নয়নতারা পর্ব ৭

#নয়নতারা_৭
#জেরিন_আক্তার_নিপা

বাড়ির বড়রা ভেবে পাচ্ছে না এখন কী করা উচিত। কী-ই বা করার আছে তাদের? মেয়ের বাড়িতে গিয়ে দশজন লোকের সামনে ওর বাবা মা’কে ক’টা কথা শোনানো ছাড়া আর তো করার কিছু নেই৷ কিন্তু সমাজের সামনে মেয়ের বাবা মা’কে ছোট করলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে? এমনিতেই তো মানুষ গুলো কষ্টের মধ্যে আছে। নিজের মেয়ে তাদের সম্মানের কথা না ভেবে বিয়ের দিন পালিয়ে গেল। ওই লোক গুলোকে আরও কোন শাস্তি দেওয়ার কোন মানেই হয়না। ইমনের বাবা এবাড়ির সবার বড়। তারপর ইলার বাবা। তৃতীয় নাম্বার আকিবের বাবা। সবচেয়ে ছোট ঝিনুকের মা। ওদের একমাত্র বোন। চার ভাইবোন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। গম্ভীর মুখে নয়নতারার বাবা বললেন,

—-এখন কী করব ভাইজান? মেয়ে পালিয়ে গেছে। এখন তো বরযাত্রী নিয়ে রওনা হবার কোন মানে নেই। কত মানুষকে দাওয়াত করা হয়েছে। কাল সবাই আমাদের ছেলের বউ দেখতে আসবে। সমাজের সামনে আমাদের নাক কাটা গেল। মেয়েটা এভাবে কারো কথা না ভেবে কীভাবে পালাতে পারল! অন্তত ওর বাবা মা’র কথা তো ভাবা উচিত ছিল।’

—-আহ ভাইজান! তুমি আছো বাবা মা’র সম্মান নিয়ে। মেয়ের যদি বাবা মা’র সম্মান এতই প্রিয় থাকত তাহলে বিয়ের দিন পালাত না। আমাদের বাড়ির কোন মেয়ে তো মরে গেলেও এরকম করবে না। ঝিনুক, ইলা,নয়ন ওরা পরিবারের খুশির কথা ভেবে হাসতে হাসতে ওরকম কয়েক ডজন ছোকরাকে ভুলে যেতে পারবে।’

ইমনের বাবা অনেকক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থেকে বললেন,

—-ওরা মেয়েটাকে জোরজবরদস্তির করে বিয়েতে রাজি করিয়েছিল না তো? নইলে তো মেয়েটা আগেই বলতে পারত সে এই বিয়েতে রাজি না। এরকম শেষ মুহূর্তে এসে কী করে বসল!’

—-ভাইজান আমাদের এখন ওই মেয়েকে নিয়ে ভাবলে চলবে না। আমাদের ইমনকে নিয়ে ভাবতে হবে। ও বেচারার তো কোন দোষ নেই।’

ঝিনুক গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ইমনের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দরজায় টুকা দিয়ে বলল,

—-নতুন জামাই আসতে পারি?’

—-তুই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ ঝিনুক। নইলে আজই তোর জীবনের শেষ দিন হবে।’

—-ও বাবা! এত বড় বড় ধমকি দিলে আমি তো ভয় পাব।’

—-এখানে কেন এসেছিস তুই? কী দেখতে এসেছিস?’

—-তুমি রেডি হয়েছ কিনা দেখতে এলাম।’

—-তোকে দেখতে হবে না। তুই আমার ঘর থেকে যা। দূর হ।’

—-অত রাগে না গো। এই সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। আমাকে যে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছ, বলি কি সান্ত্বনা দেওয়ার মানুষ লাগবে না?’

ইমন কপাল কুঁচকে ঝিনুকের কথা বোঝার চেষ্টা করছে।

—-সান্ত্বনা! সান্ত্বনা তো একটু পর তোর লাগবে। যখন তোর চোখের সামনে দিয়ে আমি বাসরঘরে যাব।’

ঝিনুক টেবিলের উপর উঠে বসল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—-আর তোমার বাসর! এই জন্মে মনে হয় ওটা তোমার স্বপ্নই রয়ে যাবে। বাস্তবে আর পূরণ হবে না।’

—-মানে? ‘

—–শুনলাম তোমার হবু বউ নাকি তার নায়কের সাথে ভেগেছে। বেচারা! তুমিও কী ভুল করতে যাচ্ছিলে বলো। অন্য কারো প্রেমিকাকে বিয়ে করার মত পাপ করতে যাচ্ছিলে।’

ঝিনুকের কথা ইমনের বিশ্বাস হচ্ছিল না। বলে কী! বউ সত্যিই পালিয়ে গেছে! তাহলে কি বিয়ে করে ঝিনুককে শায়েস্তা করতে পারবে না?
ইমন ছুটে বাবার ঘরের দিকে যাচ্ছে। কথাটা সত্যি হলে তার জন্যই ভালো। এমনিতেও মনে মনে এই বিয়ে করতে চাচ্ছিল না। বন্ধুদের নিয়ে বিয়ে বাতিল করার একটা প্ল্যানও বানিয়ে রেখেছিল।
ইমন হুড়মুড়িয়ে বাবার ঘরে এসে ঢুকে। সবাই সহানুভূতির চোখে ওকে দেখছে। আহা! ছেলেটার সাথে এটা কী হয়ে গেল। ওর বিয়েটা সমাজের চোখে মজা হয়ে রইল।

—-বাবা সত্যিই ওই মেয়ে ভেগেছে?’

ইমনের ফুপু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন,

—-তুই কিচ্ছু ভাবিস না বাপ। ওই মেয়ের থেকেও ভালো মেয়েকে তোর বউ করে আনব। এই মেয়ে তো ক্যারেক্টারলেস ছিল। দেখলি না কেমন পালিয়ে গেল। একবার ভাব, বিয়ের আগে না গিয়ে বিয়ের পরে গেলে কেমন হতো! ভালোই হয়েছে বিয়ের আগেই ওই মেয়ের চরিত্র সম্পর্কে আমরা জেনে গেছি। নইলে বিয়ের পর তোকে রেখে অন্য ছেলের সাথে চলে যেত।’

ইমন এসব সান্ত্বনার বাণী শুনতে চাচ্ছে না। আসল কথা জানতে চাচ্ছে সে। ঝিনুক হাসি মুখে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ইমনের চোখ ঝিনুকের উপর পড়তে ইমন সবার কল্পনার বাইরের একটা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল।

—-ফুপু আমার জন্য তোমাকে আর কষ্ট করে অন্য কোন ভালো মেয়ে খুঁজতে হবে না। আমি তোমার তার ছিঁড়া মেয়েকে বিয়ে করব। ওকে তুমি আমার সাথে বিয়ে দিবে?’

ঘরের প্রতিটা মানুষসহ ঝিনুকও হতভম্ব হয়ে রইল। একদিনে এই ছেলের সাহস দেখা যাচ্ছে আকাশ ছুঁয়েছে।
নক্ষত্র ইলার পাশ ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে ছিল। ইলাকে চিমটি কেটে বলল সে,

—-দেখলে নাটক? দু’জনই জানত ওরা একে অপরকে ছাড়া অন্য কাউরে বিয়ে করবে না। তবুও এই নাটক রচনা করল।’

ইলা নক্ষত্রের কথায় সমর্থন করল,

—-দুই জনই দু’টা চিজ! হায় আল্লাহ! ওদের মাথায় এত শয়তানি বুদ্ধি! বাড়ির সবাইকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। অথচ কেউ বুঝতেই পারছে না।’

—-ঝিনুকের মত তোমার ওরকম বুদ্ধি থাকলে এতদিনে আমি তোমার বাচ্চার বাবার হয়ে যেতাম। দেখেছ কেমন বুদ্ধি খেলিয়ে ইমনকে টাইট দিয়েও নিজের করে নিলো।’

—-ওরা তো নাটক করেছে। ধরো তোমার বিয়ের দিন তোমার বউ পালিয়ে গিয়ে সত্যিই তোমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায় তখন কেমন হবে?’

—-ধরে এনে ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেব। শয়তানি বুদ্ধি আমার মাথায়ও কারো থেকে কম নেই।’

ইমনের সাথে ঝিনুকের বিয়ে দিতে কারো কোন আপত্তি নেই। বরং ইমনের মুখে এই কথা শুনে সবার মাথা থেকে ভারী একটা বোঝা নেমে গেছে। কিন্তু আপত্তি জানাল ঝিনুক নিজে।

—-অসম্ভব। মামার ওই বেকার ছেলেকে আমি বিয়ে করব কেন? মামা নিজেই তো বলে ইমন ভাইয়া নাকি একটা অপদার্থ। ওরকম অপদার্থ ছেলেকে বিয়ে করে আমি আমার জীবন নষ্ট করব!’

ইমনের বাবা ঝিনুককে বোঝায়। আজ প্রথম বারের মত ছেলের পক্ষ নিয়ে ওর সুনাম করে বলেন,

—-আমি তো ওসব মুখে মুখে বলি রে মা। মনে মনে তো জানি আমার ছেলে কতটা কাজের।’

—-কাজে তাহলে মাস্টার্স কমপ্লিট করে বেকার বসে আছে কেন? ওর তো কোন চাকরিবাকরিও নেই। বিয়ের পর তোমার ছেলে আমাকে খাওয়াবে কী মামা?’

—-আমার কি কম আছে রে পাগলি? সবই তো তোর।’

—-তবুও মামা বিয়ের পর তোমার ছেলেকে একটা না একটা চাকরি করতেই হবে। তবেই আমি রাজি হব।’

মেয়ের এত বাছাবাছি দেখে ঝিনুকের মা চেতে উঠল।

—-কোথাকার কোন রাজকুমারীরে তুই? তোর এত কিসের কথা এটাই তো বুঝতে পারছি না আমি। আমি আর তোর বাবা তোকে যেখানে বিয়ে দেব, তোকে সেখানেই বিয়ে করতে হবে।’

—-বেশি জোরাজুরির ফল কী হয় দেখেছ তো। মেয়েটাকে নিশ্চয় ওর বাবা আমার তোমার মতই জোর করেছিল। তাই তো শেষমেশ পালিয়ে গিয়ে বাঁচল। আমাকে বেশি জোর করলে আমিও কিন্তু পালিয়ে যাব। করব না বিয়ে।’

—-না মা তোকে কেউ জোর করবে না। তোর মা তো রাগের মাথায় ওসব বলছে। ওই মেয়ের রাগ তোকে দেখাচ্ছে।’

ইমন দাঁতে দাঁত চেপে ঝিনুকের নাটক দেখছে। সবই সহ্য করতে হচ্ছে তাকে। তবে এর শোধ সে নিবেই। একবার শুধু বিয়েটা হয়ে যাক। তারপর এই ঝিনুকের বাচ্চাকে মজা দেখাবে। প্রেম করার সময় মনে ছিল না সে বেকার! এখন সবার সামনে তাকে বেকার বলে অপমান করা হচ্ছে। আর এমন একটা ভাব নিচ্ছে যেন সবাই জোর করছে বলেই সে রাজি হচ্ছে। আহা! বাবা মা’র কত বাধ্য মেয়ে।
নয়নতারা বাড়ির সবার ছোট সদস্যের ভুমিকা পালন করে চুপচাপ এক কোণায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে এসব দেখছে। ইমন ভাইয়া ঝিনুক আপুকে বিয়ে করবে? ভাই বোনের বিয়ে এটাও কখনো হয়! তারপরই মনে পড়ল ফুপাও তো ফুপুর কেমন ভাই হয়। ওসব চাচাতো, মামাতো বোনকে বিয়ে করা জায়েজ আছে। তবুও, ইমন ভাইয়া তো ঝিনুক আপুকে পছন্দ করে না। একজন আরেকজনকে দেখতেই পারে না। বিয়ের পর এত ঝগড়াঝাঁটি মারামারি করে ওরা একসাথে থাকবে কীভাবে?

—-কি? তোমারও এমন কেউ আছে নাকি?’

ভয় পেয়ে গেল নয়নতারা। নক্ষত্র হঠাৎ কোত্থেকে এসে কানের কাছে কথাটা বলল। নক্ষত্র আবার বলল,

—-এটাই কিন্তু সুযোগ। ওদের দেখে শিখে রাখতে পারো। ভবিষ্যতে তোমারও কাজে লাগতে পারে।’

নয়নতারা কিছু বলার আগেই নক্ষত্র মুচকি হেসে আকিবের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একই প্রশ্ন আকিবকেও বলল,

—-তোমারও এরকম কেউ আছে নাকি? এটাই সুযোগ থাকলে বলে দিতে পারো।’

আকিব হকচকিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি করে নক্ষত্রের দিকে চাইল সে। তারপর যেন চুরি করে ধরা পড়েছে এরকম ভাবে হাসল। নক্ষত্র ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,

—-আমি আগেই ধরতে পেরেছিলাম। আসলে আমার ডাক্তারি না পড়ে পুলিশ হওয়া উচিত ছিল। চোরা নজর আমি খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারি।’

সেদিন রাতেই ইমন আর ঝিনুকের বিয়ে হয়। আয়োজন সব একই রকম ছিল। শুধু কনে পাল্টে গিয়েছে। ইলা খুশি খুশি মুখে নক্ষত্রের পেছনে এসে দাঁড়ায়। ফিসফিসিয়ে বলে,

—-এর পর কিন্তু আমাদের পালা।’

—-আমি তো সেই কবে থেকেই এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছি।’

—-ঝিনুক আপুকে বলব আমাদের কথা বাবা মা’কে জানাতে। ওর কথা এখন সবাই শুনবে। নতুন বউ বলে কথা। তারপর আবার এত ঘটনার পর।’

—-ঝিনুকের বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়।’

—-হুম।’

বিয়ে শেষ। এবার নক্ষত্রকে এই বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। অনেক মেহমানরাই চলে গেছে। ও আর দুইটা দিন থাকলে ওর নিজেরই বরং লজ্জা করবে।
ইলা ঝিনুককে হাত করে ফেলে নিজেদের ব্যাপার অনেকটাই এগিয়ে নিয়েছে। ঝিনুকের কথা সত্যিই কেউ ফেলেনি। সে নক্ষত্রকে নিজের ভাই বলে দাবি করেছে। এরকম ভালো ছেলে ও আর একটা দেখেনি। এই ছেলের সাথে ইলার বিয়ে হলে মন্দ হবে না। ডাক্তারি পড়ছে ছেলে। ইলার জন্য এর থেকে ভালো কেউ হতেই পারে না। ঝিনুকের মিষ্টি কথায় না ভুলে কারো উপায় আছে? তার উপর ওরাও কয়েকটা দিন নক্ষত্রকে নিজের চোখের সামনে দেখেছে। সত্যিই এই ছেলের মধ্যে কোন খুঁত নেই। কিন্তু ওর পরিবার সম্পর্কে তো ওরা কেউ কিছুই জানে না। নক্ষত্র ইলার থেকে এই বাড়ির সব খবর জেনে নিজের বাবা মা’কে বলে। বাবার সময় নেই। এই সপ্তাহে উনি এক সেকেন্ডও সময় দিতে পারবেন না। মা শুনেই নাক সিটকে বলেছে,

—-ওদের স্ট্যাটাস কী? মেয়ের বাবা কী করে? আমাদের সাথে মানিয়ে চলতে পারবে?’

জবাবে নক্ষত্র একটা কথাই বলে,

—-বিয়ের পর ইলাকে নিয়ে আমি থাকব মম। নিজের একমাত্র ছেলের জন্যই তোমাদের সময় নেই। তোমরা নিশ্চয় ছেলের বউকে নিয়ে বসে থাকবে না। ইলা যেমনই হোক আমি ওকেই বিয়ে করব। ওর বাবার কী আছে না আছে তা দেখার কোন দরকার নেই।’

—-নো মাই ডিয়ার সান। তোমার বাবা রাজি হবেন না। ইনফ্যাক্ট আমি নিজেও এই বিয়েতে মত দেব না।’

—-ওকে। ফাইন। তাহলে বাবা মা ছাড়াই আমাকে বিয়ে করতে হবে।’

—-নক্ষত্র!’

—-রাগারাগি করে কোন লাভ নেই মম। জীবনে কখনো আমি ভালোবাসা পাইনি। এখন তা পেয়েও তোমাদের জন্য হারাতে পারব না। আমি তো তোমাদের কাছে থেকেও নেই। নাহয় ইলাকে বিয়ে করে এই বাড়ি থেকেই চলে যাব। এতে তোমাদের তেমন কিছু যাবে আসবে না। তোমরা তোমাদের মতই থাকবে।’

ছেলের জেদের কাছে মা’কে হার মানতে হলো। নক্ষত্রর বাবা আসতে না পারলেও ওর মা এসে ইলার সাথে ওর বিয়ের পাকাপাকি কথা বলে গেল।
কয়দিন আগে এই বাড়ির দু’টা ছেলে মেয়ের বিয়ে গেছে। তাই অন্য মেয়ের বিয়ে দিতে ওদের একটু সময় লাগবে। টাকা পয়সারও একটা ব্যাপার আছে।
তাই সেদিন ছয় মাস পর ওদের বিয়ের ডেট করা হয়।

চলবে____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here