আলম ওদের দিকে তাকিয়ে পুরোপুরি স্তব্ধ!
এসব কি?
তারা মাথার উপর দিয়ে সব যাচ্ছে।

অরুপ- জানে আলম চৌধুরী ভুল আলী আকরাম! দুবাইয়ের নামকরা একজন ব‍্যবসাহী। ব‍্যাবসাহীর আড়ালে দেহব‍্যাবসা আর মাদক দ্রব‍্যের বিরাটবড় মাফিয়া! এত বছর লোক চক্ষুর আড়ালে থাকলেও এখন আর পারেননি থাকতে।

জানে আলম পিস্তল নিয়ে গুলি করার আগেই
অর্নিতা তার বুকে গুলি করে দিল!

অরুপ সহ সবাই অর্নিতার কাজে পুরোপুরি বোকা বনেগেল!

অরুপ- অর্নিতা কি করলে এটা!

অর্নিতা- চুপচাপ দাড়িয়ে আছে যেন সে কোন ভুল কিছুই করেনি।

নিচ থেকে সবাই চিৎকার করে বলে উঠলো বোম ব্লাস্ট হবে! বোম চালিয়ে রেখেছে! যেকোন সময় ব্লাস্ট হয়েযেতে পারে।

অর্নিতা- সবাই যে যার মত নিচে চলে যান!

স্টাফ- ম‍্যাডাম তাহলে আপনারা কখন বের হবেন?

অর্নিতা- আমাদের চিন্তা না করে আপনারা নিরাপদে বেরিয়ে যান!

স্টাফ- ম‍্যাডাম একে কি করবো?

অর্নিতা- আমরা দেখছি!

স্টাফরা সবাই বেরিয়ে পরেছে যে যার মত। অর্নিতা জানে আলম এর সামনে গিয়ে দাড়ালো জানে আলম কাতরিয়ে যাচ্ছে! অর্নিতা আরও একটি গুলি করলো তার শরীরে।

অর্নিতা- আগের গুলি আমার বাবাকে নির্দয় ভাবে হত‍্যা করার জন‍্য! এখন যেটা করলাম সেটা আমার মাকে গনধর্ষণ করে নির্বিচারে হত‍্যা করার জন‍্য!
কি জানি বলেছিলি প্রতিশোধ! তাহলে শুন আরব‍্য বেদুইনরা জানের বদল জান দিতো আজ আমিও তাই করলাম হয়তো এখানে তুই একা একজন! সমস‍্যা নেই তোকে দিয়েই আমি আমার সব ষোলো কলা পূর্ণ করবো! দেখতে থাক বলেই অর্নিতা দিহানকে ইশারা করলো বোমটা সামনে আনতে। অর্নিতার হাতে দিতেই অর্নিতা তা জানে আলমের সামনে রাখলো।
ঘড়ির কাটায় তখন টিকটিক করছে হাতে মাত্র পঞ্চাশ সেকেন্ড! অর্নিতা একটা হাসি দিয়েই অরুপ আর দিহানকে নিয়ে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পরল!
দৌড়ে বেরিয়ে পরলো তিনজন রাস্তায়।
ভূমি কাপিয়ে যেন ভূমিকম্প হলো চারপাশে! একটা ব্লাস্টে পুরো ঐ অঞ্চল কাপিয়ে তুললো!
কেউ জানলো না জানে আলমের কি হলো! কেউ। বুঝতেই পারলো না কি করে একজন মেয়ে তার বাবা-মার হত‍্যাকারীকে নিজের হাতে খুন করলো।
__________________________________

অর্নিতার আর্তচিৎকারে কেপেঁ উঠলো আফসারী বাড়ী!
পাচঁ মাসের অন্তাসত্বা সে। ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো সে। চিৎকার শুনে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলেন জাহিদ আফসারী। তিনি এখন রিটায়ার্ড পারসন ঘরেই থাকেন এখন। অর্নিতার মামনি রান্নাঘর থেকে ঘাম মুছে দৌড়ে চলে এলেন দেখতে তাকে। এসেই অর্নিতার সামনে বসে পরলেন। অর্নিতাকে ধরে খাটের উপর বালিশ গুলো উচু করে বসিয়ে দিলেন তার বাবা।

মামনি- এখনো সেই আজেবাজে স্বপ্ন দেখিস?

অর্নিতা- হুম বারবার সেই স্বপ্নগুলো চোখে ভাসে।

মামনি- এইসব দেখা যে তোর কবে বন্ধ হবে! শোন তোর শরীরটা খুব দূর্বল এভাবে চললে এইসব আজেবাজে স্বপ্নই দেখে যাবি! শরীরের উন্নতি কিছুই হবে না!
দেখি পানি খাতো! আজই জামাই আসুক বাড়িতে! খাওয়ায় দাওয়ায় কোন খেয়াল রাখিস না তুই সব বলেদিব!

অর্নিতার মুখে হাসি হেসে বলে উঠলো- বলে দিও তোমার জামাইকে আমি কি কাউকে ভয় পাই?
বাবা তোমার মেয়ে কি কাউকে ভয় পায় বলো?

বাবা- না! আমার মেয়ে কাউকে ভয় পায় না! সবদিক থেকে সে এগিয়ে।
মামনি চলেগেলেন তার কাজে।

ক্লান্ত শরীরে বাসায় প্রবেশ করেছে অরুপ! অফিসের এমডি সে! একের পর এক বিপদ ছেলের উপর দিয়ে যাচ্ছে ভেবে অরুপের বাবা – মা তাকে তার গোয়েন্দা গিরির পেশা ছাড়তে বাধ‍্য করেছে। প্রথমে পায়ে গুলি এরপর দুবাইয়ের আলোচিত বোম ব্লাস্ট!
লোক সমাজে প্রশংসিত হলেও জীবন নিয়ে টানাটানি!
অরুপ ও বাধ‍্যহয়ে তার পেশা ছেড়ে বাবার প্রতিষ্ঠানের কাজে মন দিয়ে দিল।

ঘরটা কেমন খালি খালি লাগছে! সহধর্মিনী যখন পাশে থাকে না তখন পুরুষ হৃদয় নাকি একাকিত্বে ভোগে!
এতক্ষণে যদি অর্নিতা ঘরে থাকতো তার উচু পেট নিয়েই সে অরুপকে শরবত বানিয়ে দেওয়ার জন‍্য কাজের মেয়েকে দশবার ডাকতো। অরুপকে টাওয়াল ধরিয়ে দিতো ফ্রেশ হয়ে আসার জন‍্য।
কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে হালকা কিছু খেয়ে তৈরী হলো সে।

অরুপের মা- কোথায় যাচ্ছিস?

অরুপ – অর্নিতাদের বাসায়। আসতে একটু দেরী হবে।

অরুপের মায়ের মুখে মুচকি মুচকি হাসি।
দুবাই থেকে আসার পর অরুপ তাকে পাগল করে ফেলেছিল অর্নিতাকে বিয়ে করবে বলে। অরুপের কথা শুনে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান অর্নিতাদের বাড়িতে। অর্নিতার বাবাও খুশি হোন এতে। অর্নিতা প্রথমে রাজি না হলেও পরে তার বাবা জাহিদ আফসারী ও অরুপের পাগলামো দেখে রাজি হয়েযায়।

অর্নিতাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে অরুপ। প্রচন্ড ভালোলাগা কাজ করছে দুজনের। অর্নিতার শ্বেতশুভ্র হাত জোড়ায় অরুপ চুমু দিয়ে দিচ্ছে। গালে ও চুমু দিয়ে আবার জড়িয়ে ধরলো। অর্নিতাও পরম আবেসে জড়িয়ে আছে স্বামীর সঙ্গে। বিয়ের দেড় বছরের সময় এসে দুজনে শুনতে পেলো খুশির খবর!
অরুপ তো নাচোড়বান্দা কোনভাবেই স্ত্রীকে কোথাও যেতে দিবে না সে! চাকরি থেকে রেসিগেশন লেটার নিতে না বললেও কড়া ভাবে বলেছে ছুটি নিয়ে নিতে কয়েকদিন পরপর।
শশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে ঠিকমত আসতেও পারেনা বেচারি। দুইদিনের মধ‍্যেই অরুপ এসে পরে তাকে নিয়ে যেতে এখনো এসেছে তবে এবার নাকি তার সঙ্গেই এখানে থাকবে।
অরুপ অর্নিতার কপালে চুমু দিয়ে

– শাস্তি আছে!

অর্নিতা চোখ কুচকে- কি শাস্তি?

অরুপ- ফোন না ধরার শাস্তি!

অর্নিতা- আমি ঘুমিয়ে ছিলাম।

অরুপ- পরে সময় করে ফোন করতে পারতে!

অর্নিতা- শরীর ভালো ছিল না!

অরুপ – বেশি খারাপ ছিল?

অর্নিতা- না!

অরুপ- ধর্য‍্য ধরো! এইতো আর কয়েকমাস তারপর আমাদের মাঝে আমাদের বিশেষ অতিথি আসবে কেমন।

অর্নিতা অরুপের বুকে মাথা দিয়ে বসে আছে।
ভীষণ ভালো লাগছে তার এই বুকে মাথা রেখে!
উড়োচিঠির মালিক যে তার প্রিয়তম!

বৈধ সম্পর্কের বন্ধন
এক আত্মায় দুজন!!
যাক না সময় এই ভাবে
দুজন রবে দুজনাতে!!

– তামান্না

সমাপ্ত!
________________________________________________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here