নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব -১১+১২

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১১

‘থাপ্পড়ে গাল লাল করে দেওয়া উচিৎ আপনার। কারো বাসায় এসে কি ধরনের কথাবার্তা বলতে হয় তাও জানেন না দেখছি। আজব পাবলিক কোথাকার!’

আনজুমা রগরগে কর্কশ গলায় আরভীক এর মুখোমুখি হয়ে বলে। বউকে পেয়ে তার চোখজোড়া চকচকে উঠে। হাতে যেন চাঁদের আলো পেয়েছে, খুশিতে যেনো আত্মহারা। সেই দিকে বউ কি বলেছে, না বলেছে তার ইয়াত্তা নেই। বউয়ের মুখ মানে মিষ্টির ফুলঝুড়ি। তার বউ গা’লি দিলেও মিষ্টি উসুল করে খেয়ে নেওয়া যাবে। তা অবশ্যই আরভীক এর মত ছেলের কাছে স্বাভাবিক বিষয়। মেয়েটার রাগকে উসকে দিতে বলে,

‘আমি আমার বউয়ের কাছে এসেছি হেহে। কই সে!’

ভ্রু কুঁচকে সূক্ষ্ম সূচালো দৃষ্টি দেয় আরভীক এর উপর আনজুমা। কাঠিন্য গলায় বলে,

‘আপনার বউ এখানে কই থেকে আসবে! এটা কি বউ’শা’লা পাইছেন! যে চাইবেন আর এসে যাবে।’

‘কেন এখানে বউ দেওয়া হয় না!’

‘না।’

‘সে কি আমাকে তো ইনফর্ম করা হয়ে ছিল এখানে বউ দেয়। এই আমি একটা বউছাড়া কোলবালিশ নিয়ে আর কত জীবন পার করবো হে। তোমার ন্যূনতম দয়ামায়াও হয় না আমার উপর।’

‘দেখেন আপনার আলগা পিরিত বাহিরে গিয়ে মারেন বের হোন।’

‘না না খুকি মেহমান আসলে গ্রহণ করতে হয়, বের করে দিলে আল্লাহ নারাজ হবে তোমার উপর।’

চুপ হয়ে আনজুমা। তবুও কাঠিন্যতা তার মুখশ্রীতে বিরাজমান। বিউটিখালার পরিবারের দিকে তাকায়। তারা চকিত, অবুঝ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। লজ্জায় শিহরিত হলো সে। দাঁতে দাঁত চেপে আরভীককে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘আপনি আর আপনার লাপাঙ্গা ছেলেপেলে খেয়ে যাবেন।’

‘আরে খানার কথা কে বলছে, আমি বলছি বউ, বউ চাই একটা।’

‘আরেকবার বউ বললে এবার ফ্রাইপেন না সোজা পাতিলের বারি দেব। এতই বিয়ের শখ তো যান না। বিয়ে করে বউ নিয়ে পড়ে থাকেন।’

‘এক্সজেটলি এটাই তো পারছি না। আজ যদি বউ রাজি থাকতো। বিশ্বাস করো একদিনে বিয়ে করে তিনমাসে বাচ্চা হওয়ার সুসংবাদ দিতাম পুরু মহল্লায়।’

বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে আরভীক এর দিকে তাকায় সে। ব্যাটা বুঝি পাগল হয়ে গেছে! নিশ্চিত ক্লাবে গিয়ে গিলে আসছে। বিরবির করে আনজুমা চোরাচোখ ঘুরিয়ে কথাগুলো আওড়ায়। তার বিরবিরানো কথাগুলো আরভীক এর কান অব্দি পৌঁছেই গেল। সে ঠোঁট গোল করে আফসোসের সুরে বলে,

‘ছিঃ ছিঃ তুমি কি পাগল হয়ছো! এখন থেকে বউয়ের কথা ভেবে গিলাও ছেড়ে দিছি। বাসর রাতে বাচ্চার প্রসেসিং করলে তার প্রব্লেম হবে তো নাকি!’

আনজুমা মাত্রাতিরিক্ত ক্ষেপে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিল। পরের জটিল বাক্য শুনার সাধ্য নেই তার। অনবরত পটরপটর করে আরভীক বলতে থাকলে সে নিশ্চিত ভাইরাল হয়ে যাবে। বিউটিখালার সামনে মুখ ফসকে তার নামে বাঁদরামী রটিয়ে রঙরমা রমণীর পরিচিতি দিবে। যাকে চিনবে নতুন ডাকনামে বউদেবী। যিনি বউ দান করে। অথচ বউদেবী কি বউ দেবার জোঁ ও নেই তার। সে নিজেকে একা সংসার সামলায়। আর আজাইরা পাবলিক এসে বউ চাই। পাগলে ধরছে না হয় জ্বীনে ধরছে তারে।
আনজুমা কে নিশ্চুপ ভাবতে দেখে আরভীক মৃদু কণ্ঠে ডাক দেয়। থতমত খেয়ে তাকায়।

‘তোমার জ্বলছে!’

‘আমার কেন জ্বলবে। আমি কি আপনার বউ লাগি! যে সতীন খুঁজলে জ্বলে পুড়ে ছাই হবো।’

‘তুমি না জ্বললেও তোমারই জ্বলছে।’

‘দেখেন আপনি আপনার আবুলমার্কা কথা….।’

‘কিছুক্ষণ পর তুমিও টের পাবে তোমারই জ্বলছে, স্বীকারও করবে। স্বীকার না করলে আমি টেনে হিঁচড়ে করে দেব হেহেহে।’

‘মাই গ্যারান্টি আমার জ্বলছে না হাহ্।’

‘রিয়েলি….।’

সুরের টান দিয়ে শব্দটি বলে ঠোঁট বাঁকা করে দুষ্টুমি হাসি দেয় আরভীক। আনজুমার সামনে দুহাত বুকের উপর গুজে দাঁড়ায়। যেমন করে কিঞ্চিৎ পূর্বে আনজুমা দাঁড়িয়ে ছিল। সেও ভাব নিল যেন সে জ্বলবেই না। আরভীক বউ পেলেও তার কি, না পেলেও তার কি হাহ্। আকস্মিক নাকে ঝাঁঝালো পুড়া গন্ধ এসে তীব্রভাবে টনক নাড়ায় তার। পড়ে মনে করার চেষ্টা করে আসলেই কি কিছু পুড়ছে! তখন তার মাথায় আসে সে তো চুলায় শাক বসিয়ে ছিল। কপালে হাত দিয়ে তড়িঘড়ি কিচেনের দিকে দৌড় লাগায়। বিউটিখালা তখন কিচেনে শাকের চুলোয় বন্ধ করে দেয়। পাতিলটা বেসিনে পানির মধ্যে দিতেই ‘শাঁ শাঁ’ করে গরম ঝাঁঝ বেরিয়ে আসে। আনজুমা কান্নার ভাব করে পা ধপাধপ মেঝেতে মে’রে বলে,

‘সব দোষ ঐ খা’টাইশার। বদ’মাই’শ খা’টাশ কুনাইকার।’

আনজুমার চোখের অগোচরে মিটমিটিয়ে হাসে বিউটিখালা। সৌহার্দ্য আহাম্মক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। যেন এখানে চলা দৃশ্য তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আরভীক কোনো চতুর্থ পুরুষের উপস্থিতি এই মুহূর্ত অনুভব করে। ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের চোখে তাকায় সে দিকে। সৌহাদ্য তখনো নিবিড় চোখে চেয়ে ছিল আরভীক এর দিকে। অঞ্জয়,ফাহাদ ও সায়াজ একে অপরকে ইশারায় জানার আগ্রহ পোষণ করে, ‘কে এই ফোর্থ ক্লাস পোলা!’

আরভীক পকেটে দুহাত গুজে এগিয়ে এলো সৌহাদ্যের নিকট। সে স্থীরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ভাব এমন যেন তার কাছে আসায় বিন্দুমাত্র ভয়,ডর নেই। তার মতে সেও মানুষ, এও মানুষ।
আরভীক তার নিজের মত শান্তস্থীর মনভাবের ব্যক্তিকে সামনে পেয়ে মুচকি হাসি দেয়। ব্যক্তিটির কাছে হাত বাড়িয়ে বলে,

‘আইম আরভীক ফাওয়াজ এন্ড বস অফ আনজুমা।’

‘আইম সৌহার্দ্য মুকুল সান অফ মুবাশশেরা মুকুল। সি ইজ মাই মাদার।’

‘নাইস টু মিট ইউ। মিট মাই ফ্রেন্ড’স অলসো।’

একে একে বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করায় আরভীক। তারাও শান্তনীড় ভাবে কুশল আলাপে মগ্ন হলো। কথার ছলে আরভীক সৌহাদ্য কে প্রশ্ন করে।

‘তোমার ওয়াইফকে দেখছি না। তিনি কই!’

স্ত্রীর কথা বলাতে তার মুখে নেমে এলো একরাশ বিষন্নতার কালো ছায়া। এ প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার ছিল। কথায় না কথায় সবাই জানতেই চাইবে। কেননা সে বিবাহিত পুরুষ, দু বাচ্চার বাবা। তথাপি স্ত্রীর সম্পর্কে জানতে চাওয়া স্বাভাবিক বিষয়। কোমল কণ্ঠে মৃদু হেসে বলে,

‘বুড়ো পুরুষের সঙ্গে বিয়ে করে চলে গেছে।’

কথাটি শুনে নিরবতা ছেয়ে যায় রুমে। সৌহাদ্য মাথা নামিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে রাখে। দুঃখ, কষ্ট হচ্ছে হৃদপিন্ডে। যা ব্যক্তিবর্গের নিকট দেখানো অন্যায়। কষ্ট কাউকে দেখানো উচিৎ নয়। নির্মলচিত্তে জড়িয়ে ধরে আরভীক। হঠাৎ আরভীক এর জড়িয়ে ধরায় কি ছিল কে জানে! সৌহাদ্য ভরসার স্পর্শ পেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আরভীক পিঠে বার’দুয়েক হাত দিয়ে মৃদু ঘা দিয়ে বলে,

‘ব্রেইভ বয় ডাজেন্ট ফেইলার। ইউ আর লয়াল বয়। যে গেল ভুলে যাও। জীবনে যে আসবে তার অপেক্ষায় থাকো। হে তবে ভুলে না যেতে বলতে পারতাম। যদি স্ত্রীর গুণ মনে রাখার মত হতো। তোমার কথায় বুঝেছি আমি। দ্যাটস ওয়াই আই সেয়ে বি কন্টিনিউ ইউর ওয়ে। হাত ধরার কেউ হলে সময় মতো চলে আসবে।’

আরভীক এর কথা শুনে আজ বহু দিন পর হালকা মনে করছে সৌহাদ্য নিজেকে। এতদিন যেন চার দেওয়ালের মাঝে গুমরে মরছিল। মা, বাচ্চার সামনে যতই শক্ত দেখাক না কেনো! দিনশেষে সেও ব্যর্থ হয়ে মরার ইচ্ছে পোষণ করে। শখ করেই বিয়ে করছিল ঐ নারীকে। যে এখন অন্য পুরুষের অধীনস্থ। তপ্ত শ্বাস ফেলে অবিচল হাসি দেয় সৌহাদ্য। কিচেন থেকে আড়চোখে সবটা খেয়াল করেছে আনজুমা। আরভীক এর বলা প্রতিটা কথায় গুরুত্ব,সহানুভূতিতা ছিল। যা আজ প্রথমবার শুনেছে সে। এতদিন যাবত এ ব্যক্তির ফাজলামি,রসিকপূর্ণ কথা শুনে বেঁকে বসে ছিল। অতীব মুগ্ধতা অনুভব করে আনজুমার মন। আনমনে হাসে। বিউটিখালা একপলক আরভীক এর দিকে তাকায় তো আরেক পলক আনজুমার দিকে। তিনি মনে মনে প্রার্থনা করে।

‘আল্লাহ্ এই কেমিস্ট্রি যেন পূর্ণতা পাক আমিন।’

মনের আজগুবি ভাবনাকে ঝেড়ে কপাল চাপড়ে আবাইয়া টান করে পিছু ঘুরে। বিউটিখালাকে মিটমিটিয়ে হাসতে দেখে শরমে মাথানত হলো তার।
চোরের মত পাশ কেটে পুনরায় শাক রাঁধায় হাত দেয়। তিনিও মেয়েটিকে লজ্জা না দিয়ে খুটিনাটি কাজ সেরে ফেলতে ব্যস্ত হলো।
মেয়েকে বলছিল কাজের সময় আবাইয়া না পরতে। তবে মেয়ে পরেই রইল। যাও খুলে ছিল মুরগী কাটতে কেটে পুনরায় পরে নিয়ে ছিল। আবাইয়ার কারণে ঠিকভাবে কাটতে পারছিল না সে। এখন হাতের কাজ থাকায় আর খুলল না আবাইয়া। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
মুরগীর রোস্ট,পোলাও,বিরিয়ানি,পুই ও পালং শাক, সাদা ভাত, ডিমের অমলেট,ভাজা মাছ, ইলিশ মাছ, গরুর মাংসের বুনা, কলিজার বুনা, নানান ভর্তা বানিয়ে পরিবেশন করছে আনজুমা ও বিউটিখালা। রান্না শেষ করতে তিনঘণ্টা লেগেছে বটে। প্রত্যক্ষভাবে সময় মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় হতো। কিন্তু হয়নি কেননা বিউটিখালা নিজ বাসা থেকেও রান্না করে আনজুমার বাসায় আনছিল। এতে কাজ সহজ হয়ে যায়। আরভীক আদর্শ স্বামীর মত বার দুয়েক কিচেনে আসতো। যেন সে সত্যিকার স্বামী! যা আনজুমার কাছে ন্যাকামি ও বিরক্ত লাগছিল। মুখ ফুটে সকলের সামনে বলতেও পার ছিল না। বিউটিখালা যখনি কিচেন থেকে যেতো আরভীক কৌশলে প্রবেশ করবেই করবে। শাকে হাত দিতে নিয়ে ছিল ব্যস আনজুমা গরম খুন্তির মৃদু ছ্যাকা দেয় আরভীক এর হাতে। বেচারা মুখ ফুলিয়ে বলে,

‘ভালাইকা যামানাই নেহি রাহা! ভালো করতে এসেছিলাম। রমণী আমাকে ছ্যাকা দিয়ে কাঁচা বানিয়ে দিল। এখন এ হাতের ছ্যাকা কে দূর করবে শুনি।’

আনজুমা ক্ষেপে যাওয়া গলায় বলে,

‘খুন্তির ছ্যাকা কম হয়েছে! আসেন এবারেরটা মুখে লাগিয়ে দেয়।’

অতএব, লেজ গুটিয়ে তড়িঘড়ি কিচেন থেকে পালিয়ে আসে আরভীক। যাওয়ার পূর্বে আনজুমাকে শুনাতে ভুলেনি।

‘মনে থাকবে রমণী এ ছ্যাকা তোমাকেও দেব হাহ্।’

শুনে মোটেও পাত্তা দিল না আনজুমা। হিতে বিপরীত ভাব নিয়ে ‘ধুর ধুর’ করে তাড়িয়ে দিয়ে দেয়। খাবার প্রস্তুত হওয়ায় খেতে ডাকে সবাইকে। তারা এসে ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার মুখে নেই। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় তারা। আনজুমা তখন খেল না। প্লেটে সাদা ভাত ও অমলেট নিয়ে আশফিকে খাওয়াতে বসে। আড়চোখে আরভীক মা-ছেলের দিকে ঘোরলাগা নজরে চেয়ে খেয়ে যায়। সৌহাদ্য এ নজরের দৃষ্টিপাত বুঝে মুচকি হেসে তার মনের স্থানকৃত জায়গাটি মুছে দেয়। তার মন বলে, ‘ব্যক্তি রসিক হলেও মন্দ নয়। আনজুমা ভাবীর জন্য উপযুক্ত বটে।’
ধীরস্থির মনে খেতে থাকে। বিউটিখালা গরুর বুনা খাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করায় আরভীককে বলে,

‘বাবা তোমার পাশে গরুর বুনার বাটিটা একটু নিয়ে দাও।’

কেউ কোনো কথা বলেছে কিনা তাও কর্ণপাত হলো না আরভীক এর কানে। একধ্যানে মা-ছেলের দিকে তাকিয়ে খাচ্ছে। বিউটিখালা বিষয়টি আমলে নিয়ে নিজেই উঠে দাঁড়ায়। আরভীক এর প্লেটে গরুর বুনা আংশিক দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ধ্যান ফেরে তার। থতমত খেয়ে প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ওহ থ্যাংকস খালু! আমার খেতে মন চেয়ে ছিল।’

‘হুম এতক্ষণ মন অন্যদিকে ছিল।’

বিউটিখালার কথায় আরভীক কিছু মনে করেনি। তবে মাথা চুলকে হাসি দিল। বাকিরা মিটমিটিয়ে হাসে। আনজুমা খাবারের টেবিলে সবাইকে গুপ্তচরের মত ফসুরফসুর করতে দেখে এগিয়ে এলো। মেয়েকে আসতে দেখে চুপ হয়ে যায়। আনজুমা ভ্রু কুঁচকে সন্দেহময় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

‘কি হয়ছে!’

‘বিয়ে হচ্ছে!’

‘এ্যা কার!’

‘তুমি জেনে কি করবা! তুমি তোমার নাকে ঘি দিয়ে ঘুমাও। দিনদুনিয়া উল্টে গেলেও মেয়েটার খবর থাকে না।’

এমুর্হুতে অবস্থানস্থল গরম করার কোনো ইচ্ছে নেই আনজুমার। চুপ করে হজম করে নিল আরভীক এর ঠেসমার্কা কথা। তার দিকে ভস্মীভূত দৃষ্টি রেখে নিজের জন্য প্লেটে খাবার বাড়ে। আশফি খেয়ে সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে। ভাব এমন যেন পেটপুড়ে খেয়ে মোটু হয়ে গেছে। আনজুমা প্লেট নিয়ে আশফির কাছে যেতেই আরভীকরা অট্টহাসি দিয়ে কয়েক সেকেন্ডে নিরব হয়ে যায়।

২০.
‘আহ্ অঞ্জয় পেট ভারি হয়ে গেছে। এত খেলাম কেন!’

অঞ্জয় নিশ্চুপে গাড়ি চালাচ্ছে। বেচারাকে ঐ সময় ঘুমানোর জন্য বললেও। পরক্ষণে পল্টে খেয়ে চলে আসতে বলে আনজুমার বাসায়। তাও সঙ্গে ফাহাদ,সায়াজকে নিয়ে। এসে সুস্বাদু খাবার খেল বটে। কিন্তু তার ঘুম মহারাজ অতিষ্ঠ তার উপর! লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
ফ্রন্ট সিটে ফাহাদ, পিছনের সিটে আরভীক ও সায়াজ বসে আছে। আনজুমার বাসা থেকে বেরিয়ে অঞ্জয়কে সোজা ফার্মহাউজে নিতে বলে গাড়ি। যা শুনে আপনাআপনি মুখ হা হয়ে যায় ফাহাদ ও সায়াজের। তারা নিশ্চিৎ বন্ধু তাদের হাঙ্গামা করছে। এ থেকে বাঁচতে তাদেরকে আনছে! আমতা আমতা করে কেটে পড়তে নিল। যা সম্ভব হয়নি আরভীক এর জন্য। শক্ত করে চেপে ধরে দুজনকে বসিয়ে দেয়। ফাহাদ মুখ ফুলিয়ে বলে,

‘ডুড সো টাইয়ার্ড! ঘুম দিমু বাসায় গিয়া।’

‘পুলিশ মানুষের ওত ঘুমাতে নেই।’

কথাটি বলে ফোন বের করে পাবজি খেলায় মন দিল। সায়াজ ঠোঁট পাঁকিয়ে আরভীক এর গলা চেপে ধরে বলে,

‘ডুড তুই দুশমন মইরা যাহ্। শান্তিতে বাঁচতে তো দিবি না মর।’

গলা চাপছে না মালিশ করছে বুঝার চেষ্টা করে আরভীক। ফোনের পাবজি দেখিয়ে বলে,

‘দেখ ঐ পাগল এনিমি গুলি ছাড়া থাপ্পড় মারছে। এখন আমি এক গুলিতে টাই টাই ফিস করে দেব।’

বন্ধুর কথা শুনে সায়াজ গলা ছেড়ে নির্মলচিত্ত ভাব নেই। আরভীক এর দিকে হ্যাবলামার্কা হাসি দিয়ে বলে,

‘ডুড আইম জাস্ট জোকিং!’

‘বাট আইম নট জোকিং হেহে।’

প্রত্যত্তুর পেয়ে সায়াজ গর্দভমার্কা চেহারা করে ফেলে। ফাহাদ আলাপ শুনে সিটে বসা অবস্থায় হাসিতে গড়াগড়ি খেল। সায়াজের মুখটা এটুকুন হয়ে যায়। বাঁশ খেয়েছে বলে কথা। বিপরীতে ফাহাদের হাসি যেন কাটা গায়ে নুনের সিটা দিচ্ছে। ঠোঁট উল্টে ঠাসস করে মাথার মধ্যে বারি দেয় ফাহাদের। সে বারি খেয়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করে স্থীর হলো। সায়াজকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘বল এবার খুব তো উড়ছিলি।’

বাকাঁ হাসে আরভীক। সায়াজের মুখ ফাঁটা বেলুনের মত চুপসে গেল। অঞ্জয় গাড়ি থামালে
আরভীক এর ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়। সে মিছে রাগ দেখিয়ে বলে,

‘তুই আমার এনিমির মিত্র। শেষটারে মারতে গেলেই থামিয়ে দেস। ছেহ্ কোন দিন না জানি তোকেই পাবজিতে ঢুকিয়ে দেয়।!’

ফোনটি নিচ থেক উঠিয়ে পকেটে রাখে। গাড়িতে বেরিয়ে সচল পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে তারা। অঞ্জয় বসের কথা শুনে কি হলো বুঝার তাগিদে সময় নেই। মাথা চুলকে ভাবতে নিলে ভেতর থেকে উচ্চস্বরে আরভীক বলে,

‘ভাবনার রাজা পরেও ভাবতে পারবেন। ক্রিপা করিয়া ভেতরে আহিলে খুশি হতাম।’

বসের কথা শুনে তড়িৎবেগে বেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ফাহাদ ও সায়াজকে ভর্য়াত চোখে তাকাতে দেখে স্বাভাবিক রুপে দাঁড়িয়ে রইল অঞ্জয়। বসের সাথে ভয়ংকর দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত। দুবন্ধুর কাঁধে হাত রেখে শান্ত্বনার বাণী ছু’ড়ে দেয়।

‘কি করবেন কাজ সামাল দিতে প্রস্তুত হোন!’

তিনজন চোখ বুজে ব্যর্থ নিরলস শ্বাস ছাড়ে। কান বন্ধ করতে চেয়েও পারল না। রীতি মোতাবেক ক্রি’মি’নাল কে শায়েস্তা করায় চিৎকার সহ্য করা লাগবে। যে কোনো শর্তেই হোক! আরভীক গায়ে এপ্রোন,হাতে গ্লাভস,চোখে সেফটিগ্লাস,মুখে মাস্ক পড়ে নেই।ওয়াটার বেড এর সামনে এসে দাঁড়ায়। ফার্মহাউজে আসার পূর্বে অঞ্জয় গার্ড দুটোকে ওয়াটার বেড নিয়ে আসার আদেশ দিয়ে ছিল। কিন্তু তার অজান্তে আরভীক কল দিয়ে ঠান্ডা বেডকে ফুটন্ত গরম পানির বেডে বদলে দিতে বলে। গরম পানির ছ্যাকা লাগার ভয় হলেও গার্ড’স ধীরস্থিরে রুমে বেড এনে রাখে। বেডের কভারে হাত দিলেই যে কেউ ছ্যাকা খাবে নিশ্চিত!
চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় কাতরাচ্ছে সখি ও ক্লেভ! ক্লেভের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দেয় আরভীক। ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসি বিরাজমান। এপ্রোনের পকেট থেকে ইঞ্জেকশন বের করে। ওয়াটার বেডের মধ্যে পুষ করে দেয়। সখি ও ক্লেভ তাদের মরণ দেখতে পাচ্ছে। মুখ বুজে চিৎকার করতে না পারলেও ‘উম উম উম’ করে কাতরে যাচ্ছে। সখি ইঞ্জেকশন পুষ করার দৃশ্যটি না বুঝলেও ক্লেভ বুঝেছে। আরভীক দুহাত এপ্রোনের পকেটে গুজে। গার্ডকে অর্ডার করে।

‘গার্ড’স প্লিজ টেক দেম দিজ বেড।’

ক্লেভ আতঙ্কিত চোখে মাথা ‘না না’ করে প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছে। যার উপর দয়া দেখায়নি আরভীক। লোভাতুর দৃষ্টিতে হিংস্রভাবে চেয়ে আছে তাদের মরণ দেখার জন্য। যেই না ক্লেভকে বেডে রাখবে তার পূর্বেই আরভীক ‘স্টপ’ বলে। এতে থেমে যায় গার্ডের হাত। ক্লেভ চোখ বুজে ছিল। কিন্তু ‘স্টপ’ শুনে প্রাণআয়ু পেয়েছে ভেবে চকচকে চোখে তাকায়। আরভীক সেই চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে তার ঘনিষ্ঠ হলো। ক্লেভের চোখ জন্ডিস রোগীর মত হলুদ বর্ণ হয়ে গেছে, শরীর কালচে-লাল বর্ণ হয়ে গেছে, পেটের মধ্যে গুড়গুড় শব্দের তীব্রতা চারজনের কর্ণ ভেদ করছে। আরভীক বাদে বাকিরা সেই শব্দের উৎস আর কারণ খোঁজে পাচ্ছে না। ক্লেভের পেটের দিকে তাকিয়ে বাকাঁ হেসে জিজ্ঞেস করে।

‘কেমন লাগছে মাকড়সার বাপ হয়ে! প্রথমবার বাচ্চা জম্মাবে তোর। হাউ ইট’স ফিল ডু ইউ নো দ্যাট! ফিল লাইক এ হেলল!’

শেষাক্ত কথাটি জোরালো ভাবে বলে ক্লেভের পেট বরাবর বারি দেয়। যন্ত্রণায় ‘উমম’ করে উঠে ক্লেভ। সখি জিন্দা লাশের মত চেয়ে থাকে। গার্ডকে হাতের ইশারায় ওয়াটার বেডের উপর ফেলতে বলে। তারা ছু’ড়ে দেয়। সঙ্গেই দুজনের শরীর বেডের উপর ধপ করে পড়ে। পড়লেও বাঁচতো কিন্তু বেডের পানি ছিল সালফিউরিক এসিডযুক্ত। আরভীক সালফিউরিক এসিড ইঞ্জেকশনে করে আনিয়ে রেখেছিল।
দুজনের শরীর গলিয়ে খসখসে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ছাই ছাই হয়ে যায় তাদের শরীর। ফাহাদ,সায়াজ আর অঞ্জয় চুপচাপ দৃশ্যটি দেখে গেল। ভাগ্যবশত মুখে মাস্ক ছিল তাদের। ফলে তিনজনের নাকে দুর্গন্ধ প্রবেশে বাধা পেল।
তিনজন ঢোক গিলে প্রশান্তির শ্বাস ছাড়ে।
কয়েক মিনিট পর রুমের পারিপার্শ্বিক দশা নিরবচ্ছিন্ন হলো। চোখের কোণায় জমে উঠা অশ্রু হাতের পিঠ দিয়ে মুছে নেই আরভীক। দহনকৃত হৃদয়ে উদ্বেগহীন হলো। যে উদ্বেগ একবছর আগে জমিয়ে রেখেছিল। তা নিমিত্তে ইতি টেনে হাতের ময়লা ঝেড়ে ফেলল।
ফাহাদ আরভীক এর নিরবধি রুপ দেখে বাক্যহীন বন্দোব্যবস্থা করে। তার কাজ কি সেটা সে বুঝে নিয়েছে! সায়াজও বিনা বাক্যে বেরিয়ে যায়। তার হাতের নাগালে আরভীক চাবি দিয়ে ছিল। সকলের অগোচরে গুপ্ত কণ্ঠে বলে ছিল।

‘চাবি দিয়ে তোর কাবার্ড খুললে একটা ডকুমেন্ট পাবি। সেটা স্টাডি করে কালকের মধ্যে হেড নিউজ ছড়িয়ে দিবি।’

কথা মোতাবেক সে চলে যায় তার অফিসে। ফাহাদ গার্ডের সহায়তায় নোংরা বেডকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। একাকিত্বে নিরহ অঞ্জয় কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। আমতা আমতা করে বসের কাছে গিয়ে অনুনয় কণ্ঠে বলে,

‘বস আমি ভাবছি ঘুমা..।’

তার কথা পূর্ণ হতে না দিয়ে আরভীক হাত উচিঁয়ে হামি দিতে থেকে বলে,

‘খেয়ে পেট টাইড হয়ে গেছে। বউ-অবউয়ের রাঁধার হাত দারুণ মাশাআল্লাহ্। ঘুম পাচ্ছে। তুই যাহ্ আমার পদে আজ তুই বসে কাজ করবি।’

চূড়ান্ত বাণীগুলো শুনে ভোঁতা ইঁদুরের মুখ বনে গেল অঞ্জয়ের। সে নিজের মুখে আঙুল চেপে রাখে পণ করে জীবনেও আর মাঝখানে নাক কি, পুরু শরীরও গলাবে না। গলালেই তার বিপদ এমনভাবেই চলে আসে। কোথায় ঘুম দেবে ভেবে ছিল তা দিতেই পারল না। ঢুলুঢুলু পায়ে অফিসের জন্য রওনা দেয়। আরভীক সেদিক তাকিয়ে আনমনে হেসে বলে,

‘ভাই আমার আসলেই বলদ!’#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১২

‘রহস্যের তান্ডব চলছে আজ। সখি না’রী,শিশু বিক্রেতা ও আমেরিকান গার্লস ডিলার মিস্টার ক্লেভ নামের দু’ অপরাধীকে জ’ঘ’ন্যভাবে হ’ত্যা’ করা হয়েছে। কে বা করেছে তা জানতে অপেক্ষা করুন।’

‘কিঞ্চিৎ পূর্বেই নোট পেয়েছে খোঁজকারী অফিসারর্স। বছর এক আগে মিস্টার আজীব ফাওয়াজ নামের কারর্স ডিলারের সঙ্গে আমেরিকান ফেই কারর্স ডিলার ক্লেভের সাক্ষাৎ হয়ে ছিল। ইতিমধ্যে আজীবকে বছর এক আগে যে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পুনঃনিরীক্ষার মাধ্যমে জানা গিয়েছে তিনি ছিলেন নিদোর্ষ। কোর্টের মুখাপেক্ষী হয়ে এক নিদোর্ষ জীবন হারিয়ে ছিল। তিনি ছিল সৎ মানব। মিস্টার ক্লেভের মিথ্যে কারর্স ডিলের বানোয়াট প্ররোচনায় ও সখি মেয়েটির মিথ্যে প্রেমের জালে ফেঁসে তিনি হয়ে ছিলেন দোষী। আজ আসল দোষী বেরিয়ে আসলেও আমাদের নিদোর্ষ ব্যক্তিকে হারানোর তীব্র বেদনা প্রকাশ করছি। আল্লাহ্ যেন সকলের ক্ষমা খায়েম করেন। আজকের নিউজ এখানেই শেষ হলো!’

আরাজ সাহেব টিভি বন্ধ করে দিল। তার চোখের কোণা ভেজে জুবুথুবু দশা। পুরু একবছর ধরে ছেলের দোষী তর্কমা নিজের গায়ের সঙ্গে নিয়ে ঘুরছিল। আজ তার সাফল্য দেখল তিনি। তার ছেলে কখনো দোষী হতেই পারে না। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা মানুষটির কথা তখন নিতান্তই অগ্রাহ্য লেগেছিল পুলিশ ও জর্জের কাছে। আজ তারাই মাথানত করে সম্মান জানাচ্ছে। পা কাঁপছে তার। পাশে রকিং চেয়ার থাকায় ধপ করে বসে পড়ে। জোরেসরে শ্বাস ছাড়তে লাগে। ইনহেলার বের করে তীব্রভাবে ব্যবহার করে নিম্নস্থে শান্ত হয়। ভাবনায় গেল একবছর পূর্বের কথা।

২১.
‘ড্যাড আই উইল গো এন্ড কমপ্লিট আওয়ার ড্রিম।’

‘মাই সান আই ক্যান্ট সেয়ে ইউ ডোন্ট গো। বাট ডাজেন্ট নো ওয়াই মাই হার্ট ফিলিং ব্যাড ফর ইউর গোইং।’

‘ড্যাড অযথা চিন্তে করছো কেন হুম! একদম মাথা ঠান্ডা রেখে নিজের খেয়াল রাখবে। ইনহেলার টাইমমত ইউজ করবে। খাবার সময়মাফিক খাবে।’

বলেই জড়িয়ে ধরে আজীব তার বাবা আরাজ কে। ছাব্বিশ বছর বয়সী যুবক সে। আরাজ সাহেবের মন তখনো আনচান করছে। তিনি চেয়েও পারছে না ছেলেকে থামাতে। তার মনমতে, ‘কোনো অঘটন বা বিপদ সংকেত জানাচ্ছে। যা আগুন্তক।’
কিন্তু ছেলে যে মানতে নারাজ। তার মতে, ‘সে যাবেই আর গিয়ে কারর্স বিগ ডিল কমপ্লিট করে তবেই ফিরবে।’ ছেলের জন্য অশেষ দোয়া মনে গেঁথে রেখে বিদায় দিল। আজীব হাত নাড়িয়ে ‘বাই’ দিচ্ছে । তার পা মন্থরগতিতে এগিয়ে গেল ইমাগ্রেশনের দিকে। ইমাগ্রেশনে প্রবেশ করতেই ছেলের অবয়ব অদৃশ্য হলো। আরাজ সাহেবের নিলিপ্ত চোখজোড়া হতে দু’ফুট অশ্রুসিক্ত হয়। বেরিয়ে যায় এয়ারপোর্ট থেকে। বাসার উদ্দেশ্যে গাড়ি ঘুরায় ড্রাইভার। মনমরা হয়ে বসে জানালা দিয়ে প্রাকৃতিক রুপ দেখে গেল তিনি। মনে চলছে একরাশ বিচলতা,অস্থিরচিত্ততা। যা বহিঃপ্রকাশ করার সাধ্য নেই তার। ছেলেকে দূরে পাঠিয়ে ছিল তিনি বহুবার। কিন্তু আজকের এ দূরত্বে কেনো যেন তিনি পীড়া অনুভব করছে। যন্ত্রণাদায়ক পীড়া যার ফলে কোনো বিপদের আশঙ্কা পাচ্ছে। আমেরিকায় তার পরিচিতি কেউ নেই। কিন্তু আজীবের ভাষ্যমতে, ‘ক্লেভ নামের এক ব্যক্তি তার সঙ্গে ডিল করতে চাইছে। সে নাকি আজীবের কর্মে খুশি হয়েছে।’ তবুও পারেনি বিশ্বাস করতে আরাজ সাহেব নিজে। তার ধারণা এ হয়তো ভুয়া, বানোয়াট কথা। তথাপি আজীব অনুনয় ভরা গলায় আশ্বস্ত করেছিল।

‘ড্যাড বিলিভ মি! এভরিথিংক উইল গেট এমাজিংক ওয়ানডে ইন শা আল্লাহ্।’

ছেলের মায়াভরা কথায় হার মেনে নিল আরাজ সাহেব। তিনি পারেনি বুঝাতে সোশার্ল মিডিয়ায় হওয়া প্রেম,ব্যবসা সবস্তরে সাফল্য,জয় বয়ে আনে না। কখনো বিফলে ফেলে বিপদের সম্মুখে ছু’ড়ে দেয়। তপ্ত এক শ্বাস ফেলে ঘড়ির মধ্যে একপলক সময় দেখে নেয়। বিশ মিনিট পর আজীব এর ফ্লাইট টেকঅফ হবে। তার পর দেখা মিলবে একবছর পর! তাও মেলে কিনা কে জানে।
কথাটি ভেবেই বুক মোচড়ে উঠে আরাজ সাহেবের। তিনি বুকে হাত দিয়ে উত্তেজিত যন্ত্রণাকে আমলে নিতে ইনহেলার মুখে নেয়। চোখ বুজতে নিলে আকস্মিক ফোন কল চলে এলো। তিনি ফোনের স্ক্রিনে ‘আজীব’ নাম লিখা দেখে মুচকি হেসে কানে ধরে।

‘আসসালামুয়ালাইকুম ড্যাড কিছুক্ষণ পরই ফ্লাইট টেকঅফ করবে। এখন প্লেনের সিটে বসে আছি ইয়াহুউউ।’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম মাই সান টেক কেয়ার। ল্যান্ড হলেই ফোনে সিম ভরে কল দেবে।’

‘ওকে ড্যাড লাভ ইউ আল্লাহ্ হাফেজ।’

‘আল্লাহ হাফেজ।’

কল কেটে দিয়ে ফোন রাখার পূর্বেই মেডিক্যাল থেকে কল চলে আসে। যা দেখে তিনি চমকে যায়। ফোনটি কানে ধরে উদ্দীপিত গলায় শুধায়।

‘ইজ এনিথিংক পজেটিভ ডক্টর!’

‘নো স্যার আই থিংক হি উইল বি ডেড।’

‘ওয়াট! আর ইউ সিরিয়াস ডক্টর!’

‘ডোন্ট নোউ বাট ট্রাইং আওয়ার বেস্ট।’

জর্জরিত হলো অচেনা ব্যক্তির জন্য তার মন। ড্রাইভারকে গাড়ি তৎক্ষণাৎ মেডিক্যালের উদ্দেশ্য নিতে বলে। ড্রাইভার আশঙ্কাজনিত দৃষ্টি ফেললে তিনি হেসে বলে,

‘ওভাবে দেখতে হচ্ছে না। পরিচিত এক মানুষের জীবন থেমে আছে। তাকে দেখতে যাবো।’

ড্রাইভার শুনে মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিল। গাড়ি ঘুরিয়ে মেডিক্যালের পথে নেয়। কিন্তু সমস্যা হলো মেডিক্যাল পথের ডান মোড়ে বিশাল জ্যাম পড়েছে। কখন খুলবে তার ইয়াত্তা নেই। ফলে তিনি ড্রাইভারকে আদেশ দেয় জ্যাম শেষে মেডিক্যালে আসতে। সে সুপ্তমনে কথার উত্তরে ‘জ্বি স্যার’ বলে গাড়িতে অপেক্ষারত থাকে। আরাজ সাহেব বেরিয়ে সামনে হাঁটা ধরে। মন্থরগতির পরিবর্তে তার পা দ্রুতবেগে চলছে। যেন আজ সময় বিলম্ব হলে প্রিয় কারোর প্রাণ নিমিশেষে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে যাবে। জ্যামের ফুটপাতে এসে থামে। রোডে ট্রাফিক পুলিশ নেই। ফলে জ্যাম ধরেছে। তিনি কৌশলে রাস্তা পার করে মেডিক্যালে ঢুকে পড়ে। অচেনা ব্যক্তির অপারেশন কেবিনের সামনে এলে চিকিৎসায় অধীনস্থ ডক্টরের মুখাপেক্ষী হয়। তিনি আরাজ সাহেবকে দেখে শান্ত মনে তার কেবিনে নিয়ে যায়। ‘বসতে’ বলে তিনিও বসে পড়ে। হাতজোড়া টেবিলের উপর রেখে গুরুত্ব সহকারে বলে,

‘পেশেন্টের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। মাছ যেন তার শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে খেয়েছে। তার শরীরে তিন-চার পাশে গভীর ঘাও দেখেছি। মনে হচ্ছে কেউ ধারালো অস্ত্র দিয়ে তীব্র আঘাত করেছে ব্যক্তির শরীরে। তাও সেরে যাবে। তবে নিউ ফেইস লাগবে। পেশেন্টের ফেস জ’ঘ’ন্যভাবে কাটা হয়েছে। এ ক্ষত ছাড়লেও ব্রেনের ক্ষত ছাড়াতে আমি অক্ষম।’

প্রতিটা কথা মনযোগ দিয়ে শুনছে আরাজ সাহেব। শেষাক্ত কথায় তার হৃদপিন্ডে কষ্ট অনুভব করে। ডক্টর দেখেও ক্ষুণ্ণ রইল। আরাজ সাহেব শুকনো ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করে।

‘ব্রেনের ক্ষত ছাড়বে কেমনে!’

‘সেটা এখনো বুঝছি না কারণ পেশেন্ট রেসপন্স করছে না। তার ফ্যামিলি আছে কি নেই সেটাও জানা যায়নি। পেশেন্টের পকেটে শুধু এক টুকরো কাগজ ছিল। সেটি আমি দিচ্ছি।’

কথাটি বলে ডক্টর ড্রয়ার থেকে কাগজটি নিয়ে আরাজ সাহেবের হাতে দেয়। কোনো পথ পাবে ভেবে যেই না কাগজটি খুলে। কাগজে লেখা দেখার পর তীব্র ব্যর্থতা প্রকাশ করে। সেখানে গোটা অক্ষরে লিখা ছিল, ‘ভালোবাসি প্রণয়োণী’।
তিনি ক্লেশকর চাহনী নিয়ে প্রশ্ন করে।

‘এখন কি হবে!’

‘অপেক্ষা করুন। তার ব্রেনের অপারেশন হওয়ার পর জানাবো হবে। শরীরের ক্ষত আর মুখের অপারেশন করার পরই আমরা ব্রেনের অপারেশন করব। বাট ইটস অল ডিপেন্ড অফ রেসপন্স! সে এখন কোমায়।’

ডক্টর কথার সমাপ্তি টেনে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আরাজ সাহেব উদাসীন চাহনী নিয়ে কাগজটির দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো এক তরুণ বয়সে তিনিও চিরকুটে লিখে প্রেয়সীকে দিতো। যেখানে লিখা থাকতো, ‘ভালোবাসি বাবুর মা!’

তিনি কিছুক্ষণ নিজেকে নিরবতায় গুটিয়ে নেয়। জানেনা এর পরিণতি কি হবে। মেডিক্যাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে।

কয়েকমাস পর….

আজীব আমেরিকায় পৌঁছে সেই যে কথা বলে যোগাযোগ করে ছিল। তার পরে আর যোগাযোগ রাখেনি। কি হয়ে ছিল কিছু বলেনি সে! কল দিলেই কর্কশকণ্ঠে মেজাজের গরম দেখাতো। বাবা হয়ে তিনি প্রত্যক্ষপক্ষে রাগ দেখায়নি। কেননা ছেলে দূরদূরান্তে কাজ করছে। মনমেজাজ ভালো না থাকতেই স্বাভাবিক। তাই বলে তিনি তো আর মুখ লটকিয়ে বসে থাকতে পারে না। মাসে একবার হলেও ফোন দিতো তিনি। আজীব চাইলে রিসিভ করে দু’তিন মিনিট কথা বলে রেখে দিতো, মাঝমধ্যে তাও রিসিভ হতো না। তবে আজ ছেলে স্বেচ্ছায় ফোন দিয়েছে। এর চেয়ে খুশির কথা আর কিই হতে পারে আরাজ সাহেবের কাছে। আজীব কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,

‘ড্যাড আইম ইন লাভ!’

‘মাশাআল্লাহ্ কে সেই বউমা!’

‘বাট ড্যাড হেয়ার ইজ ওয়ান ট্রুথ হার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ইজ নট মাচ রিচ।’

আরাজ সাহেব ছেলের কথায় হেসে দেয়। তিনি আশ্বস্ত গলায় বলে,

‘বউমায়ের ফ্যামিলি মধ্যবিত্ত এটাই বলতে চেয়েছো রাইট! নো প্রব্লেম। আই উইল একসেপ্ট ইউর ড্রিমগার্ল।’

‘থ্যাংকস ড্যাড লাভ ইউ এন্ড হার নেইম ইজ সখি মেহতাব।’

‘নাইস নেইম। কবে আসবি তোরা!’

‘ড্যাড তার পরিবারে কেউ নেই মুসলিম নারী একা ভিনদেশে পড়ে রয়েছে। তার পার্সপোট বানিয়ে আসব।’

‘ওহ তোর ডিল হলো!’

‘নো ড্যাড আরো তিন মান্থ ওয়েট করতে হবে।’

‘ওকে বেস্ট অফ লাক।’

কথা শেষ করে শান্ত পেল আরাজ সাহেব। ছেলে তার প্রেমে ফেঁসেছে বলেই কল রিসিভ করে না। ভেবেই হেসে পেল তার। ছেলে আর তার বউয়ের আসার অপেক্ষার প্রহর গুণছে। তারা এলেই বিয়ের বরণডালা নিয়ে গ্রহণ করবে।
কিন্তু তিনমাস পর কোনো এক ঝড় এলোমেলো করে দিল আরাজ সাহেবের মনোভূতি। টিভির নিউজে আমেরিকার চ্যানেলে আজীবের দুনার্ম রটানোর দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। তার ছেলে নাকি ই’য়া’বা ডিলার, নারী পা’চা’র’কারী,ধর্ষক। অবিশ্বাস্য কথা শুনে আরাজ সাহেবের হাত-পা কেঁপে চলছে ক্রমান্বয়ে। তিনি ঢোক গিলে আপনমনে আওড়ায়।

‘না না আমার ছেলে এসব করবেই না। এটা ফেইক নিউজ।’

তিনি ফোন নিয়ে কথা বলতে নিলেই দেখে আজীবকে মেরে ক্ষতপূর্ণ করে টেনেহিচঁড়ে জেলবন্দি করা হচ্ছে। আরাজ সাহেব উম্মাদের মত টিভির স্ক্রিনে বারি দিয়ে বলছে,

‘না না ছাড়ো তোমরা। আমার ছেলে নিদোর্ষ। সে এমনটা করতেই পারে না।’

জোরালো আঘাতের স্বর রুমের বাহির পর্যন্ত যাওয়ায় বাসার মেইড’স এসে দৃশ্যটি দেখে নেয়। ফলে তারা তোড়জোর করে আরাজ সাহেবকে ধরে শান্ত করে। কিন্তু বাবার মন আদৌ শান্ত হবে!
ছেলেকে টেনেহিচঁড়ে নেওয়ায দৃশ্যে আজীবের ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ তার কানে কর্ণপাত হচ্ছে। আজীব কেঁদেকুটে বলছে,
‘আইম ট্রান্সপারেন্ট, ইনোসেন্ট, আই ক্যান্ট ডু অল অফ দিজ। প্লিজ অফিসারর্স বিলিভ মি।’

আজীবের কথা শেষ না হতেই ‘সখি’ নামের মেয়েটিকে টিভিতে দেখানো হলো। তাকে পুরুপুরি বিবস্ত্র, বিধ্বস্ত চাহনীতে দেখাচ্ছে। সে তার সম্মান বাঁচানোর লক্ষ্যে নিজের শরীর ঢেকে চিৎকার করে বলছে,

‘হি ইজ ক্রি’মি’নাল স্যার! হি ইজ রেপ’ড মি। হি ইজ দ্যা ড্রাগ ডিলার। প্লিজ এরেস্ট হিম এন্ড হ্যাংইড হিজ লাইফ।’

আজীব তাজ্জব, ছলছল দৃষ্টিতে তার প্রেয়সীর মুখপানে চেয়ে ছিল। ভাবেনি ভালোবেসে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হবে। সে শুধু চোখ বুজে তার নিদোর্ষতার বাণী আওড়ে যাচ্ছিল। টিভির স্ক্রিনের দৃশ্যপট দেখে সহ্যসীমা হারিয়ে ফেলে আরাজ সাহেব। অজ্ঞান হয়ে নেতিয়ে পড়ে। এতে অবিচ্ছেদ্য তোড়জোড় লেগে পড়ে মেইড’দের মাঝে। তারা আরাজ সাহেবের জ্ঞান ফেরাতে ব্যস্ত। টিভির স্ক্রিনে হওয়া ঘটনায় তারাও কষ্ট পেল। কিন্তু অন্যায়কারী না হয়েও যার ফাঁসি হবে তার জন্য মন থেকে দোয়া করল তারা। তারাও বিশ্বাস করে, তাদের আজীব স্যার কখনো ঘৃণ্য কাজগুলো করবে না। কিন্তু প্রমাণের অভাবে নিশ্চুপে দেখে গেল।
আজীব রিপোর্টারের ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ছলছল কণ্ঠে বাংলা ভাষায় বলে,

‘ড্যাড আমি নিদোর্ষ, তোমার ছেলে জ’ঘ’ন্য কাজ করতে পারে না। তুমি হলে বিশ্বাস রেখো। বেঁচে থাকলে তোমার চরণে আজীবন কাটিয়ে দেব। আর বেঁচে না থাকলে পরকালে তোমার চরণে ক্ষমা চাওয়ার অপেক্ষায় থাকব আব্বু। ভালোবাসি তোমাকে। আর কেউ বিশ্বাসী নয়। তোমার কথা অমান্য করাতে ক্ষমা করিও আব্বু। ড্যাডডড…।’

২২.
‘আজীব’ বলে চিৎকার করে জেগে উঠে আরাজ সাহেব। চোখ বুজে ঘুমন্ত অবস্থায় অতীতের কালো চিত্র ভেদ করেছে তিনি। পুনরায় টিভির চ্যানেল পরিবর্তন করে। দেখে ক্লেভ ও সখির মৃত্যুর কার্য। নোট করা ফাইলের থেকে সকলে তাদের আসল অপরাধী ও নিদোর্ষ ব্যক্তির মুখাপেক্ষী সম্পন্ন করেছে। পুলিশ অফিসার ফাহাদ আকবার রিপোর্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্র সহিত কণ্ঠে শুধায়।

‘আজীব ফাওয়াজ কখনো দোষী ছিলেন না। তিনি অপরাধীদের ষড়যন্ত্রের বশীভূত হয়ে নিজের মায়াময়ী জীবন হারিয়েছিল। এর জন্য যে শুধু ঐ দু’অপরাধী দোষী ছিলেন তা নয়। দোষী আমরাও। আমেরিকার জনগণ ও কোর্টের সামান্য ভুলের দ্বায়ে আজ আজীব স্যার আমাদের মাঝে নেই। আমেরিকার কোর্টের জর্জ নিজমুখে স্বীকারোক্তি দিবেন বলে জানিয়েছে।’

আরাজ সাহেব দেখে তড়িঘড়ি টিভির চ্যানেলের ভলিউম বাড়িয়ে দেয়। আমেরিকার জর্জ এসক্রট সাহেব অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে মাথানত করে আজীব সাহেবকে উদ্দেশ্য করে ইংরেজিতে বলে,

‘উই অল আর প্রে ফর আজীব। এন্ড অলসো সরি ফর হিম এন্ড হিজ ফ্যামিলি।’

আরাজ সাহেব উম্মাদের মত উল্লাসী হয়। টিভি বন্ধ করে নিম্নস্বরে বলে,

‘বাবা আমার আজীব বাবা তুই নিদোর্ষ, প্রমাণিত হয়েছে বাবা। আমি জানতাম আমার ছেলে দোষী হতে পারে না।’

ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয় তিনি। ধপ করে বিছানায় বসে আহাজারিতে ছটফট করতে থাকে। এতদিন পর ছেলের নিদোর্ষতা রায় ফেলেও। তার সন্তান, তার রক্ত কাছে নেই। মাটির কবরে শায়িত হয়ে আছে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
ঐ অতীতে ঘটা দৃশ্য ভুলার মত নয় আরাজ সাহেবের কাছে। তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ছিল ছেলেকে নিদোর্ষ প্রমাণ করার। কিন্তু কেউই শুনেনি তার কথা। দেশ থেকে আমেরিকায় গিয়ে ছিল ছেলেকে শেষবার জড়িয়ে ধরতে। ঐ শেষবারই আজীব কেঁদে ছিল। মায়ের কাছে চলে যাচ্ছে বলে। আরাজ সাহেব শুনে আকাশচুম্বী যন্ত্রণায় ফেটে পড়ে ছিল। কি নিদারুণ যন্ত্রণার দৃশ্য! ছেলে নিদোর্ষী হয়েও ফাঁসি পেল তখন। ছেলের ফাঁসির দিন দেখা করার সুযোগ দেয়নি কোর্টের লোকেরা। তারা একদমে ফাঁসির কার্য শেষে ছেলের লাশ ঢেলে দিয়ে ছিল আরাজ সাহেবের বুকে। তিনি মাঝরাস্তায় ছেলের লাশের বুকে মাথা রেখে কান্না করে জ্ঞান হারিয়ে ছিল বারংবার। যে কান্না করে মায়েরা জ্ঞান হারায়। সেই ধরনের কান্না করেছিল। দেশের মাটিতে শায়িত করা হয় আজীবের দেহকে। পরম শান্তিতে আদৌ ঘুমিয়ে আছে তার ছেলে।
অতীত ভেবে পুনরায় উল্লাসী হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তিনি।

২৩.
রুমের বাহির থেকে আরভীক নিজের সচল অশ্রুজল মুছে নেয়। বাবার উল্লাসে আজ তার প্রাণভরে এলো। প্রতিশোধ পূর্ণ করেছে সে! তার কার্য রাজত্ব সে নিজ হাতে গড়েছে। তার ইশারায় এসে ছিল ঐ ট্যুরিস্ট সাধুবেশে ক্লেভ আর তারই ইশারায় নেচে ছিল ঐ সখি। যাদের কে সে নিজ হাতের মুঠোয় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মরণযন্ত্রণা দিয়েছে। রাত প্রায় বারোটা।
বাবার রুম থেকে এসে সে শান্তপণে শুয়ে পড়ে। ফোন বের করে ভিডিও কল দেয় ডুড’স গ্রুপে।
যেখানে তারা চারবন্ধু আছে। ফাহাদ,সায়াজ,অঞ্জয় আর সে।
ফাহাদ ও সায়াজ সঙ্গেই রিসিভ করে ভিডিওকলে আসে। অঞ্জয় বেচারা ঘুমে কাদা। তার কানে মেসেঞ্জারের রিংটোনও ঢুকবে না।
আরভীক এর মুখশ্রীতে জয়ের হাসি দেখে ফাহাদ বলে,

‘ডুড আঙ্কেল কেমন আছে!’

‘ভালো আলহামদুলিল্লাহ। রুমে আহাজারি ভরা কেঁদেছে। কাদুঁক আজ থামায়নি। কিছু কান্না ঝরাতেই হয়। আজীব ভাই জীবনে যে পাপ না করেই সাজা পেয়েছিলেন। গতরাতে সেই পাপের সাজা আমি নিজ হাতে দিয়েছি দুজনকে।’

চোখ বুজে নেয় সে। সায়াজ তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলে,

‘ডুড ইউ আর দ্যা হিরো।’

‘ইয়েস ডুড তোর মত সন্তান সবার ঘরে জম্মাক। আমার মত পুলিশ ও সায়াজের মত অভিজ্ঞ রিপোর্টারের কাছেই যেখানে কোনো নিখুঁত প্রমাণ আসেনি। সেখানে তুই ক্ষুদ্র কারর্স কোম্পানির ডিজাইনার এন্ড ডিলার সিইও হয়ে সবটা কৌশলে হাতিয়েছিস। ইউ আর গ্রেট বয়।’

‘যাহ্ দুষ্টু লজ্জা দিতে নেই। মাশাআল্লাহ্ বলবি যে।’

লাজুক হেসে আরভীক মুখ ঢেকে নেয়। থতমত খেয়ে যায় ফাহাদ ও সায়াজ। তারা একে অপরের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে অট্টহাসি দিয়ে উঠে। তার বন্ধু যতই সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কাজ করুক না কেনো! পরিশেষে সে রসিকতা দেখাবেই। হয় কৌশলে, না হয় চলচাতুরে!
আধুনিক জাতের বেডবয় বলে কথা। আরভীক ও তাল মিলিয়ে হেসে পুনরায় নিশ্চুপ হলো। শান্ত কণ্ঠে বলে,

‘তোর মনে আছে সায়াজ! তোকে আমি ট্যুরিস্ট হিসেবে ইনভাইট করতে বলছিলাম দেশবিদেশের প্রখ্যাত মানব-মানবীদের!’

অবাক দৃষ্টিতে সায়াজ বলে,

‘হে তাতে কি! কথাগুলো তো বহুত মাস আগের।’

‘হুম সেই ট্যুরিস্ট লিস্টে ক্লেভকে তুই ইনভাইট করেছিলি!’

সায়াজ ভাবান্তর হলো। কিন্তু যখন মনে পড়ল সে তো ক্লেভ নামের ঐ মানুষকে আমন্ত্রণ জানায়নি। ফলে সে তৎপর গলায় শুধায়।

‘না না ডুড আমি তো ওরে ইনভাইটই করিনি।’

কথাটি শুনে মৃদু হেসে দেয় আরভীক। ভাবপূর্ণ কণ্ঠে বলে,

‘আমিই তাকে মরণের দাওয়াত দিছিলাম। তার সঙ্গে ঐ সখিকেও। যাকে নিজের হাতের জালে একটুর জন্য বন্দি করে ছিলাম। সেখানেও দুজনে চলচাতুরী কে একে অপরের সঙ্গে টুনাটুনির সংসার পাততে পালাচ্ছিল। আমার ভাইয়ের রক্ত চুষে নেওয়া দুজনকে কেমনে আমি বাঁচতে দিতাম।’

দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র ক্রোধ দমানোর চেষ্টা করে আরভীক। পুনরায় বলা আরম্ভ করে।

‘ফলে আজীব ভাইয়ের কেসের ফাইল নিয়ে স্টাডি করি। আমেরিকায় পরিচিত মানুষ দিয়ে খোঁজ লাগায় ব্যাপারটায়। তখনি জানছি ক্লেভ নারী পা’চারকারী ও ড্রাগ ডিলার, সখি তার প্রেমিকা এবং নারীর সন্ধান দিয়ে নারীকে নিখোঁজকারী মহিলা।’

ফাহাদ ও সায়াজ শুনে তাদের মাথায় হাত এসে গেল। বিশ্বাসই করতে পারছে না তারা। তাদের বন্ধু কতদূর পর্যন্ত চলে যেতে পারল! আর তারা টেরই পেল না। দুজনে গর্বের সহিত এক হাত দিয়ে তাদের কাধে তালি দিয়ে দেখায় ভিডিও কলে আরভীককে। আর বলে,

‘প্রাউড অফ ইউ ডুড। নাউ আইম ফিলিং স্লিপি ডুড। আল্লাহ্ হাফেজ।’

‘মি টু আরভীক আল্লাহ্ হাফেজ।’

‘আল্লাহ হাফেজ তোদেরকে।’

কল কেটে শুয়ে পড়ে। কাল অফিসে যেয়ে কাজ দেখতে হবে। অঞ্জয় বেচারার নাতী ফাইলের উপরই কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে। সকালে গিয়ে কাজ ধরে আনজুমাকেও তার জ্বালাতে হবে। একমাত্র বউ বলে কথা।
ভেবেই দাঁত কেলিয়ে হাত-পা নাড়ানি দিয়ে কোলবালিশকে চেপে ধরে। যেন সে কোলবালিশকে নয় আনজুমাকেই চেপে ধরেছে। বার দুয়েক চুমু দিয়ে দুঃখী চোখে বলে,

‘কিছু মনে করিস না তোর ইজ্জত নেবো না। হালকা পাতলা চুমু খাবো বউকে ভেবে। উমমমম্মাহ্।’

চুমু খেয়ে কোলবালিশের মাথায় মাথা রেখে চোখ বুজে নেয় আরভীক।

চলবে…

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here