নয়নতারা পর্ব ৩|রোমান্টিক প্রেমের গল্প

#নয়নতারা
|পর্ব -৩|
#জেরিন_আক্তার_নিপা

ঝিনুক নয়নতারাকে না পেয়ে রাগে গজগজ করতে করতে উপরে আসে। রুমে এসে দেখে নয়নতারা শুয়ে আছে। ঝিনুক রাগে দরজায় জোরে শব্দ করে রুমে ঢুকে। নয়নতারা ভয় পেয়ে এবারো চেঁচিয়ে উঠে,

—মাগো ভূত।’

—ভূত না, তোর যম। তোরে আজ… ঘরে এসে শুয়ে আসিস! ওদিকে তোর সিরিয়াল এসেছে। স্টেজে সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।’

—আমি নাচতে পারব না আপু।’

ঝিনুক ঝাঁঝিয়ে উঠে,

—মানে! তাহলে এক সপ্তাহ আগে থেকে লাফাচ্ছিলি কেন? আচ্ছা কেন নাচবি না বল।’

—আমার পা কাঁপছে। দাঁড়াতেই পারছি না।’

—কেন? হয়েছেটা কী? একটু আগে পর্যন্ত তো ঠিকই ছিলি। তোরে যে মাঝে মাঝে কোন ভূতে ধরে।’

মিনমিন করল নয়নতারা,

—সত্যিই ভূত আমার পেছনে পড়েছে আপু।’

—আসবি তুই নয়ন। আমি কিন্তু সত্যিই এবার রেখে যাচ্ছি। এক্ষুনি দেখবি চলে যাব তোদের বাড়ি থেকে। এইজন্যই আমি আসতে চাচ্ছিলাম না। মা যে কেন জোর করে নিয়ে এলো। তোরা তো আমার কোন কথাই শুনিস না।’

ঝিনুক আপু কি সত্যিই তার সাথে রাগ করে চলে যাবে এখন? বিছানা থেকে পা নামাল নয়নতারা। না চাইলেও বলল,

—চলো। আসছি আমি।’

—তাড়াতাড়ি আয় বোন। মুক্ত কর আমাকে।’

ওরা নিচে যাবার সময় বারান্দায় ইমনের সাথে দেখা হয়ে গেল। ইমনের বিয়েরই এত আয়োজন হচ্ছে। সে একপলক ঝিনুককে দেখে নয়নতারাকে বলল,

—নিচে যা তুই। ঝিনুকের সাথে আমার একটু দরকার আছে।’

—আচ্ছা।’

নয়নতারা চলে গেলে ইমন ঝিনুকের কব্জি চেপে ধরল। চোখ গরম করে বলল,

—কী চাইছিস তুই? এসব কেন করছিস?’

ঝিনুক কিছু না বোঝার মত করে বলল,

—কী করছি আমি? তুমি কিসের কথা বলছো?’

ইমনের রাগ আরও বাড়ল। ঝিনুককে টানতে টানতে একটা রুমে নিয়ে গেল। দেয়ালের সাথে ওকে চেপে ধরে দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল,

—এক্সের বিয়েতে ভালোই এনজয় করছিস! নাচছিস, গাইছিস। সব কাজে সবাইকে সাহায্য করছিস। এত ফূর্তি কোথায় থেকে আসে তোর?’

ঝিনুক কপাল কোঁচকাল। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

—ও মা করব না? তুমি আমার এক্সের পাশাপাশি আমার মামাতো ভাইও। আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র এক্স কালসাপ। তুমি বিয়ে করছো। ফূর্তি করার দিন তো আমারই।’

—তোর কষ্ট হচ্ছে না!’

—কষ্ট! হাসাও তুমি। কষ্ট কেন হবে? আমাদের তো ব্রেকআপ হয়ে গেছে। মামা মামীর পছন্দের মেয়েকে বিয়েও করছো। বোন হিসেবে ভাইয়ের বিয়েতে আনন্দ করব না!’

—ব্রেকআপ আমি করেছিলাম তুই না। তবুও কষ্ট হচ্ছে না তোর?’

—না। অনেক ভেবেচিন্তে যা বুঝলাম তোমাকে বিয়ে করলে আমি সুখী হতাম না হয়তো। যা রাগ তোমার! এমন রাগী স্বামী দিয়ে আমার পোষাবে না। আমার দরকার যে আমার কথায় উঠবে বসবে, আমার কথাই শেষ কথা হবে এমন টাইপ বর। তুমি ওই মেয়েকেই বিয়ে করো।’

—তোর কারণে আমাদের ব্রেকআপ হয়েছে। তোর দোষে। তবুও তুই এতটা স্বাভাবিক থাকতে পারছিস কীভাবে?’

ঝিনুক তীক্ষ্ণ চোখে ইমনকে দেখে। হেসে বলে,

—কেন তোমার কষ্ট হচ্ছে? নিজেই ব্রেকআপ করে এখন আফসোস হচ্ছে? মনে মনে পস্তাচ্ছ নাকি? ভাবছো রাগ-গোসা ঝেড়ে ফেলে আবার প্যাচআপ করে ফেলি। নাহ। এখন ওরকম মনে হলেও লাভ নেই। অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিয়ের কাজ সব শেষ। চারটা গানে নাচ তৈরি করেছি। এখন তুমি বিয়ে না করলে আমার কষ্ট মাটি হবে।’

ঝিনুক খুব সহজভাবে কোন খারাপ লাগা ছাড়াই কথাগুলো বলেছে। ইমন নিজেকে আর কন্ট্রোল করে রাখতে পারল না। ঝিনুকের চুল মুঠো করে ধরে ক্রোধে চাপা গলায় বলল,

—হারামির বাচ্চা! যা আমারও কষ্ট হচ্ছে না। বিয়ে তো আমি করবোই। আমার বাসরঘর তোকেই সাজাতে হবে। হানিমুনেও তোর চোখের সামনে দিয়েই যাব। হানিমুন থেকে ফিরেই তোকে ফুপি বানাব। দেখে রাখিস তুই। বউকে এত ভালোবাসবো যে, তুই দেখে জ্বলেপুড়ে মরে যাবি।বিয়ে তো হবেই হবে। না হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। দেখি কার বাপের সাধ্য আছে যে এই বিয়ে আটকায়। তোর মত নাগিনকে বিয়ে না করে আমার জীবন বেঁচে গেল।’

ইমন রেগেমেগে ঝিনুককে ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কপাল বাড়ি খেল ঝিনুক। সাথে সাথে জায়গাটা ফোলে গেল। আঘাত পাওয়া জায়গায় হাত দিয়ে ডলতে ডলতে দরজার দিকে তাকিয়ে হেসে ঝিনুক বলল,

—যাও না। ধরে রাখল কে? বিয়ে করো। বাসর করো৷ বাচ্চার বাপ হও। তাতে আমার ডট ডট ডট। শালা খাটাশ। ইশ কপালটা ফাটিয়ে দিল। বিয়ে যে কত মজা তা করার পরই বুঝবি। এক্স কালসাপ কোথাকার। তোর কিচ্ছু যায় আসে না তাহলে এত রাগ দেখাচ্ছিস কেন হ্যাঁ? আমার মত তুইও তোর বিয়েতে এনজয় কর না শালা।’

ঝিনুক কপালে হাত বোলাতে বোলাতে বারান্দা দিয়ে গান গাইতে গাইতে যাওয়ার সময় নক্ষত্রের সাথে ধাক্কা খেল। নক্ষত্র দুই হাত উপর তুলে সারেন্ডার করার মত দাঁড়িয়ে গেল। ঝিনুক হেসে ফেলে বলল,

—কী জামাই সাহেব! কোথায় যাওয়া হচ্ছে হুম? আমার বোনকে খুঁজছেন?’

নক্ষত্রের চোখ বড় হয়ে গেল। হায়, হায়! এ এসব জানল কীভাবে? ঝিনুক নক্ষত্রের মুখের চেহারা দেখে একদফা খিলখিল করে হাসল।

—আমি সবই জানি ভাই। এসবে আমার বহুত এক্সপিরিয়েন্স আছে। তোমরা নতুন জুটি। খুব সহজেই বোঝা যায়। চাইলেও আবেগ লুকাতে পারো না।’

ঝিনুক হাসছে। নক্ষত্র অপরাধী মুখ করে কিছু বলতে যাওয়ার আগে ঝিনুক বলল,

—ভয় নেই। আমি কাউকে বলব না। তবে ইলার সাথে একটু বোঝাপড়া করতেই হবে। খবিশটা আমাকে কিচ্ছু জানালো না! কীভাবে পারল হ্যাঁ! আমাকে ছাড়া এত প্ল্যানিং করে তোমাকে আকিবের বন্ধু সাজিয়ে সোজা বাড়ি নিয়ে এলো! এত সাহস বাবা! গাধীটার তাহলে বুদ্ধিও আছে।’

—ভয়ে কাউকে জানায়নি।’

—আমাকে ভয় কিসের ভাই! আমি তো আরও সাহায্য করতাম।’

—এখন করুন তাহলে।’

—এই আমি তোমার ছোট হবো। আপনি আপনি করে আমার বয়স বাড়িয়ে দিও না।’

নক্ষত্র হাসল। বলল,

—সম্পর্কে তো বড়।’

—তবুও। আমার থেকে বড় কারো মুখে আমি আপনি ডাক শুনতে পারব না। আমাকে তুমি, তুমি করেই বোলো। এখন চলো, চলো। নিচে নাচ হবে। তোমার জনও নাচবে। দেখবে চলো।’

ঝিনুক কোন দ্বিধা ছাড়াই নক্ষত্রর হাত চেপে ধরে ওকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। নক্ষত্র কিছুটা সংকোচ বোধ করলেও ঝিনুক খোলামেলা মনেই ওকে আপন করে নিয়েছে। আসলে ঝিনুক ইমনকে জ্বালানোর জন্য নক্ষত্রর সাথে একটু বেশি বেশিই করছে। ইমন ঝিনুককে নক্ষত্রর হাত ধরে হাসতে হাসতে নিচে আসতে দেখে মনে মনে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেল।

—নাগিনটা ওই ছেলের হাত পেঁচিয়ে রেখেছে। এবার গিলে খাবে। এই কালনাগিনীকে আমি ভালোবেসেছিল! ছ্যাহ! আমিও দেখব তুই কাকে বিয়ে করিস। কোন ছেলে তোকে বিয়ে করতে আসে। তোর এমন এমন পিক আমার কাছে আছে না, যা দিয়ে এক চুটকিতে আমি তোর বিয়ে ভেঙে দিতে পারব। কষ্ট হচ্ছে না তার! বিয়ে বাড়িতে মজা করছে! কাজিন আবার নাকি এক্স! শালি খচ্চর নারী।’

ঝিনুক দূর থেকেই ইমনের মন পোড়ার গন্ধ পাচ্ছে। এটাই তো চাইছিল সে। ইমনকে দেখেও এড়িয়ে গেল। ওর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মনে মনে বলল,

—লে হালুয়া মুভির ওই ডায়ালগটা মনে আছে না তোর। দেখবি আর জ্বলবি, লুচির মত ফুলবি। জ্বল শালা। জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যা।’

প্রথমে ছোটদের নাচ শেষ হলো। তারপর ছেলেরা। তারপর মেয়েরা নাচবে। ইলা স্টেজে ওঠার সাথে সাথে সবাই হৈহৈ করে উঠল। নক্ষত্রর দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেল ইলা। তবুও নাচ শেষ করল। নক্ষত্র মুগ্ধ হয়ে ইলার নাচ দেখল। তারপরই নয়নতারার পালা। সে-ও খুব সুন্দর করেই নাচ শেষ করল। কিন্তু নাচ শেষে সবার বাহবা আর হাততালি পেয়ে লজ্জায় তাড়াতাড়ি স্টেজ থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেল। তখন আর কে নাচ দেখবে? সবাই ব্যস্ত হয়ে ওর কাছে ছুটে গেল। একেকজন একেক জিনিস আনার জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করছে। বাবা বললেন,

—বরফ আন। ইলা, বাবলু কেউ বরফ নিয়ে আয়। আহা! কীভাবে পড়ে গেলি মা? দেখে হাঁটতে পারিস না তুই? এত বড় হয়েও বাচ্চা মেয়েদের মত যখন তখন যেখানে সেখানে হুঁচট খেয়ে পড়ে যাস। আজ তো পা-টাই ভেঙে ফেললি। ইশ, ব্যথা হচ্ছে রে মা?’

ওর ফুপুরা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে।

—কই রে তোরা? দরকারের সময় একটাকেও পাওয়া যায় না। কেউ কি ডাক্তার ডেকেছে? আরে এই ঝিনুক!’

ইমন একটা চেয়ার এনে বোনকে সাবধানে বসিয়ে দিল। সে এই মুহূর্তে কী করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। দিশাহারা ভাবে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। ইলা তো কেঁদেই ফেলেছে। বারবার একই কথা বলছে,

—পা-টা ভেঙেই গেল। বেশি ব্যথা পেয়েছিস? বাবা আস্তে ধরো৷ আরও ব্যথা পাবে।’

নক্ষত্র একটু দূরে দাঁড়িয়ে এই সার্কাস বাড়ির লোকজনের সার্কাস দেখছিল। বিরক্ত হচ্ছিল সে। এতগুলো মানুষ কেউ কাজের কোন কথা বলছে না। হুদাই চিৎকার চেঁচামেচি হাহুতাশ করে যাচ্ছে। বিপদের সময় একটা মানুষ মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে না! ছোটরা তো না-ই। বড়রাও আরও বেশি বেশি করছে। এরকম আরও এক ঘন্টা চলতে থাকবে তবুও কেউ আসল কাজ করবে না। এগিয়ে গেল সে। নয়নতারার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ইলার বাবাকে বলল,

—আমাকে একটু দেখতে দিবেন?’

উনি নক্ষত্রর মুখের দিকে তাকালেন। ইতস্তত করে বললেন,

—তুমি পারবে?’

—দেখি তো আগে।’ বলতে বলতে নক্ষত্র এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে নয়নতারার পা নিজের হাতে নিল। নয়নতারার পায়ে হাত দেওয়ার আগেই ওর বাবা বলল,

—দেখো বাবা ব্যথা দিও না। একটু আস্তে… ‘

নয়নতারা পা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। অচেনা একটা মানুষ তা পা ধরছে। তার থেকে বড়। আসল কথা ব্যথার সাথে সাথে পায়ে কাতুকুতুও লাগছে। নক্ষত্র নয়নকে কিছু বলার আগে ইমন ধমক দিল,

—ওকে দেখতে দে না। বেঁকে যাচ্ছিস কেন? পা সোজা করে রাখ। ঢিল দে। পাথর হয়ে থাকিস না। এতটা কেয়ারলেস হলে কীভাবে হবে?’

নক্ষত্র এই বাড়ির মানুষগুলোর কাণ্ড দেখে মনে মনে না হেসে পারছে না। এরা সামান্য ব্যাপারেও অস্থির হয়ে যায়। বাড়ির কারো কিছু হলে তো কথাই নেই। আর তার পরিবার! হাহ্, পরিবার কাকে বলে? কোনটাকে পরিবার বলে? পরিবার শব্দটার আসল মানে কী? এদেরকে পরিবার বলে? নাকি তার পরিবারকে? যেখানে বাবা মাসে পঁচিশ দিনই দেশের বাইরে থাকে। মা তার ফ্রেন্ড, পার্টি, জিম, ফিটনেস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একমাত্র ছেলে কী করছে, কী খাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে তার খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করে না। এত বড় একা বাড়িতে ছোট থেকেই বাবা মা’র অবহেলা পেয়ে বড় হয়েছে। যার ফলে সময়ের সাথে সাথে বাবা মা’র সাথে দূরত্বটাও এতটা বেড়েছে যা চাইলেই এখন মেটানো যাবে না। একটা বাচ্চা বড় হওয়ার জন্য তার শুধু ভালো জামাকাপড়, দামী খেলনা, চাওয়ার আগে সবকিছু পেয়ে গেলেই হয়? বাবা মা’র ভালোবাসা কিচ্ছু না? বাবা মা এক মাসে তাকে এত হাতখরচ দেন যে তিনমাস আর চাইতে হবে না। তবুও প্রতি মাসেই দিয়ে যাবে। সেই টাকা দিয়ে সে মদ খাচ্ছে না জুয়া খেলছে নাকি মেয়েদের পেছনে ওড়াচ্ছে সেই খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। তাদের ধারণা টাকা দিয়েই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি আমরা। ছেলের আর কোন চাওয়া থাকতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নক্ষত্র। আবার একবার চোখ ঘুরিয়ে পুরো পরিবারটাকে দেখে নিল।

চলবে___

/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here