নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব -১৫+১৬

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৫

‘ডুড হেডমাস্টার তো বলল তার মেয়েরে কিডনাপ করা হয়ছে! এটার জন্যে তোকে কেন ডাকছে। পুলিশ কমপ্লেইন করতো।’

ফাহাদের কথা আরভীক এর কর্ণপাত হতেই সে ভ্রু নাচিঁয়ে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নেই তার বন্ধুর। সে থতমত খেয়ে যায়। ভুলেই গেছিল সেই তো পুলিশ তাও আবার সিআইডি অফিসার। সে তার বন্ধুর দিকে তাকায়। হেডমাস্টারের রুমের ঢুকার আগে ও বের হওয়ার পর থেকে আরভীককে ভাবলেশনহীন দেখাচ্ছে। যেন সে গভীর মনে কোনো পরিকল্পনা কসায় ব্যস্ত। সায়াজ ইতিমধ্যে ট্রাফিক রোডের সামনে চলে আসে। আপাতত তাকে নেওয়ার জন্যে এ ব্যস্ত রাস্তার ধারে আসা। সায়াজ গাড়িতে উঠে তৎপর গলায় শুধায়।

‘সরি সরি আইম লেইট। ইজ এনিথিংক ফিনিশ!’

ফাহাদ নাবোধক মাথা নেড়ে নেতিবাচক ইঙ্গিত দেয়। সায়াজ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বেচারা ঘুমকাতুরে। রাতে বহু দেরি করে ঘুমানোর কারণে সাতসকালে চোখ খুলতেই পারেনি। অন্যথায় এলার্ম বেজে উঠলে হাত চালিয়ে বন্ধ করে দেয়। ঠিক এগারোটা বেজে জাগতে পেরেছে। ঘড়ি দেখে হা হুতাশ করে প্রস্তুত হয়ে বাসার সামনে আসার জন্য অনুরোধময় বার্তা পাঠায় আরভীককে। সে তার ড্রাইভারকে তাই করতে বলে! লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
কিন্তু ভেবেছিল গাড়িতে মসমাস্তি চলছে! যা ছিল সায়াজের অবাস্তব কল্পনা। গাড়িতে নির্জীব অবস্থা ভরপুর। আরভীক যে সবটা সময় রসিকতায় কাটিয়ে দিতে পারে। সেই আজ নিশ্চুপে কিছু ভেবে চলছে। সায়াজ হাত নাড়িয়ে ধ্যান ফেরায় তার। সে মাথা নেড়ে ‘কি’ বোঝায়।

‘ডুড আগে গাড়িতে কত মসমাস্তি করতাম! তুই নিজেই ছিলি লিডার। আজ এত চুপচাপ কেন!’

‘নাথিং।’

‘সি ডুড উই আর বেস্ট ডুড এভার! শেয়ার আস।’

ক্লেশময় চাহনী নিয়ে সে ফাহাদের দিকে তাকায়। ফাহাদ তার বন্ধুর চাহনী দেখে সায়াজকে বলে,

‘লিসেন ডুড আমি বলি!’

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা…..

হেডমাস্টারের রুমে নক করে আরভীক। মুখশ্রী তখনো গাম্ভীর্যতায় ভরপুর তার। কারণ আনজুমাকে ফোনের মধ্যে রুডভাবে নিষেধ করেছে। এতে হয়তো মেয়েটা সাময়িক কষ্ট পেয়েছে। সে চাইনি রুডলি বিহেভ করতে। তবুও শ্রেয়ার কারনামা সে ভালো করে জানে। ক্লাবে চড় মেরে ছিল। বিধেয় ডেঞ্জারাস মেয়ে চুপ করে বসে থাকার নয়।
হেডমাস্টার সিসিটিভি ফুটেজে দরজার বাহিরে আরভীক ও ফাহাদকে দেখে খোশমনে ভেতরে আসতে বলে। তারা এসে ভদ্রতার সহিত বসে। হেডমাস্টার কে সালাম দিয়ে আরভীক বলে,

‘আপনি কি এমন জরুরি কাজের জন্য ডাকলেন! যার জন্য আমার থেকে সূদুর মাহদিপুর শহর থেকে আলখেল্লাপুরে আসতে হলো।’

কথাটি শুনে মিইয়ে গেল হেডমাস্টারের মুখশ্রী। বয়স্ক পুরুষ,চুলে পাক গজেছে,মোটা ফ্রেমের চশমাটি খুলে টেবিলের উপর রাখে। দৃষ্টিনত করে ঠোঁট কামড়ে জিজ্ঞেসা করে।

‘তোমরা আগে বলো বাবা আমার কাজটা কি করে দিতে পারবে!’

‘আপনি আমাদের গুরুজন। বলে দেখুন নিরাশ হবেন না।’

আরভীক এর কথায় আবেগী হয়ে গেল হেডমাস্টার। আকস্মিক ফাহাদ ও তার ডান হাতজোড়া ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ভেবাচ্যাকা খেয়ে যায় তারা। তড়িঘড়ি আরভীক তার স্যারের পিঠে হাত বুলিয়ে সহায়তার আহ্বান জানায়। দৃঢ় কণ্ঠে শুধায়।

‘ভেঙ্গে পড়বেন না। পরিবেশ সামলাতে খাপছাড়া হওয়া যাবে না।’

আরভীক এর কথায় হেডমাস্টার অতীব কষ্টে বলে,

‘আমার মেয়েটিকে কয়েকজন বখাটে ছেলে তুলে নিয়ে গেছে। ওদের মধ্যে বখাটের লিডার হচ্ছে যাবের। তার কুনজরের স্বীকার আমার মামুনি। সে তাকে তোলে নিয়ে গেছে বিয়ে করতে। তোমরা প্লিজ তাকে বাঁচিয়ে আনো। এই উপকারের কৃতজ্ঞতা আজীবন বহন করব।’

‘আপনার মেয়ে কাউকে ভালোবাসে!’

কথাটা আড়চোখে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে। সে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে আরভীক এর বলা কথাটির অর্থ খোঁজে লাগে তার মনে। কিন্তু এই চোখভরা রহস্যে মানুষের ব্রেনের কল্পনা জাস্ট ইম্পসেবল!
আরভীক এর কথায় কান্না থামিয়ে দিল হেডমাস্টার। টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটি নিয়ে ঢকঢক করে পুরু গ্লাসের পানি খেয়ে নেয়। আরভীক এর কথার বিপরীতে উত্তর দিল।

‘মামুনিকে জিজ্ঞেস করলেই বলতো তার ভালোবাসা আছে। সে এবা…..।’

হেডমাস্টারের পরের বাক্য বেশ ভালো আন্দাজ করেছে আরভীক। সে তাকে থামিয়ে তাড়াহুড়োর সাপেক্ষে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘তোকে কি আসার জন্যে ইনভাইট করতে হবে!’

ফাহাদ তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে যায়। আরভীক তার স্যারের হাত ধরে আশ্বস্ত গলায় বলে,

‘ডোন্ট ওয়ারি স্যার বিয়ে হবে আপনার মেয়ের তবে যাবেরের সঙ্গে না। যার সঙ্গে আমার মন চাইবে তার সঙ্গেই আপনার মেয়ের বিয়ে করিয়ে জামাইবাবুকে নিয়ে আপনার সামনে হাজির হবে।’

হেডমাস্টার হতবাক হয়। ক্ষণিকে হেসে মাথা নাড়ে। তিনি তার দু’ছাত্রের উপরে সম্পূর্ণ আস্থা রাখে। তাদের বিবেচনাধীন ছেলে কখনো অনুপযুক্ত হতে পারে না। ফলে তিনি এখন প্রশান্তির শ্বাস নেয়। ফাহাদের থেকে ঘটনা শুনে সায়াজ সন্দেহের চোখে আরভীক এর দিকে তাকায়। তার কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করে।

‘কারে ভালিকা বাকড়া বানানোর চিন্তা করছস হে! তোর কুবুদ্ধিভরা ব্রেনে আমাদের ফিউচার নিয়ে ভাবিস না। আইম সিঙ্গেলমেট এন্ড নট ফল ইন লাভ!’

‘বাট আওয়ার ফাহাদ অলরেডি ফলড।’

দীর্ঘ এক হামি দিয়ে মাথা হেলিয়ে দেয় সিটে আরভীক। ফাহাদ ঢোক গিলে সায়াজের দিকে তাকায়। সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। যেন মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে ফাহাদ। এর শাস্তি স্বরুপ নিশ্চিত তাকে গরুর বিরিয়ানীর জায়গায় গরুর গোবর খাওয়ানো হবে।
সায়াজ সূক্ষ্ম ভস্মীভূত চোখজোড়া ফাহাদের দিকে করে বলে,

‘কে রে মাইয়া! যার প্রেমে পইড়া তুই হইয়াছিস অপরাধী।’

‘কে আবার তোর চাচাতো বোন সাইবারাণী!’

বন্ধুর লাভারের কথা শুনে হা হয়ে যায় সে। মুখ আপনাআপনি চমকে পরিণত হয়। তথাপি বিষন্নতায় মনঃক্ষুণ্ণ হলো তার। সে জানে তার পাগলী বোনটা আরভীক এর উপর ক্রাশ খেয়ে বাঁশের মত বকা খেয়েছে প্রতিবার। দূরত্ব নিয়ে থাকতে বললে উল্টো নিকটস্থ হওয়ার প্রেরণা জুটাতো। কিন্তু পাগলীটা ঠিক পিছু হাঁটেনি। আরভীককে পেলেই আগপিছ ঘুরপাক করবেই। যা দেখে প্রতিনিয়ত হৃদ পুড়তো ফাহাদের। আরভীক সায়াজের ভাবনা দেখে চোখ ঘুরাল। ধুপধাপ করে তার পিঠে বারি দিয়ে বলে,

‘ভাবতেছিস কি হে! সাইবা আমার না ফাহাদের প্রেমে লুতুপুতু খাচ্ছে। আর এই বলদ ভাবে ঐ নাকি আমাকে ভালোবাসে। কত বলদ হলে কেউ এমন ভাবে!’

শেষাক্ত কথাটি আরভীক ইচ্ছেকৃতভাবে সায়াজকে পিন্চ করে বলে। পুরু কথা শুনে সায়াজ নির্বোধ চাহনী নিয়ে আমতা আমতা করে বলে,

‘আসলেই তুই একখান বলদ। আমার বোনটাকে আমি চিনি। ঐ দিন বিচে ওর সেজে যাওয়া,সারপ্রাইজ প্লানিং এন্ড প্রপোজ প্লানিং তোর জন্যে ছিল আবাল!’

‘বুঝছস এবার তুই কেমনে মেয়েটারে হার্ট করছস। একবার তারে ধরে জিজ্ঞেসই করতি যে সে কাকে ভালোবাসে! নাহ্ মশাই নিজের মত ভেবে আলকাতরা সেজে আছে। এবার ভোগ তুই।’

মনমরা হয়ে বসে থাকে ফাহাদ। বন্ধুদের আড়ালে ফোনে কয়েকবার মেসেজ দিয়েছে সাইবাকে সে। তবে একটাও দেখেনি মেয়েটা। আজ সত্যি মাত্রা ছাড়িয়েছে সে। চড় না মেরে আদুরীয় গলায় শুধালে নিশ্চয় সত্য কথা বলতো! ফাহাদের এখন তার নিজের কপাল চাপড়াতে মন চাচ্ছে। একবার শুনা উচিৎ ছিল। আরভীক আনমনে বলে,

‘এখন আফসোস খেয়ে পস্তালে লাভ নেই। বসে বসে নাকে দুদু খাহ্।’

২৭.
জাফর সাহেব খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে ইনসার্চার রুমে বসে আছে। তার ফোন পুলিশ ইনসার্চের কাছে। সে তারই পাশে বসে লক্ষ করছে। পুলিশ ইনসার্চ মেসেজ আসা নাম্বারটি তাদের সিক্রেট ক্রিমিনাল সার্চ কোডিং এর মাধ্যমে খোঁজার প্রচেষ্টা করছে। লিয়াকত সাহেব কেবিনের বাহির থেকে বিষয়টা ঘোর নজরে দেখছে। তার কল্পনায় কিছু একটার জন্যে অশুভ আশঙ্কা করছে! সেই অশুভ আশঙ্কা সত্য না হওয়ার জন্যে তারা ফোনে মেসেজ দেওয়া ব্যক্তিকে খোঁজে বের করতে চাইছে। ইনসার্চ একটা কোড দিয়ে পুনরায় ফোনের নাম্বার ট্যাগ করে। ট্যাগ না হয়ে একটি লিখা সাজেস্ট টাইপ কিছু দেখা গেল স্ক্রিনে। ইনসার্চ ও জাফর সাহেব লিখাটি পড়ে।
ইনসার্চ খোশমনে শুধায়।

‘স্যার শিগ্রই ক্রিমিনালের কথা জেনে যাব। আরেকবার মেসেজ পাওয়ার অপেক্ষা করুন।’

জাফর নিশ্চিত মনে ফোনটি তাদের কাছে রাখতে বলে বেরিয়ে পড়ে। লিয়াকত সাহেবকে দেখে গলা জড়িয়ে লম্বা একটা শ্বাস ছাড়ে। তিনি জাফর সাহেবের উদাসীনতা দেখে শান্ত্বনার কণ্ঠে শুধায়।

‘চিন্তা করছস কেন বন্ধু! ওমন ছাইপাশ ছোকরা কিছুই করতে পারব না আমাদের সাথে।’

‘বন্ধু তুই জানস আমি চিন্তিত কোন বিষয়ে!’

‘কোন বিষয়ে!’

‘চার বছর আগে হওয়া দূবির্ষহ ঘটনাটা মনে আছে তোর।’

কথাটি লিয়াকত সাহেব শুনতেই তার বন্ধুর মুখ চেপে ধরে। আশপাশে চোরা চোখ বুলিয়ে ধীরস্থির ভাবে হাতটা সরায় তার মুখ থেকে। জাফর সাহেব আতঙ্কিত হলো না। বরং নিশ্চুপ হয়ে ছিল শুধু। তিনি তার বন্ধুর কাঁধে হাত বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘পুরোনো কথা তুলতে নেই। যা গেছে তা গেছে। নতুন কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখ। তখন যা পাওয়ার ছিল তা পেয়ে শান্তি পেয়ে ছিলাম। অথচ পেতে কত কাঠখোড় না পুড়াতে হলো মনে নেই তোর।’

জাফর সাহেব গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝায়। লিয়াকত সাহেব তিক্ষ্ণ শ্বাস নিয়ে বলে,

‘তুই বল প্রথমদিনের মেসেজে কি লিখা ছিল!’

জাফর সাহেব উদ্দীপ্ত গলায় ঢোক গিলে ভীতি দৃষ্টি নিয়ে তাকায় লিয়াকত সাহেবের দিকে। তিনি নিজেও যে সাহসী মনভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা নয়। তিনিও ভেতরে ভেতরে ভীতিগ্রস্থ। তবুও বন্ধুর সামনে প্রকাশ করছে না। ভাব এমন যেন কেউই তাদের কিছু করতে পারবে না। জাফর সাহেব কপাল চুলকে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

‘মেসেজ ছিল, মনে পড়ে চার বছরের আগের কথা।’

লিয়াকত সাহেব শুনে ঘাবড়ে গেল। এর মানে যে ব্যক্তি মেসেজ করেছে সে অবশ্যই তাদের কারসাজির কথা লুকিয়ে প্রমাণ জমিয়েছে। এখন সেই প্রমাণের রেশ ধরে তাদের পাগল কুকুরের মত তাড়া করতে চাইছে। মনে মনে সেই ব্যক্তিটি নোংরা গালি দেই তিনি। সে তার বন্ধুকে সিটের মধ্যে বসিয়ে চোরা কণ্ঠে বলে,

‘শুন তুই ইনসার্চের কাছে ফোন দিয়ে বড় ভুল করছস।’

বন্ধুর কথার অর্থ বুঝে উঠেনি তিনি। কপাল কুঁচকে রাশভারী কণ্ঠে শুধায়।

‘ওয়াট ডু ইউ মিন!’

‘আব্বে হা’লা’র পু’ত তুই ফোনে কুকীর্তি লেইখা রাখস নাই। আবাইল্লা কথা জিগাস!’

চকিত দৃষ্টিতে তিনি উঠে দাঁড়ায়। আসলেই তার বন্ধুর বলা কথাতে সে ভুলেই গিয়ে ছিল। তার ফোনের গ্যালারি, ফাইল’স এ বিভিন্ন কুকর্মের ছবি,ডকুমেন্ট তৈরি করে সেভ রেখেছে। সে নিজেই যেন তার মরণ ডাকলো । লিয়াকত সাহেব তার বন্ধুর বাহু চেপে ধরে বলে,

‘জলদি যাহ্ দাঁড়ায় আছস কেন! ধরা খাইলে তুই, আমি বাকি সবাই মরবে।’

তিনি সময় বিলম্ব না করে ভেতরে যাওয়ার জন্য দরজায় নিজের আইডিকার্ড স্ক্যান করায়। স্ক্যান সফল হতেই দরজা খুলে যায়। আর তখনি প্রবেশ করতে নিলে তার কদম থেমে যায়। ভীতি,বিপদশঙ্কায় তার গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ অবস্থা। তার ফোন যে ইনসার্চের কাছে ছিল। সেই পিস্তল ঠেকিয়ে ধরেছে তার মুখোমুখি। জাফর সাহেবের পেছনে লিয়াকত সাহেব ইনসার্চের চোখের আড়ালে আয়নার কাঁচ দিয়ে লক্ষ করে। বিষয়টা ধামাচাপা দিতে হবে অন্য কেউ আসার পূর্বেই। না হলে বহু পূর্বের জমানো খেল নিমিশেষে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। ভেবেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল লিয়াকত সাহেবের। তিনি খুব সাংঘাতিক ভাবে পাশে থাকা কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর সিলিন্ডার হাতে নেই। ইনসার্চ তখনো লিয়াকত সাহেবকে খেয়াল করেনি। তার ধাঁরালো চোখের দৃষ্টিপাত জাফর সাহেবের উপর নিবদ্ধ। এ মানুষটিকে খুব ভদ্র,সুশ্লীল,সৎ মানুষ ভেবে ছিল সে। এ তো মানুষ নামে অমানুষ একটা। ইনসার্চ পিস্তল দেখিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

‘আ আপনি আম আমাদের সসুয়াইব স স্যারের খু খুনি!’

আতঁকে চোখ বড় হয়ে গেল জাফর সাহেবের। অতীতের দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে তার। মুখে বিশ্রী এক অমার্জিত ভয়ানক হাসি ফুটে উঠে। স্যারের হাসি দেখে ঘাবড়ে যায় ইনসার্চ। সে পিস্তল ধরে রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,

‘এখনি আপনি সামনে ঘুরে চলুন! পিছু ঘুরলে একটা গুলিও আপনার কপাল ভেদ করে যাবে না। কি হলো যানন!’

কথাগুলো বলে ইনসার্চ জাফর সাহেবের পিঠ ধাক্কিয়ে সামনের দিকে ঘুরায়। ইনসার্চ সাবধানে জাফর সাহেবের ফোনটি নিয়ে পকেটে রেখে দেয়। এই ফোন এখন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের হাতে সপে দেবে। সেখান থেকেই আসল খুনিকে তারা সাজা দেবে! জাফর সাহেবকে সামনে মোড়িয়ে রেখে ইনসার্চ তার চুক্ষগোচরে নিজস্ব ফোন দিয়ে ফাহাদকে মেসেজ দেয়।

‘ভাই যত জলদি পারস ইনসার্চ রুমের দিকে আয়। মনে আছে চারবছর আগে সুয়াইব স্যারের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। এর রহস্য জেনে গিয়েছি দোস্ত। হারিআপ ডুড!’

মেসেজ পাঠিয়ে ফোন পকেটে রেখে দেয়।

_______

আরভীক,ফাহাদ ও সায়াজ দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো বিল্ডিং এর সামনে। আরভীক তার গুপ্তচরের মাঝে জেনেছে হেডমাস্টারের মেয়েকে এই বিল্ডিংয়ের মধ্যে নিয়ে আনা হয়েছে। যেই না তারা এর সত্যতা কতটুকু প্রমাণ করতে প্রবেশ করবে। ক্ষণিকে থেমে যায় ফাহাদের পথচলা। আরভীক প্রায় সিড়ির কাছে পৌঁছে গিয়ে ছিল। সায়াজও সঙ্গে ছিল। কিন্তু ফাহাদকে না দেখে পিছু ঘুরে দেখে সে আশ্চর্যের দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। আরভীক ভ্রু কুঁচকে তার নিকট গেল। পিঠে হাত রেখে বলে,

‘এনি প্রব্লেম ডুড!’

‘সুয়াইব স্যার!’

চমকিত কণ্ঠে বলে ফাহাদ। সে নিজেও জানতে চাই খুনি কে! ইনসার্চ রুমে কাজরত ইনসার্চম্যান তার বেস্ট কলিগ হয়। শুধু কি তার ! সে,সুয়াইব,সায়াজেরও বেস্ট কলিগ ছিল। তার মেসেজ দ্বারা প্রমাণ সে বিপদে আছে। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। তার কণ্ঠ, পুরু শরীর ক্রমান্বয়ে কাঁপছে। আরভীক স্তদ্ধ। তার নড়চড় না দেখে ফাহাদ তার কাঁধ নাড়িয়ে দেখে। এতে ক্ষণিকে তার স্তদ্ধতা কেটে যায়। ‘সুয়াইব’ নামটা তার মস্তিষ্কের ইন্দ্রিয়জোড়া দূর্বল করে দিচ্ছে। নামটা তার কাছে ঝাঁপসা জানা পরিচিত মনে হচ্ছে! হ্যাঁ, সে শুনেছে তার ধারণা অপরিকল্পিত হতে পারে না। সে শুনেছে নামটা! এই কি সেই সুয়াইব যে মিস আবানের হাজবেন্ড!
‘মিস আবানের হাজবেন্ড’ কথাটি ভাবনায় আসতেই মাথা ঝিম ধরে গেল আরভীক এর। জীবনে কোনো মেয়েদের সাথে ওত ফাজলামি করেনি সে। যতটা মিস আবানকে পেয়ে করছে, হয় হেসেছে না হয় মজার ছলে মেয়েটিকে রাগিয়েছে। কিন্তু সে তো বিবাহিত ! এ বাস্তব সত্যতা তার মনে বিশেষরুপে প্রভাব ফেলছে। আমতা আমতা করে ফাহাদকে জিজ্ঞেস করে।

‘সসুয়াইব কে!’

‘আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের বেস্ট লয়াল অফিসার। কিন্তু একরাতে কার এক্সিডেন্টে তার মৃত্যু হয়ে যায়। বলতে পারিস অকালে ঝরে পড়ে ছিল। ওহ হে সে বিবাহিত ও তার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট ছিল মনে হয়। সে একবার তার খুশির উপলক্ষে আমাদের ট্রিট দিয়ে ছিল। তবে কখনো তার বউবাচ্চাকে দেখার সুযোগ হয়ে উঠেনি। নানান মিশন হাতের নাগালে চলেই আসতো।’

ফাহাদ তার ফোন পকেটে রেখে তড়িঘড়ি আরভীক এর কাঁধে হাত রেখে বলে,

‘ডুড তুই এখানেরটা সামলে নেস। আমি আসব। এখন ইনসার্চ বলছে সে সুয়াইব ভাইয়ের মৃত্যুর রহস্য জেনেছে। তাই আমার যেতে হবে। আমাকে ডাকছে।’

আরভীক মুচকি হেসে তার কাঁধে রাখা হাতটি চেপে আশ্বস্ত নয়নে যেতে বলে। ফাহাদ চলে গেলে পিছ থেকে সায়াজ বলে,

‘চল ডুড ভালিকা বাকড়া আমারী হওয়া লাগব আরকি।’

সে হেসে সায়াজের সঙ্গে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠা আরম্ভ করে। ইতিমধ্যে বিল্ডিংয়ের সামনে শব্দহীন পুলিশের গাড়ি এসে থেমেছে। এর ব্যবস্থা ফাহাদই করে ছিল। সে যাওয়ার পূর্ব মুহুর্তেই থানায় থাকা কনস্টেবলকে আসতে বলে ঠিকানা তাদের ফোনে মেসেজ করে দেয়।

২৮.
আনজুমা নাক টানছে আর কাঁদছে। আশফি অবুঝের মত টিস্যু পেপার তার মায়ের দিকে একেকটা এগিয়ে দিচ্ছে। তার মন চাইছে মাকে উচ্চস্বরে বলতে যে, ‘মা কেঁদো না। এত ছিদকাদুঁরে মা কেনো তুমি হুম!’
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
কিন্তু মনের কথা সাজিয়ে বলতে পারে না আশফি। আদু আদু কণ্ঠে মায়ের বুকের উপর শুয়ে বলে,

‘মাম্মা কি হতে!’

‘কিছু না পাপা তুমি ঘুমাও। পেটভরা না ঘুমিয়ে যাও আমি তোমার মাথায় বিলি কেটে দেই।’

আনজুমা একহাতে আশফির মাথায় বিলি কাটছে অন্যথায় রাগে ফুলছে। তার সাথে রুড বিহেভ করে যেন আরভীক ঠিক করেনি। এর শোধ সে নিবিড়ভাবে নেবে। তাও কেমনে ঐ ‘শ্রেয়া’ নামের মেয়ের চাওয়া পূর্ণ করে। কথাটি ভেবে পৈশাচিক হাসি দিল সে। আজ পর্যন্ত গলা উঁচিয়ে কথা শুনে আসলেও রাগের মাথায় তার ফোনকে উপেক্ষা করে কেটে দেওয়া এমনটা কেউ করেনি। তার উপর রেগে কথা বলাটা বেশ ইগো হার্ট করেছে তার। বেশ আত্মসম্মান প্রখর। ফোন কাটবে তো শালীনভাবে কথা শেষ করে কাটুক। ওমনেই কট করে কেটে দেবে নাকি!
এর শোধ না নিলে তার মন আকুপাকু করতে থাকবে। মনে মনে আরভীক এর চেহারাটা ভেবে পৈশাচিক কণ্ঠে বলে,

‘এতদিন খুব ফাজলামি করছেন! এবার পালা আমার। নিষেধ করছেন না দেখেন আমি সেই নিষেধের মাইরে বাপ করে দেব কালকে হাহ্।’

সে ফোন বের করে ‘শ্রেয়া জাফর’ এর নাম্বারে মেসেজ দেয় যে, ‘ম্যাম আপনি প্রডাক্ট’স নিতে কাল আসুন।’
ফোনটি ড্রয়ারের উপর রেখে চোখ বুজে নিল। মেয়েটির প্রডাক্ট’স নেওয়ার ব্যাপারটা ও তার নাম্বার দিয়ে ছিল তারই এসিস্ট্যান্ট রাজিব নামের ছেলেটি।
কাজ সম্পূর্ণের দ্বায়ে আনজুমা তৎপর হলেও সে কাজ সফলতা বয়ে আনবে।
না, কোনো বড় সুনামি জীবন এলোমেলো করে দেবে।
#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৬

পুলিশ ডিপার্টমেন্টের স্তদ্ধতা দেখে আতঁকে উঠে ফাহাদ। তাকে এগোতে দেখে এক কলিগ কান্নারত কণ্ঠে বলে, ‘আওয়ার ইনসার্চম্যান ইজ নো মোর’।
কথাটি শুনে ফাহাদের সুপ্ত ধ্যান মুছে যায়।
ইনসার্চম্যানের ঘাড় থেকে র’ক্ত ঝরে পুরু রুম র’ক্তা’ক্ত হয়ে আছে। ফ্লোরের সবটুকু অংশ র’ক্তে মাখামাখি। ফাহাদ কাঁপান্বিত গলায় তার কলিগকে জিজ্ঞেস করে।

‘এ এসব কে কেমনে হলো!’

‘আল্লাহ জানেন কেমনে হলো! তিনি নাকি কোন এক কাজের জন্য হলরুমের রাস্তার দিকে আসছিল। ইনসার্চ রুমের দরজা পেড়ানোর আগে পিছলা স্থানে পা লেগে পড়ে যায়। তাও আবার পিছলা স্থানে ঐ কংক্রিট রাখা ছিল। ঘাড়ের সঙ্গে লেগে বেশ বাজে আঘাত লাগে ফলে মৃ’ত্যু হয়। এমনটাই জানানো হয়েছে।’

কথাগুলো শুনে চোখ বুজে দীর্ঘ কষ্টের শ্বাস নেয় ফাহাদ। মৃত্যু’দে’হের পোস্টমোটার্ম রিপোর্ট টেস্ট করে কাল পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে ডক্টর। আপাতদৃষ্টিতে দেহটির দাফনের ব্যবস্থা করে সবাই মিলে। ফাহাদ প্রতিটা ক্ষেত্রে সংযুক্ত ছিল। দাফনকার্য শেষ হতেই সিসি টিভি ফুটেজ রুমে গেল। এ মুহুর্তে সিসিটিভি ফুটেজের ওয়াচম্যান নেই। তিনিও জানাযার মধ্যে সামিল আছে। এ সুযোগের সদব্যবহার করার জন্য উতলা হয়ে চলে এলো ফাহাদ। সিসিটিভিতে গতকালের ঘটে যাওয়া ভিডিও রিভিউ দেয়।। স্ক্রিনে জাফর সাহেবের প্রথম দিকের ফোনে মেসেজ আসার কথাগুলো ও দৃশ্য দেখে ভিডিও সামনে টানল। জাফর সাহেব বেরিয়ে তার পরিচিত মানুষের সঙ্গে বসে কথা বলে। কিন্তু ভেবেছিল পরের ভিডিও ক্লিপে কোনো ক্লু পাবে। তাও পেল না। কেননা পরের ভিডিওতে রুমে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু ইনসার্চম্যান চেয়ারে বসে আছে তা দেখাল। পরক্ষণে ভিডিও সামনে টেনে নিলে মৃ’ত্যু দৃশ্যটি দেখায়। হতাশ হলো তার মন।
তাদের ডিপার্টমেন্টের সম্মানিত এসি জাফর সাহেব। তিনি কখনোই খু’ন করে পারে না।
ফাহাদের ভাবনামতে, ‘হয়ত আসলেই এক্সি’ডে’ন্ট।’
সিসিটিভি ফুটেজ রুমের বাহিরে এসে ফোন বের করে পুনরায় তার কলিগ ইনসার্চম্যানের মেসেজটা পড়ে। হতাশার গ্লানি ছেড়ে আরভীককে কল দেয়।
কয়েকবার রিং এ আরভীককে না পেয়ে আশঙ্কা হলো তার। কোনো বিপদ হলো কি তাদের!
দ্রুত ডিপার্টমেন্ট অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসে ছুটে গেল। পুরুনো বিল্ডিংয়ের সামনে কোনো মানুষের ছিটেফোঁটা না দেখে তার বুকের ধুকপুক ক্রমশ বেড়ে যায়। কোনো ভুল করল না তো তাদের একা ছেড়ে গিয়ে!
সিড়ি বেয়ে প্রত্যেকটা ফ্লোর চেক দেয়। না সাড়া নেই কারো! পা মন্থরগতিতে পিছিয়ে গেল। আকস্মিক কারো ‘উম উম’ শব্দের গোঙানি শুনতে পেল সে। তৎক্ষণাৎ শব্দের গোঙানি অনুসরণ করে সেদিক গেল। ভাঙ্গা টিনের বক্সের ভেতর থেকে শব্দগুলো ভেসে আসছে। কণ্ঠের নিম্নস্বর শুনে অনুমান করে নিশ্চিত মেয়ে হবে!
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
বক্স খুলে চমকে গেল। ভেতরে অন্য কেউ নয় বরং তার প্রেয়সী সাইবা। সাইবাকে র’ক্তা’ক্ত দশায় দেখে তার গালে হাত রাখে। কাতর গলায় বলে,

‘সা সাইবা চোখ খোল প্লিজ। তুমি কি ঠিক আছো!’

গোঙানি বেড়ে চলেছে সাইবার। নিভু চাহনী নিয়ে ফাহাদকে দেখে যেন শেষ ইচ্ছে ফিরে পেল। তার কথার জবাব না দিয়ে তার হাতটা সাইবা নিজের পেটের উপর রাখে। কেঁপে উঠে দুজনের শরীর। কিন্তু উদ্বিগ্ন হয়ে গেল ফাহাদের হৃদয়। সে তার হাতে নরম তরল অনুভব করছে। হাতের দিকে চোখ দিয়ে বিচলিত চোখে সাইবার দিকে তাকায়। তার পেট থেকে র’ক্ত গড়িয়ে কামিজ ভিজে জুবুথুবু হচ্ছে। ফাহাদ তার র’ক্তে মাখা হাত সাইবার গালে রেখে বলে,

‘এ এ রাণী আমাকে ছেড়ে যাবি না প্লিজ। তোর কিছু হতে দেব না। ওয়েট..।’

কোলে নিতে গেলে বাঁধা দিল সাইবা। কাঁপা গলায় নিভু শ্বাস নিয়ে বলে,

‘বে বে শি স সময় নে নেই। তু তুমি আ আমার এ এক ইচ্ছে পূ পূরণ করে দাও প্লিজ।’

কথাটি যেন তীরের মত বিঁধল ফাহাদের বুকে। তার দুগাল আদলে নিয়ে বলে,

‘এক কেন হাজারো ইচ্ছে পূরণ করতে রাজি আমি।’

‘সত্যি বিয়ে করবে আমাকে!’

গর্দভ বনে গেল ফাহাদ। এতক্ষণ যে মেয়েটি কাতরাছিল এখন সে মেয়েটিই চঞ্চলভাবে কথা বলে উঠল। খটকা লাগে বিষয়টি তার কাছে। সাইবা খুশির চটে ফাহাদের গালে গভীর চুমু একেঁ দেয়। থতমত খেয়ে যায় সে। সাইবা লাজুক হেসে মুখ ঢেকে ফেলে। ফাহাদ মেয়েটির আচরণে ঘোরে চলে গিয়েছে। আরভীক,সায়াজ মিটমিটিয়ে হাসি দিচ্ছে। আরভীক ফাহাদের ধ্যানমগ্নতা দেখে শয়তানি হেসে তার হাতের মধ্যে কালি মেখে সিল বসিয়ে দিল বিয়ের কাগজপত্রে। সাইবা লাফাচ্ছে তার স্বপ্নপুরুষ এবার সত্যিতে তার জীবনসঙ্গী! সায়াজ বোনের লাফানি দেখে ধীরস্থির গলায় বলে,

‘বোন আস্তে লাফা; না হলে বিল্ডিং ভেঙ্গে ম’র’ব।’

ভাইয়ের কথা শুনে ধুপধাপ চট’কানি দিল তার পিঠে। বোনকে রাগানোর শা’স্তি এ আরকি! আরভীক কাগজটি সাইবার কাছে দিয়ে ফাহাদের ব্যাকসাইডের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ডুড এন্ড সিস প্লিজ ক্লোজ ইউর আইস!’

‘কেনো!’

সায়াজের কথায় প্রত্যত্তর করে না আরভীক। শুধু দুষ্টুর মনভাবে চোখ টিপ দেয়। এ চোখ টিপের রহস্য উদঘাটন করার সাধ্য বেচারা সায়াজের নেই। ফলে সে চোখ বন্ধ করে সাইবার চোখও শক্ত করে বন্ধ করে ফেলে। সাইবা নিজের হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করলেও হাতের ফাঁকা অংশ দিয়ে দেখে চলছিল। সায়াজ ধরতেই অন্ধকার অন্ধকার দেখল! ঠাসঠুস মেঝের উপর লা’থি দিয়ে মুখ ফুলালো। আরভীক ফাহাদের পিছে গিয়ে দাঁড়ায়। জুতোজোড়া খুলে ঠোঁট চেপে ফুটবল মা’রা’র মত পজিশন করে দাঁড়ায়। বন্ধুর বলের মত বসার ধরণ দেখে তার মাথায় বাচ্চামি মনভাব জেগে উঠে। বিধেয় দিগিদ্বিক না ভেবে ‘ইয়া আল্লাহ মেরে দিলাম’ বলে লা’থ দিল বন্ধুর কোমরের নিচে। ফাহাদ কানে তার বন্ধুর বলা কথা শুনে বোঝার পূর্বেই। হঠাৎ কটিদেশে ব্যথা পেয়ে ধপাস করে উল্টো হয়ে গেল। বেচারা ‘আহ আহ’ করে কটিদেশ ঘষতে থেকে উঠার চেষ্টা করে। আরভীক মৃদু হেসে তার হাত ধরে দাঁড় করায়। ফাহাদ ক্ষোভমিশ্রিত গলায় শুধায়।

‘ওই হা’লার বদ’মা’ইশ পা’ছায় লা’থি দিলি কেন!’

‘তুই বসছিলিই এমন।’

কথার ইতি টেনে সে নিজেই ফাহাদের পুরু কাপড়ের ময়লা ঝেড়ে দিয়ে কাঁধ ধরে বলে,

‘ডুড’স এন্ড লাভলী সিস লিসেন টু মি! ফাহাদ আকবার ও সাইবা ইসলাম আজ থেকে স্বামী-স্ত্রী।’

বেক্কলের মত চেহারা করে ফেলে ফাহাদ। কবে বিয়ে হলো তার! ভাবতেই প্রশ্নাত্মক চোখে বন্ধুর দিকে তাকায়। সে চাহনী বুঝে কাগজটি দেখায়। সাইবা লাজুকে যেন মরেই যাবে! মুখ ঢাকতে ঢাকতে তাকেও বন্ধুদের সামনে লজ্জায় ফেলছে। দাঁতে দাঁত চেপে আরভীককে শুধায়!

‘ওয়াট’স ডুড এমন টা কেন করলি! আমি কি বলছিলাম এডারে বিয়ে করব।’

‘না বললে খোকা তুমি যে সুজির অভাবে ক্ষুধার্ত হয়ে মরতে। তখন এসবের দ্বারভার কে নিতো শুনি।’

বিড়ালের মত সূচাঁলো হলো ফাহাদের চালচলন! কথার বিপরীত প্রতিক্রিয়া কি হবে তার ব্রেনে আসছে না। ঠোঁট কামড়ে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আগে বল ঘটনা কি হলো!’

আরভীক অলসতার মুখ করে হামি দেয়। সায়াজকে ইশারায় সংক্ষিপ্ত করে বলতে বলে। সে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘হেডমাস্টারের মেয়ে অন্যকেউ না এই সাইবা ইসলাম। তার গুন্ডা প্রেমিক যে বিয়ে করতে চাইছিল আমরা আসা অব্দি ছিল না। কাজি আনতে গেছিল আর কনের জন্য যাবতীয় জিনিসপত্র। বিয়ে নাকি আজই করবে বলে ঠিক করছিল! আরভীকের এসবে ইন্টারেস্ট ছিল না। তাই সে বসে বসে ঘুম মারল। আমি আর তোর পাঠানো কনস্টেবল মিলে যাবেরকে ধরে সাইবাকে উদ্ধার করি। এরপর গিয়ে আরভীকের ঘুম ভাঙ্গে। ঝিমানো শেষে চলে যেতে নিলে সাইবা অনুরোধ করে তোর আর তার বিয়েটা করিয়ে দিতে। আরভীক ভাই তো দুপায়ে খাড়া ছিল! নাটকটা এ কারণে রচিত। বুঝছেন মশাই!’

ফাহাদ উদ্দীপ্ত মেজাজে দাঁত কেলিয়ে চওড়া হাসি দিল। তার প্রেয়সী চিরজীবনের জন্য তার বন্দিনী হয়ে গেল।! উফ ভাবতেই খুশিতে ফেটে যাচ্ছে তার মন। সাইবা তার খুশির চেহারা দেখে মনে মনে শয়তানি ফন্দি আঁটকে রেখেছে। আরভীক বুঝতে পেরে সাইবার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘শাস্তি ততটুকু দিবে যতটুকু প্রাপ্তি। সীমা ছাড়িয়ে গেলে হারিয়ে বসবে।’

ত্রপাট কেঁপে উঠে সাইবার হৃদপিন্ড। না সে ওতটাও কষ্ট দিবে না তার প্রিয়তমকে। মাথা নেড়ে আরভীক এর বাণীতে সায় দেয়। তারা বেড়িয়ে বাসার দিকে রওনা দিল। যেহেতু আরভীক তার ওয়াদার প্রণয়ে সর্বদা তৎপর। অতঃপর হেডমাস্টারের বাসায় সদ্য বিবাহিত জামাইবাবা ও মেয়েকে রেখে সায়াজ ও সে চলে যায়। তাদের গন্তব্য কার্রস পেট্রোলিয়াম অফিসের কন্ডাক্টরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা।

২৯.
রাজিব আনজুমার থেকে বিভিন্ন প্রডাক্টের রেট অনুযায়ী হার মোতাবেক হাতিয়ে নেয়। ফলে তার কাছে প্রডাক্টস নিতান্ত কমে যায়। সেল করার জন্য আনজুমার হাত শূন্য হলো। লাভের কথায় এলে শ্রেয়া জাফরের এসিস্ট্যান্ট রাজিব মিছামিছি মন নিয়ে শুধায়।

‘ম্যাম এখনো আসেনি। তিনি আসলে প্রডাক্টসের রেট শোধ করে দেবে। এগুলো গাড়িতে তুলতে হবে। তাই আমি যায়।’

তড়িঘড়ি কেটে পড়ে রাজিব। আনজুমার মনে ভোর থেকে কু’ডাকছে। ক্ষিপ্রবেগে রাতের সিদ্ধান্তে অটুট থেকে দিনে এর পূর্ণতা মিটিয়ে দিল। তবে এখন যেন তার রুহ কাঁপছে। টাকা শোধ করার কথা বলে রাজিব যে গেল প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে। বুকের ধুকপুকানি ক্রমাগত বাড়ছে। সিদ্ধান্ত কি তবে ভুল প্রমাণিত হতে চলেছে !
কপালে ঘামের ছড়াছড়ি। রিসেপশনের দুপাশে পায়চারী করছে এবং আড়চোখে বাহিরে দৃষ্টিপাত রাখছে। ফোন বের করে রাজিবের নাম্বারে কল দেয়। এ কি কল বন্ধ বলছে কেনো!
সে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিল রাতে। ক্রোধের বশীভূতী হয়ে ভুয়া,বানোয়াট ব্যক্তিকে সব প্রডাক্টস দিয়ে ভয়ে অস্থির হচ্ছে। এখন তবে প্রডাক্টসের শোধ না পেলে কোম্পানি লস খেয়ে যাবে! এতে না জানে আরভীক কেমনে ভড়কে উঠে তার উপর। আনজুমার ভেবেই আতঙ্কে নুয়ে নুয়ে মরছে। সেল রিসেপশন আজকের জন্য বন্ধ করে দেয়। বাসায় চলে এলো। বারংবার ফোন দিচ্ছে রাজিবের দেওয়া নাম্বারে। চোখ বেয়ে ভুলের অশ্রুসিক্ত হচ্ছে তার। আত্মসম্মানের লোভ জাগলেও আরভীক এর নিষেধাজ্ঞায় ত্রুটি ছিল না। তা এখন বুঝতে পারছে। ভাগ্যের জোড়ে চাকরী পেল! সেই চাকরী হাতছাড়া হবে। অন্তর বেয়ে শীতল স্রোত বইছে তার। বিপদের মুখোমুখি হতে সময় বেশিক্ষণ নেই। দুদিন যাবত অফিসে আরভীক ছিল না। বাহিরের কাজে ব্যস্ত ছিল। তবে অঞ্জয় খেয়াল রেখেছে। ভুল হলে ধরিয়ে দিয়েছে। একদম বোনের মত আগলে রেখেছে। গতকাল তার উচিৎ ছিল ভাইয়ের সঙ্গে একবার পরামর্শ করা। না, সে তার জেদে এঁটে ছিল!
মনের তীব্র আশঙ্কায় ফোন বেজে উঠে তার। ফোনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কেঁপে উঠে আনজুমার। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ‘আরভীক’ লিখা নামটি। ঢোক গিলে ফোন কানে ধরে।
অফিসের মধ্যে চেয়ারে কপালের উপর হাত রেখে বসে আছে। সন্ধিবিচ্ছেদের সংখ্যা রেখা মিলাচ্ছে যেন। শান্ত,নির্মল গলায় জিজ্ঞেস করে।

‘কোথায় তুমি!’

‘বা বাসায়।’

‘তোঁতলে কথা বলছো কেন!’

‘ক কই এ এমনি গ গলা শু শুকিয়ে আছে।’

‘পানি খাও।’

‘জ্বি!’

‘বলছি পানি খেতে!’

আরভীক এর কণ্ঠ ঝাঁঝালো শুনাচ্ছে। ধুড়ুধুড়ু বুকের যন্ত্রণা বাড়ছে আনজুমার। ঢোক গিলে পানিভর্তি গ্লাস মুখে পুরে নেই। দম আঁটকে এক শ্বাসে পানি খেয়ে নেয়। জোরালো শ্বাস বেরুচ্ছে তার ফুসফুসের থেকে। যেন রক্তপ্রবাহের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কানে ফোন ধরে বলে,

‘খে খেয়েছি।’

‘আমার নিষেধ শুনোনি কেনো!’

নিশ্চুপ রইল আনজুমা। আরভীক সাড়া না পেয়ে চেঁচিয়ে একই কথা আবার জিজ্ঞেস করে। আনজুমার কান্না পাচ্ছে। ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছে তাই বলে মোকাবেলা করার শক্তি নেই তার এমনটা নয়। মানুষটা প্রায় সময় রসিকতার আচরণ করেছে তার সঙ্গে। ফলে সুপ্ত এক আনন্দ পেতো তার মন। রসিক মানুষটি যদি হিংস্রের রুপ নেয় তবে ভয়, শ্রদ্ধাবোধ কমে আসে। তবু কোথাও যেন সে অনুভব করে এই ব্যক্তির প্রতি হওয়া তার মনের গহীনে আনচান করা বেহাল দশা। আশফি অবুঝ চাহনী নিয়ে দেখছে। সে তার ফোন নিয়ে রুমের ভেতর যায়। ‘আরভীক আব্বু’ লিখা মেসেজে ভয়েস রের্কড পাঠায়।

‘আব্বু আম্মু আত বেতি কাঁদছে।’

রেকর্ড পাঠিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখে তার আম্মু মেঝেতে বসে কাঁদছে। দুহাত মুখে চুপে আর্তনাদ করছে। দুরন্ত মনে ছোট পায়ে হেঁটে পায়ের কোল ঘেঁষে বসে বলে,

‘মাম্মা কাঁদে না। প্লিজ!’

ছেলেকে বুকে পেয়ে বিতৃষ্ণা মিটে গেল। ছেলে আছে তার আর কিছুই চাই না! একজীবনে স্বামীকে হারিয়ে যে নিসঙ্গতায় ভোগছে। তার জায়গায় উপরন্তু অন্যকারো অবস্থান নেই। আশফির গাল ধরে বলে,

‘আজ আমরা নতুন বাসায় যাব কেমন!’

মায়ের কথা শুনে আশফি বুঝেনি কিছু। শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়েছে। আনজুমা চোখ মুছে ছেলেকে সোফায় বসিয়ে দিল। রুমে গিয়ে আলমারি খুলে জমানো টাকার ব্যাংক দেখে। প্রায় একলাখ টাকা জমেছে। এ টাকা দিয়ে নতুন চাকরী ও বাসা এবং সরঞ্জাম অনায়াসে পেয়ে যাবে। সব গুছাতে আরম্ভ করে। এতটা অপমান সহনশীল নয়। সে বুঝেছে ভুল হয়েছে তার। তার মানে এই নয় আরভীক যা বলবে তাই হবে। ভুলের প্রায়শ্চিত্ত ধীরসুস্থে বুঝিয়েও বলা যেতো। না তখন কলে কিভাবে রুড বিহেভ করে গেল সে। আল্লাহ চাইলে সে পুনঃচাকরীর সন্ধান পেয়ে যাবে।

কলের মধ্যে….

আরভীক চেঁচিয়ে বলে,

‘তোমাকে বারণ করার সত্ত্বেও কেনো দিয়েছো শ্রেয়াকে প্রডাক্টস! আর ইউ ফরগেট! ইউ আর এমপ্লয়। আমি তোমাকে বসিয়ে কোম্পানির লস খাওয়াতে রাখিনী। যোগ্যতা আছে দেখে রেখে ছিলাম। এখন তো মনে হচ্ছে তুমি একটা নির্বোধ,মূর্খ মেয়ে। না শব্দটার অর্থ বুঝো না! তখন রেগে বলেছি কি সেটা তোমার ইগো হার্ট করেছে। অথচ আমি এতবছর কোম্পানি চালিয়ে আসছি। তোমার সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছি কি! তার মানে এই না যে তুমি আমার কোম্পানি খেয়ে দেবে। এর ফল জানো কি হবে! যার কাছে তুমি এত এত মাল বিক্রি করেছো। সেগুলো দিয়ে তোমার নামে দুনার্ম রটাবে। তোমার নামে পুলিশের কাছে কমপ্লেইন দেবে।’

আনজুমা মুহুর্তেই ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল। এতটাও অবুঝের মত কাজ করেছে যে বলার মুখ নেই তার। তার কান্না শুনে আরভীক এর হৃদয় পুড়ে ছারখাড়। মেয়েটার কান্না অসহনীয়। দৃঢ় শ্বাস নিয়ে তর্জনী আঙুল দিয়ে কপাল চুলকাতে থেকে বলে,

‘প্রডাক্টস কত দিয়েছো!’

‘আশি পার্সেন্ট!’

মনে মনে আরভীক ‘ড্যাম! মিস আবান এটা তুমি কি করেছো উফ!’ মনের মধ্যে বুদ্ধি বুনতে লাগে। মুখে আনজুমাকে রুক্ষ গলায় শুধায়।

‘পরের বার থেকে মনে রেখো তুমি এমপ্লয় আমার কথার উপর চলবে। একটুও এপার ওপার করলে সোজা রেজিগনেশন লেটার ধরিয়ে দেব।’

‘আমি আপনার কথায় হার্ট হয়ে এমনটা করেছি।’

চমকে গেল আরভীক। মনের কোথাও আনজুমার বলা কথাটি তীব্রতর হাতুড়ি পিটাচ্ছে। যেন এ কথাটার দ্বারা সে তার আপন কেউ বোঝায়। মুচকি হেসে প্রশ্ন করে।

‘কেনো আমি এমন কে যার কথায় তুমি হার্ট হয়েছো!’

প্রশ্নটি দ্বিধাবিভাজনে ফেলে দেয় আনজুমাকে। মনস্থীর হয়ে গেল প্রশ্নটির মধ্যে। স্বামী ছাড়া হলেও এ ব্যক্তির মধ্যে স্বামীর অস্তিত্ব অনুভব করে। অথচ চেহারা,চালচলনে পরিপূর্ণ অমিল। অস্তিত্ব থাকলেও বিরহের চোট বড্ড পুড়ায়, না থাকলেও পুড়ায়। আমতা আমতা করে বলে,

‘আইম লিভিং।’

বলেই কল কেটে দিল আনজুমা।

৩০.
‘বুঝলি অঞ্জয় এবার তো বিয়ের শেনাই বাজাইতে হবে।’

অঞ্জয় ভ্রু কুঁচকে তার বসের দিকে তাকায়। কার বিয়ের শেনাই বাজানোর কথা বলছে বস! তার মাথাটা কখন না জানে ব্লাস্ট হয়। ধাঁধার মত তার বস যেকোনো কথা বলে অনড় হয়ে গেলে, সেও শুনার অতীব আকাঙ্ক্ষায় বসে থাকে। অথচ প্রত্যত্তর পায় না। বরং জবাবের বদলে সরাসরি এর দৃশ্য দেখে ফেলে।
আরভীক দাঁড়িয়ে সিটের থেকে তার কোট পরে আয়নার সামনে স্টাইল করতে থাকে। চুলগুলো একসাইডে করে স্পাইকিং করে। মনে মনে ছুঁচোমি বুদ্ধি এঁটে বাঁকা হেসে আওড়ায়।

‘ড্যাড তোমার চুজ করা মেয়ে গেল মাইঙ্কার চিপায় আর আমি গেলাম বউবাচ্চা আনতে।’

চলবে….
চলবে…..
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here