নয়নতারা পর্ব ২|ভালোবাসার গল্প

#নয়নতারা
|পর্ব -২|
#জেরিন_আক্তার_নিপা

নয়নতারা ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে উঁকি দিয়ে কাউকে খুঁজছে। উঁহু, নিচেও নেই। সে ডাকল,

—আপু, এই আপু। তুমি কি নিচে?”

ঠিক তখনই কেউ তাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরল। এত শক্ত বাঁধন সে ছুটাতে পারছে না। ভয় পেয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। এটা মানুষ না জ্বীন ভূত! গায়ে এত জোর! ভয়ের চোটে নয়নতারা আকাশ ফাটানো এক চিৎকার দিল,

—ও বাবা গো ভূত…

নয়নতারার কন্ঠ শুনেই নক্ষত্র বুঝল এবারও তার ভুল হয়েছে। সন্ধ্যার মত এখনও সে ভুল মানুষকে ধরে আছে। নক্ষত্র তাৎক্ষণাত নয়নতারার মুখ চেপে ধরল। যেন সে আর চিৎকার করতে না পারে। বিয়ে বাড়ি। নিচে হল ভর্তি মানুষ। এই মেয়ে দেখছি কোন একটা কেলেঙ্কারি না বাঁধিয়ে শান্তি পাবে না। ইলার জায়গায় সব সময় ওর ছোট বোন এসে পড়ে কেন? নক্ষত্রকে প্যাচে ফালানো ছাড়া এই মেয়ের কি আর কোন কাজ নেই। নয়নতারা যেহেতু ভূত বলে চিৎকার দিয়েছে তাই নক্ষত্র এই সুযোগটাই কাজে লাগালো। গলার স্বর বিকৃত মোটা করে বলল,

—এই মেয়ে একদম চুপ। চিৎকার করলেই ঘাড় মটকে রক্ত চুষে খাব। রাত-বিরেতে আমার আস্তানায় তোমার কী কাজ হ্যাঁ? সন্ধ্যার পরে ছোট মানুষদের ছাঁদে আসতে বারণ জানো না তুমি?”

নক্ষত্র মনে মনে হেসে কুটিকুটি। আর এদিকে ভয়ে নয়নতারার বুক পিঁজরা থেকে প্রাণ ভোমরা উড়াল দিচ্ছে। সে নয়নতারাকে আরও ভয় দেখানোর লোভ সামলাতে পারল ন।

—হাউ মাউ কাউ…
নয়নতারার রক্ত চুষে খাও।
চিৎকার চেঁচামেচি করলে ঘাড় মটকে দিয়ে যাও।
তুমি জানো আমি কোন গাছে থাকি? ওইযে তোমাদের ওই নিম গাছটা আছে না। যেটা তোমার বাবা কখনও কাটতে দেয়না। আমি ওই গাছেই থাকি। একা একা থাকতে বড় কষ্ট হয়। ব্যাচেলর লাইফ আর ভালো লাগে না৷ রান্নাবান্না নিজের করতে হয়। নইলে মাছ মাংস কাচা খাওয়া লাগে। দেখলাম তোমাদের বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে। তাই চলে এলাম। ভাবলাম সুন্দর সুন্দর মেয়ে পাওয়া যাবে। একটাকে ধরে নিয়ে বিয়ে করে ওই গাছটাতে থাকব।
জ্বীন ভূতনির সুখী সংসার।”

নক্ষত্র হাসির কারণে আর বলতে পারছে না। তার পেট ফেটে হাসি আসছে। এখানে আসার পর এমন মজা সে আর পায়নি। দশটা না পাঁচটা না। একটা মাত্র শ্যালিকা। তার সাথে আরেকটু মজা নেওয়া যাক। নক্ষত্র সিঁড়ির দিকে উঁকি দিল। না এখন এদিকটায় কেউ আসবে না। আর এলে তো পায়ের শব্দ শোনাই যাবে। যা নিচু ছাদ। একতলা, সে লাফিয়েই পালাতে পারবে। এখন বরং তারাকে ভয় দেখিয়ে একটু মজা নেওয়া যাক।

—কিন্তু মেয়ে, আমি এখানে আসার পর থেকে শুধু তুমিই আমার সামনে পড়ছো। কী চাও, আমি তোমাকে ধরে নিয়ে বিয়ে করে ওই গাছে বাসা বাঁধি? আমাকে পছন্দ হয়েছে তোমার।”

নয়নতারা এর থেকে বেশি ভয় নিতে পারছিল না। সে জ্ঞান হারিয়ে হঠাৎ সমস্ত শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে নক্ষত্রের উপর ঢলে পড়ল।
নক্ষত্র হাসি থামাতে পারছে না। আবার নয়নতারাকে জ্ঞান হারাতে দেখে ওকে ছেড়ে দিতেও পারছে না। সে হাসতে হাসতেই বলল,

—আরে আরে… এই মেয়ে। নয়নতারা, এই তারা। জ্ঞান হারিয়ে ফেললে নাকি? কী আজব! একটু তো ভয়ই দেখাতে চাইছিলাম। আরে আমি মজা করছিলাম। এই নয়ন…

সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কেউ ছাদে আসছে। কে আসছে? এই বাড়ির কেউ এসে ওকে নয়নতারার সাথে এভাবে দেখে নিলে নিশ্চয়ই তাকে শূলে চড়াবে।

—এইরে! এইবার আর রক্ষে নেই। মজা করতে গিয়ে এবার মনে হয় একটু বেশিই করে ফেলেছি। বিয়ে করতে এসে লাশ হয়ে ফিরতে হবে মনে হচ্ছে। এরা আমাকে আস্ত ছাড়বে না। কেটে কুঁচিকুঁচি করে বাড়ির পেছনের পুকুরে ফেলবে।”

নক্ষত্র নয়নতারাকে কোলে তুলে নিল। সিঁড়ির মাথায় এসে উঁকি দিয়ে নিচে দেখার চেষ্টা করল। ইলা নিচু গলায় ডাকছে,

—নক্ষত্র, এই তুমি কি ছাঁদে?”

নক্ষত্র স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। যাক, অন্য কেউ আসছে না। ইলা আসছে। এই যাত্রায় তাহলে বেঁচে গেল সে। ইলা তাকে বাঁচিয়ে নেবে।
ইলা নক্ষত্রের বুকে নয়নতারাকে দেখে অস্ফুট চিৎকার দিয়ে এগিয়ে এলো।

—এই তুমি আমার বোনের সাথে কী করো?”

—আমি কিছু করি না। তোমার বোনই জ্ঞান হারিয়ে আমার চান্স নিচ্ছে। দেখো না কীভাবে আমার বুকে পড়ে আছে।”

ইলা এখনও কিছুই বুঝতে পারছে না। তার চোখ ছানাবড়া।

—নয়ন, নয়ন এখানে কেন? আর তুমিই বা ওর সাথে ছাদে কেন?”

—তুমি ভেবে এবারও আমি পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরি। তোমার অবুঝ বোন আমাকে ভূত মনে করে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।”

ইলার নক্ষত্রের উপর এত রাগ হলো। সে দুমদাম নক্ষত্রের গায়ে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলল,

—তুমি সত্যিই ভূত। মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়া তোমার অনেক বড় একটা ভুল। তোমার তো ভূত হয়েই শ্যাওড়া গাছে থাকার কথা ছিল। ভূত কোথাকার। আমার বোনকে ছাড়ো। ওকে আমার কাছে দাও।”

—বা রে! তুমি আমার উপর রাগ করছো কেন? আমি তো তোমাকে ছাদে আসতে বলেছিলাম। তোমার জায়গায় যে তোমার বোন চলে এসেছে তা আমাকে ভূত এসে বলে যাবে নাকি।”

ইলা নয়নতারাকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। ওর সারা শরীর ঘামে ভেজা। বেচারি কম ভয় পেয়ে জ্ঞান হারায়নি নিশ্চয়ই। এমনিতেই নয়নের অন্ধকার, ভূত এসবে ভয় বেশি। সে কপট রাগী গলায় বলল,

—তুমি এখানে আমাদের বিয়ের জন্য বাবা মা’কে রাজি করাতে এসেছ? নাকি ভয় দেখিয়ে আমার বোনটাকে মারতে এসেছ বলো তো? সন্ধ্যা থেকে বেচারিকে জ্বালিয়ে যাচ্ছ। এখন তো সীমাই পার করে ফেললে। ওর কিছু হলে আমি তোমাকে ছেড়ে দেব ভেবেছ।”

—- তোমার সব ভালোবাসা তো দেখছি বোনের প্রতি। যত দোষ এখন নক্ষত্র চৌধুরীর! আমি কী করে জানব তুমি আসোনি। এসেছে তোমার বোন। আর ওকে কি আমি ভূত সেজে ভয় দেখিয়েছি? অত বড় ধিঙ্গি মেয়ে নাকি ভূতে ভয় পায়। শুধু শ্বশুর শাশুড়িকে রাজি করানোর জন্য তোমাদের বাড়িতে পড়ে আছি। নয়তো কবেই চলে যেতাম।”

—হয়েছে। তোমার আর উল্টো রাগ দেখাতে হবে না। নয়ন নড়ছে। ও পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে তোমাকে এখানে দেখে ফেলার আগে তুমি কেটে পরো। নইলে কপালে দুঃখ আছে। শ্বশুর শাশুড়িকে আর রাজি করাতে হবে না। উনাদের হাতে রাম কেলানি খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।”

নক্ষত্র কথা বাড়াল না। সে ইলার উপর রাগ করেছে। তার অবস্থা হয়েছে, যার জন্য করলাম চুরি সে-ই বলে চোর টাইপ। সে ছাদের সাথে লাগানো আম গাছটা বেয়ে দুই লাফে নিচে নেমে গেল। ইলা ওর জন্য চিন্তা করে পেছন থেকে বলল,

—সাবধানে যাও। পড়ে গিয়ে হাত পা ভেঙ না আবার। ”

নয়নের জ্ঞান ফিরছে। ইলা ওর গালে আলতো চাপড় দিয়ে ডাকছে,

—নয়ন! এই নয়ন। কী হয়েছে তোর?”

নয়নতারা চোখ খুলে আতঙ্কে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে আশেপাশে তাকায়। সেই লোকটাকে খুঁজছে ও। এটা লোক ছিল না ভূত তা এখনও সে বুঝে উঠতে পারছে না। ওর সামনে ইলাকে দেখে কাঁপা গলায় নয়নতারা বলল,

—আপু! আপু তুমি…এখানে… এখানে একটু আগে…

এটুকু বলে কথা শেষ না করে আরেকবার চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে দেখে নিল সে।

—হ্যাঁ বল। কাউকে খুঁজছিস তুই? কাকে খুঁজছিস নয়ন? কে ছিল এখানে? আর তুই রাতের বেলা একা ছাদে কী করছিস? আমি এসে দেখলাম তুই নিচে পড়ে আছিস। জ্ঞান ছিল না তোর।”

—আপু তুমি জানো না। আমাদের বাড়িতে জ্বীন আছে আপু। সত্যিই আছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। কন্ঠও শুনেছি। পুরুষ জ্বীন৷ আমার সাথে কথা বলেছে…

বলতে বলতে নয়নতারা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ইলার নক্ষত্রের উপর এত রাগ হচ্ছে। সব সময় তার বোনকে ভয় দেখায়। ইচ্ছে করছে নক্ষত্রটাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে। জ্বীন হওয়ার শখ জেগেছে তার।

—এই পাগল, আমাদের বাড়িতে জ্বীন আসবে কোত্থেকে? তোর হয়তো ভুল হয়েছে। বাবা মাসে মাসে আমাদের বাড়িতে মিলাদ পড়ায় না? জ্বীন থাকলেও ওই জ্বীন আমাদের কারো কোন ক্ষতি করবে না বুঝলি। জ্বীনেরা ভালো হয়। ওরা মানুষের ক্ষতি করে না।”

—কিন্তু ওই জ্বীন আমার মুখ চেপে ধরেছিল। আমাকে দক্ষিণের ওই নিম গাছে নিয়ে যাবে বলছিল। আমার ভয় লাগছে আপু। ওই জ্বীন যদি সত্যিই আমাকে নিয়ে যায়!”

—নিবে না। আমি আছি না এখন তোর সাথে? আমাকে রেখে ওই বজ্জাত জ্বীন তোকে নিবে না।”

—আমি বাবার কাছে যাব। আমি আর কক্ষণো ছাদে আসব না। সন্ধ্যার পরে তো না-ই। ”

নয়নতারার শরীরটা ভালো লাগছিল না। তাই সে রুমে এসে বসে আছে। অনেকক্ষণ ওকে ডাকার পরেও রুম থেকে বেরোয় নি সে। আজ ডান্স পারফর্মেন্স করা তার পক্ষে অসম্ভব। দাঁড়ানোর জন্যেই পায়ে জোর পাচ্ছে না। নাচবে কীভাবে সে? ঝিনুক আপু রাগারাগি করবে। তবুও তার কিছু করার নেই। জ্বীন যে তাকে নিতে এসেছে এই খবর তো আর ঝিনুক আপু জানে না। দক্ষিণের ওই নিম গাছে ভূত আছে এই কথা ছোটবেলা দাদী মা’ও বলত। আজ তো নিজেই প্রমাণ পেল সে। দাদী মা’র কথাগুলো তারার মনে পড়ে গেল।

—-অ সতীন। আমারে টক্কর দিয়া দিন দিন সুন্দর হইতাছো। তোমার জ্বীন দাদা আমারে ছাইড়া না জানি কবে তোমার ঘাড়ে চাপে। সুন্দরী মাইয়াদের নিয়া এই হইলো জ্বালা। দেখোস না আমারে কেমন রাইত বিরাইতে ছাদে ডাইকা নিয়া যায়।’

দাদী মা’র ওসব কথায় অনেক ভয় পেত সে। তবুও দাদীমা তার সাথেই যতসব জ্বীন ভূতের কথা বলত। যেদিন সে ভূতের গল্প শুনত সেদিন রাতে বাবার মা’র রুমে ঘুমাত। ইলা আপুর সাথে থাকলে ভয় লাগত। আপু জড়িয়ে ধরতে দিত না। এজন্য বাবা দাদীর সাথে রাগারাগিও করেছে কত। দাদী বাবার কথা শুনে হেসে বলত,

—-তোর এই মাইয়া সবার থেইকা আলাদা। এরে আমি অনেক পছন্দ করি। ভয় পাওয়াইয়া ওরে একটু শক্ত করি। জামাই বাড়ি যাওয়া লাগব তো। অত ভয় ওর কাটব কেমনে?’

বাবা তার বিয়ের কথা শুনে আরও রেগে যেত।

—–আমার এই মেয়েকে বিয়ে দেব না আমি। আর দিলেও ঘরজামাই এনে রাখব। মেয়েও আমার কাছে থাকবে জামাইও। দুই মেয়েকেই কাছ ছাড়া করলে আমি বাঁচব নাকি? ওদের একজনকেও কাছে না পেলে আমি তো মরেই যাব।’

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here