নয়নতারা পর্ব ১|রোমান্টিক গল্প

#নয়নতারা
|পর্ব -১|

নিজের বড় বোনের প্রেমিকের সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে নয়নতারার। হ্যাঁ, নক্ষত্র তার বড় বোন ইলাকে ভালোবাসে। নক্ষত্র এই বাড়িতে সর্বপ্রথম এসেছিল, তার আর ইলার বিয়ের জন্য ইলার বাবা মা’কে রাজি করাতে। সবাই ওদের বিয়ের জন্য রাজিও হয়েছিল। তবুও আজ ভাগ্যের পরিহাসে ইলার জায়গায় তার ছোট বোন নয়নতারাকে নক্ষত্রের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে।

ছয় মাস আগে

হঠাৎ ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে পুরো হলরুম অন্ধকারে ছেয়ে গেল। আর ঠিক সেই সময় অন্ধকারের ভেতর থেকে এক বলিষ্ঠ হাত পেছন থেকে নয়নতারার মুখ চেপে ধরে। ওর কানে কাছে মানুষটা মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,

—একদম চেঁচাবে না। তোমাকে ছাদে আসতে বলেছিলাম? আসো নি কেন? একবার শুধু একা পাই। তখন মজা দেখাব। ইদানিং আমার কোন কথা শোনো না তুমি। অপেক্ষা করছি তাড়াতাড়ি আসো।”

কথাগুলো বলেই মানুষটা ওকে ছেড়ে দিয়ে অন্ধকারে কোথাও উধাও হয়ে গেল। সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল যে নয়নতারা চিৎকার করারও সময় পেল না। ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে। মানুষটা কে হতে পারে? কন্ঠ শুনে তো চেনা মনে হয়নি। বাড়ির সবার কন্ঠ সে ভালো ভাবেই চেনে। আর বাড়ির কেউ তার সাথে এমন একটা কাজ কেন করতে যাবে? তাকে কে ছাদে যেতে বলবে? অন্ধকারে সবাই ছুটাছুটি করছে। কেউ কেউ মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়েছে। অন্ধকারে বাবা চেঁচিয়ে বললেন,

—বাবলু, দেখ না বাবা কোথাও লাইনে সমস্যা হলো কি-না?”

—দেখছি বাবা।”

—কাকা, কেউ মেইন সুইচ বন্ধ করে দিয়েছে।”

—হ্যাঁ? এই কাজ কে করলো? দুষ্টুমির একটা সীমা থাকে। ছেলেমেয়ে গুলো সব সীমা পেরিয়ে গেছে। জাহিদ বাবা মেইন সুইচ চালু কর।”

—করছি কাকা।”

মেইন সুইচ অন করে দিলে মুহূর্তে আবার ঘর আলোকিত হয়ে উঠল। এবার মা বললেন,

—তুমি আবার রাগারাগি শুধু কোরো না তো। বিয়ে বাড়িতে ছেলেমেয়েরা একটু আধটু মজা করবেই।”

—তুমি এটাকে মজা বলছো! অন্ধকারে পড়ে গিয়ে কেউ ব্যথা পেলে?”

—ব্যথা পায়নি তো। এখন তুমি চুপ করো।”

বাবা মা’র ঝগড়া শুরু হয়ে গেছে। ইলা এসে নয়নতারার পাশে দাঁড়াল। বাবা মা’র দিকে চোখ রেখে বলল,

—দেখ বাবা মা কেমন ঝগড়া করতে পারে! একটা দিনও বাদ যাবেনা। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে লেগে পড়ে।”

নয়নতারার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। সে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগের ঘটনাই সে ভুলতে পারছে না। ইলা ওর দিকে ফিরে বলল,

—কীরে নয়ন, তুই ঘামছিস কেন? বেশি গরম লাগছে নাকি? এই তোর হাতও তো কাঁপছে। কী হয়েছে তোর? এই নয়ন!”

নয়নতারা কাঁপা গলায় কোনরকমে বলল,

—আপু অন্ধকারে কেউ আমার মুখ চেপে ধরে কী কী যেন বলে গেছে।”

ইলার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।

—অ্যাঁ! কী বলছিস এসব? কে কী বলেছে? ”

—জানি না। কন্ঠ চিনতে পারিনি। শুধু বলছিল, ছাদে যাইনি কেন? আমি নাকি ইদানিং কোন কথা শুনি না। আরও যেন কী বলেছে।”

ইলা মনে মনে নক্ষত্রকে কয়েকশো গালি দিয়ে ফেলল। গাধাটা তার জায়গায় তার বোনকে উল্টাপাল্টা কী বলে গেছে আল্লাহ জানে। নয়ন কিছু বুঝতে না পারলেই হলো। নইলে এই যাত্রায় তার রক্ষে নেই। ইলা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,

—আর কী কী বলেছে? ”

—মনে করতে পারছি না আপু। আমার মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছিল কেউ আমাকে মেরে ফেলার জন্য এভাবে মুখ চেপে ধরেছে।”

—দূর পাগলী! আমাদের বাড়িতে তোকে কে মারতে চাইবে।”

—জানি না।”

—আচ্ছা কারো নাম বলেনি? মানে তোকেই কথাগুলো বলেছে? নাকি অন্য কেউ মনে করে তোকে…

—জানি না আপু। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

ইলা মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। যাক, গাধাটা তার নাম নেয়নি। ইলা এবার শিওর হলো একটু আগের মেইন সুইচ অফ করে দেওয়ার ঘটনা ওই বাদরটাই ঘটিয়েছে। আচ্ছা এসব করার কোন মানে আছে? কোন কাজ করার আগে একবার ভাববে না? বাড়ির কারো কাছে ধরে পড়ে গেলে তখন কেমন হত? বাবা তো সোজা তাকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিত। সে তো একটু পরে ছাদে যেতই। তর সয়না ক’টা মিনিট! ইলার এখন সবার আগের কাজ হলো নয়নতারাকে সামাল দেয়া।

—তারা, বোন আমার। তুই ঘরে আয়। ফ্যানের নিচে বসলে মাথা ঠান্ডা হবে। আর এই ঘটনা কাউকে বলিস না। কেউ হয়তো তোর সাথে মজা করেছে। বাবা যা রাগী, জানিস তো! এসব শুনলে একটা কাণ্ড বাধিয়ে ফেলবেন।”

—আচ্ছা বলব না।”

ইলা নয়নতারাকে ঘরে গিয়ে গেল। নয়ন এখনও স্বাভাবিক হতে পারছে না। ইলা বলল,

—তুই বোস। আমি ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে দিচ্ছি।”

—হু।”

ইলা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ইলা নয়নতারা দুই বোন। ইলা বড়। নয়ন ওর থেকে দুই বছরের ছোট। আর বাবলু ওদের সবার ছোট। এবার এইটে পড়ে। রান্নাঘরে এসে ফ্রিজ থেকে পানির বোতল নিয়ে পিছন ফিরতেই নক্ষত্রের সাথে ধাক্কা খেতে নিচ্ছিল ইলা। ওকে দেখে চোখ পাকিয়ে ইলা বলল,

—মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? এসব কী করে বেড়াচ্ছ? তুমি জানো অন্ধকারে আমি ভেবে কাকে কথাগুলো বলে এসেছ!”

নক্ষত্র কপাল কুঁচকে বলল,

—কাকে মানে? ওটা তুমি ছিলে না?”

—জি না।”

নক্ষত্র চিন্তিত মুখে বলল,

—তাহলে কে ছিল?”

ইলা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

—আমার বোন নয়নতারা।”

—ওহ তারা! তাহলে সমস্যা নেই। শালী আধি ঘারওয়ালি। ওর উপর আমার অধিকার আছে। বড় বোনের একটামাত্র বয়ফ্রেন্ড বলে কথা! একটু জ্বালাতন সহ্য করা লাগবেই।”

—নয়ন কিন্তু ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। এই ঘটনা ও বাবাকে বলে দিলে বাবা কিন্তু বিয়ে বাড়ি মানবে না। হৈচৈ করে বিয়েটাই হয়তো বন্ধ করে দিতে পারে।”

—বাহ! শ্বশুর মশাই তোমার থেকে শ্যালিকাকে বেশি ভালোবাসেন নাকি?”

—শুধু শ্বশুর মশাই না। নয়নতারা বাড়ির সবার নয়নের মণি।”

—তাই ওর নাম নয়নতারা রাখা হয়েছে!”

—ঠাট্টা করো না। এটা মজার কোন বিষয় না। তোমাকে আকিবের ফ্রেন্ড সাজিয়ে এনেছি। তুমি ওভাবেই থাকো। কারো কাছে ধরা পড়ে গেলে আমাকে সহ আকিবকেও বাড়ি থেকে কিক মেরে বের করে দিবে।”

—কেন? আমি নয়নতারার সাথে দুষ্টুমি করেছি বলে! অবশ্য তোমার বাড়ির মানুষের চোখে এটা দুষ্টুমি না, অসভ্যতা বলে গণ্য হবে।”

—হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটা কারণ না। তুমি ভালো করেই জানো আমার পরিবার প্রেম ভালোবাসার বিরুদ্ধে। যতদিন তুমি তোমার পরিবারকে মানাতে না পারো, আমি চাই না ততদিন আমার পরিবার আমাদের সম্পর্কে জানুক। একবার তোমার পরিবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসুক। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।”

—হুহ।”

ইলা গলার স্বর নরম করে বলল,

—তুমি কেন বুঝতে চাও না। পরিবারের বিরুদ্ধে আমি যেতে পারব না। বাবা মা’র কথার বাইরে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

—তোমার কাছে তোমার পরিবারই সব ইলা। আমি কিছুই না।”

—এভাবে কেন বলছো? তুমি কিছু না হলে আমি এতকিছু কেন করতাম। আকিবকে ধরে কেন তোমাকে ওর বন্ধু সাজিয়ে আমাদের বাড়িতে আনতাম? আমি একটা সুন্দর সম্পর্ক চাই নক্ষত্র। যেখানে আমাদের দু’জনের পরিবারই খুশি থাকবে।”

—বুঝলাম। রাতে ছাদে দেখা করবে? নাকি সমস্যা হবে? ”

—আমি আসার চেষ্টা করব। আসতে না পারলে তোমাকে কল করব।”

—আচ্ছা।”

ইলা পানি নিয়ে এসে দেখে নয়নতারা ঘরে নেই। ইলা ওকে ওয়াশরুমে, ব্যালকনিতে খুঁজে পেল না।

—এই মেয়েটা আবার কোথায় গেল! দু’টা মিনিট স্থির হয়ে বসতে পারে না। ভয়ে কাঁপা কাপি করছিল। এখন আবার কোথায় ছুটাছুটি করছে?”

নয়নতারা নিচে এসে সব ভয় ভুলে গেল। নিচে ঝিনুক আপুরা নাচছে। ইশ, সে মিস করে ফেলল।

—আপু তোমার নাচ শেষ?”

—না। রিহার্সাল করছিলাম। তুই কোথায় ছিলি এতক্ষণ? ইলাটা আবার কই? তোদের খুঁজে খুঁজে আনা লাগে কেন? জানিস না পারফর্মেন্স আছে। সব কয়টাকে একসাথে পাওয়াই দুস্কর। দূর! আগে জানলে আমি তোদের নিতামই না। এক সপ্তাহ আগে থেকে আপু নাচব,নাচব বলে লাফাচ্ছিস। অথচ এখন মেইন সময়ে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ধরে আনতে হচ্ছে।”

—সরি আপু। আমি ইলা আপুকে খুঁজে আনি।”

—না থাক তোর যেতে হবে না। এখন তুই ইলাকে খুঁজতে যাবি। একটু পর তোকে খোঁজার জন্য আমাকে যেতে হবে। তুই এখানেই থাক। দেখ তোর সিরিয়াল কত। সবাই এসে বসে গেলে তখন তোদের ঠেলে ধাক্কিয়ে স্টেজে পাঠাতে পারব না আমি। আগে থেকেই সবাই রেডি হয়ে থাকবি। আমি নাম এনাউন্স করার সাথে সাথে যেন স্টেজে উঠে যেতে পারিস।”

—আচ্ছা।”

ঝিনুক সবাইকে তাড়া দিতে লাগল। নক্ষত্র এদিক দিয়েই যাচ্ছিল। নয়নতারার উপর ওর চোখ পড়লে একটু আগের ঘটনা মনে করে হাসল। ইলা বলেছিল তারা নাকি অনেক ভয় পেয়েছে। ওকে আরেকটু ভয় দেখালে কেন হয়? না থাক, মেয়েটা আবার চেচাঁমেচি শুরু করলে এই বাড়ির লোকগুলো তাকে উল্টো ঝুলিয়ে দেবে। বাড়ির সকলের নয়নের মণি নয়নতারা।
বাবা নয়নতারাকে ডাকলেন,

—তারা। ও মা তারা।”

নয়নতারা নক্ষত্রকে পাশ কাটিয়ে ছুটে যেতে যেতে বাবার ডাকের সাড়া দিল।

—আসছি বাবা।”

নক্ষত্র ঠোঁট বাঁকাল। বাড়িতে শ্যালিকার বিশেষ স্থান দেখে তার রীতিমত হিংসে হচ্ছে।

—আহা শ্যালিকা! তুমি সবার কাছে অতটা স্পেশাল কেন? আমার বউয়ের ভাগের ভালোবাসাও নিজে নিয়ে নিচ্ছ। অন্যদের চান্স দেবে তো। তোমার জন্য শ্বশুড়বাড়িতে কেউ আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। সারাক্ষণ তোমাকে নিয়েই মেতে আছে। আমার দিকে নজর দেবার সময়টুকু নেই কারো কাছে। এরকম চলতে থাকলে শ্বশুর শাশুড়িকে পটাতে যে আমার কষ্ট হবে।”

আকিব এসে নক্ষত্রের পাশে দাঁড়াল। তার চোখও নয়নতারার দিকে। আকিব নক্ষত্রের ছোট হবে। এদিকে সে আবার ইলার বড়। নক্ষত্রকে সে দুলাভাই ডাকবে নাকি নক্ষত্র তাকে ভাই ডাকবে এটা নিয়ে সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে।

—কি জামাই সাহেব, কী ভাবছেন অত?”

—ভাবছি তোমার পরিবারের লোকজনকে কীভাবে পটাব।”

আকিব হেসে ফেলল। বলল,

—আপনি যতটা ভাবছেন কাজটা কিন্তু অতটা সহজ হবে না। আমার জেঠু ভীষণ কড়া। উনাকে হাতে আনতে অনেক সময় লাগবে।”

—হুম। তেমনই তো মনে হচ্ছে। আচ্ছা,উনাকে বাগে আনতে শর্টকাট কোন রাস্তা নেই?”

—আছে। এবাড়িতে এমন একজনই আছে যার কথা কেউ ফেলতে পারে না। তাকে ধরলে কাজ হতে পারে। কিন্তু সে কখনও বাবা মা’র সাথে মিথ্যা বলে না। এটাই সমস্যা।”

—কে? নয়নতারা?”

—হুম।”

—ওকে নিজের সাইডে আনতে পারলে কাজ হবে বলছো?”

—জি, একশো পার্সেন্ট না হলেও পঁচানব্বই পার্সেন্ট হয়ে যাবে।”

—তাহলে আগে তারাকে হাত করতে হবে। কিন্তু কীভাবে?”

—ভাবতে থাকুন। কোন আইডিয়া পেলেও পেতে পারেন। আমি এর থেকে বেশি আপনার হেল্প করতে পারব না।”

আকিব চলে গেলে নক্ষত্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। মনে মনে বলল,

—শ্যালিকা, এবার তুমি কোথায় যাবে? তোমার আমাকে সাহায্য করতেই হবে। নইলে তোমার নিস্তার নেই। দুলাভাই যে কত ভাবে তোমাকে জ্বালাবে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”

চলবে…..
Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা

(পিক কালেক্টেড ফ্রম ফেসবুক)
প্রথম পর্বে সবার মন্তব্য আশা করছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here