নেশাটাই তুমিময় পর্ব -১৬

#নেশাটাই_তুমিময়
#আবরার_আহমেদ_শুভ্র (Writer)
#পর্বঃ ১৬ [স্পেশাল পর্ব]

[কপি করা একবারেই নিষেধ]

৩৬.

শীতের শেষ হতে না হতেই এসে গেছে রূপে গুণে অতুলনীয় বসন্তের আগমনী বার্তা। সময়ের স্রোতে ভেসে ভেসে এভাবেই পালাবদল হয় প্রতিটি ঋতুর। শীতের সৌন্দর্য সব বিগলিত হয়ে ঝরে পড়ছে বিষন্ন বিদায়ের কোলে! অবিশ্রান্ত সময়ের দৌড়াদৌড়িতে সবুজাভ প্রকৃতিতে এসেছিল কুয়াশাবৃত শীত! সাথে নিয়ে এসেছিল ঠাণ্ডা শীতল বায়ু ও সাদা ধবধবে কুয়াশা! ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো প্রকৃতির প্রত্যন্তরে। একপা দু’পা করে করে শীত ঋতু প্রায় শেষের বেলায় উপনীত! তবুও সবুজাভ বাংলার উচ্ছল প্রকৃতির বুকে এখনো লেগে আছে দুর্মর হিমহিম শীতের প্রতিচ্ছবি শীতের শীতল আঁচড়ে। শীতের বিদায়ী প্রহরের নিস্তব্ধ সময়ে প্রতিটি গাছের পাতায় পাতায় মিষ্টি রঙের মেলা জমে গেছে। শীতের বিদায়ে প্রকৃতি যেন মাতোয়ারা নববধুর সাজে! অতিথি পাখিরা ঝাঁকবেঁধে ছুটে চলেছে দিগন্ত ছুঁয়ে। একে একে গাছগাছালির ডালে ডালে ঝুলন্ত পাতাগুলো বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে হেলেদোলে ঝরে পড়ছে শিশিরসিক্ত উর্বর মৃত্তিকার গর্ভে! দুপুরের এলোমেলো উত্তরা বাতাসে উড়ে উড়ে খেলা করতে আরম্ভ করেছে পাতাঝরা গাছগাছালিও বন বনানী’র গা ঘেঁষে! খুবই দৃষ্টিনন্দন ও নয়নাভিরাম তার চাহনি! ছিন্নমূল পাতাগুলো ঝরে ঝরে সবুজের পৃথিবীটা ধীরে ধীরে পাতাশূন্য হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে শীত ঋতু বিষন্ন বিদায়ের কোলে ঢলে পড়ছে। প্রকৃতিতে বসন্ত ঋতুর বাতাস এসে গেছে। উত্তরের হাওয়া শীতের বিদায়ের বাঁশি বাজাচ্ছে! শুকনো ঝরাপাতার কড়মড় শব্দে। ফাগুনের ছোঁয়ায় প্রতিটা উদ্যানে শোনা যাচ্ছে উঁচু বৃক্ষের মগ ডালে পত্র-পল্লবের আড়ালে,আবডালে বসে থাকা বসন্তের বাঁশরি কোকিলের মিষ্টি মধুর কুহুতান! প্রকৃতির গায়ে ফোঁটে উঠছে বিদায়ী শীতের অপরূপ দৃশ্য।

বিচিত্রাপুরের শীতের ক্রান্তিকাল এসেছে। এসেছে রুদ্ধদের বিদায়ী বার্তা। তার আগে সে তার বাবাকে বিচিত্রাপুরে নিয়ে এসেছে। ফারদিন শাহরিয়ার আসতে চায়নি কিন্তু রুদ্ধ নিজের কথায় অনড় থাকায় তিনি বাধ্যগত চলে এসেছেন তার চিরচেনা সেই গ্রামে! যেখানে কেটেছিল তার শৈশব আর তিক্তময় তরুণ সময়! যেখানে মিশে আছে তার হাজারো স্মৃতি! গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ যেন আজ তার বড্ড অচেনা লাগছে যে পথে একসময় ঘুরে বেড়াতো আজ সেটার এতো পরিবর্তন! রাতের অন্ধকারে সে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু সাইফের বাসায় অবস্থান নিয়েছে। যেটা সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান। এসেছেনও বেশ খানিকটা আগেই। তাকে বেশ সাদরে গ্রহণ করেছে সাইফের পরিবারের মানুষেরা। বড্ড বেশিই ভালো মানুষ তারা। যেটা বেশ দূরেও নয় শাহরিয়ার প্যালেস থেকে। অতঃপর রাতের খাবারের শেষে এসে রুদ্ধকে ফোন দিলেন। প্রথম রিং হতেই রিসিভ করলো সে! সাথে একঝাক প্রশ্নের সম্মীলন!

–বাবাই কেমন আছো? ঠিকমত এসেছো? আসলে এদিকটায় সামলিয়ে উঠতে পারিনি। স্যরি বাবাই?!

–কুল রুদ্ধ! এতো প্রশ্নের ফুলঝুরি কেন তোমার মেয়েদের মতোন? আর আমি ঠিক মতোই এসেছি। এখন তোমার সাইফ আংকেলের বাসায় আছি। সে আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড! এখন আপাতত রেস্ট নেবো।

–ওকে। তাহলে তুমি রেস্ট নাও আমি এদিকটায় সামলায়। এখনও কিছু কাজ বাকি সেগুলো শেষ করে নিই।

–আচ্ছা বেশ। তা তোমার কাজ কতদূর? তোমার দাদুই কি সবটা মেনে নিয়েছেন?

–না এখনও দাদুইকে বলা হয়নি। তবে কালকের মাঝেই সবকিছু পরিষ্কার হবে। তুমি টেনশন নিও না।

–তাহলে ভালোই হলো। তোমার উপর পূর্ণ বিশ্বাস আমার আছে সো টেনশন নেয়ার প্রশ্নই আসে না।

-থ্যাংকস বাবাই। আর মাত্রই দুদিন! তারপরই আসল অপরাধী ধরা পরবে। সে কে তা শোনলেও তোমার অবাক লাগবে! যাস্ট ওয়েট এ ফিউ ডেইজ!

–অবাক জীবনে অনেকবার হয়েছি। তবে দেখা যাক সে কে? যে আমায় ফাঁসিয়ে নিজেই চরমদশার স্বীকার হতে চলছে। তাকে আমি কিছুতেই ছাড়বো না।

–তা তো অবশ্যই। আচ্ছা বেশ অনেক কথা হলো তুমি এবার রেস্ট নাও। লং জার্নি করে এসেছো সো ইউ নিড এ রেস্ট!

–আচ্ছা তাহলে রাখছি। আর যা করবে একদম সাবধানে। ওকে?

— হুম। রেখেদিল ফোন রুদ্ধ। ফারদিন শাহরিয়ার এবার শোয়ে পড়লেন। বেশ জার্নি হয়েছে তার। তাই তিনি সবচিন্তা থেকে মুক্তির উদ্দ্যেশে ঘুমের দেশে পাড়ী জমালেন।

৩৭.

খাবার টেবিলে আজ রুদ্ধরাসহ শাহরিয়ার প্যালেসের সকল সদস্যই খেতে বসেছে। একেবারে রাজকীয় ধাঁচে! সকলের খাবার মাঝে রুদ্ধদের উদ্দ্যেশে আফাজ শাহরিয়ার বলে উঠলেন,

–সময় তো বেশ ফুরিয়ে এসেছে। তোমরা নাহয় আরও কয়েকটা দিন এক্সট্রা থেকে যেও।

সকলের দৃষ্টি এখন রুদ্ধ অহনের উপর। রুদ্ধ বলে উঠল,

–না দাদু, আসলে মেডিকেলে যেতে হবে। আর্জেন্ট কয়েকটা মিটিং আছে চারদিন পর তাই।

–তুমি ডাক্তার? কই বললে না তো আমায়?

–আসলে দাদু সময়ই হয় নি। আর শুধু আমিই নয় অহনও ডাক্তার।

অবাক চোখে রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইল অনিমা। আর অহনের দিকে তন্বী। তারা জানতোই না যে রুদ্ধ আর অহন দুজনেই ডাক্তার।

–আচ্ছা সমস্যা নেই। তা কখন যাবে বলে ঠিক করেছো?’ খেতে খেতে প্রশ্নটি করলেন রুদ্ধের দাদুই।

–এই তো কালই যাবো।

–না, কাল নয় বরং দুদিন পর যেও। কারণ, কাল আমার বন্ধু আলি মির্জার মেয়ে কনক আসবে। তাদের সাথে পরিচিত হয়ে যেও?

রুদ্ধ আর অহন তাহমিদা খাতুন আর ফাহাদ শাহরিয়ারের দিকে একপলক তাকালো। তারাও সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেন। তাই অহন বলে উঠল,

–ওকে দাদু, আমরা তাহলে দুদিন পরেই যাচ্ছি। আর রুদ্ধের কোনো সমস্যা নেই। মিটিংটাতেও এটেন্ড হওয়া যাবে।

–বেশ তাহলে তাই হোক।’ বলে খাবার শেষ করে উঠে পড়লেন তিনি। সকলেও খাওয়া শেষ।

রুদ্ধ মনে মনে বিড়বিড় করছে,

–অবশেষে আসছে শাহরিয়ার পরিবারের সবচেয়ে মহা শত্রু। শাহরিয়ার পরিবারের ভাঙ্গার একমাত্রই মূল চক্র! আসুন আসুন মিস মির্জা! তবে আসল কাজ হবে কালই। এক ঢিলে দিই পাখি তুমি মেরেছো, আমিও সেই কাজ করবো যাতে সাপও না মরে আর লাঠিও না ভাঙে! আর সেটা নাহয় কাল দেখবে দাদুই তুমি। যে তারা তোমার বন্ধু ছিলোনা তারা জাতশত্রু ছিলো এই শাহরিয়ার পরিবারের।

রুদ্ধকে বসে থাকতে দেখে অহন এগিয়ে গেলো তার কাছে,

–কি ভাবছিস?

–কাল কি হবে সেটাই।

–পেনিক নিচ্ছিস কেন? কাল দেখবি সব গোছালোভাবেই হবে যেমনটা করে আমরা প্লানগুলো করেছিলাম।

–সেটা তো বুঝতে পারছি। কিন্তু সবটাই শোনার পর দাদুইয়ের অবস্থা কেমন হবে সেটার টেনশন বেশি হচ্ছে।

–আংকেল থাকবে সেখানে সো টেনশন করার কোনো কারণ নেই। আর চল কেউ এভাবে দেখলে খারাপ ভাববে।

–হুম। চল রুমে কথা আছে।’ বলে দুজনেই অহনের রুমের উদ্দ্যেশে চলে গেলো।

অহন খাটের উপর বসে রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক সেসময় এলো রুদ্ধের ফোন। তার আপুই কল করেছে। রিসিভ করে কানের কাছে নিতেই,

–হা আপুই বল।

–…

–ওকে, তুই শিউর?

–হান্ড্রেট পার্সেন্ট শিউর। তবে খুব নিখুঁতভাবেই কাজটা করতে হবে। আমি সবকিছুর রেকর্ড করে নিয়েছি। সে তোর কাছে দিয়ে দিলাম দেখ।

–কে কে ছিলো?

–….

–বেশ তাহলে ঠিক আছে। তুইও কাল এখানে চলে আসবি সবাইকে নিয়েই।

–ওকে। ঠিকানাটা মেসেজ করে দিস।

–হুম।

রেখেদিল ফোন রুদ্ধ। তার মাথা এখন পুরোই চিন্তামুক্ত। যেটার ভয় সে এতক্ষণ করছিলো সেটা তার আপু অনায়াসেই করে দিলো। সে ডাটা অন করে ক্লীপটা চালু করলো। অহনও দেখলো সবটাই।

–তাহলে গুটি এখন সঠিকভাবে চাল দিলেই ছক্কা উঠবে।

–কিছুর দরকার নেই। কজ, জাহিদ আলি এখন বিচিত্রাপুরের মধ্যেই আছে। আর তাকে আমিই আনিয়েছি।

–কখন করলি এসব?

–করলাম একসময়!’ বলে রহস্যময় হাসি দিলো অহনের উদ্দ্যেশে। বোকারামের মতোন রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইল সে। সবকিছুই তার মাথার উপর দিয়েই যাচ্ছে।

৩৮.

নিস্তব্ধতায় ঘেরা রাত্রির চন্দ্রবিলাশ করছে অনিমা। আর ভাবছে রুদ্ধের কথা। তুরন তার জীবন থেকে চলে যাওয়াতে কয়েকটা দিন খারাপ লাগলেও কখনও তার ভেতরটা নাড়া দেয়নি। কিন্তু এই কয়েকদিনে তার মনের ভেতরে বেশ সুপ্ত অনুভূতির জন্ম নিয়েছে। তাও সবটাই রুদ্ধময়! সবসময় তার এখন রুদ্ধকে নিয়ে ভাবতে বেশ ভালোই লাগে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়! একমনে আকাশপানে তাকিয়ে নিজের মনকুঠিরে রুদ্ধের ছবি আঁকছে সে! সে জানে না এই অনুভূতিটার নাম সে কি দিবে? ভালোবাসা! তাই হবে! সে হয়তো ভালোবেসে ফেলেছে তার অসভ্যকে। তার অনিরুদ্ধকে! তারই মাঝে এসে উপস্থিত হলো তার কাঙ্খিত সেই মানুষটি! যাকে নিয়ে সে তার রঙিন ভুবন সাজাতে ব্যস্ত আর মানুষটি তার প্রেয়সীকে দেখতে ব্যস্ত। রুদ্ধ একমনে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে অনিমার দিকে তাকিয়ে আছে। অনিমা মুচকি হেসে সেদিকে ফিরতে রুদ্ধকে দেখতে পেলো। এ যেন এক অন্য রুদ্ধ। সে হালকা কেশে ধ্যানচ্যুত করলো রুদ্ধকে।

–কি ব্যাপার এই অসময়ে আমার রুমে কি?

অনিমার প্রশ্নে হালকা হাসলো রুদ্ধ। যেই হাসিটা অনিমার কাছে বেশ প্রিয়!

–তোমায় দেখতে এলাম ফুলপরী! এই চন্দ্রের আলোয় আমার প্রিয়সীকে ঠিক কেমন লাগে তা উপভোগ করতে এসেছি।

–অসভ্য! তাই এই কারণেই তো আপনাকে অসভ্য বলি।

–তোমার কাছে আমি হাজারবার অসভ্য হতে রাজি। যদি তার পারমিশন তুমি দাও।

–ধ্যাত। আপনার মুখে কিছু আটকায় না একদম। আপনাকে যে বিয়ে করবে সে নির্ঘাত হার্ট এট্যাক করবে।

–তাই!

–হুম।

–তা আমায় কে বিয়ে করবে জানো?

–কে?

হালকা ভ্রুকুঁচকে জিজ্ঞেস করলো অনিমা।

–তুমি! মিস অনিমা মেহরুবা। উফস্ স্যরি, মিসেস অনিমা রুদ্ধ শাহরিয়ার।

রুদ্ধের এমন কথায় বেশ লজ্জা পেয়ে অপরদিকে তাকিয়ে রইল সে। অনুভব করছে রুদ্ধকে। হঠাৎ অনিমার গা ঘেঁষে দাড়ালো রুদ্ধ। হালকা কেঁপে উঠল সে। তারপরে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

–তুমি কি জানো? প্রত্যেক দিনের শুরুতে তোমায় মনে মনে ভেবে দিনটাকে আলোকিত করি! প্রত্যেক বিকেলে তোমাকে গোধুলী আকাশে মনের মতোন করে সাজাই! প্রত্যেক সন্ধ্যায় শুক তারার মত করে আমার পাশে তোমাকে সাথে করে রাখি! প্রত্যেক রাতে তোমায় ভেবে আমার স্বপ্ন রঙ্গিন বানায়! এভাবে আমার এক একটা দিন সর্ম্পূন হয়! যার শুরুতে থাকো তুমি আর শেষেও থাকো শুধুই তুমিটা! তাই সবটা সময়ই তোমায় ভেবে আমি ভাল থাকি।…. বুঝলে মিস অনিমা মেহরুবা উহুহহ মাই সুইট ফুলপরী!

রুদ্ধের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমা। প্রতিদিনই এমন করে তবে আজ যেন সে অন্য রুদ্ধকে দেখছে। কেমন যেন ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

–হঠাৎ এমন রোমান্টিক মুডে মিস্টার রুদ্ধ শাহরিয়ার ওরফে মি.অসভ্য!!

–তোমায় দেখলে প্রতিটা মুহুর্তেই রোমান্টিকতা ছেয়ে ধরে আমায়! তাই তো নিত্য নতুনাকার মতোই আবারও ফিরে এলাম সেই এক্টিভমুডে… বলেই চোখ টিপ মারলো রুদ্ধ।

–উহুহ একদমই না।…. বলেই দৌড়ে পালালো অনিমা।

অনিমার এমন বাচ্চামো দেখে হেসে ফেললো রুদ্ধ।
.
.
.
.
~চলবে ইনশা’আল্লাহ্।

[ভুলত্রুটি মার্জনীয়। হ্যাপি রিডিং 💜।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here