নেশাটাই তুমিময় পর্ব -১৩

#নেশাটাই_তুমিময়
#আবরার_আহমেদ_শুভ্র [Writer]
#পর্বঃ ১৩ [ধামাকা পর্ব]

২৮.

প্রকৃতি হলো সরলতায় পূর্ণ যেন এক যৌগিক আশ্রয়! প্রকৃতিতে প্রস্ফুটিত প্রত্যেকটি ফুলই হলো যেন এক একটি আত্মাস্বরূপ! প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেলেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় না যেন! প্রকৃতির অনির্বচনীয় শোভা মানুষকে বুঝতে শেখায় যে, পৃথিবীতে এমন কিছু জিনিষ আছে যা অকৃত্রিম! অকার্পণ্য হস্তে সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতিকে ঢেলে সাজিয়েছেন! প্রকৃতির চেয়ে ভালো নকশা যেন তাই কোথাও খুজে পাওয়া দুষ্কর! প্রকৃতিতে যত বেশি সময় অতিবাহিত করা যায় তত বেশি করে এর মর্ম বুঝতে পারা দুঃসাহসী কাজ নয়! প্রকৃতি সব সময় এক আত্মিক রঙ গায়ে জড়িয়ে রাখে! তাই তো একধ্যনে প্রকৃতির পানে চেয়ে আছে অহন। ধ্যানচ্যুত হলো তার আদুরে বোনের কণ্ঠে,

– ‘ভাইয়ু, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। খুবই গুরুত্ববহ সেই কথাসমূহ।’ চোখে কাঠিন্য এনে বলল অনিমা।

অবাক হলো অহন! আজ কতদিন পর সে তার বোনের মুখে ভাইয়ু ডাকটা শুনতে পেলো। নিজেকে যেন আজ ভাগ্যবান মনে হচ্ছে তার। অভিমানটার রেশ কিন্তু একটু বেশি ছিলো অনিমার মনে সেটা বুঝতে পারলো অহন। এতোদিন হয়তো সুপ্ত অভিমাটাকে জমিয়ে রেখে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল অনিমা কিন্তু সেটা আর বেশিদিন দমিয়ে রাখতে পারলো কই? অহনও খুশি মনে বলে উঠল,

– ‘বল অনু, কি এমন কথা যা অত্যাধিক গুরুত্ববহ?’

– ‘লিসা আপু, আই মিন যে মেয়েটা সকালে রুদ্ধ ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরেছে সে তোমাদের করা কোনো পরিকল্পনার কথা কেউকে আড়ালে লুকিয়ে ফোন করে বলছিলো, যা আমি স্পষ্ট শোনতে পেয়েছিলাম। এও বলতে শোনেছি তাদেট পরবর্তী মাস্টার প্লান নিতে।’

তারপরে লিসার বলা সমস্ত কথা অহনকে বলল সে। টনক নড়ে উঠলো অহনের। তাহলে লিসাও এই কাজে জড়িত?তবে কি সেই যে এই সমস্ত কিছুর মাষ্টারমাইন্ড! সে লিসা নয়তো!

– ‘কি ভাবছো ভাইয়ু?’

অহন কিছু একটা ভেবে উত্তর দিলো,

– ‘নাহ্, তেমন কিছু না। যা তুই ফ্রেশ হয়ে নে। ডিনার করতে হবে তো আমাদের! কাল না আমাদেরকে তাড়াতাড়ি বের হতে হবে? আর শোন এসব বিষয়ে একদম টেনশন করার প্রয়োজন নেই। ঠিক আছে?’ বলে অহন জড়িয়ে ধরল বোনকে। সেও শান্তভাবে মাথাটা উপর নিচ করলো অনিমা। মানে সে একদমই চিন্তা করবে না।

তবে আদৌ কি সে চিন্তামুক্ত থাকতে পারবে? যেখানে তার প্রিয় তিনজন মানুষের অস্থিত্ব আছে এই ভয়ংকর প্লানিং এ! একদিকে তার ভাই অহন, পরিবারের সকলের চেয়েও অনিমার কাছে একমাত্র আপন বলতে সেই। যে একদমই তার বাবার মতোন আর তন্বী যে তার ভাইয়ের হবু বউ আর তার ছোট বোনের মতোন। অন্যদিকে রুদ্ধ যাকে সে ভালো না বাসলেও তার মনে সুপ্ত বাসনা জন্ম দিয়েছে যা স্পষ্টত যে সেও রুদ্ধকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। এই মহাবিপদে তারা তিনজনই আবদ্ধ। সে চাই না যে তাদের কিছু হোক। এমন হাজারো দুশ্চিন্তা তার মাথায় দলা পাকাচ্ছে! এসব ভাবতে ভাবতে সেও চলে গেল নিজেদের রুমে। আর মনে মনে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠল,

– ‘সবাই সবটাই করুক, আমিও কিন্তু এর শেষ দেখেই তবে ছাড়ব। আর এই লিসা মেয়েটাকে আমার কাছে একদমই সুবিধার লাগছে না। না লাগছে এই মেয়ের কাণ্ডহীন কাজগুলো। এর মাঝে নিশ্চয় কোনো গণ্ডগোল তো আছেই। বের করা প্রয়োজন এর রহস্য। যায়হোক, শেষটা যেন ভালোই হয়।’

২৯.

গ্রাম প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্যের নাম! বিধাতার সৃষ্টি যে এত্ত সুন্দর তা গ্রাম না দেখলে বুঝা এতো সোজাও নয়!যে দিকে দুচোখ যায় সেদিকেই খালি সবুজের সমারোহ। গ্রামের সবুজ প্রকৃতি, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, ধানক্ষেতের ওপর সবুজাভ হলুদের সমারোহ প্রতিবারই মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে! গ্রামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কত কবি, সাহিত্যিক যে কতশত কাব্য রচনা করেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। গ্রামের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে কবিতার পাতায় পাতায়। গানের প্রতিটি লাইনে লাইনে। তাই তো কবির শুরে বলা হয়, “গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথ
আমার মন ভোলায় রে!” সবুজের ছায়ায় ঘেরা গ্রামের সৌন্দর্য মুগ্ধ করে সকলকে। গ্রামের বিশাল বির্স্তীর্ণ মাঠ সেই সাথে বেয়ে চলা আঁকাবাঁকা পথ যদি জানান দেয় প্রকৃতি বয়ে চলে তা নির্দিষ্ট নিয়মে এবং নির্দিষ্ট গতিতে!গ্রামের সৌন্দর্য কখনোই ইটঁকাঠে তৈরি দালানের শহরে পাওয়া সম্ভব নয়! তাইতো শহরের মানুষ খানিকটা অবসরে নাড়ির টানে ছুঁটে আসে তারই জন্মস্থল! প্রকৃতিতে ঘেরা এই গ্রামে। প্রতিটি ঋতুর জন্য থাকে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের আচার এবং অনুষ্ঠান। প্রতিটি ঋতু তাই আপন মহিমায় ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্যের উৎস নিয়ে হাজির হয় গ্রামে। গ্রীষ্মকালে নানা ধরণের ফলের বাহার, শীতকালের খেজুরের রস এর হিড়িক, বর্ষাকালে নানান ধরণের মাছ ধরার হিড়িক, শরতের শুভ্র কাশফুল প্রতি দিন হয়ে উঠে গ্রামিণ উৎসব পারবনময়। গ্রামে হয়তো শহরের মতোন অটো সুযোগ কিংবা সুবিধা নেই, কিন্তু রয়েছে অপরূপ শান্তি এবং অপার প্রকৃতির সমারোহ।

বিচিত্রাপুরের প্রকৃতিতেও এই ধরনের আমেজ বর্তমানে বিরাজমান! এইখানকার আবহাওয়াও যেন বিচিত্রাপুরের মতোন সম্পূর্ণ বিচিত্র! বেশ মনোরম আর মনজুড়ানো! রুদ্ধরাও বেশকিছুক্ষন আগেই পৌঁছেছে এই গ্রামে। অনিমা, তন্বীরও বেশ ভালো লাগছে এই সবুজের সমারোহ প্রকৃতি! অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল প্রকৃতি! অহন-রুদ্ধও তাদের প্রেয়সীদের অবাক চাহনির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে তাদের পরিলক্ষিন করছে। রুদ্ধদের সকলের সম্ভিৎ ফিরলো গ্রাম্য কিছু লোকদের কোলাহলে যেটা তাদের জন্যই হয়েছে মনে হলো রুদ্ধের। সে দ্রুত গাড়ী থেকে নেমে পড়ল। সাথে অহন অনিমা তন্বীও নেমে পড়ল। একজন ৪০র্ধ বয়সী লোক এলো রুদ্ধের কাছে। রুদ্ধের মানুষটাকে বেশ চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছে বলে মনে হচ্ছে তাকে। লোকটা রুদ্ধের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘তোমরা কি শহর থেকে এসেছো বাবারা? তোমাদের দেখে তো এমনই মনে হচ্ছে।’

রুদ্ধও তৎক্ষণাৎ উত্তরটা দিয়ে দিলো, ‘জ্বী আসলে আমরা শহর থেকে এসেছি। আসলে বিচিত্রাপুরের নাম অনেক শোনেছি তো তাই এখানে আসা। এখানকার পরিবেশের সাথে পরিচিত হতেই আসা।’

লোকটাকে শিক্ষিত মনে হচ্ছে ওদের সকলের। লোকটা যেন এবার বেশ খুশি হলো মনে হয়।

– ‘আচ্ছা বেশ! তোমরা তাহলে গ্রামে যেতে পারো। আরেকটা কথা, তোমাদের কি এখানে চেনা জানা কেউ আছে যাদের কাছে তোমরা থাকবে?’

– ‘না তবে, আফাজ শাহরিয়ারের নাম শোনেছি। যিনি এই বিচিত্রাপুরের জমিদার! বর্তমানেও তিনি এখানকার জমিদারই আছেন। তারা নাকি বেশ আত্মীয়পরায়ন। যদি তাদের বাড়ীটা দেখিয়ে দিতেন।’

– ‘ওও, বুঝেছি। ভাইজানের নাম বলতেছো, আমি ফাহাদ শাহরিয়ার। ওনার ছোট ভাইপো।’ এবার আর চিনতে অসুবিধা হলো না রুদ্ধের। সে বাবার পারিবারিক ফটোগ্রাফে এনাকে দেখেছিলো। এই লোকটাই তার বাবার চাচাতো ভাই। মানে রুদ্ধের ছোটচাচ্চু এই লোকটা! রুদ্ধের মনটা আনন্দে ভরে উঠল। যে সবসময় তার বাবা ফারদিন শাহরিয়ারের আদরের ছিলো সেই ব্যক্তিটি আজ তাদের সামনে। যাকে বাঁচাতেই আজ ফারদিন শাহরিয়ার তাদের ছেড়ে অনেক দূরে। রুদ্ধের ধ্যান ভাঙ্গলো লোকটির কথায়।

– ‘বেশ, চলো তাহলে। বড়বাবাও তোমাদের দেখলো খুশি হবেন। বেশ ভালো মনের মানুষ আমার বড়বাবা।’ বলে সামনের লোকদের তাদের স্থানিয় ভাষায় কি যেন বললো। সকলে আস্তে আস্তে সরে গেলো সামনে থেকে আর তাদের যাওয়ার পথ করে দিয়ে। যে যার কাজে চলে গেলো। আর আমান শাহরিয়ার নামের লোকটিসহ সকলে আবার গাড়ীতে চড়ে বসল। তাদের সাথে করে গাড়ী নিয়ে এগিয়ে চলল ‘শাহরিয়ার প্যালেস’ এর উদ্দ্যেশে।

৩০.

বেশ কিছুক্ষণ পর তাদের গাড়ী এসে পৌঁছালো ‘শাহরিয়ার প্যালেস’ এর সামনে। সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বাড়ীটার দিকে। রাজপ্রসাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এটা। পুরোনো হলেও বেশ সুন্দর আর রাজকীয় ভাবটাই রয়ে গেছে এই বাড়ীর। রুদ্ধের ছোট চাচা বলে উঠল,

– ‘তোমরা কিছুক্ষন দাড়াও আমি আসছি ভেতর থেকে। কিছু মনে করো না বাবারা।’

অহনও নির্দ্বিধায় উত্তর দিলো, ‘সমস্যা নেই আংকেল আপনি যেতে পারেন, ততক্ষণে আমরা এখানে আছি।’

– ‘আচ্ছা তাহলে।’ বলে ওনি বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করলেন। আর এদিকে রুদ্ধ অহনকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বললে অহন আশ্বস্ত করলো সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন থেকেই কেউ কোনো কথা বলেনি। রুদ্ধের ছোটচাচ্চু বললেও সকলে শুধু হা হু, আর কিছু টুকিটাকি উত্তর দিয়েছিলো। অহন রুদ্ধের কাছে এসে চুপিচুপি বলল,

– ‘দোস্ত, কোনো কিছু চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। সবকিছু ঠাণ্ডা মাথায় করতে হবে। আর যেন ভুল নাহয়। তাহলে সবটাই গঙ্গার জলে! বুঝেছিস?’

– ‘ইয়েস, আই ক্যান! তবে তোরাও একটু সাবধানে থাকবি। ইয়ে মানে, তন্বীর সাথে বেশি রোমান্স করতে যাইস না আবার! যদি ওরা দেখে তাহলে তোদের ধরে এখানেই বিয়ে দিয়ে দিবে।’

– ‘আরে নো প্রবলেম। সেটাই তো চাইছি ভাই! সেটা হলে তো ভালোই হয় একেবারে শ্বশুরবাড়িতে বাচ্চা পয়দার খবর নিয়ে যাবো।’ বলে রুদ্ধকে চোখমেরে দিলো অহন। বেচারি তন্বীও লজ্জায় মাথানিচু করে রইল। যেন সুযোগ পেলেই মাটিতে গর্ত করে লুকিয়ে পড়বে এমন অবস্থা। আর অনিমা সুযোগ পেয়ে আরও লজ্জা দিচ্ছে তন্বীকে। রুদ্ধও হাসতে হাসতে জবাব দিলো,

– ‘আমিও রে। বাবাকে যেন সুখবর দিতে পারি একেবারে এখান থেকে বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে।’ রুদ্ধের কথায় যেন বাজ পড়ল অনিমার।

– ‘কিসের সুখবর ভাইয়া?’ দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল অনিমা।

– ‘আমার বাবা হওয়ার! দেখি গ্রামের কোনে সুন্দরী মেয়ে পায় কিনা। তাহলে একেবারে বিয়ে করে বাবা হওয়ার সুখবরটা বাবাইকে দিবো!’ দাঁত কেলিয়ে বলে উঠল রুদ্ধ।

এবার যেন হঠাৎ মাথায় যেন আগুন ধরে গেলো অনিমার। যেন মুহুর্তেই হিতাহিতো জ্ঞান লোপ পেলো তার। সে এসে তার ভাইয়ার সামনেই রুদ্ধের কলার চেপে ধরে বলে উঠল,

– ‘আমাকে ছেড়ে অন্য মাইয়াকে বিয়ে কথার মাথায় আনছস বেটা খাটাশ! তুই শুধুই আমার! এই অনিমার অনিরুদ্ধ!’

রুদ্ধরা যেন অবাকের শেষ পর্যায়ে। অনিমা এমন বিহেভ যেন রুদ্ধের হজম হচ্ছে না। অনিমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে উঠল,

– ‘মাই গড, মিস অনিমা মেহরুবা! আপনি কি বললেন?’

সম্ভিৎ ফিরে এলো অনিমার। কি বলল সে কিছুক্ষণ আগে? লজ্জায় নিজেই নিজের মাথায় চাপড় দিলো। রুদ্ধ বিয়ে করবে এতে নিজের কেন এত রাগ হচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছে না অনিমা। দ্রুত কলার ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে রইল অনিমা। সবাই যেন আজ নতুন অনিমাকে দেখছে। অহন মনে মনে খুশি হলো অবশেষে তার বোনও তার প্রাপ্ত মানুষটির দিকেই এগুচ্ছে। সকলের ভাবনার মাঝে আগমন গঠল রুদ্ধের ছোট চাচা আর একজন ষাটোর্ধ বয়স্ক মানুষের। পিছনে আরও কয়েকজন মহিলা। সকলকে চিনতে একটুও কষ্ট হলেও ষাটোর্ধ বয়স্ক ব্যক্তিটিকে চিনতে অসুবিধে হলো না রুদ্ধের। এই সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি! অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,

– ‘দাদুই!’
.
.
.
.
~চলবে ইনশা’আল্লাহ্ 🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here