নেশাটাই তুমিময় পর্ব -শেষ

#নেশাটাই_তুমিময়
#আবরার_আহমেদ_শুভ্র (Writer)
#পর্বঃ ১৯ (অন্তিম পর্ব)
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]

৪৩.

শীতে ম্রিয়মাণ প্রকৃতি বসন্তের জাদুময়ী স্পর্শে হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত! দখিনা ঝির ঝিরে বাতাস, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া নিয়ে এসেছে বসন্ত! শীতের নির্জীব প্রকৃতি যেন সহসা জেগে ওঠে। শীতের পরে রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ আর সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে আসে এই ঋতুরাজ বসন্ত। দখিনা মলয়ে বসন্ত ঋতুর আগমনী বার্তা শোনা যায়।বসন্তের আগমনে প্রকৃতি যেন তার জীর্ণতা মুছতে শুরু করে। শীতের পাতাঝরা বৃক্ষগুলো এত দিনে যেন বিগত যৌবনা বৃদ্ধার মতো দাঁড়িয়ে ছিল রিক্ত বেশে। বসন্ত এসে যেন তাকে দান করেছে যৌবনের উন্মাদনা। মৃতপ্রায় নগ্ন ডালগুলোতে আসে নতুন পাতার আশীর্বাদ। শুকনো মাটির বুক ফেটে গজিয়ে ওঠে মসৃণ সুন্দর ঘাসের দল। বসন্ত আসে পাখির কলকাকলী আর অপার সবুজের সমাহার নিয়ে। গ্রামবাংলার প্রকৃতি এ সময় নবরূপে সজ্জিত হয়। গাছে গাছে নতুন কচি পাতা আর পুষ্প মঞ্জরির সমারোহ। চারদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। দিগন্ত বিস্তৃত ধানের খেতে সবুজের ঢেউ খেলে। পাতায় পাতায় আলোর নাচন। প্রকৃতি ভরে উঠে এক অনুপম সৌন্দর্যে। রং-বেরঙের ফুলে ফলে ভরে যায় গাছগাছালি।

বিচিত্রাপুরের বসন্ত যেন নতুন রূপে হাজির হয়েছে গ্রামবাসীর মাঝে! সাথে শাহরিয়ার পরিবারে বিয়ের আমেজ এসেছে নতুন করে। গ্রাম্য জমিদার আফাজ শাহরিয়ারের প্রথম নাতীর বিয়ে বলে কথা! কিন্তু এরই মাঝে শাহরিয়ার প্যালেসে খবর এলো জাহিদ আলি ও জাফরিন আলি কনক ওরফে কলি বেগমের ফাঁসির রায় হয়েছে। সকাল সকাল খবরটা শোনা কান্নায় ভেঙে পড়ল লিসা। সে কখনওই ভাবে নি তার বাবা আর ফুপির এমন দশা তাকে দেখতে হবে! কিন্তু এটা যে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! তাই মনকে শক্তকরে গুটিয়ে নিলো নিজেকে। তাকে যে শক্ত হতে হবে। আর অপরাধীরা শাস্তি না পেলে আগের চেয়ে ভয়ানক হতেও সময় নেবে না। তার ভাবনার মাঝে ছেদ পড়ল তুরন আর ফারিহার আগমনে। তুরনের চোখেও পানি। কারণ, তার মাও যে আজ ফাঁশির আসামী!

–কান্না করছিস লিসু?

তুরনের প্রশ্নোত্তরে অন্যদিকে মুখ ঘোরালো সে। নিজের চোখেরজল মুছতে ব্যতিব্যস্ত হলো। চোখ মুছে আবারও তাদের দিকে ফিরে উত্তরটা দিলো,

–না ভাইয়া, নিজেকে শক্ত করছি! অপরাধীদের শাস্তি পেতে হবে না? তাতে কি আর কান্না করলে চলে তুই বল?

ফারিহা এগিয়ে গিয়ে লিসার থুতুনি ধরে বলল,

–সেটা নাহ বুঝলাম, কিন্তু তোমার চোখ যে অন্য কথা বলছে!

–হা, সেটাও স্বাভাবিক। হালকা কাঁদছিলাম তাদের জন্য। কিন্তু আর কাঁদবো না। কখনও না!

–আচ্ছা বেশ, চল নাস্তা করতে হবে। নিচে সকলে তোর অপেক্ষায় রয়েছে।

–হুম।

–কি হুম? রুদ্ধের বিয়ের পরই তো তোর আর তুর্যনের বিয়ে! তো বিয়ের জন্য নিজেকে রেডি করে নে!

বিয়ের কথা শোনামাত্রই লজ্জায় ঘিরে ধরল লিসাকে। হাজার হলেও বিয়ের কথা! যেকোনো নিয়েই অনেক স্বপ্ন থাকে। লিসাও তার ব্যতিক্রম নয়। লজ্জায় নিজেকে রাঙিয়ে,

–ধ্যাত তোরাও না ভাইয়া।.. বলে দৌড়ে নিচে চলে গেলো সে।

নিচে সকলে খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছিলো লিসার জন্য। ও আসা মাত্রই রুদ্ধের মা বলে উঠল,

–লিসা মা! তোমার আসতে লেট হলো কেন?

–আসলে আন্টি….

লিসাকে বলতে না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে তুরন বলে উঠল,

–আসলে আন্টি লিসা রঙিন স্বপ্নে বিভোর তাই! সেই রঙিন স্বপ্ন থেকে বের হতে একটু লেট হলো।

সকলে স্বশব্দে হেসে উঠলো বেচারি লিসাকে লজ্জা দিয়ে। লিসা আর না পেরে লজ্জায় তুর্যনের পাশে যে খালি টেবিল ছিলো তাতেই বসে পড়ল। তা দেখে সকলেও এবার খাবারে মন দিলো।

৪৪.

‘শাহরিয়ার প্যালেস’ আজ ভিন্ন রঙে সেজেছে আজ! আফাজ শাহরিয়ারের বড় নাতি রুদ্ধ শাহরিয়ারের বিয়ে আজ। প্রকৃতিও যেন তাল মিলিয়ে ভিন্ন রূপে ধরা দিয়েছে ধরনীর বুকে! সকাল থেকেই অতিথিরা আসতে শুরু করেছে। অনিমাকেও আজ বেশ খুশি খুশিই লাগছে! অবশেষে তার বহু প্রতিক্ষার ফল সে পাচ্ছে।

বেলা গড়াতেই তার ছোট মামি এসে হাজির তার রুমে। বিয়ের শাড়ী আর প্রসাধনী নিয়ে। সাথে পার্লার থেকে আগত কয়েকজন স্পেশালিষ্ট। তাদের নিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন আসমা বেগম। অনিমা তখন বারান্দায় দাড়িয়ে বাহিরের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত। আসমা বেগম অনিমাকে রুমে না পেয়ে বারান্দায় গেলেন। বারান্দায় গিয়ে দেখতে পেলেন সে বারান্দার রেলিং ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ তাদের ছোট্ট অনুর বিয়ের দিন। আঁচলে চোখেরজল মুছলেন তিনি। অবশেষে তাদের ছোট্ট অনু সুখের দেখা পাচ্ছে।

–কিরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি?

ধ্যান ভাঙলো অনিমার। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো তার ছোট মামি। মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলো উঠল,

–আজ খুব দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে ছোটমা। আজ মা থাকলে খুব খুশি হতো তাই না?

–মন খারাপ করতে নেই যে? আমাকে কি তুই মা বলে মনে করিস না?.. মন খারাপ করে বলে উঠল আসমা বেগম।

অনিমা এক কদম এগিয়ে এলো আসমা বেগমের দিকে।।আলতো করে জড়িয়ে বলে উঠল, ‘কেন মনে করবো না? আমার দ্বিতীয় মা তো তুমিই।’

–তাহলে মন খারাপ না করে ঝটপট রেডি হয়ে নে। কিছুক্ষণ পরই তো বিয়ের কার্যক্রম সব শুরু হয়ে যাবে।

বিয়ের কথায় লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেলো অনিমার। সে মুচকি হেসে জবাব দিলো, ‘হুম।’ বলে একপ্রকার লজ্জায় রুমে চলে এলো।

পার্লার স্পেশালিষ্টরা ইতিমধ্যে অনিমাকে সাজাতে শুরু করে দিয়েছে। বেশ সুন্দর লাগছে অনিমাকে সবুজের উপর সাদা পাতের লেহেঙ্গায়। এক অভিন্নতায় সাজিয়ে তোলা হয়েছে তার সাজগুলো।

বেশ খানিক পরই সাজানো পর্ব শেষ হলো। এককথায় অসাধারণ লাগছে অনিকে। আসমা বেগম খুঠিয়ে খুঠিয়ে দেখছে তাকে। শেষে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,

–‘মাশা’আল্লাহ্, বেশ লাগছে আমার মেয়েটাকে।’
______

বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। রুদ্ধও বেশ অবলীলায় স্টেইজে বসে আছে কাজি সাহেবের সাথে। অপেক্ষা করছে তার প্রিয়সী আসার। কিন্তু কনে এখনও নামছে না দেখে অনির বড় মামা ইনকিয়াত আনাস ফারিহাকে অনির রুমে পাঠাতে বলবেন এমন সমম কানে এলো, ‘কনে আসছে’ এমন কয়েকটা আওয়াজ। সাথে সাথে সকলে সেদিকে তাকালো। সিড়ি বেয়ে নামছে অনিমা সাথে তন্বী আর আসমা বেগম। স্টেইজে আসার আগেই হাফসা খান এসে অনিমার ঘাড়ের দিকে হালকা কাজল লাগিয়ে বলে উঠল, ‘মাশা’আল্লাহ্ বেশ লাগছে আমার বউমাকে। নজর না লাগে যেন।’ সাথে সাথে সকলে হেসে উঠল।

অনিমাও একবার রুদ্ধের দিকে তাকালো। সবুজ শেরওয়ানি আর সাদা কুটিতে বেশ দেখতে লাগছে। একধ্যনে রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইল সে। কিন্তু রুদ্ধের চোখেচোখে হতেই নামিয়ে নিলো চোখজোড়া।

রুদ্ধ অনিমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড়িয়ে উঠল,

–তোমার প্রতিটা রূপই আমার মনে আগুন ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট। কখন যে তোমার এমন রূপে দগ্ধ হয় নিজেও জানি না।

কথাগুলো বিড়বিড় করে বললেও অনিমা ঠিকই কথাগুলো শোনতে পেলো। আর সেগুলো শোনা মাত্রই একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরল তাকে। খানিক পরে কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করল।

রুদ্ধকে কবুল বলতে বলায় সে কোনো জড়তা ছাড়াই তিনবার কবুল বলে দিলো। তার এমন কাণ্ডে সকলে বেশ অবাক হলো। সবচেয়ে বেশি অবাক হলো তার দাদুই। তিনি মনে মনে বলতে লাগলেন, ‘দাদু আমার বউয়ের জন্যই দেখি তর সইছে না। তাই তো বলি প্রথমদিন থেকে কেন আমার নাতিটা নাতবৌয়ের পিছে পিছে ঘুরে! এখন বুঝতে পারলাম আসল কাহিনী। সাবাস বেটা! দাদুর মতোন হলি তুই।’

বিয়ে শেষ হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। নিয়ম রিতী অনুসারে অনিমাকে কোলে করে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করেছিল সে। অবশেষে তাকে রুমে পৌঁছে দিয়ে সকলে বেড়িয়ে এলো। এদিকে বেচারা রুদ্ধ রুমে ঢুকতেও পারছে না কাজিনদের জন্য। সাথে ওয়ালেট না থাকায় টাকাও দিতে পারছে না। শেষমেশ অহনের কাছ থেকে ধার নিয়ে তাদের অহন রুদ্ধের কানে কানে ফিসফিস করে বলল,

–শালা, বিয়ে করতে এসেছিস টাকা রাখবি না সাথে?

–আমি কি জানতাম? এর আগে দু একটা বিয়ে করলে হয়তো জানতাম।

–হয়েছে এবার যা। ঐদিকে আমার বোনটা একা একা বসে আছে।

–হু, সেটাই তো শালাবাবু। যায় হে। দোয়া করিস। যেন বছর ঘুরতে না ঘুরতেই খুশির খবরটা দিতে পারি।… বলে অহনকে চোখ টিপ দিয়ে চলে গেলো রুদ্ধ। অহন বোকার মতোন রুদ্ধের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।

৪৫.

খাঠের উপর ইয়া বড় একটা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে অনিমা। খুশি আর ভয় দুটোই কাজ করছে আজ তার। একদিকে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার ভয়, আর নিজের ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পেতে বেশ খুশি লাগছে তার।

দড়জা খুলার শব্দে নড়েচড়ে বসল সে। রুদ্ধের উপস্থিতি টের পেল। রুদ্ধ একদম এগিয়ে এসে খাঠের উপর বসল। অনির দেয়া ঘোমটা তুলে তার দিকে তাকালো। আবেশে অনিমা আঁখিজোড়া বন্ধ করে নিলো। তা দেখে রুদ্ধ বলে উঠল,

–এভাবে আমায় আর কত রাঙাবে ফুলপরী? তোমার রঙে নিজেকে হাজার বারই তো রাঙিয়েছি! আর কত বার রাঙাবো বলোতো?

অনিমাও চোখ বন্ধ করে জবাব দিলো,

–আপনি যতবার চান ঠিক ততোবারই রাঙাবেন নিজেকে ডাক্তারসাহেব!

–বেশ! জানো, আজ আমি খুউব খুশি! আমার ফুলপরীকে আমি আপন করে পেয়েছি। একদম নিজের করে।

–আমিও খুশি ডাক্তারসাহেব আপনাকে পেয়ে। ভয় হয় যদি আপনি আমায় কখনও ভুল বুঝেন?

–বিশ্বাস রাখতে পারো তোমার ডাক্তারসাহেবের প্রতি। তোমার এই হাতজোড়া ধরেছি ছাড়তে নয়! সারাজীবন এক হয়ে চলার অনুযোগে। কারণ, কি জানো?

অনিমা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালো রুদ্ধের দিকে,

–কারণ, তুমিই তো রুদ্ধের অনি। অনিরুদ্ধ! সারাটা জীবন যেন তোমায় সাথে নিয়ে চলতে পারি তার জন্যেই তোমায় একেবারে আপন করলাম। এই দুহাত আমার কাছে বিশ্বস্ততার প্রতিরূপ!

–আমার কাছেও আপনি বিশ্বস্ততার এক অনন্য প্রতিচ্ছবি!

–তুমি কি জানো ফুলপরী তুমিই আমার নেশা! আমার নেশাটাই_তুমিময়!

রুদ্ধের কথায় মুচকি হাসি দিলো অনিমা। সে জানে রুদ্ধ তাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে! সে দুহাতে জড়িয়ে ধরল রুদ্ধকে। রুদ্ধও তার প্রিয়সীকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। তারপরে কপালে আলতো করে নিজের উষ্ণ অদরের ছোঁয়া দিলো। যেটাতে মিশে আছে পবিত্রতা! শুরু হোক এভাবে কিছু ভালোবাসা তৃপ্তিতার সাথে!

— সমাপ্ত —-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here