নেশাটাই তুমিময় পর্ব -০১

সারাটাদিন প্রাক্তন প্রেমিকের বিয়ের সকল কাজকর্ম করে সন্ধ্যেবেলা যখন দুমুঠো খাবার নিয়ে রান্নাঘরে খেতে বসল অনিমা ঠিক তখনই কেউ একজন তার চুলের মুঠো করে খাবারের তালাটা ছুড়ে ফেলে দিলো অনেক দূরে। সাথে সাথেই ক্লান্ত শরীরের অসহ্য ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো সে! সারাদিনের ক্লান্তি আর তার সাথে দুর্বল শরীরে এতোটা আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েকফোঁটা অবাধ্য নোনাজল! অশ্রুসিক্ত নয়নে সামনের লোকটির দিকে তাকাতেই একরাশ ঘৃণা এসে ভর করলো তার মনকুঠিরে! কেননা, এই সেই ব্যক্তি যার কারণে তার জীবন আজ এমন সংকট মুহুর্তে! হঠাৎ ছিঁড়ে যাওয়া হাতের কব্জি ধরে টেনে নিয়ে বাইরে নিয়ে চলল সেই ব্যক্তিটি, তাতেই যেন বার বার ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে অনিমার ক্ষত হওয়া শরীরখানি, কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র হেলদোলই নেই সামনের ব্যক্তিটির। ঠোঁট চেপে বারবার ব্যথা সয়ে নিচ্ছে সে। আর লোকটি তাকে শক্তহাতে ধরে নিয়ে চলল সামনের দিকে। পরক্ষণে, রক্তচক্ষু নিয়ে সামনের ভরা বিয়ের অনুষ্ঠানের লোকসম্মুখে ছুড়ে মারলো অনিমাকে, তাতেই যেন হুশ ফিরে এলো অনিমার। কেননা, এতক্ষণ অসহ্য যন্ত্রণাময় অবস্থা আর আপন ভাবনার মাঝে ছিলো বলে পারিপার্শ্বিক কোনো হুশে ছিলো না সে! তার মাঝেই লোকটি বলে উঠলো,

– কি যেন বলছিলেন মিস্টার খান? আমার দাভাইয়ের সাথে এই মেয়েটার সম্পর্ক ছিল! হাসালেন! যেটা শোনেছেন তার পুরোটাই মিথ্যা!

– ওহ আই সি! তাহলে সত্যটা কি? বলুন আমাদেরকে! আমরা শুনতে চাই কেন সকলে বলাবলি করছে তুরনের সাথে এই অনিমা নামে মেয়েটার সম্পর্ক ছিলো। আরও বাজে কত কি?

– অফকোর্স। সত্যটা শোনতে চান তো? তাহলে শুনুন, এই মেয়েটা আমাদের বাড়ীর একজন সার্ভেন্ট মাত্রই! যাদের ঠিকানা বাড়ীর রান্নাঘর আর কাজের অন্তরালে।

‘সার্ভেন্ট’ কথাটা কানে আসতেই দুকদম পিছিয়ে গেলো অনিমা। তাকে এতবড় অপমান করলো লোকটি? শব্দটা যত ছোট তার গভীরতা ঠিক কতটুকু সেটা হয়তো আন্দাজ করার ক্ষমতা লোকটির নেই বলে তাকে অপমান করলো সে। তার উপর লোকসমাগমে ভরপুর এই অনুষ্ঠানে তাকে ঠিক কি কারণে এমন অপমান করলো তা বুঝতে পারলো না অনিমা। মাথা নিচু করেই নিরবে অশ্রুবিসর্জন দিচ্ছে সে। পাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,

– তুর্যন এসব কি? মুখ সামলে কথা বলো। ও তোমার বোন হয়। আপন না হলেও একই রক্তের অংশীদার তোমরা?

– মা প্লীজ, ভাইয়াকে বলতে দাও। তোমায় ভাইয়া আগেও বলছিলো এই মা-বাপ মরা মেয়েকে বাড়ীতে না রাখতে। কিন্তু শুনলে না ভাইয়ার কথা। নিজের মা-বাপকে একসাথে খেয়েও মন ভরে নি তার। এখন হলো তো! দুধ দিয়ে কালসাপ পোষেছো তোমরা।….. মেয়ের কথায় চুপ হয়ে যান তোহা চৌধুরী। অসহায় দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করলেন অনিমার দিকে। নিজে থেকেও কিছু করতে পারছেন না অনিমার জন্য। হা-পা তা অদৃশ্য শিকলে বাধা যে!

পাশ থেকে কোনো এক মহিলা বলে উঠলো, ‘এ কেমন মেয়েরে বাবা, যে থালিতে খায় সেই থালিটাই ফুটো করে?’ আরেকজন বলেন,’ ঠিল বলেছেন আপা, এমন মেয়ে যেন আর কারও ঘরে না হয়।’ কথা শেষ না হতেই অন্য আরেকজন বলে উঠল, ‘মেয়েটার মরে যাওয়া উচিত, চৌধুরী বাড়ীর মানসম্মানটা একা নিজেই ডুবিয়ে দিলো, বলি মেয়ে কাজের মেয়ে হয়ে সাহেবের ছেলের সাথে সম্পর্ক করলি সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার জন্য?’…

এমন হাজারো আপত্তিকর কুৎসিত কথাবার্তা বলছে সকলে। এমন কথাগুলো বারবার ছাড়খাড় করে দিচ্ছে অনিমার নরম কোমল মনটা। আর ‘কালসাপ’ কথাটা যেন তীরের মতোন ভীড়ল অনিমার মনে। যে মেয়েটা সারাদিন অনিমা ছাড়া কিছুই বুঝতো না সেই এই কয়েকদিন সময়ের ব্যবধান তাকে কালসাপ বলে লোকসম্মুখে পরিচয় দিচ্ছে। কি আজব তার জীবনটা! কয়েকদিন আগেও যারা আপন ছিলো তারাই আজ তাকে পর ভাবছে, কালসাপ, সার্ভেন্ট বলে লোকসম্মুখে পরিচয় দিচ্ছে। আপন মানুষের এমন ব্যবহার কখনও আশা করেনি অনিমা। হা যে ব্যক্তিটি অনিমার সাথে এতো রুড় বিহেভ করেছিলো সেই হলো তার প্রাক্তন প্রেমিক তূরন ইনকিয়াত চৌধুরীর ছোট ভাই তুর্যন ইনকিয়াত চৌধুরী। যে কিনা সম্পর্কে অনিমার মামাতো ভাই হয়। যাকে বাঁচাতে একটা সময় নিজেই রক্তদান করেছিলো সকলের অঘোচরে। আর আজ সেই মানুষটি তার সাথে এমন আচরণ করলো! অপমানকর বিষয়টা করতে সহজ হলেও অনিমার মনে শক্ত দাগ কেটে দিলো আজ! যাকে বাঁচাতে কতে কি করলো আর সেই আজ…..!!

আর ভাবতে পারছে না সে। দৌড়ে চলে এলো সেখান থেকে। নিজ রুমে এসে দরজা বন্ধ করে পাশেই হাঠুগেড়ে বসে পড়ল সে। কি থেকে কি হয়ে গেলো? তুরনও আজ আর তার হয়ে কিছুই বলল না তুর্যনকে? এতো অপমান করা স্বত্বেও! কিন্তু কেন? তুরন তো সেখানেই উপস্থিত ছিলো! কেন সে প্রতিবাদ করলো না? তিন বছরের প্রেমকে সে চাইলে কি প্রণয়ে রূপ দিতে পারতো না? পারতো না তার ভালোবাসাকে নিজের করে রাখতে? সবটাই কি তাহলে নাটক ছিলো? এতো ভালোবাসা! এতো কেয়ার! কেন এমন করে তার জীবন শেষ করে দিলো তার? কি অপরাধ করেছিলো সে? তার মা-বাবা তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেরাই না ফেরার দেশে পাড়ী জমিয়েছিলেন, এটাই কি তার দোষ?… সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। মাথাটা ধরে আসছে তার। এখন হয়তো কিছুক্ষণ নিরবে চক্ষুজল বিসর্জন দিলে হয়তো ভালো লাগবে।
[লেখনিতে: আবরার আহমেদ শুভ্র]
__________

ঘন্টাখানেক নিরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়ার পর ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো অনিমা। তাকে দ্রুত ফ্রেশ হতে হবে। কেননা, রান্নাঘরের অনেক কাজ এখনও বাকি আছে। কাজগুলো ফেলে রাখলে তার বড়মামি হয়তো রেগে যেতে পারেন। তাতে সে তার গায়ে হাত তুলতেও দুবার ভাবে না। সাথে অপমানও আছেই এছাড়া সে অনিমার মা-বাবাকে নিয়েও বাজে কথা বলতে ছাড়ে না। কেননা এই বাড়ীতে একমাত্র ছোট মামি আর ছোটমামা ছাড়া সকলের কাছে এখন সে চক্ষুশূল! আগে যে কয়েকজন তাকে দেখতে পারতো তারাও কয়েকদিন ধরে তাকে কোনো না কোনোভাবেই অপমান অপদস্থ করে। কথায় কথায় কুঠা দেয়। যা অনিমা নিরবে সহ্য করে তার একমাত্র ছোটমামি আর মামার দিকে চেয়ে। এই মানুষ দুটো না থাকলে হয়তো তার অস্থিত্বও পাওয়া যেতো না। তাই সবকিছু সয়ে নিতে হয়।

তার মাঝেই হঠাৎ টুং করে মেসেজের আওয়াজে ধ্যান ভাগলো অনিমার। মেসেজটা এসেছে আননোন নম্বর থেকে। মোবাইল হাতে নিয়ে ওপেন করলো মেসেজটা। তাতে স্পষ্ট লেখা আছে,

প্রিয় ফুলপরী,
কেমন আছো! নিশ্চয় ভালো নয়? কেননা কিছুক্ষণ আগেই লোকসম্মুখে অপমান করে তোমায় এই তুরন ইনকিয়াত চৌধুরী আর তনুজা চৌধুরী। অবশ্যই তারা এর শাস্তি পাবে! কেননা আমার প্রেয়সীকে অপমান করার ফল তাদের ভোগ করতেই হবে। এন্ড ইটস্ ফাইনাল! এন্ড দে হেভ টু পূটআপ উইথ ইট! বাই দ্যা ওয়ে, আজ সাদা- হলদে শাড়ীতে বেশ মানিয়েছে তোমায়! কিন্তু একটা জিনিষের বেশ অভাব ছিলো! সাদা ফুলের গাজরা। খোঁপায় বাধলে বেশ মানাতো। এনিওয়েজ, তোমাকে কাছে পেলে এসবের একদম কমতি রাখবো না প্রেয়সী। ভালোবাসি!

এমন মেসেজ পরে বেশ অবাক হলো অনিমা। আবার মুখে হাসির রেখাও ফুটে উঠলো, আর ভাবতে লাগলে,,

লোকটা আমায় চিনে! কিন্তু কিভাবে? আবার আমায় অপমান করেছে বলে তাদের শাস্তিও দিবো, তাও আবার যন্ত্রণাদায়ক, মাই গড! কে হতে পারে এই লোক? নিশ্চয় মেয়েপক্ষের কেউ! কিংবা তার পরিচিত! কিন্তু মেয়েপক্ষের লোক তো তাকে আজই দেখলো। কিন্তু লোকটা সামনে কেন এলো না? কি চাই সে? আমার নম্বর পেলো কোথায়? এমন হাজারো উদ্ভট প্রশ্ন খেলে যাচ্ছে তার মনে। সে আর কিছু না ভেবে দ্রুত গায়ে উড়না জড়িয়ে দড়জা খুলে রান্নাঘরে চলে গেলো।
_________

– কি ভেবেছে এই তুর্যন ইনকিয়াত চৌধুরী? আমার প্রেয়সীর দিকে তার নজর বরাবরই খারাপ ছিলো। এতোদিন তুরনকে ভালোবেসেছিলো বলে তাদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয় নি কিন্তু আর পারলাম না, এই তুরন ইনকিয়াত চৌধুরীও আমার ফুলপরীকে কষ্ট দিলো, বিশ্বাসঘাতকা করলো আমার ফুলপরীর সাথে। এদের আমি এমন শাস্তি দেবো না, তারা নিজেরাই নিজেদের মৃত্যুর জন্য কাঁদবে। গেট রেডী ফর ইউর পানিশমেন্ট বেইব! হা হা হা…. বলেই বিকট কণ্ঠ রাগান্বিত স্বরে হাসলো লোকটি। কেননা এই হাসিটা কারও কালে পরিণত হবে।
অনিমার ছবি হাতে নিয়ে বলতে শুরু করলো,

– আই প্রমিজ! সকল দুঃখ কষ্টে তোমার ছায়া হবো আমি, কোনো কষ্ট যেন ছুতে না পারে তোমায় সেই ব্যবস্থা করছি প্রেয়সী। খুব শীঘ্রই আপন করে নিবো তোমায়। তুমিই একমাত্র এই রুদ্ধ শাহরিয়ারের। রুদ্ধের ফুলপরী তুমি।

#নেশাটাই_তুমিময়
#পর্বঃ- ০১
#লেখনিতে_আবরার_আহমেদ_শুভ্র

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here